চেষ্টা করা বৃথা

চেষ্টা করা বৃথা

“কোন সাহসে তুমি আমার বাসায় এসেছো? মেয়ে মানুষ এতটা নির্লজ্জ হয় কি করে? তোমার মত যদি আমার মেয়েটা হতো না তাহলে তাকে কেটে কুচি কুচি করে পদ্মায় ভাসিয়ে দিতাম। অথচ তোমার ফ্যামিলি তোমাকে কোনো শিক্ষাই দেয়নি। এত সহজেই তুমি আমার ছেলেকে ফাঁসাতে পারবে না। দরকার হলে আমি থানায় যাবো, কোর্টে যাবো।”

আমি চুপচাপ কথা গুলো শুনছি। আমার কাঁদা উচিত কিন্তু আমি কাঁদছি না কারণ কাঁন্না শেষ হয়ে গেছে। সত্যিই তো আমি নির্লজ্জ, আর নির্লজ্জরা কখনোই কাঁদে না। তাই তো এত কথা শুনেও আমার চোখ শুষ্ক, নিস্পৃহ। আমি উনার দোষ দিচ্ছি না। দোষ তো আমার, ভুল যায়গায় মন হারিয়ে তারপর সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে নির্লজ্জের মত অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে অন্যের দরজায় এসে দাড়িয়েছি। আমার এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবেশ উনি মানবেন কেনো? কোনো মা-ই চাইবে না যে, অপরিচিত একটা মেয়ে হুট করে এসেই তার পরিবারে ঢুকে পড়ুক। শুধু তাই নয়, সেই অপরিচিত মেয়ের গর্ভের সন্তানের দায় কেউ নিজের সন্তানের কাঁধে চাপাতে প্রস্তুত নয়। তাই উনাকে দোষারোপ করছি না। আমি তো সত্যিই নির্লজ্জ। বিয়ের আগেই প্রেমিকের বাচ্চা গর্ভে ধারণ করে ফেলেছি। আর সেই বাচ্চাকে অস্বীকার করেছে বাচ্চার জন্মদাতা। আমাকে স্বীকৃতি দেবার ইচ্ছে থাকলে বাচ্চাটাকে সে অস্বীকার করতো না। আত্মহত্যা করতে চেয়ে ছিলাম কিন্তু সবাই আত্মহত্যা করতে পারে না। আত্মহত্যা করার জন্য যতটা সাহস দরকার আমার তা নেই।

বাসায় আমার প্রেগনেন্সীর ব্যাপারটা জানাজানি হবার পরে অনেক মার খেয়েছি ভাইয়ের হাতে। সবাই মিলে চাইছে বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দিতে। আমিও নিজের উপর রাগ করে নষ্ট করতেই চেয়ে ছিলাম। হঠাৎ উপলব্ধি করলাম, একটা নিষ্পাপ শিশু যে মৃত্যুর ভয়ে করুণ চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। সে আর কেউ নয়, সে আমার সন্তান। পৃথিবীর সব চেয়ে নিরাপদ স্থান হলো মায়ের কোল। আর মায়ের কোলে থেকেই নিষ্পাপ শিশুটা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে আছে। সেই মা-টাই আমি। কি দোষ ছিল তার? সে তো পৃথিবীতে নিজের ইচ্ছেতে আসেনি। আমরা তাকে এনেছি পৃথিবীতে। অথচ আজ আমরাই তার দায় এড়িয়ে যাচ্ছি। কি আজব মানুষের বোকামীর শাস্তি। আজ যদি আমার এটা বৈধ সন্তান হতো, তার যদি স্বীকৃতি থাকতো তাহলে ঘটনাটা উল্টো হতো। আমার মা হয়ত আমাকে খুব যত্ন করতো। বাবা হয়ত তার অনাগত নাতি বা নাত্নির নাম ঠিক করে ফেলতো। ভাই হয়ত গর্ভবতী ছোট বোনের গায়ে হাত তুলতো না, পাছে যদি বাচ্চার ক্ষতি হয়ে যায়! সজলের মা হয়ত আমাকে ভালোবাসতো। সজলের বাবা হয়ত বাজারে যাবার সময় জিজ্ঞেস করতো, বউমা কি খেতে ইচ্ছে করছে? সজলের বোন হয়ত আচারের কৌটো এনে দিয়ে বলতো, ভাবী এটা তোমার জন্য।

আর সজল! সে কি কি করতো তা না হয় না-ই ভাবলাম।
এই সব কিছুই হয়নি কারণ আমার সন্তান সমাজ স্বীকৃত নয়, সে অবৈধ সন্তান। আর সে কারণেই কেউ চায় না সে পৃথিবীতে আসুক। কিন্তু আমার সন্তান পৃথিবীতে আসতে চায়। আমি ওর আওয়াজ শুনতে পাই। আমি ওর ভাষা বুঝতে পারি। এই অসীম ক্ষমতাটা আল্লাহ শুধু মাত্র মা-দেরকেই দিয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত আমি পারিনি, পারিনি নিজের সন্তানকে খুন করতে। একটা অচেনা ভাষায় আমার গর্ভের সন্তান বললো, “মা আমি পৃথিবীতে আসতে চাই। আমাকে খুন করো না।” ওর কথা শুনে আমি তাকে খুন করতে পারিনি। তাই বাধ্য হয়েই আমি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি। আমার যাবার কোনো যায়গা নেই। এই কঠোর পৃথিবীতে এই অসহায় মুহূর্তে আমি কোথায় যাবো? তাই বাধ্য হয়েছি নির্লজ্জের মত সজলদের বাড়িতে উঠতে।

একজন নারীর নারীত্ব হলো তার মাতৃত্বে আর আমি আমার মাতৃত্বকে অসম্মান করতে চাই না। এই দেশে হাজার হাজার নারী আছে যারা মা হবার জন্য কত কি করছে আর আমার সন্তানকে খুন করার জন্য সবাই উঠে পড়ে লেগেছে। দূর্ভাগ্য আমার যে, একটা প্রতারকের সন্তানের মা আমি। যে আমার সাথে পৃথিবীর সেরা বঞ্চনা করেছে। সজলের মায়ের কথাতেই আমার চেতনা ফিরলো।

–“তোমার মত মেয়েকে পুলিশে দেয়াটাই উচিত আর আমি সেটাই করবো।”
–“দেখেন আম্মা পুলিশ আপনি নয় আমিই ডেকে আনছি।”
–“মানে?”
–“পুলিশ এসেই না হয় দোষীকে সনাক্ত করুক।”
–“কি বলতে চাইছো তুমি?”

–“আপনার ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে চার মাস আগে। আমি নই সে-ই বিয়ের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে ছিল। বার বার চেয়েছে লুকিয়ে বিয়ে করতে কারণ সে বেকার আর বাড়ি থেকে আমার বিয়ের চাপ ছিল। তাকে ভালোবাসি বলে আবদার ফেলতে পারিনি। কিন্তু তখন জানতাম না যে, সবটাই তার সাজানো নাটক ছিল। বিয়ের কাবিনটা জাল ছিল। কিন্তু ধর্মমতে আমাদের বিয়েটা কিন্তু মিথ্যা নয়। যেহেতু রেজিস্ট্রিটা জাল তাই আজ আমার গর্ভের সন্তানটা এই সমাজের কাছে অবৈধ। কিন্তু আমি কাবিন এনেছি আর সেটাই পুলিশকে দেখাবো।”
আমি নিরুপায় হয়ে বাধ্য হয়েছি সজলের সাক্ষর নকল করতে। এমনটা করার কোনো ইচ্ছেই ছিল না আমার। যদি থাকার মতো কোনো আশ্রয় থাকতো তবে সজলের মত এমন জঘন্য কাজ আমি করতাম না। ওর আর আমার মধ্যে হয়ত আর কোনো তফাৎ নেই।

আমার কথায় উনি ভড়কে গেলেন। উনি নিঃস্পৃহ চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। সেই চোখে ভয় দেখলাম স্পষ্ট।
হঠাৎ পাড়ার কয়েক জন মহিলা হুড়মুড় করে হাজির হলেন। তাদের দেখে উনি আরো ভয় পেয়ে গেলেন। মহিলা গুলো আড় চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। উনাদের মধ্যে থেকে একজন সজলের মাকে জিজ্ঞেস করলেন-
–“কি হয়েছে ভাবী? চিৎকার শুনে ছুটে এলাম আর এই মেয়েটাই বা কে?”

কথাটা বলার সময় মহিলা আমার দিকে রহস্যজনক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। উনাদের কথা শুনে সজলের মা আরো ভড়কে গেলেন। বেশ থতমত হয়ে জবাব দিলেন-
–“এটা আমার দুঃসম্পর্কের বোনের মেয়ে।”
কথাটা বলেই তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-

–“ঘরে যাও।”
আমিও কথা না বাড়িয়ে ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে ঘর খুঁজতে শুরু করলাম। সজলেরর ঘরটা খুঁজে বের করে ঢুকে পড়লাম। তারপর সময় নষ্ট না করে কাপড় চোপড় আলমারিতে গোছালাম। কারণ এখান থেকে কোথাও যাওয়ার উপায়টি আমার নেই। পাড়ার মহিলা গুলো চলে যাবার পর সজলের মা এই রুমে এসে বললেন-
–“এত সহজেই আমি তোমাকে আমার বৌমা হিসেবে মেনে নেবো না।”
–“ঠিক আছে কঠিণ করেই মেনে নিয়েন কারণ আমিও সহজ নই।”

আমার কথা শুনে উনি হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। দুপুরে খাবার সময় পেরিয়ে গেলেও তিনি আমাকে খেতে ডাকলেন না। বুঝলাম উনি ডাকবেন না। আমি নিজের জন্য না খেয়ে থাকতে পারলেও গর্ভের সন্তানের জন্য পারি না তাই নিজেই খাবার বেড়ে নিলাম। আমার খাবার বেড়ে নেয়া দেখে তিনি বললেন-

–“কতটা নির্লজ্জ হলে মানুষ অন্যের বাসায় এসে বেড়ে খায়!”
উনার কথা শুনে বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলেও বাহিরে তা বুঝতে দিলাম না। খাবারের অভাবে আমি এই বাড়িতে আসিনি। খাওয়ার জন্যও এ বাড়িতে আসিনি। চোখে জল না এনে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম-
–“নির্লজ্জ আমি নই, নির্লজ্জ আপনার নাতি বা নাত্নি, যার রক্ত আপনার ছেলের। আমি নিজের জন্য নয়, আপনার নাতি নাত্নির জন্য বেড়ে খাচ্ছি তাই নির্লজ্জ যদি বলতেই চান তবে নিজেদের রক্তকেই বলুন।”

উনি আর কথার জবাব দিলেন না। আমি নির্লজ্জের মত খেতে শুরু করলাম। আজ ভাগ্য দোষে এই পরিস্থিতিতে পড়েছি। কেনো আবেগী হয়ে এত বড় ভুল করলাম সেই আফসোসটা ভেতর ভেতর আমাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিচ্ছে।

বিকেলে সজলের বোন সিথি কলেজ থেকে ফিরলো। সে বাড়ি ফিরতেই সজলের মা আবার শুরু করলেন আমাকে নিয়ে। আমি রুম থেকে বের হলাম না। সব নিরবেই শুনলাম। ঘন্টাখানেক পর সজলের বাবা বাসায় ফিরলেন। আবার সজলের মা শুরু করলেন। এই সব কিছু সহ্য করার মত মানুষিকতা তৈরি করেই আমি এসেছি। কারণ প্রেমিকের মিষ্টি কথায় গলে গিয়ে ভুলটা তো আমিই করেছি। কিন্তু সজলের অপরাধের শাস্তিটাও দেয়া উচিত। কে দেবে তাকে শাস্তি? পুরুষ শাসিত এই সমাজে কোন্ কালে পুরুষদের শাস্তি হয়েছে? এই সমাজের বিচারকরাই বা কতটা নির্দোষ? পাপী হয়ে পাপের বিচার করবে কি করে?
রাতে সজল বাসায় ফিরলো। তার মা আবার প্রথম থেকে শুরু করলেন। সজলের বাবা কিছু না বললেও বিষয়টা মেনে নিলেন না। সব শুনে সজল এই রুমে এলো। আমার দিকে আগুন ঝরিয়ে তাকিয়ে রইল। আমিও তাকে পাত্তা না দেবার ভান করে রুমের এটা ওটা মুছতে শুরু করলাম। হঠাৎ সে আমার হাত ধরে টেনে রুম থেকে বের করে দিলো। আমি রুমের বাহিরে দাড়িয়ে বললাম-
–“এই রাতেই থানাতে যাবো নাকি পাশের বাসায় রাত টুকু কাটিয়ে সকালে থানায় যাবো?”
সজলের বাবা তাকে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করলেন। সে শান্ত হয়ে গেলো। আমি রুমে ঢুকে বিছানায় শুতেই সে বললো-
–“তুই আমার বেডে শুবি না। ফ্লোরে ঘুমা।”

ওর কথা শুনে অবাক হলাম না। অবাক হবার অনুভূতিটাই যেন আমার আর নেই। ওর মত প্রবঞ্চকের মুখে এমন কথাই শোভা পায়। আমি মুচকি হেসে বললাম-
–“এখন বুঝি আমার সাথে শুতে রুচিতে লাগে? চার মাস ধরে তো বহু বার শুয়েছো তখন রুচিতে লাগেনি?”
–“এতটা নির্লজ্জ তুমি হলে কি করে আয়েশা?”
–“তুমি নির্লজ্জ নও? একটা নারীকে ভোগ করার জন্য বিয়ের নাটক করতে তোমার বিবেকে বাঁধেনি? তোমার ঘরে আমার বয়সী একটা বোন আছে তার সাথে কেউ এমন করলে তোমার এবং তার কেমন লাগবে তা কি কখনো উপলব্ধি করে দেখেছো?”
আমার কথায় সে চুপসে গেলো। আমি আর কিছু না বলে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সে রাগে বালিশ নিয়ে ফ্লোরে নেমে গেলো। আমি চুপচাপ শুয়ে রইলাম।

সজলের বাবা সজলকে ঢাকা পাঠিয়ে দিলো। সেখানে নাকি তার চাকরী হয়ে গেছে। হাস্যকর বিষয় হলো এত দিনের বেকার ছেলেটার ঘরে বউ আসতে না আসতেই তার কপাল খুলে গেছে। আমার সামনে থেকে সজলকে সরিয়ে আমাকে তারা তাড়াতে চায় এটা না বুঝার মত নির্বোধ আমি নই। সে যাকগে, আমি তো জানিই যে এখানে আমি সম্মান নিয়ে থাকতে পারবো না কোনো দিন। তাও নিরুপায় হয়ে এখানে থাকতেই হবে।

শ্বাশুড়ী মা এক গাদা কাজের লিস্ট ধরিয়ে দিলেন। ঘর মোছা থেকে শুরু করে বাসন মাজা, কাপড় কাঁচা, রান্নাসহ ছাদ ঝাড়ু দেয়া পর্যন্ত লিস্টে আছে।
–“আম্মা ভারী কাজ গুলো করা আমার নিষেধ তবে দাড়িয়ে রান্না করতে পারবো। তাই অযথা কাজের লিস্ট ধরিয়ে দেবেন না প্লিজ!”
–“কে তোমাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে মেয়ে?”

উনার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সজলের বাবাকে ডেকে বললাম-
–“বাবা আপনার মা কি ভীষণ অত্যাচারী ছিলেন?”
–“মানে?”
–“আমার তো মনে হয় গর্ভবতী অবস্থায় তিনি আম্মাকে দিয়ে সব কাজ করাতেন।”
–“কখনোই না। সজল গর্ভে আসার পর আম্মা তো সজলের মায়ের খুব যত্ন নিতেন। আম্মা খুব খুশি ছিলেন।”
–“তাহলে বোধ হয় আম্মার মা অত্যাচারী ছিলেন।”

আমার কথা শুনে শাশুড়ি মা তেড়ে উঠে বললেন-
–“একদম আমার মাকে নিয়ে টানাটানি করবে না। আমার মা আমার কোনো ভাবীকেই গর্ভাবস্থায় কাজ করায়নি।”
–“তাহলে আপনি কেনো আমাকে জোর করছেন?”
–“কারণ আমি তোমাকে আমার পুত্র বধূ হিসেবে মানি না।”
–“আর আমার গর্ভের সন্তানকে?”
–“কার না কার পাপের ফসল নিয়ে আমার ঘরে উঠেছো। আমি এসব কিছুতেই মানবো না।”
–“আমার সন্তান পাপী নয়। পাপী তার জন্মদাতা।বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আসতে দিন তারপর ডিএনএ টেস্ট করে পাপীকে সনাক্ত করবেন।”

আমি রান্না করি, সবাই মুখ বুজে খায়। খারাপ হলে ঠিকই চিৎকার করে ছাদ কাঁপাতো। চার মাসে সজল একটি বারও বাড়ি আসেনি। কষ্ট হয়, শ্বাস আটকে আসে। এই সেই মানুষ যাকে ভালোবেসে আজ আমি নীড় হারা, পরগাছা। ভালোবাসার রঙ বড়ই অদ্ভুত। কারো আনন্দ উল্লাসের জন্য একসাথে দুটো জীবন বরবাদ। আমি কিছুতেই চাইনি যে আমার সন্তান পিতৃ পরিচয়হীন হোক। চাইনি সবাই তাকে আঙ্গুল উঠিয়ে বলুক তুই অবৈধ। তাই শত অপমান সয়েও মাটি কামড়ে পড়ে আছি এখানে।

আমার নয় মাস চলছে। এ বাড়ির সবাই আমাকে একটু একটু মেনে নিয়েছে। আমার সাথে ওরা আর আগের মত খারাপ আচরণ করে না। কাজের চাপও কমে গেছে। আসলে বাড়িতে একটা কুকুর পুষলেও তার প্রতি মায়া জন্মে, হয়ত সেই টাইপের মায়া আমার প্রতি তাদের। আমি সবটাই বুঝতে পারি। অনাকাঙ্ক্ষিত আমার এই সংসার। স্বামী বিহীন, স্বামীর সোহাগ বিহীন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সংসার করে চলেছি। রাতে আমার ঘুম আসে না। শরীরের এমন অবস্থায় ভরসা দেবার জন্য আমার পাশে কেউ নেই। না আছে আমার মায়ের কোল, না আছে স্বামীর বুক। আমার বাবা মা কেমন আছে তা আমি জানি না। হয়ত ভালোই আছে। জানি না তারা আমাকে খুঁজে নাকি ভুলে গেছে? হায়রে আমার অভিশপ্ত ভাগ্য! এমন দূর্ভাগ্য নিয়ে যেন পৃথিবীতে কোনো নারীর জন্ম না হয়।
নিঃস্ব এই জীবনে, একলা এই পৃথিবীতে আমার একজন আপনজন আছে। যে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে আমার গর্ভে। তাকে ঘিরেই এখন আমার এই বেঁচে থাকা, আমার এই পথ চলা।

রাত একটায় লেবার পেইন উঠলো। এম্বুলেন্স ডেকে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। মনে হলো আমি আর বাঁচবো না। সুজনের বাবা মা দু’জনের চোখেই এই প্রথম ভয়ের সাথে ভালোবাসার মিশ্রণ দেখলাম। এম্বুলেন্সে সারা পথ আম্মা আমার হাত ধরে বসে ছিলেন। অপারেশন থিয়েটারে ঢুকার আগে আম্মার হাত ধরে বললাম-
–“আমি যদি ফিরে না আসি তবে আমার সন্তানটাকে মানুষ কইরেন। আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে সবাই থেকেও কেউ নেই তার। পারলে ডিএনএ টেস্ট করে সন্দেহ মুক্ত হয়েন।”

আম্মা আমার কথা শুনে শুধু কাঁদলেন কিছু বললেন না।
আমি ফিরে এলাম একটা মেয়ে জন্ম দিয়ে। মেয়েটার মুখটা অবিকল তার বাবার মত। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর দেখলাম সবাই কেমন বদলে গেছে। আম্মা সারা দিন আমার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে রাখেন। ঘড়ি ধরে আমাকে খাবার খাওয়ান। বাবাও যেনো তার নাত্নী বলতে অজ্ঞান। ঐ টুকু বাচ্চার জন্য এক গাদা খেলনা কিনে এনেছেন। কিন্তু সজল কোথায়? সে তো তার মেয়ের মুখ দেখতে আসেনি। আমার মেয়ের নাম রাখলাম সুধা। সুধার জন্মের দেড় মাস পর এক দিন হঠাৎ সজল বাড়ি এলো। বেশ অবাক হলাম। সে আমার সাথে কথা না বললেও তার মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আদর করে। আমার সাথে কথা দু’ একটা হয়। যদিও ওটাকে কথা বলা চলে না।
সুধার বয়স চার মাস হতেই সজল ঢাকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়ি এলো। আশে পাশে চাকরি হলে সে করবে, তা না হলে যে কোনো ব্যবসা শুরু করবে। শেষমেস সে ব্যবসাই শুরু করলো। মেয়ের টানেই যে তার এই বদল সেটা আমি বুঝতে পারি।

এখন সজল অনেকটাই স্বাভাবিক। আমি ওর চোখে আমার জন্য ভালোবাসা দেখতে পাই। সেই আগের মত, যখন সজল আমার জন্য পাগল ছিল। কত পাগলামিই সে আমার জন্য করেছে। অবশ্য সবটাই তো তার সাজানো নাটক ছিল। আমার সাথে চিট করা হয়েছে। ভালোবাসার নাটক করে সে আমাকে ঠকিয়েছে। বঞ্চনা করেছে মিথ্যা বিয়ের আয়োজন করে। আর আমি পৃথিবীর সেরা বোকা মেয়ে, যে কিচ্ছু টের পায়নি। এখন সেই নাটকময় পাগলামি না করলেও কাছাকাছি থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষাটা বুঝতে পারি। কিন্তু আমার মনে কিঞ্চিত আকাঙ্ক্ষাও নেই। আমি আমার জীবন থেকে, মন থেকে তাকে বাদ দিয়ে দিয়েছি। জানি না এ জীবনে কখনো তাকে ক্ষমা করতে পারবো কি না। তাকে ক্ষমা করার মত উদার মন কি আছে আমার? নেই, আমি তো মহামানবী নই। তাই সহজেই সব কিছু পারি না। পারি না আমার গর্ভকালীন অসহায় নয়টা মাসকে ভুলে যেতে।
এক দিন হুট করে সে বললো-
–“আয়েশা কাল আমার সাথে তোমাকে এক জায়গায় যেতে হবে?”
–“কোথায় আর কেনো?”
–“আমাদের বিয়েটা তো নাটক ছিল তাই এখন সত্যি বিয়েটা করা দরকার।”

ওর কথা শুনে হাসি পেলো। হাসি ভেতরে বন্দী রেখেই বললাম-
–“কোনো দরকার নেই।”
–“আমার মেয়ের বৈধতার জন্য দরকার আছে। দরকার আছে আমাদের দূরত্ব সরিয়ে তোমাকে কাছে পাবার জন্য।”
–“কিন্তু তোমাকে তো আমার কাছে পাবার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। আমি চাই না তোমাকে। তোমার কাছাকাছি থাকার কিঞ্চিত রুচিও নেই আমার।”
–“তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও আয়েশা। চলো সব ভুলে নতুন করে শুরু করি।”
–“জীবন কখনো নতুন করে শুরু করা যায় না। অতীতটা কি বাদ দেয়া যায়? আর ক্ষমা পাবার যোগ্য অপরাধ কি করেছো তুমি? তোমার বোনের সাথে যদি এমন ঘটতো তাহলে তাকেও কি তোমরা সহজেই ক্ষমা করতে? কি এমন প্রায়শ্চিত্ত করেছো তুমি? কি শাস্তি ভোগ করেছো? এই সমাজ তো আমার ভুলের বিচার করেই দিয়েছে আমাকে ঘর ছাড়া করে। কিন্তু সমান দোষে দোষী হয়ে সমাজ তোমার কি বিচার করেছে?”

আমার কথা শুনে সে চুপ হয়ে গেলো। আমি তার জবাবের অপেক্ষা করি না কারণ আমি জানি আমার একটা প্রশ্নেরও জবাব নেই তার কাছে। কাপুরুষদের জবাব থাকে না।

আমি সবার অগোচরে একটা চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলাম আর ভাগ্যক্রমে সেটা হয়েও গেলো। জয়েনিং লেটার এলো। বাড়িতে কেউ খুশি হলো না। পোস্টিং দূরে বলে সবার মন খারাপ। সুধাকে ছাড়া তারা চোখে আধার দেখে। বাবা কিছুতেই রাজী নয় আমার দূরে চাকরী করতে যাবার ব্যাপারে। এটা নিয়েই শুরু হলো ঝামেলা। ওরা সবাই এক দল আর আমি একাই। যাবার জন্য সব প্রস্তুতির পরে হঠাৎ সজল চিৎকার চেচামেচি শুরু করলো। সে সুধাকে যেতে দেবে না। ওর চিৎকার চেচামেচি আমি তোয়াক্কা করলাম না। জোর গলাতেই বললাম-

–“সুধা শুধু মাত্র আমার মেয়ে সজল। তার প্রতি কারো কোনো দাবী নেই। তুমি অযথাই চিৎকার করছো।”
–“দাবী নেই মানে? আমি সুধার বাবা। সমান দাবী আমারো আছে।”
–“আজ যে সন্তানকে স্বীকার করছো আগেই যদি তা স্বীকার করতে তবে আমার জীবনটা একটু ভিন্ন রকম হতো। আমার পরিবার আমাকে ত্যাগ করতো না। গর্ভাবস্থায় আমাকে অযত্ন অবহেলা সইতে হতো না। আজ স্বীকার করে কি লাভ? গর্ভবতী নারীরা গর্ভাবস্থায় তার স্বামীকে সব সময় পাশে চায় অথচ তুমি আমার বাচ্চার মুখ দেখলে যখন তার বয়স দেড় মাস। কোথায় ছিল তখন তোমার পিতৃত্ব? এমনিতেও তো আমি তোমার নকল বউ। তাই সন্তানটাও নকলই। কার কাছে গিয়ে সন্তান দাবী করবে? কি প্রমান আছে তোমার কাছে?”

আমার এক নাগাড়ে বলা কথা গুলো শুনে সবাই চুপ হয়ে গেলো। আমি কারো কথা তোয়াক্কা না করে সুধাকে নিয়ে বাড়ি ত্যাগ করলাম। সজলের এই শাস্তিটা দরকার ছিল। পারলাম না তাকে ক্ষমা করতে।

আমার আর সংসার হলো না, ভালোবাসা হলো না, স্বামী হলো না। সংসার হয়ত সবার জন্য নয়, ভালোবাসাও সবার জন্য নয়। আমিই সেই হতভাগী, যার কপালে এই সব কিচ্ছু লেখা নেই।

সুধাকে নিয়ে ছোট্ট একটা পৃথিবী আমার। সারা দিন অফিস করে সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফিরি তখন সুধাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। কষ্ট একটাই, সেটা হলো কাজের মেয়ের কাছে বড় হতে হচ্ছে আমার রাজকন্যাকে। আমি তো এমনটা চাইনি। আমি তো চেয়ে ছিলাম একটা ঘর, একটা সংসার। যেখানে স্বামী সন্তান নিয়ে খুব সুখে থাকবো। অথচ একটা ভুলের মাসুল দিতে গিয়ে আশা আকাঙ্ক্ষা সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। উল্টে গেছে জীবনের মোড়। উচিত প্রতিটা নারীর, তার সমভ্রম রক্ষা করে ভালোবাসা। যে মন দেখে ভালোবাসে সে শরীর চায় না। এটাই তো ভালোবাসার সব চেয়ে বড় পরীক্ষা। যে জীবনে থাকবে সে এমনিতেই থাকবে আর যে চলে যাবে তাকে গোটা পৃথিবী দিলেও ঠিক চলে যাবেই। যে জীবনে থাকবে সে শত ভুলের মাঝেও একটা কারণ খুঁজবে থাকার জন্য। আর যে চলে যাবে সে বিনা কারণেই চলে যাবে। তাই চলে যেতে চাওয়া মানুষ গুলোকে আটকে রাখার চেষ্টা করা বৃথা।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত