পিতাঠাকুর গত হলেন ১৯৮০ সাল । আটাত্তরের বন্যার দু বছর পরে । আমার তখন সবে বাইশ বছর বয়েস!মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো বুঝলি!”
-এই অবধি বলে একটু থমকে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন আনন্দদা!
আনন্দদা মানে ভালো নামে শ্রুত্যানন্দ আচার্য! প্রথম প্রথম আমরাও শ্রুত্যাদা বলেই ডাকতাম! ভয়ঙ্কর রেগে যেতেন ভদ্রলোক! বাংলার মাস্টার ছিলেন বলেই হয়তো, ভুল বাংলায় কিছু বললে বা লিখলেই যারপরনাই খেপে যেতেন!
চোখটাকে গোল গোল করে বলতেন,”সন্ধিবিচ্ছেদ শিখিসনি? এদিকে মাস্টার হয়েছিস! শ্রুতি যোগ আনন্দ, তবে হয় শ্রুত্যানন্দ! তা সংক্ষেপে বলবিই যখন নয় শ্রুতিদা ডাক, নয় আনন্দ! শ্রুত্যা কী করে হয় বাপু?”
ভেবে দেখলুম, সত্য বটে! সেই থেকে উনি আমাদের আনন্দদা!
আমরা বলতে বর্ধমান জিলার আউশগ্রামের বড়োবেলগোলা পোস্ট আপিসের অন্তর্গত বিল্বগ্রাম ইশকুলের মাস্টাররা! আমি অনিমেষ ভূগোল পড়াই! আর সে যাত্রায় সঙ্গে ছিল পুলকেশ, অংকের সিনিয়র সেকশনের মাস্টারমশাই আর ফিজিক্যাল ট্রেনিঙের অমল হাজরা! সরকারি ইশকুলের মাস্টার, তাই সেবার ভোটের ডিউটি পড়েছিল বোলপুরে! আমরা চারজন বেলাবেলি রওয়ানা হয়েছি, পৌঁছেও গেছি সন্ধের মুখটায়! এমনিতে জায়গাটা ভালোই! যে ইশকুল বাড়িতে রাত কাটানোর বন্দোবস্ত হয়েছে, সেটা ইলেকশন বুথ থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে! ভবরঞ্জন প্রাইমারি ইশকুল! একতলা বেশ পুরোনো ইশকুল বাড়ি! দোতলার কাজ চলছে!
আশেপাশে দু-চার ঘর খোড়ো বাড়ি আর দিনের বেলায় মস্ত বড় বাজার বসে, সন্ধে হলে জায়গাটা বেশ শুনশান! স্কুলের উত্তরদিকে মস্ত বড়ো একটি জলা! জলা পেরিয়ে যদ্দুর চোখ যায় ধু ধু মাঠ, চাষের জমি আর রেললাইন! সন্ধের মুখটায় পৌঁছে দেখলাম খাতিরযত্নের ব্যবস্থা মন্দ না! জনাকয়েক স্থানীয় ক্লাবের মেম্বাররা আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়ে গেলেন একতলার একটা বড় ক্লাসঘরে। ব্যবস্থা বলতে খানচারেক চৌকি আর মশারি, বিছানাপত্তর! সঙ্গে করে ওডোমস আর টর্চ নিয়ে এসেছিলাম,এ অঞ্চলের মশার খ্যাতি কিন্তু আকাশচুম্বী! তা সন্ধে সন্ধে খাসির মাংস আর গরম ভাত দিয়ে নৈশভোজ সেরে ভাবলুম একটু আড্ডা দেওয়া যাক! স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ভালো মানুষ! বারবার করে বললেন,কোনো অসুবিধে হলে খবর দিতে! একটি দারোয়ান রাতে থাকবে ইস্কুলের ফটকে! আর ভোর হতেই ওনারা তো চলে আসবেনই!
সেদিন পূর্ণিমা!
রাত নয়টার মধ্যে এ অঞ্চল শুনশান! খাওয়াদাওয়া শেষ করে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে ইশকুলের ছাদে এসে একটা মাদুর পেতে চারজন গুছিয়ে বসলাম! গরমকাল! পচা ভাদ্রমাসের গরম! হাতপাখা ছাড়া গতি নাই! স্কুলবাড়িতে কারেন্ট আছে বটে, কিন্তু কী এক অজানা কারণে সেদিন বাতি জ্বলছে না! তাই যতক্ষণ বাইরের হাওয়া খাওয়া যায়, ততক্ষনই আরাম! তো প্রসঙ্গটা উঠলো, আনন্দদার ব্যাগে বিড়ির প্যাকেট পাওয়া গেল বলে! থলে থেকে টর্চ, গামছা, রাতের পাজামা ইত্যাদি টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে রাখছিলাম সকলে, তখনি চোখে পড়লো আনন্দদার ব্যাগে একটা বড়পাতার বিড়ির প্যাকেট! পুলক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে “ওকি, আনন্দদা! আপনি না বিড়ির গন্ধই সহ্য করতে পারেন না, এদিকে সঙ্গে বিড়ি নিয়ে ঘুরছেন?”
আনন্দদা, খানিক অপ্রস্তুত হয়ে চারদিকে দ্রুত একবার তাকিয়ে নিয়ে প্রথমে খানিকটা আমতা আমতা করে ব্যাপারটা প্রসঙ্গান্তরে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু আমি আর অমল চেপে ধরতেই বললেন, “আসলে,কি জানিস,ওটা আমার জন্যে নয়,সঙ্গে রাখি,আরেকজনের দরকার হয় বলে”-খানিকটা হো হো করে হেসে অমল বললে, “মানে, জনস্বার্থে রাখেন বলছেন? লোকজন কার কখন দরকার হবে,আর আপনার কাছ থেকে চেয়ে নেবে?” এবার আনন্দদা একটু চুপ করে বললেন, “না হে,এটা আমার বাপের জন্যে!”
“মানে???”
সমস্বরে আমরা বলে উঠলাম! সকলেই জানি আনন্দদা পিতৃমাতৃহীন এবং প্রথম পক্ষের স্ত্রীর মৃত্যুর পরে আর দার পরিগ্রহ করেন নি! সন্তানাদিও নেই! এক্কেবারে একলা,নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ! তা শৌখিন মানুষ হিসেবে তার নামডাক আছে বটে,মাঝেসাঝে বিলিতি সিগারেটও খেতে দেখেছি তাঁকে,তবে তা নেহাতই শখ করে! তবে বিড়ির প্রতি তাঁর একটা বিশেষ অনীহা! কেউ আশেপাশে খেলেও তাকে প্রায় ধমকে ওঠেন আনন্দদা, ঐ কড়া গন্ধ তিনি মোটেও সহ্য করতে পারেন না! সেই তিনি, সঙ্গে কিনা বিড়ির প্যাকেট!!!
নাহ,ব্যাপরটা ভারী গোলমেলে! যাই হোক, চেপে ধরতেই তিনি বললেন” বেশ, চল ছাদে গিয়ে বসা যাক! তারপর নয় গল্পটা বলবো!”
মাদুর পেতে ছাদে যখন গোল হয়ে বসলুম, পূর্ণিমার চাঁদ তখন চরাচর ভাসাচ্ছে! একটা ফুরফুরে মিষ্টি হাওয়া বইছে দক্ষিণের দিক থেকে! আনন্দদা ফতুয়ার পকেট থেকে বেরোলো সেই বিলিতি সিগারেট! আমাদের মধ্যে একমাত্র পুলকই যা খায়, বাকি আমি ও অমল ও রসে বঞ্চিত! পুলক আর আনন্দদা একটা একটা করে ধরিয়ে নিয়ে বেশ গুছিয়ে বসে এক মুখ ধোয়াঁর রিং ছেড়ে আনন্দদা শুরু করলেন তাঁর রহস্য গল্প! “পিতাঠাকুর গত হলেন ১৯৮০ সাল । আটাত্তরের বন্যার দু বছর পরে। আমার তখন সবে বাইশ বছর বয়েস! মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো বুঝলি! আমাদের বাড়ি ছিল সাহেবগঞ্জে! বাবা ছিলেন স্থানীয় পোস্টাপিসের পোস্টমাস্টার! খুব বেশি যে একটা মাইনেপত্র তা নয়,কিন্তু আমি আমার বাবা মায়ের বেশি বয়েসের একটিই সন্তান,তাই বড় আদরের ছিলুম! মা ঘরসংসার সামলাতেন আর বাবা পোস্টাপিস! টেনেটুনে চলেই যাচ্ছিলো একরকম, কিন্তু হঠাৎ করে বাবার এক শখ চাগাড় দিলো। ডাকে কী সব বইপত্তর আনাতে লাগলেন কলকাতা থেকে। আর রাত জেগে শুরু হলো সেসব নিয়ে পড়াশোনা! প্রথম প্রথম আমি বা মা কিছুই বুঝিনি,পরে এক আধদিন রাত্তিরে বাবার ঘরে উঁকি দিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত দৃশ্য দেখে আমার তো প্রায় আক্কেল গুড়ুম! মোমবাতি জ্বালিয়ে,ধুপ জ্বালিয়ে,বাবা অদ্ভুত সব আওয়াজ করছেন,এই চোখ বুজে চুপ করে বসে আছেন আবার এই হাততালি দিয়ে গোটা ঘর নেচে বেড়াচ্ছেন! সঙ্গে বিচিত্র বিচিত্র সব শব্দ! লোকমুখে শুনলুম,তিনি নাকি প্রেতচর্চা শুরু করেছেন! অভাবের সংসারে আর কিছু পেলে না,প্রেতচর্চা!!!
যত্তসব!
মাথায় আগুন ধরে গেল আমার! তখন সবে ইশকুলের গন্ডি ছাড়িয়ে কলেজের পরীক্ষা দেওয়া শুরু করেছি! সংসারের প্রয়োজন বাড়ছে দিনে দিনে! ওদিকে বাবা তার প্রেতচর্চা নিয়ে এমন মেতে উঠলেন যে কাজকম্ম সব ডকে উঠলো!
পোস্টাপিসের চাকরি বলে তারা তাও দীর্ঘকাল সহ্য করছিলেন,অন্য কোথাও হলে তারা কবেই বাবাকে তাড়িয়ে দিত! মা কান্নাকাটি করে,খাওয়াদাওয়া ত্যাগ করে অনেক চেষ্টাচরিত্র করলেন ঠিকই,কিন্তু বাবাকে বোঝায় কার সাধ্যি!
দিনে দিনে বাবার সাথে দূরত্ব বেড়ে গেল আমারও! ঐ সুন্দর ভালোমানুষ চেহারার লোকটা কেমন যেন হারিয়ে গেল! চোখগুলো ভাঁটার মতো লাল, গলা ভর্তি কতরকম রংবেরঙের পাথরের মালা! চিমসে গেল শরীরটা, শিরা উঠে গেল সর্বাঙ্গে! শেষের দিকে নিজের ঘর ছেড়ে বড় একটা বেরোতেন না! লোকে বলাবলি শুরু করলো,তিনি নাকি,পিশাচসিদ্ধ হয়ে উঠেছেন! সংসার তখন টালমাটাল! টাকাপয়সার সংস্থান তো দূর অস্ত! রাগে, ঘেন্নায় আমিও তাঁর থেকে দস্তুরমতো দূরে সরে গেলাম! প্রয়োজন ছাড়া কথাবার্তাও বন্ধ! তবু আমায় বড় ভালোবাসতেন তিনি, আর দেখা হলেই ধাঁধার মতো একটা হাসি হেসে বলতেন, “তোরা যতই রাগ কর, আমি চলে গেলে বুঝবি, আমি তোদের ছেড়ে যাইনি! তোদের ভালো মন্দ স-ও-ব দেখবো আমি!”
আশি সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বাবা মারা গেলেন প্রায় হঠাৎই! তিনদিনের জ্বরে কাবু হয়ে! সব চুকেবুকে গেলে পোস্টাপিসের চাকরিটা পেলেন মা, মাস চারেকের মধ্যে, আর বছরখানেকের মধ্যে আমিও চাকরি পেলুম এক বহুজাতিক সংস্থার আপিসে! বেশ খানিকটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই,বাবার মৃত্যুর পর সংসারের চাকা ঘুরছিল! আবার আগের মতো সংসারের ছিরিছাঁদ ফিরছিল একটু একটু করে।
আমার চাকরিটা ছিল ভারী অদ্ভুত! বড্ডো ঘুরতে হতো বুঝলি!আজ বিহার,কাল উড়িষ্যা,পরশু আসাম এই করে বেড়াচ্ছিলাম!মাসের শুরুতে একগাদা টিকিট আর ওষুধপত্তর নিয়ে সেমিনার করতে যেতুম ভূ-ভারতে! আমাদের কোম্পানি কী এক ভেষজ আয়ুর্বেদিক ওষুধ বিক্রি করত! তো সেই উদ্দেশ্যেই নামী-দামি ডাক্তারদের দিয়ে সেসব ওষুষের ব্যাপারে সেমিনার, আলোচনা এসব চালানো হতো ম্যারাপ বেঁধে,জায়গায় জায়গায়! তা বলতে নেই, বিক্রিও হতো যাকে বলে হু হু করে! সঙ্গে দস্তুরমতো টাকাপয়সা আর ওষুধের ব্যাগ নিয়ে মাসভর ঘোরাঘুরি,প্রথম প্রথম বেশ মন্দ লাগছিল না! একে তো বয়েস অল্প তারপর নতুন জায়গা দেখা,দেশভ্রমণের সুযোগ,সঙ্গে কাঁচা টাকা, আর কী চাই বল দিকি! তাই স্বপ্নের মতো লাগছিল! তো সেবার গেছি বিহারের পূর্ণিয়া ডিস্ট্রিক্টে!”
“পূর্ণিয়ার নাম শুনেছিস তো?” ভূগোলের শিক্ষক আমি,পূর্ণিয়ার ব্যাপারে গড়গড়িয়ে বলে গেলাম! বিহারের আটত্রিশটি জেলার মধ্যে পূর্ণিয়া অন্যতম! আগে প্রায় জঙ্গলই ছিল,এখন ব্যবসাপত্র চাষবাস হয়ে জায়গাটার বেশ শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে শুনেছি!
সিগারেটে একটা টান মেরে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে আবার শুরু করলেন আনন্দদা!
“সেবার সেমিনার ছিল পূর্ণিয়াতে! প্রথমটাতে রাজি হইনি! জায়গাটার অসম্ভব দুর্নাম যে! আপিসের অন্যান্যদের মুখে আগেই শুনেছিলাম, পূর্ণিয়া নাকি আদতে ডাকাতদের ডিপো! মানে বড়রাস্তায় গাড়ির ওপর গাছের ডাল ফেলে অবাধে লুটপাট সেখানে প্রায়ই চলে! স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গে মালপত্তর, ক্যাশপয়সা নিয়ে ওসব জায়গায় যাওয়া,সে ভারী বিপদের ব্যাপার! তারপরে ত্রাহস্পর্শ যেটা হলো,যেদিন সেমিনার তার পরদিন কাকভোরে আমায় পৌঁছতে হবে কাটিহার ইষ্টিশনে! সেখান থেকে শিলিগুড়ির ট্রেন ধরতে হবে! তা ধর, পূর্ণিয়া থেকে কাটিহার প্রায় না না করে ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা! রাস্তা মানে জঙ্গল চিরে হাইওয়ে! শুনশান লণ্ঠন জ্বলা দু একটা খোড়ো ঘর যদি বা চোখে পড়ে,তার মধ্যে কে যে সাধারণ মানুষ আর কে যে ডাকাত,তা বোঝা দুস্তর! তারপর সঙ্গে থাকবে কালেকশনের টাকাপত্রও! ও রাস্তায় ক্ষনে ক্ষনে বিপদের আশংকা! বেশ দোনোমোনা করেই রাজি হলুম!
শুক্কুরবার সেমিনার শেষ করে হোটেলে ফিরেছি প্রায় রাত্রি ৯টা!
হোটেল বলতে ঐ অঞ্চলে তখন দু চারটি সরাইখানা! ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে ছেলেটিকে বলে রেখলুম আমায় রাত দুটোর সময় দেন ডেকে দেয়! হোটেল থেকে সদরের বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতে হলে বেরোতে হবে রাত আড়াইটার মধ্যে! তাই একটা রিক্সা,ঘোড়াগাড়ি কিছু যদি বলা থাকে! ছেলেটি ঘাড় নেড়ে গেল ঠিকই,কিন্তু ব্যবস্থা কিস্যু হলো না! রাত আড়াইটায় বেরিয়েই দেখি চতুর্দিক একেবারে খাঁ খাঁ করছে ।একে শীতের রাত! তারপর ও অঞ্চলের শীত যে কী সাংঘাতিক,সে তোরা কল্পনাই করতে পারবি না! কথায় বলে মাঘের শীত বাঘের গায়ে! ফুলস্লিভ সোয়েটারের ওপর চাপিয়েছি একখান শাল, মাথায় মাঙ্কিক্যাপ আর হাতে দস্তানা পরেও তো আমার প্রায় দাঁতকপাটি লেগে যাওয়ার জোগাড়! অবিশ্যি অনেকটাই ভয়েও! হাতে হোল্ডঅল আর মালপত্তর নিয়ে হাঁটা লাগলাম সদরের দিকে । আদৌ রিক্সা, গাড়ি কিছু পাবো কিনা জানি না! একবার আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালাম, ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে যা থাকে কপালে,বলে বেরিয়ে পড়লুম অজানা রাস্তায়!
সে যে কী অন্ধকার, সে তোদের বলে বোঝাতে পারব না! মিশমিশে গাঢ় অন্ধকারে এমনকী নিজের হাতের তালু পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না! তারপর রাস্তায় নেই কোনো আলো! শুধু ধ্রুবতারার আলো নির্দিষ্ট করে হেঁটে চলেছি সদরের দিকে! বুক ঢিপঢিপ করছে,ঘামে ভিজে গিয়েছে গায়ের সোয়েটার পর্যন্ত । কতক্ষন হেঁটেছি খেয়াল নেই, হঠাৎই চোখে পড়ল একটি রিক্সা! চোখে পড়ল বললে ভুল বলা হয়,ঠুং ঠুং আওয়াজে মালুম পেলুম,একটি রিক্সা এসে দাঁড়ালো আমার সুমুখে । হিন্দিতেই রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাইয়া,সদর বাসস্ট্যান্ড, যায়গা?”
রিক্সাওয়ালাকে দেখতে পর্যন্ত পাচ্ছি না । তবু আন্দাজে একতাল অন্ধকারকে উদ্দেশ্য করেই বললাম কথাগুলো । খানিকটা দেহাতি টানে এবার শুনলুম,উত্তর এল – “চলিয়ে,বাবুজি!”
যাক বাবা,হে তারকনাথ রক্ষা করো প্রভু ।
রিক্সায় মালপত্তর নিয়ে উঠতেই, এ কী গেরো!
পাশে দেখি আরেকজন বসে! মানে, আগে থেকেই ছিল তাহলে! মোটা কম্বলে আপাদমস্তক ঢাকা আর তীব্র পোড়া তামাকের গন্ধ! চিনতে ভুল হলো না,খুব কড়া তামাকের বিড়ি খাচ্ছিল লোকটা! প্রথমটায় বলতে যাচ্ছিলুম রিক্সাওয়ালাকে, ” কী হে ভাই, আগে তো বলোনি,আরেকজনকে চাপিয়ে নিয়ে এসছো,তাহলে উঠতুম না, ইত্যাদি, কিন্তু ভেবে দেখলুম,এই মহান ভদ্রলোক যদি এখন আমায় ছেড়ে দিয়ে চলে যায়,এই অকুলপাথারে, আমার যে আর কোনো অবলম্বন থাকবে না ! তাই যে বসে আছে,থাক! ওতে আমার কী! আমার দৌড় তো সেই বাসস্ট্যান্ড অবধি! সে থাকুক না তার মতো! রিক্সা চলতে শুরু করলো! রাস্তায় জনপ্রাণী নেই কোত্থাও! এমনকী একটা কুকুর বা বেড়ালের দেখা পর্যন্ত নেই! রাস্তার দুপাশের বড় বড় গাছগুলো ঝুঁকে আছে প্রায় অশরীরীর মতো! নাকে এসে লাগছে গাছের পাতা! আজ ঘোর অমাবস্যা! শিবের নাম করতে করতে ব্যাগ আঁকড়ে চলেছি!
অনেকক্ষণ থেকেই একটা অদ্ভুত চিন্তা আমায় গ্রাস করছে,এই যে লোকটি পাশে বসে রয়েছে সে বিশেষ নড়াচড়া করছে না তো! মানে, দু’একটা গলা খাঁকড়ি ও তো দিতে পারে! এমনভাবে সে কম্বল জড়িয়ে বসে আছে,যেন বা মৃত মানুষ! বুকের ভিতরটা হঠাৎ কী জানি একটা অজানা ভয়ে ছ্যাঁৎ করে উঠল! তারপর নিজের ওপর নিজেরই রাগ হলো,পঁচিশ বছরের পুরুষমানুষ আমি! শক্তপোক্ত চেহারা! এত্ত ভয় পেটে পেটে আমার! একটু বেশ আওয়াজ করেই বসলাম! পাশের লোকটি এবার বিড়ি ধরালো, ওফফ, আবার সেই বেয়াড়া, বোঁটকা গন্ধ! বিড়ির গন্ধ আমি মোটে সহ্য করতে পারি না! ভাবলাম,লোকটিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই রিক্সা থেকে! তারপর নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেরই হাসি পেল! কিন্তু একটা ব্যাপার, যেটা আমার মনে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিলো, এই গন্ধটা খুব চেনা! এমনকী এই কম্বলের স্পর্শটাও কোথায় জানি দেখেছি! খুউব যেন চেনা! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে সদরে পৌঁছে গেলাম। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি বাসগুমটির ফুটকি ফুটকি আলো!
রিক্সাওয়ালাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পকেট থেকে ভাড়া বের করতে যাবো, খেয়াল হলো, আরে,পাশের লোকটি কই? আমার পাশের সিটটা তখন শূন্য! আমি মূর্খের মতো রিক্সার একপাশ ঘেঁষে ব্যাগপত্তর নিয়ে বসে আছি! অবাক বিস্ময়ে,আমার গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল! রিকশা তো একটিবারের জন্যও দাঁড়ায়নি! তবে,লোকটি নামলো কোথায়? রিক্সাওয়ালাকে খানিকটা কিন্তু কিন্তু করে প্ৰশ্ন করেও ফেললাম,” আচ্ছা, ভাইয়া, আপকা রিক্সা মে মেরে সাথে অর কৌন থা?”
বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা বাঁদুরে টুপিটা সরিয়ে আমার মুখটা ভালো করে ঠাহর করে দেখে নিলো, যে লোকটা পাগল আছে কি না! খানিকটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতেই বললে, ” কৌন হোগা সাহেব ” পূর্ণিয়া সে আপ তো খুদে হী আয়ে, আপকে সাথে তো অউর কই নেহি থা! ”
আমার তলপেটের ভিতরটা ঠিক কেমন একটা ভয়ে, না বিস্ময়ে জানি না অসম্ভব গোলাতে শুরু করেছে ততক্ষন! ওর সাথে আর তর্কে গেলাম না, কিন্তু বিড়ির বোঁটকা গন্ধটা যে এখনো আমার ডানহাতে লেগে রয়েছে, হাত শুঁকে আবারো পেলাম! এমনকী সেই কম্বলের বিশ্রী চিমসে গন্ধটা! সেটা তো আর মিথ্যে হতে পারে না! বাসে ওঠার আগেই হড়হড় করে বমি করে ফেললাম! আকাশ তখন ফিকে হতে শুরু করেছে! পাখি ডাকছে! বাস ছাড়তেই জানলার ধারে বসে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, বাবা তার কথা রেখেছে, বাবা সত্যি এখনো আমায় ছেড়ে যায়নি তবে । ঐ, বিড়ি, ঐ কম্বলের গন্ধ, স্পর্শ আমি বিলক্ষণ জানি ।কান্নায় দুচোখ ভেসে জল ঝরছে আমার চোখে তখন!”
বেশ খানিকক্ষণ হবে আমি, পুলকেশ আর অমল চুপ করে বসে আছি! সামনে জলার ওপরে থালার মতো চাঁদ প্রায় মাথার কাছে উঠে এসেছে! আমাদের ছায়াগুলো লম্বা হয়ে পড়ছে ছাদের অন্য প্রান্ত অবধি! চতুর্দিক দুধগোলা জলের মতো জোছনায় ভেসে যাচ্ছে । সামনের মাঠটায় জমাট বাঁধা ধোয়াঁর মতো কুয়াশা ধানক্ষেতের ওপর গাঢ় হয়ে ঝুলে রয়েছে! আনন্দদা, বুকের সামনে হাত দুটো জড় করে মাথাটা ঝুঁকিয়ে চুপ করে বসে রয়েছে! নিস্তব্ধতা ভাঙলো অমল! ককিয়ে বলে উঠলো “তার মানে আ-আ-আপনি বলতে চাইছেন, আপনার বাবা এখনো আপনার সাথে দেখা করেন । এই বিড়ির প্যাকেট আ-আপনি তার জন্যেই মজুত রাখেন ।”
আনন্দদা, মুখ তুলে তাকালেন! শূন্য ফ্যালফ্যালে একটা দৃষ্টি! বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর, আস্তে আস্তে মাথাটা উপর নিচে দুলিয়ে অমলের কথার সমর্থন করলেন! ঘড়ঘড়ে গলায় অস্ফুটে বলে উঠলেন,
” বাবা আমার সঙ্গ ছেড়ে যাননি ! এই এতগুলো বছর পেরিয়েও মায়ের মৃত্যুর পরেও বাবা এখনো রোজ রাত্তিরে আমার সাথে দেখা করতে আসেন! এই বিড়ির প্যাকেট থেকে একটা দুটো করে সুখটান দেন! বকাবকি করেন ছোটবেলার মতো! উপদেশ দেন, কোনো আগাম বিপদ থেকে সতর্ক করেন তারপর….চলে যান! “
আনন্দদার কথাটা শেষ হওয়ার পরেই,মাথার ওপর দিকে বিশ্রী আওয়াজ করে উড়ে গেলো একটা রাতচরা পাখি! মাথার ওপর থেকে পিঠের নিচ অবধি কেমন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো আমার!লোকটা কি পাগল?বলে কী?
স্ত্রীর মৃত্যুর পর আত্মীয়স্বজনহীন অবস্থায় থাকতে থাকতে বোধহয় লোকটার মাথাটাই গেছে! আমার প্রশ্নটা ঠিক যেন পড়তে পারলেন আনন্দদা!
মুচকি হেসে, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“অনিমেষ, আমি কিন্তু পাগল নই । আমার স্ত্রীও আমায় পাগলই ভেবেছিলেন! কিন্তু এক রাত্রের পর ….তিনিও, যাই হোক…! অনেক রাত হলো, চলো শুয়ে পড়া যাক!”
নিঃশব্দেই ইশকুলের ছাদ থেকে নেমে গেলাম আমরা চারজন!
হাতঘড়ির ডায়ালে রেডিয়ামের কাঁটা বলছে রাত সাড়ে তিনটে! কেমন একটা অস্পষ্ট আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল! সকাল হয়ে গেল নাকি! মশারির মধ্যে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম!তবে কি চোর-টোর? সতর্ক হয়ে বালিশের নিচ থেকে বের করলাম পাঁচ সেলের বড় টর্চটা!দারোয়ান ঘাটের মড়া ব্যাটা যে কোথায় সেই জানে! আশেপাশে আলো ফেলে বুঝলাম পুলকেশ আর অমল ঘুমিয়ে কাদা! শুধু আনন্দদার বিছানার মশারি তোলা! কোথায় গেলেন আনন্দদা?
এত রাত্রে?
একে নতুন জায়গায় অন্ধকারে ভালো করে ঠাহর করতে পারছি না, অচেনা ক্লাসরুমে হোঁচট খেতে খেতে দরজাটা খুলে ডানদিকে পাঁচধাপ সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলাম! বাইরেটা ঠিক সেইরকম চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে! এতখানি স্পষ্ট আশপাশ, মনে হচ্ছে যেন রোদ্দুর উঠে গেছে! সামনের করিডোর ধরে একটু গেলেই খেলার মাঠ, মাঠের পাশেই জলা আর একটা বিরাট পাকুড় গাছ। আওয়াজটা ওখান থেকেই আসছে। কেউ যেন চাপা গলায় কারোর সাথে তর্কাতর্কি করছে । টর্চের আলোয় এগিয়ে গেলুম!
করিডোরের ভেজানো দরজাটা খুলতেই দেখি পাকুড় গাছটার নিচে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন আনন্দদা! খুব হাত পা নেড়ে কাকে যেন কী বোঝাচ্ছেন! নিশ্চই ঐ দরোয়ানটাকে!কিন্তু এত রাত্রে সে ব্যাটা এখানে এসেছে কেন? কাছে যেতেই একটা অদ্ভুত গন্ধ পেলাম!
হ্যাঁ, কড়া তামাকের গন্ধ! কেউ বোধহয় বিড়ি ধরিয়েছে! ওহ,সেই কারণেই বোধহয় আনন্দদা ওকে ধমকাচ্ছেন! আনন্দদার গলার স্বর খুব বিচিত্র শোনাচ্ছে! একবার যেন খুব অনুনয় করে, কাউকে কিছু বোঝাচ্ছেন আর আরেকটা স্বর ফ্যাসফ্যাসে,হিংস্র, বকে বকে যেন তাকে চুপ করিয়ে দিচ্ছে!
অবাক লাগল!
এ সময় কার সাথে কথা বলছেন আনন্দদা? আস্তে আস্তে হেঁটে গেলাম গাছটার দিকে, খুব কাছে গিয়ে আলতো করে আনন্দদার পিঠে হাত দিতেই, হঠাৎই চমকে পিছন ফিরে আমার দিকে তাকালেন আনন্দদা!
এ কী!! এ কে!!
আমার সমস্ত স্নায়ু ঝিমঝিম করে উঠল, আমার সমস্ত শরীরের রক্ত যেন মাথায় এসে ভিড় করল, এ আমি কী দেখছি!আনন্দদার সেই হাসি হাসি মুখখানি উধাও! কী প্রবল গনগনে ভাঁটার মতো চোখ আনন্দদার!ঐ দৃষ্টি কি আগে কখনো দেখেছি?কী তীব্র,কী ভয়ঙ্কর!
সমস্ত মুখখানা যেন একটা হিংস্র উল্লাস ধিকধিক করছে! যেন এক আশি বছরের লোলুপ বৃদ্ধর মতো চোখমুখ বদলে গিয়েছে মানুষটার! এ কে? ঠোঁটে জ্বলছে একটা বিড়ি! কুন্ডলী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া! আর সামনে চাপ চাপ শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই! সবকিছু দুলে উঠলো আমার সামনে! চরাচর এক নিমেষে অন্ধকার হয়ে গেল । আমি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম!
বলা বাহুল্য , পরের দিন আমায় অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছিলো ঐ পাকুড় গাছটার নিচে! এবং ইলেকশন ডিউটি আমার সে যাত্রা আর হয়নি! এবং পুলকেশ,অমলের সাথে আমায় হাসপাতালে ভর্তি করার সব বন্দোবস্ত করেছিলেন আনন্দদা নিজেই!
(সমাপ্ত)