ম্যানশন

ম্যানশন

আমার বউ আমাকে একটা ভিডিওতে যখন ম্যানশন করলো আমি সাউন্ড ছাড়াই তা দেখে বিষ্মিত। ভিডিওতে একটা মহিলা তার স্বামীকে ইচ্ছেমত মাইর দিয়ে সাইজ করছে। মাইর দেখে আমি নিজেই মনে মনে বললাম “এভাবে কেউ স্বামীকে মারে?” সে ওখানে আমাকে ম্যানশন দিয়ে লিখেছে “তোমার অবস্থাও আমি আজকে এমন করবো বুঝলা। আজ শুধু বাসায় আসো।” আমি এটা দেখে ভিতরে ভিতরে হাসি।অফিসে জোরে হাসা যায় না। তবুও হাসির কিছুটা শব্দ আফসার ভাই শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বললো “কি ব্যাপার ভাই হাসেন কেন?” আমি হাসি মাখা চেহারা নিয়ে আস্তে করে বললাম “বিয়ে করে যা অবস্থা হয়েছে আমার। কে যে বললো বিয়ে করতে।এসব বলা যাবে না ভাই। আগে বিয়ে করেন তারপর বুঝবেন।” আফসার ভাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “এই সুযোগটা যে কবে আসবে।আব্বাকে ভয়ে বলতেও পারি না যে তার ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে দিতে হবে।আহা জীবন।আহা জীবন।” আমি ফের হাসি কিন্তু আফসার ভাই এর কথার কোন প্রত্যুত্তর দেই না। দিতে ইচ্ছে করে না।

আমার বউকে আমি মাঝে মাঝে ম্যাও বলে ডাকি।যদিও তার নাম “জেনিয়া।” পশুপ্রানীর প্রতি ওর একটা আলাদা টান আছে। তবে এই টানটা আমার মনে হয় শুধু মাত্র বিড়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমাদের বাসর রাতে আমি যখন রুমে ঢুকে দেখলাম ও চুপ করে বিরাট একটা ঘোমটা দিয়ে ছোট্ট একটা বিড়াল কোলে নিয়ে বসে আছে আমি তখন কাছে গিয়ে একটা কাশি দিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়েছিলাম। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার কাছে বড় অদ্ভুত মনে হয়েছিল। বাসর রাতে এই ভাবে কেউ বিড়াল নিয়ে বসে থাকে? আর বিড়াল কখন আনলো? আমি তো দেখিইনি। আমার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সে বুঝতে পেরে বললো “মিনু, সাহেব এসেছে সালাম দাও।” আমি চোখ বড় বড় করে ফেললাম। বিড়ালটা ম্যাও করে উঠে।আমিও নেড়ে চড়ে দাঁড়াই।সে বিড়ালটাকে বললো “লক্ষি আমার। আমার কথা যেমন শুনো, আজ থেকে এই সাহেবের কথাও শুনবে ঠিকাছে?” বিড়ালটা আবার ম্যাও করে উঠে।আমি কি করবো বুঝতে না পেরে একটা হাসি দিয়ে বিছানায় বসে বললাম “সুন্দর।আমাদের সব মানুষেরই পশুপাখির প্রতি ভালোবাসা থাকা দরকার।আমার এখনি কি মনে হচ্ছে জানেন?” জেনিয়া ঘোমটার ভিতরে আস্তে করে বললো “কি?” আমি আরও একটা হাসি দিয়ে বলি “বিড়ালকে আপনি যেভাবে আদর করছেন বা কাছে রেখেছেন, না জানি আমাকে কতটা আদর দেন বা কাছে রাখেন। আমার মনে হয়কি আমাকে তো আপনি অফিসে যেতেই দিবেন না।এভাবেই সারাদিন নিজের কাছে রেখে দিবেন।”

সে হাসতে থাকে।আমিও হাসতে থাকি।তখন আমার খুব ইচ্ছে করছিল ঘোমটা উঠিয়ে তার হাসিটা দেখতে। একবার হাতটা কাছে নিয়েও সরিয়ে ফেলি। সে হাসতে হাসতে বললো “মিনু তোমার সাহেব তো খুব পাজি।” বিড়ালটা ম্যাও করে উঠে। আর আমি মনে মনে ভাবি বিড়ালটা কি তার কথার সাথে সহমত জানালো?” ওর এমন কথা শুনে আমিও বললাম “মিনু তোমার ম্যাডামের হাসির শব্দটা খুব সুন্দর। হাসিটা দেখতে ইচ্ছে করছে।আমি কি ঘোমটা খুলে হাসিটা দেখবো?” কিন্তু মিনু ম্যাও বলে ডাকেনি।এই ম্যাও বলে না ডাকাতে আমার মনটা খারাপ হয়। আমি মনে মনে মিনুকে বকা দেই হারামজাদি একটা। কিন্তু জেনিয়া ঘোমটার ভিতরে ইতস্তত করে বললো “মিনু বলে দাও পারমিশন দিয়েছি।” আমি কিছুক্ষন সময় নিয়ে জেনিয়ার ঘোমটা উপরে তুলে দেই। জেনিয়া চোখ বন্ধ করে চুপ করে ছিল।আর আমিও চুপ করে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষন।সে চোখ বন্ধ করেই বললো “কি দেখেন এমন করে? আমি চুপ করে চেয়ে থাকি। জেনিয়াকে দেখে মিলির কথা মনে পড়েছিল। মেয়েটা কখনো আমার ছিল না। আমি ওর হাতটা কতবার ছুয়ে দিতে চেয়েছি কিন্তু আমি পারিনি। সে আমাকে পছন্দ করতো না একদম করতো না। আমি খুব গভীর হয়ে বললাম “পৃথিবীর অদ্ভুত রুপ দেখি। জানেন জেনিয়া আমার কেন যেন খুব ইচ্ছে করছে পৃথিবীর এই অদ্ভুত মায়াকড়া রুপকে ছুয়ে দিতে। এই প্রথম ছোয়ার পর যে অনুভূতিটা তৈরি হবে সেই অনুভূতিটা আমার ভিতরে বন্ধি করে রাখবো। দিবেন ছুয়ে দিতে?” সে কিছু বলে না। আমি আলতো করে তার গাল ছুয়ে দি। আমার ছোয়া পেয়ে সে খানিকটা কেঁপে উঠেছিল। তারপর চোখ খুলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো “এই যে পাজি, হয়েছে। মিনু এখন ঘুমাবে ওকে ঘুম পারাতে হবে।” আমি একটু হেসে বললাম “আজকে মিনু এমনিতেই ঘুম যাবে।আমরা না হয় জেগে থেকে চাঁদের রুপালি আলোয় একটু রুপালি হই।” সে মুখ ভেংছি দিয়ে বললো “ঢং, আমার এতো চাঁদ দেখার ইচ্ছা নেই।দুইটা দিন আমি ভালো করে ঘুমাতে পারিনি এই বিয়েটা নিয়ে।সরেন, এই মিনু ঘুমাতে আয়।” এটা বলেই ও ঘুমিয়ে যায়।মিনু ম্যাও করে উঠে। ওর এই ডাকে আমার ভিতরটা ধক করে উঠে।

এই ডাকটা যেন আমাকে ঠিক বলছে “আমার মত হতে চাও? হিংসে হয়?” আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। গাধার মত তাকিয়েছিলাম। এরপর দিন থেকে যতবার ওর কাছে যেতে চেয়েছি, ছুয়ে দিতে চেয়েছি ঠিক ততবার কোন না কোন একটা অযুহাত দিয়েছে। কখনো বলেছে “এই কি করো ছাড়ো, মিনু দেখে ফেলবে। আবার কখনো বলতো “এই পাজি, আমার শাশুড়ি আম্মার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে ছাড়ো তো।” আমি তখন চুপ করে ভাবি কি চমৎকার করে আমার অদ্ভুত মায়াকাড়া পৃথিবীটা আমার পরিবারের সাথে মিশে যাচ্ছে।আমি ভাবতেও পারিনি এমন চঞ্চল, মিশুক একটা মেয়ে আমার ভিতরের কাব্যগুলোর মাঝে সুর দিয়ে একটা ভালো লাগার অনুভূতি ছড়াবে।কিন্তু আমার আসলেই হিংসে হতো ঐ মিনুর প্রতি।ওকে যেমনটা আদর বা কাছে রাখে আমাকে একটুর জন্যও এমন সময় দেয় না। আর এ কারনে কি করবো ভেবে না পেয়ে ওর মিনুকে আজকে অফিসে আসার আগে ছাদে লুকিয়ে রেখে এসেছিলাম। আর এ ব্যাপারটা নিশ্চয় জেনিয়া বুঝতে পেরেছে। কারন জেনিয়ার সাথে মিনুকে রাখার বিষয়টা আব্বা আম্মা তেমন কিছুই মনে করতো না। কেমন করে মনে করবে? যা মনে করার আমিই মনে করি। আব্বা আম্মার মন কি চমৎকার করে ও দখল করে ফেলেছে। আর এ কারনেই আমাকে এই ভিডিওতে ম্যানশন করেছে। বউ এর ম্যানশনের কোন রিপ্লে বা রিয়েক্ট না দিয়ে নেট থেকে বের হয়ে আস্তে আস্তে কাজে মনোযোগ দেই। আমি মনে মনে বলি আজকে কি সত্যি আমার খবর আছে? আসলেই কি খবর আছে?

সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় শহরটা কেমন যেন আধাঁরে তলিয়ে যায় আর মুহুর্তেই লাল, নীল, হলুদ বাতিতে শহরটা অদ্ভুত রুপে সাজে। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে মানুষগুলো ঘরমুখি হয়। আমি ফুটপাথে হাটতে হাটতে শহরটাকে দেখি। শহরের ব্যস্ত মানুষের চেহারার ছাপটা দেখি। কি অদ্ভুত একেক জন মানুষের চেহারার ছাপটা। এসব দেখতে দেখতে এলাকার গলির মুখে আসতেই মিঠু ভাই এর সাথে দেখা। পাক্কা একটা হারামজাদা। হারামজাদারে দেখলেই আমার শরীর জ্বলে। গলির মোড়ে সব সময় আড্ডা মারে। মেয়ে দেখলেই কেমন করে তাকায়। আমাকে ডাক দিয়ে বললো “তুমি মিয়া এই বিড়াল প্রজাতি মেয়েকে কই থেইকা ধইড়া আনছো? তোমার বউ নাকি সারাক্ষন ম্যাও ম্যাও করে ডাক পারে?” আমি চুপ করে থাকলাম। একটু মেজাজ খারাপও হয়েছে। ওর সাথে থাকা ছেলে গুলা হাসতে লাগলো। আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম “ভাই কাছে আসেন।

কানে কানে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলি।” মিঠু ভাই তার সাথে থাকা ছেলেগুলার দিকে একটু তাকিয়ে আমার কাছে এসে বললো “কি বলতে চাও?” আমি একটু হেসে কানে কানে বললাম “আপনার লাগবে এমন বিড়াল? আমার কাছে এমন বিড়াল আরও আছে। লাগলে বলিয়েন।” সে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বললো “সত্যি বলছো?” আমি কাধের ব্যাগটা একটু ঠিক করে বললাম “আপনার সাথে তো আমার ফেইসবুকে এড আছে। কোন ব্যাপার না। বিড়ালটা আপনাকে আগে থেকেই পছন্দ করে। আমাকে আগে বলছিল অবশ্য। আমি ভয়ে বলি নাই আপনাকে। যদিও বিড়ালটা এখন এখানে থাকে না। আপনাকে আমি রাতে ম্যানশন দিব বিড়ালটার আইডি ঠিকাছে? ম্যানশন পর্যন্তই আমার কাজ। বাকিটা আপনাকে করে নিতে হবে।আমি জানি আপনি পারবেন।আপনাকে দেখলেই বুঝা যায়।আপনার ভিতর একটা প্রেম প্রেম প্রতিভা আছে।শুধু এটাকে বাহির করে আনতে হবে। এখন যাই।” সে আমাকে ইতস্তত করে বললো “ইয়ে মানে তুমি আসলে একটা ভালো ছেলে। আমি যা বলছি কিছু মনে করিও না। তোমার কোন কিছুর প্রয়োজন হলে আমকে বলিও হ্যাঁ? আর রাতে বিড়ালটাকে ম্যানশন দিতে ভুলিও না।” আমি মনে মনে বললাম “হারামজাদা তোরে কি করি আমি দেখ।তুই আমার বিড়াল নিয়ে কথা বলিস। বিড়াল যে মাঝে মাঝে কত ভয়ানক হয় তোরে আমি বুঝাবো।” আমি আর কিছু না ভেবে একটা হাসি দিয়ে চলে আসি।

দরজা খুলতেই দেখি জেনিয়া। আমি জেনিয়াকে দেখে থতমত খেয়ে সিড়ি দিয়ে উঠে ছাদে চলে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন ও আমাকে ডাক দিয়ে বললো “এই দাঁড়াও, দাঁড়াও বলছি।” আমি ওর দিকে তাকিয়ে বলি “জ্বি আমাকে বলছেন? না আসলে হয়েছে কি আমি না মাঝে মাঝে সব কিছু ভুলে যাই।আমি ভুলে আপনাদের বাসার কলিং বেল বাজিয়েছি। আমার বাসাটা উপর তলায় তাই না?” সে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে কোমড়ে দুহাত রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বললো “এমন করলা কেন তুমি? তুমি জানো আমি কতটা খুজেছি মিনুকে।কেমন হয়ে গিয়েছিলাম।আমার প্রিয় কোন কিছু যখন হারিয়ে যায় আমার মন ভালো থাকে না জাহেদ।আমাকে তোমার কি মনে হয় বলো তো? কেন এমন করলা? ” আমি চুপ করে সিড়ি দিয়ে নেমে ওর কাছে যাই। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর দিকে তাকিয়ে খুব গভীর হয়ে বললাম “তোমার সাথে বিয়ে হওয়ার পর তুমি সব সময় দেখেছো আর্টসেলের অনিকেত প্রান্তর গানটা আমি অনেক শুনি। বার বার শুনি। তুমি বলেছিলে “এই একটা গান এতোবার শোনার পরও তোমার বিরক্ত লাগে না?” আমি বলেছিলাম “না, লাগে না, হাজার বার শুনলেও লাগবে না।” তুমি আমাকে কি ভাবো বা কি মনে করো আমি জানি না জেনিয়া। কিন্তু যেদিন তুমি আমার মাঝে আসলে, তোমার মায়া মায়া কথার মাঝে জড়ালে, আমার জীবনের একটা অংশ হলে আমি সেদিন থেকেই তোমাকে “অনিকেত প্রান্তর” ভাবতে শুরু করেছি।তুমি আমার কাছে একটা অনিকেত প্রান্তর।তোমার সাথে আমার বাকিটা জীবন পরে আছে। এই জীবনে চলার সময় অনেক কষ্ট, ঝামেলা, রাগ, অভিমান হবে কিন্তু তারপরও তোমার হাতটা আমি ছাড়বো না।তোমার আশেপাশেই বারবার ঘুরঘুর করবো। কারণ আমি তোমাকে অনিকেত প্রান্তর ভাবি।অনিকেত প্রান্তর হওয়া এতো সহজ না জেনিয়া।আমি তোমাকে সেই অনিকেত প্রান্তরের জায়গায় বসিয়েছি।” জেনিয়া আমার দিকে তার মায়ামায়া চোখে তাকিয়ে থাকলো। তারপর কোমড় থেকে তার দুহাত নামিয়ে আমার কাধ থেকে ব্যাগটা নিয়ে বললো “পাগল এমন ভয়ংকর ভাবে কেউ কথা বলে?” আমি একটা হাসি দেই। মৃদু হাসি। তারপর ভিতরের দিকে যাই।

আমি কিসের মধ্যে দৌড়ে যাচ্ছি আমি নিজেও জানি না। আমার ভিতরটা এমন করে কেন উঠলো তাও বুঝতে পারছি না। অফিসে কাজ করতে করতে যখন লাঞ্চ আওয়ারের সময় হলো ঠিক তখন আমি নেটে ঢুকে দেখি দশ মিনিট আগের একটা স্ট্যাটাসে রক্তের গ্রুপের এডমিন আমাকে সহ অনেকজনকে ম্যানশন করেছে।এক্সিডেন্ট হওয়া একটা সাত বছরের বাচ্চার জন্য আর্জেন্ট বি পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন।স্ট্যাটাসে ঠিকানা আর একটা রেফারেন্স নাম্বার দিয়ে দিয়েছে। আমি কিছুক্ষন ভেবে ফোন করে বলেছিলাম একটা স্ট্যাটাস দেখলাম, আপনারা কি রক্ত ম্যানেজ করতে পেরেছেন?” আমাকে জানায় পায়নি। আমি আর কিছু না ভেবে ছুটে যাই।রক্ত দেওয়ার পর হাতের স্থানটায় ধরে যখন দরজা দিয়ে বের হলাম তখন মিলিকে দেখতে পেয়ে আমার বুকটা কেমন করে যেন উঠলো। মিলির সাথে আমার আবার দেখা হবে এটা আমি আশা করিনি।ওকে দেখে আমি খানিকটা অবাক হয়েছি।ও আমাকে দেখে ইতস্তত করে বললো “তুমি” আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না।একটু সময় নিয়ে বললাম “তোমার সাথে সত্যিই আবার দেখা হয়ে গেলো। পৃথিবীটা গোল না হলে এমন হতো না।কানাডা থেকে কখন আসলা? আর এখানে কি জন্য?” সে মুখটা বিষন্ন করে আমার হাতের দিকে তাকালো।

তারপর বললো “চারদিন হয়েছে আমি দেশে আসছি।আমার মেয়েটা এক্সিডেন্ট করেছে। আমার কলিজার টুকরোটা। ” আমি চুপ করে রইলাম।ভিতর থেকে একটা ভদ্র লোক এসে বললো “মিলি ইনিই তোর মেয়েকে রক্ত দিয়েছে।” মিলি আমার দিকে কিছুক্ষন কেমন করে যেন তাকিয়ে থেকে বললো “একটু দাঁড়াও আসছি।” তারপর ও ওর কলিজার টুকরোটার কাছে ভিতরে যায়।আমি আর কিছু না ভেবে চলে আসি। রাস্তার ফুটপাথের উপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাটি। দুপুরের এই রোদ্রটা আমার বিষন্ন মুখটাকে আরও বিষন্ন করে তুলে।ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে মিলিকে আমার ভিতরের ভালো লাগার কথা জানিয়েছিলাম।জানিয়েছিলাম তাকে নিয়ে আমার উদ্ভাসিত আলোড়ন এর কথা।কিন্তু সে খুব সুন্দর করে জানিয়েছিল “তোমার সাথে আমার যায় না জাহেদ।তোমার সাথে মানায় তোমার স্ট্যাটাস অনুযায়ী এমন মেয়েকে পছন্দ করো কেমন?” কিন্তু তারপরও ওর পিছন পিছন ঘুরতাম।

সে আমাকে অবজ্ঞা করে চলতো।এই অবজ্ঞার মাত্রাটা এতোটাই বেড়ে গিয়েছিল সে একদিন আমাকে বললো “কেন তুমি এমন করো বলো তো? আমাকে তোমার ভালো লাগে আমি মানছি।কিন্তু আমারও তো ভালো লাগার বিষয় আছে।ভালো লাগাটা এক তরফা থেকে আসে না জাহেদ।এই ভালো লাগাটা দুজনের মধ্যে থাকতে হয়।তোমার ভালো লাগাকে আমি অসম্মান করছি না। আমাকে ভালো লাগতেই পারে।তোমার সাথে আমার যায় না এটা বুঝো না কেন? না পারবে আমাকে তেমন সুখ দিতে। না পারবে আমার আবদার মিটাতে।তুমি আমার জন্য কিছুই করতে পারবে না।” আমার খুব লজ্জা লাগছিল তখন।এরপর থেকে আমি ওর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়িয়েছি। একটা অচেনা স্মৃতি হিসেবে ভাবতে লাগতাম যদিও আমার খুব কষ্ট হতো।আমাদের ইন্দ্রজালে কত আশা,স্বপ্ন জমা হয়। কিন্তু সময় আর বাস্তবতায় এই জমানো স্বপ্নগুলোকে পরাজয়ের পাতায় ঠেলে দিতে আমার মন একটুও কার্পন্যবোধ করেনি তখন।কিন্তু আজ আমি তোমার জন্য সত্যিই কিছু করতে পেরেছি মিলি।তোমার কলিজার টুকরোটার কাজে লেগেছি। এমন কজনে পারে? আমার ভিতরে কেমন যেন একটা ভালো লাগা কাজ করছে। তোমাকে বলা হয়নি মিলি আমার জীবনে একটা অনিকেত প্রান্তর এসেছে।আমার অন্তমিলে এই অনিকেত প্রান্তরটাই বিরাজ করছে। প্রিয় মিলি ভালো থেকো। তোমার জন্য আমার ভিতরে কখনো ঘৃনা জন্মায়নি।আমি এই রোদ্দুর দুপুরে চুপচাপ আবার হাটতে থাকি। এই দুপুরের রোদ্দুর মাঝে হাটতে আমার একটুও খারাপ লাগছে না।

টিভির সামনে জেনিয়া তার মিনুকে কোলে নিয়ে টিভি দেখছে আর চানাচুর মুড়ি খাচ্ছে। আমি গাধার মত তাকিয়ে আছি।জেনিয়া বললো “এমন করে তাকিয়ে আছো কেন? খাবে তুমি? না খেলে এমন করে তাকাবে না। আমার পেট খারাপ হবে বুঝলে? আমার পেট খারাপ হলে বাথরুম থেকে বের হতে আর ইচ্ছে করে না।” আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম “একদিন আমি বিড়াল হবো। তোমার আশে পাশে ঘুরঘুর করে ম্যাও ম্যাও করবো।তুমি আমায় জড়িয়ে নিবে।আমাকে আদর করবে।তখন দেখবো তুমি কি করে আমায় দুরে দুরে রাখো।” জেনিয়া হাসতে লাগলো।হাসতে হাসতেই বললো “আমার জামাইটা এতো পাগল কেন হ্যাঁ?” আমি কিছু বলি না। তারপরই আমার ফোনটা বেজে উঠে। আমি রিসিভ করতেই বললো “কেমন আছো ভাই? আমাকে চিনতে পারছোনি? আমি তোমার মিঠু ভাই। তুমি তো বিড়ালকে ম্যানশন দিলে না।” আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম “ভাইয়া খুব ব্যস্ত ছিলাম।এক্ষনি ম্যানশন করছি আপনার প্রফাইল পিকে।এ সময়ে ও নেটে থাকে।” ওপাশ থেকে বললো “মন যে মানে নারে ভাই তাড়াতাড়ি করো না।” আমি ফোনটা রেখে দি।জেনিয়া বললো “কে ফোন করেছিলো?” আমি ল্যাপটপটা নিতে নিতে বললাম গলির মোড়ের হারামজাদাটা।ওকে কি নাচান নাচাই ছেড়ে দিব ও নিজেই বুঝতে পারবে না।ভার্সিটিতে পড়ার সময় একটা ফেইক আইডি খুলেছিলাম বন্ধুদের সাথে মজা করার জন্য।অনেক মজা করেছি অবশ্য।হারামজাদাটাকে একটা শিক্ষা দিব।কত বড় সাহস ও তোমাকে নিয়ে কথা বলে। আমার বিড়ালকে নিয়ে কথা বলে।” জেনিয়া আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে থাকলো।আমি চুপচাপ ল্যাপটপ খুলে ওর প্রফাইল পিকে ম্যানশনে দিয়ে লগআউট হয়ে ফেইক আইডিতে লগইন করি।কিছুক্ষনের মধ্যে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসে। আর একটা মেসেজ আসে

“ম্যাও” আমি রিপ্লে দিলাম “ম্যাও ম্যাও” জেনিয়া আমার পাশে এসে বসে বললো “তুমি এই গুলা করে বেড়াতে বদমাইশ।” আমি একটা হাসি দিয়ে বলি “বন্ধুদের থেকে কত কিছু হাতিয়ে নিয়েছি আল্লাহ জানে।” আমি ল্যাপটপের দিকে তাকাই। রিপ্লে আসে “ম্যাও ম্যাও ম্যাও” আমি পাল্টা রিপ্লে দেই…

“এতো ম্যাও ম্যাও করেন কেন? দুষ্টু ছেলে।আমার এমন দুষ্টু ছেলে একদমি পছন্দ না হুহ”
“আমি বেশি দুষ্টু নাতো।একটু একটু।আপনি আমাকে দুষ্টু বলেছেন। খুব ভালো লাগছে।

আমি একটা অবাক হওয়ার ইমো দেই। সে ভালোবাসার ইমো দিয়ে রিপ্লে দিয়ে লিখে
“রিকুয়েস্ট এক্সেপট করেন না প্লিজ। আমার মনটা কেমন যেন হয়ে আছে।
“একটা শর্তে করবো ঠিকাছে? আমার ছবি মোবাইল নাম্বার চাইতে পারবেন না।আমার ছবি আমি আপনাকে নিজেই দিব।প্রথমে আমাদের সম্পর্কটা একটু মজবুত হোক কেমন?’ম্যাও ম্যাও। আচ্ছা আমার প্রোফাইল পিকের বিড়ালটা সুন্দর না?
”হ্যাঁ অনেক কিউট।
”আচ্ছা আপনি কি কুকুরের ডাক দিতে পারেন?
”আবার জিগায়।এটা কোন ব্যাপার।

সে আমাকে মেসেঞ্জারে কুকুরের ডাক দিয়ে শোনায়।আমি রিপ্লে দেই
”আল্লাহ কি সুইট। ওলে আমার কুত্তাটা।

সে একটা দাঁত বের করার হাসির ইমো দেয়। আমি রিপ্লে দেই।
”এই আপনি মাইন্ড করেন নি তো আবার।আপানাকে কুত্তা বলেছি বলে।
”আপনি আমাকে যা খুশি ডাকেন। আমি মাইন্ড খাইনা। আমার কি যে ভালো লাগছে।
”আচ্ছা এখন যাই হ্যাঁ। আম্মু ডাকছে।পরে কথা হবে।টাটা।

জেনিয়া আমার কান ধরে টেনে হাসতে হাসতে বললো “বদমাইশ এটা কি হলো? বেচারা তো শেষ হয়ে যাবে।তুমি এইগুলা কিভাবে পারলে?” আমি বললাম “কান ছাড়ো তো।ব্যাথা লাগে।” এমন সময় আম্মা এসে বললো “বউমা আমার নামাজের জায়নামাজটা কোথায়?” জেনিয়া আম্মার আসার শব্দ শুনে আগেই আমার কান ছেড়ে দেয়। আম্মাকে বললো “আমি দেখে দিচ্ছি।” এটা বলেই মিনুকে আমার কোলে দিয়ে আম্মার রুমে যায়।আর আমি চুপ করে মিনুর দিকে তাকিয়ে বললাম “কিরে হারামজাদি আমাকে জ্বালাতে তোমার ভালো লাগে?” সে ম্যাও করে ডাকে। যদিও তার প্রতি আমি মনে মনে জ্বলি কিন্তু ঠিকি আদর করি।এমন ছোট্ট একটা কিউট বিড়ালকে আদর না করে সত্যি পারা যায় না।

আমি বিকেল বেলার আলোয় এই ধানমন্ডি লেকটার চারপাশে একবার ভালো করে তাকালাম। আজকে একটা বিশেষ দিন। আগে এই বিশেষ দিনে সারাটা দিন ধানমন্ডি লেকের ধারে বসে থাকতাম।ভাবতাম আমি মানুষটা এমন কেন? আমার ভিতরের ভালোবাসা গুলার কোন দাম নেই? জানতাম মিলি আমার কখনো হবে না এবং হয়নি তারপরও আমি এইসব কথা মনে করে ভিতরে ভিতরে কাঁদতাম। আমার ভালোবাসাটা সে হয়তো কখনো বুঝেনি আবার এমনও ভাবতাম আমার ভালো লাগাটা আমি ঠিক মত তাকে বুঝাতে পারিনি। আজও এসেছি এই লেকের ধারে। এই দিনটা আমি কেন যেন ভুলতে পারি না। আজকে মিলির জন্মদিন। আর এই দিনেই ওকে আমি আমার ভালো লাগার কথা জানিয়েছিলাম। অনেকে ফুল, আংটি আরও অনেক সারপ্রাইজ দিয়ে প্রপোজ করে তার ভালো লাগার মানুষটাকে কিন্তু আমি এমনটা করিনি। আমার মত সাধারন একটা ছেলে তাকে সাধারন ভাবে ভালো লাগার কথা জানিয়েছিলাম জীবনান্দদাশ এর কবিতার বই দিয়ে। সে আমার উপর খুব রাগ করেছিল। আমার দেওয়া কবিতার বই গ্রহণ করেনি। আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আর এই দিনটা আসলে আমার কেন যেন কথা গুলো মনে পড়ে যায়। আমার কষ্ট লাগে ভীষন কষ্ট। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার আজকের দিনটায় এই কষ্টটা আমি একটুর জন্যও অনুভব করতে পারছিনা। এই দিনে আমি কখনো অফিসে যেতাম না।কিন্তু আজ আমি অফিস করেছি।আমার ভিতরে বিষন্নতা আমাকে আচ্ছন্ন করতে পারিনি।আমার ভিতরটাকে আর আচ্ছন্ন করতেও দিব না।আমি কাধের ব্যাগটা ঠিক করে আকাশটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে বললাম “জেনিয়া আমি স্বপ্ন দেখবো। একটা ভালোবাসার স্বপ্ন।অনিকেত প্রান্তরের স্বপ্ন।যে স্বপ্নের মাঝে সারাদিন তোমার মাঝে ডুবে থাকবো।সে স্বপ্নটা অতীতের কোন কিছুই আমাকে মনে করিয়ে দিয়ে বিষাদের ছায়া স্পর্শ করতে পারবে না। একটুও না।

সোফায় বসে বসে ল্যাপটপে যখন ফেইসবুক চালাচ্ছি তখন জেনিয়া আমাকে বললো “একটা কথা বলি?” আমি ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই বললাম “পারমিশন নেওয়ার কি আছে? বলো।” সে একটু গভীর হয়ে বললো “এতোদিনে আমার প্রতি তোমার কত টুকু ভালোবাসা জন্মেছে?” কথাটা শুনে আমি ওর দিকে তাকাই। আমার তাকানো দেখে ও আবার বললো “অবাক হলে? বিয়ে হওয়ার পর সাথে সাথেই একে অপরের প্রতি ভালোবাসাটা তৈরি হয় না। এই ভালোবাসাটা আস্তে আস্তে তৈরি হয়।তাই বললাম।” আমি একটু সময় নিয়ে বললাম “শোনতে জানি খারাপ লাগবে। তোমার বাবা মা আমার কি দেখে আমার সাথে তোমাকে বিয়ে দিয়েছো জানো? আমি কি করি আর আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখে।চেহারা কোন রকম চললেই হলো।আমি শুধু একটা মানুষ এটা ভেবে তোমার বাবা মা আমার সাথে তোমাকে বিয়ে দেয়নি।সব বাবা মায়েরা এটাই চায়।আর এমনটাই হয়।কিন্তু বিশ্বাস করো জেনিয়া আমি তোমাকে শুধু মাত্র একজন মানুষ হিসেবেই ভালোবাসতে শুরু করেছি।

তোমার স্ট্যাটাস, তুমি কেমন এটা ভেবে আমার ভালোবাসাটাকে অসম্মান করতে চাই না।” জেনিয়া আমার দিকে চুপ করে তাকিয়ে থেকে বললো “তুমি জানো, তুমি এমন ভয়ংকর করে কথা বললে আমার খারাপ লাগে।তোমাকে খুব খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।” আমি ল্যাপটপে দিকে তাকিয়ে বললাম “আমি জানি জেনিয়া। ল্যাপটপে তাকানোর সাথে সাথেই একটা নটিফিকেশন আসে। আমি চেক করে দেখি আমার শাশুড়ি আম্মা আমাকে আর জেনিয়াকে একটা ছোট্ট বাবুর ভিডিওতে ম্যানশন করছে। আমি একটু হেসে জেনিয়াকে ভিডিওটা দেখিয়ে বলি “আমাদের দুজনকে এই ভিডিওতে তোমার মায়ের ম্যানশন দেওয়ার কারন কি বলো তো?” জেনিয়া আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে উঠে বললো “জানি না” এটা বলেই যখন চলে যাচ্ছিল তখন আমি ল্যাপটপটা রেখে উঠে ওর হাতটা ধরে বললাম “জানি না বললে হবে? জানতে হবে।” সে বললো “এই ছাড়ো তো।মিনু দেখবে।” আমি ওকে টান দিয়ে কোলে নিয়ে বললাম “মিনুর কথা ভাবলে চলবে না।মিনুর খেতারে পুরি।” এইটা বলেই আমি ওকে কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে হেটে আমার রুমের ভিতরে যেতে থাকি। যাওয়ার সময় ও আমার গলায় দু হাত জড়িয়ে ধরে আমার চোখে তাকিয়ে থেকে বললো “ছাগল কোথাকার। এমন বাচ্চাদের মত করো কেন হ্যাঁ।” আমি হাসি দিয়ে বললাম “আমি প্রতিবার এমন বাচ্চা হতে চাই তোমার সমস্যা আছে?” জেনিয়া হাসতে লাগলো। আমি আমার ভালোবাসার অনিকেত প্রান্তরের হাসির দিকে ভালোবাসার চোখে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে হাটতে হাটতে দরজার কাছে আসতেই রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দেই…

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত