লাল নীল ভালোবাসা

লাল নীল ভালোবাসা

তোমার মোবাইল নাম্বরাটা দেয়া যাবে?” মেয়েলী কন্ঠ শুনে ফিরে তাকালো ফাহিম। গিটারের নাট ঠিক করছিল ও। থার্ড স্ট্রিং এর সাউন্ডটাতে ঘাপলা আছে। কাজটায় বিঘ্ন ঘটাতে সে খুব বিরক্ত বোধ করলো। “নাম্বার দিয়ে কি করবেন ?”দায়সারা একটা জবাব দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো সে। “আশ্চর্য ! এক ক্লাসে পড়ি , নাম্বারের দরকার থাকতে পারে না? তুমি মিউজিক নিয়ে ব্যস্ত থাকো, অনেক গানই শুনো মনে হয়। ভাবলাম তোমার থেকে মাঝে মাঝে অ্যালবাম নিয়ে শুনবো। এজন্য তো যোগাযোগের দরকার আছে। তাছাড়া তোমাকে তো কারো সাথে কথা বলতে দেখিনা। তাই এলাম নিজেই কথা বলতে । এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো মেয়েটা ৷ “আমি কাউকে নাম্বার দেইনা।” বলে নিজের কাজ করতে লাগলো ফাহিম।

“আশ্চর্য তো ! তুমি এত অভদ্র কেন? কি মনে করো নিজেকে ? ভালো গিটার বাজাও বলে দেমাগ দেখাও নাকি? একটা মেয়ে নাম্বার চাইতে আসছে ,মানা কিভাবে করতে হয় সেটার শিক্ষাও তোমার নেই। যত্তসব !” ঝাঁঝালো জবাব দিয়ে মেয়েটা গটগট করে হেঁটে চলে গেলো। মুখে তুলে তাকালো ফাহিম। ওর চুল একটু বেশি ঘন কালো আর কিছুটা লম্বা। চোখে এসে পড়ে। চুলের ফাঁক দিয়ে মেয়েটাকে চলে যেতে দেখলো। মেয়েটার নাম নায়না। খুব ভালো ছাত্রী ওদের ক্লাসের ।ফাহিম ওর প্রতি একটা আকর্ষণ বোধ করে , কিন্তু একটা পিছুটানও কাজ করে। অজানা সেটা। বিকেলের সময়। কয়েকজন বন্ধুদের সাথে ক্যাম্পাসের এক কোনায় গিটার বাজাচ্ছে ফাহিম। স্প্যানিশ গিটারের সুরে ঝংকার তুলছে আশপাশটা। হঠাত্ বাজানো বন্ধ করে গিটারটা এক ফ্রেন্ডের হাতে দিয়ে দৌড় দিলো ফাহিম। একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। নায়না ! “এক্সকিউজ মি।” পিছন থেকে নায়না একটা ডাক শুনলো। চোখ গরম করে ফাহিমের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। “জিরো ওয়ান সিক্স সেভেন এটা আমারনাম্বার।” মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো ফাহিম। “তখন দিলেনা কেন ? এখন কিজন্য আসছ ?” আগুনে গলায় বললো নায়না। “আপনার কথা তখন মনোযোগ দিয়ে শুনিনি। গিটারটা ঠিক করছিলাম। স্যরি।”

চোখের উপর থেকে চুল সরিয়ে একটা বোকা বোকা হাসি দিলো ফাহিম। “ইটস ওকে !” বলে হঠাত্ একটা হাসি দিলো নায়না। ফাহিমকে সেও খুব পছন্দ করে। অপেক্ষা করতে করতে সে ক্লান্ত। তাই নিজ থেকেই আজ নাম্বার চাইতে গিয়েছিল। দূরালাপনে একটু বলতে চাওয়ার ইচ্ছায় মনের কথাগুলা। এভাবেই একটা গল্পের শুরু হয়। গল্প এগিয়ে যায়। ফাহিম আর নায়নার। ফাহিমের গিটারের সুরে নায়নার স্বপ্নগুলো ডানা মেলতে থাকে ৷ পউরসবা লেক। ফাহিমের গিটার শুনছে নায়না। আমাকে গিটার শিখাবা? শুনতে শুনতে বললো নায়না। গিটার শেখা এত সোজা না। ফাহিমের উত্তর। চেষ্টা করতে দোষ কি? অনেকদিন লাগবে। আর প্রচুর প্র্যাকটিস। এত কথা বলো কেন ? শিখাতে বলছি , শিখাও। আচ্ছা , এখন একটু শেখানো যায়। এই যে গিটারের ছয়টা তার , এগুলা হচ্ছে E,A,D,G,B,E। একেকটার সুর একেক রকম। E,A,D এরপর কি? আরে E,A,D,G,B,E। এগুলা মনে রাখতে একটা বাক্য আছে ইংলিশে , Every Adult Dog Growls, Barks, Eats।

প্রত্যেকটা শব্দের ১ম অক্ষর একেকটা স্ট্রিং এর নাম। বাহ! ভালো তো। আচ্ছা , তোমার হাতটা ধরি? কেন? এমনি। দেখোনা কত কত কাপল এখানে হাত ধরাধরি করে বসে আছে? তুমি কি হাত ধরতে আসছ নাকি ?তুমি আসছ গিটার শুনতে। আচ্ছা , তুমি এত ম্যানারলেস কেন?মুখের উপর একটা মেয়েকে কিভাবে মানা করো ? ফাহিম কিছু বলেনা , চুপ করে থাকে। কথা বলোনা কেন ? মাথাটা খুব ব্যাথা করছে নায়না। কেন কি হয়েছে? কিজানি। রাতে ভালো ঘুম হয়নি , এজন্য হয়তো। আচ্ছা , তাহলে এখন উঠো। তোমাকে মেসে দিয়ে আসি। আমি যেতে পারব একা একা। গিটারটা ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়ালো ফাহিম। এক পা এক পা করে হেঁটে যেতে লাগলো। নায়নার দিকে ফিরে তাকালোনা একবারো। পরদিন থেকে ফাহিমের আর কোন খোঁজ পায়না নায়না। নাম্বার অফ। মেসে গেলো সে ,মেস নাকি ছেড়ে দিয়েছে ফাহিম , মেসের মালিক জানালো। ক্লাসেও আর তাকে দেখেনি নায়না।

একটা চাপা কান্না বুকের ভিতরে পুষে দিন কাটতে থাকে নায়নার। ফাহিমের জন্য ভালোবাসাটা বুকের ভিতরেই ছিঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকে তার। ফাহিমের স্মৃতি ধীরে ধীরে ম্লান হয় একসময়। সেই ঘন কাল বড় চুল , কানে ব্লুটুথ হেডসেট ,বোকা বোকা হাসি একসময় ঝাপসা হতে থাকে নায়নার কাছে। এর মাঝে বিয়ে ঠিক হয় নায়নার। গায়ে হলুদ হয়ে যায় তার। নায়নার বাড়িতে আজ বিয়ের সাজ। বধূ সেজে সে বসে আছে নিজ ঘরে। এমন সময় একটা ফোন। নায়না? কে বলছেন? আমি ফাহিম। একটা মূহুর্ত কথা ফোঁটেনা নায়নার মুখে। কোন সাহসে আমাকে ফোন দিয়েছ তুমি? জানো কতদিন ধরে খুঁজেছি তোমাকে ?দুই মাস।! আজ কেন ফোন করেছ আমাকে ? আজ আমার বিয়ে দেখোনা তুমি? ঝংকার দিয়ে কথাগুলো বলে গেল নায়না। আমি হসপিটালে ছিলাম । আমার চিকিত্সা চলছিল। কাউকে দিয়ে তোমাকে খবর পাঠাতে পারিনি। স্যরি। স্যরি বললেই সব শেষ হয়ে যায় না ফাহিম। তোমাকে একটা গান শোনাতে আসছি নায়না । জানালা দিয়ে তাকাও।

নায়না জানালা দিয়ে তাকালো। দূরে একটা ছেলে গিটার নিয়ে বসে আছে। কথা বলছে ব্লুটুথ হেডসেট দিয়ে। নায়নাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গান শুরু করলো ফাহিম। “প্রতিদিন এ গলি , ও গলিতে ঘুরোঘুরি , কেটে যায় সময় আসে রাত। মেয়েটা বাঁকা করে চুল বাঁধে, প্রেম করে, দেখো, ছেলেটাও পড়ে ফুলহাতা শার্ট। এই দেখে হাসাহাসি ,গানটাকে ভালোবাসি, এই ভালো আছি এই স্বপ্ন আমার। কখনো বুঝিনি যে এটা ছিলো সূচনা, আছে বাকি স্বপ্নের উপসংহার” গান গাইতে গাইতে কাঁদতে থাকে ফাহিম। ফোনের লাইনে স্তব্ধ হয়ে রয় নায়না। তোমাকে ভালোবাসি নায়না। কখনো বলতে পারিনি আমার পিছুটানের জন্য। আমি ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন।

আমার কেমোথেরাপী চলছিল এতদিন। আমার জীবনটা তোমার সাথে অন্যরকম ছিল এতদিন। স্বপ্নের মত। কিন্তু বাস্তবতায় আমি হেরে গেছি নায়না। আমাকে মাফ করে দিও। মোবাইলটা কানে চেপে ধরে রাখে নায়না। দূরের ছেলেটাকে দেখছে সে। ঝাপসা স্মৃতিগুলো ছাড়খার.করে রাখা ভালোবাসাটাকে হঠাত্ জাগিয়ে দেয়। দৌড়ে নিজের রূম থেকে বেরিয়ে গেল নায়না। ফাহিমের কাছে যেভাবেই হোক তাকে যেতে হবে। জানালা থেকে নায়নাকে চলে যেতে দেখলো ফাহিম। লাইন.কাটেনি। হেডসেটে শুনতে পেলো নায়না আর বাড়ির লোকজনের চিত্কার , চেঁচামেচি। সে বলছে,”আমি ফাহিমকে ভালোবাসি।

আমাকে বাইরে যেতে দাও। যেতে দাও “উঠে দাঁড়ায় ফাহিম। ব্লুটুথ হেডসেটে লাইনটা কেটে দেয়। এক পা এক পা করে ক্যান্সারে আক্রান্ত শরীরটা নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে হেঁটে যেতে থাকে। ক্ষীন এ জীবনটায় নায়না আর না আসুক। মৃত্যু তাকে অনুসরণ করছে। সে কেন নায়নার জীবনকে অনুসরণ করাতে যাবে? তার জীবনের সুর যে কেটে গেছ।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত