খাওয়ার মাঝেই মা এই নিয়ে পাঁচবার কথাটি বললেন।
– আর একটু ভাবলে হয় না, বাবা?
আমি ভাতের সাথে ডাল মাখাতে মাখাতে বলি, ‘না মা। তুমি ওদের মানা করে দাও।’
মা তবুও জিদ ধরলেন, ‘এ কেমন কথা? তুমি কিছু বলো না কেন?’
বাবা এবার মুখ খুললেন, ‘আমি আর কি বলবো? রানু যখন বলেছে নিশ্চয় কিছু একটা কারণ আছে। তুমি অহেতুক মাথা ঘামাচ্ছ শান্তা।’
– ও আমি অহেতুক মাথা ঘামাচ্ছি তাহলে! বেশ তো বাপ ছেলে মিলে আমার জীবন অশান্তিপূর্ণ করে তুলেছ। সেদিনই যদি বিয়েটা দিয়ে দিতাম। আজ এমন হতো না। এই পাঁচ বছরে বউ ঘরে আসতো, নাতি নাতনি তে ঘর ভরে উঠত। সেটা তো আমার কপালে নেই। শুধু আছে তোমাদের রান্না করে খাওয়ানো। কবে যে এই জীবন থেকে মুক্তি পাবো আল্লাহ্ জানে। বলে, প্লেট বাটি উঠিয়ে মা রাগে ধুপধাপ করে চলে গেলো।
বাবার সাথে চোখাচোখি হলো। একটু হেসে পানির বোতল নিয়ে রুমে চলে আসলাম।
ঘটনা তেমন গুরুতর না। আজ থেকে পাঁচবছর আগে যখন বাবা – মায়ের সাথে মেয়ে দেখতে গেলাম, সেদিনই নিলার সাথে পরিচয়। নিলার সাথে বিয়ের আলাপ বাবার এক বন্ধু দিয়েছিল। দেখলাম সবাই যখন চাচ্ছে আমিও না করিনি।সবার সাথে কথা বলার পর যখন নিলার সাথে একান্তে কথা বলার জন্যে সবাই বললে পিছুপিছু ওর সাথে গেলাম। কিছুক্ষণ দুজনের মুখে কোনো কথা ছিল না। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এমনটা না যে আমি খুব মুখচোরা স্বভাবের বা মেয়েদের সাথে কথা বলার অভ্যাস নেই। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি টাই আলাদা। অন্যের বিয়েতে মজা করা আর নিজের বিয়েতে মজা করার ধরণ আলাদা। শেষমেশ আমাকেই নিরবতা ভাঙ্গতে হলো। বুঝতে পারছিলাম, নিলা নিজে থেকে কিছু বলবে না। তাই খুক খুক করে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি। আমার দিকে চেয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
– বিয়েতে আপনার কিছু বলার নেই?
উত্তরে শুধু মাথা নাড়িয়েছিল নিলা। তাই সেদিকে আর কথা বাড়াই নি।
– আচ্ছা আপনি তো অনার্স দিবেন এবার। এখুনি বিয়ে কেন?
– বাবা-মায়ের ইচ্ছে তাই।
– কেন! আপনার কোনো ইচ্ছে নেই?
– হাসালেন আপনি? সব মেয়েদের জীবনে এমন একটা সময় আসে, সেই সময় আমাদের কোনো ইচ্ছাই প্রাধান্য পায় না। আমার ইচ্ছে আছে মাস্টার্স ও শেষ করার। কিন্তু ইচ্ছে ইচ্ছেই থাকবে।
– কেন? ধরুন আমি এখন এই বিয়েতে না করে দিলাম। তাহলে তো আপনার ইচ্ছে পূরণ হবে।
আমার কথায় নিলা হেসেছিল। সেই হাসিতে বিষাদ মাখা ছিল।
– রানু সাহেব, আপনি এখন না করবেন। কিন্তু আপনার মতো আরো অনেকি আসবে তখন? আর মা- বাবা রা সব খানে হার মানলেও মেয়েদের বিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।
– বুঝলাম, কিন্তু বিয়ের পরও তো পড়ালেখা চালাতে পারবেন।
– সে আমি জানি। কিন্তু তাতে শুধু চিন্তা থাকে কিভাবে তাড়াতাড়ি পড়ালেখা শেষ করা যায়। আর তার পিছনে পুরো চাপ থাকে কার জানেন? শ্বশুর ঘরের। যতই তারা বলুক না কেন যে তারা পড়াবে।
এরপর আর তেমন কিছু কথা হয়নি। বাবা- মাকে বলেছিলাম আমার পছন্দের কথা। সবাই খুশি হয়েছিল। শুধু নিলার চোখে স্বপ্ন হারানোর আর্তনাদ দেখেছিলাম। তবুও আমি শেষ চেষ্টা করেছি। নিলার বাবা-মাকে বলেছিলাম, আমি নিলাকে বিয়ে করব।কিন্তু ও আগে মাস্টার্স শেষ করুক।নিলার পরিবার রাজি হয়েছিল। আসার সময় নিলার মুখে ধন্যবাদ সূচক হাসি দেখেছি। প্রত্যুত্তরে আমি কিছু না বলে হেসেছি শুধু। এরপরের ঘটনা বেশি কিছু না। নিলার সাথে তেমন একটা কথা হতো না। ফোনে একটু কথা, দেখা হলে হাই হ্যালো বলা। এম এ শেষ করার পর শুনেছিলাম ওর গবেষণা প্রবন্ধ দেখে উচ্চশিক্ষার জন্যে বৃত্তি দিয়েছে ওর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শুনে বেশ খুশি হয়েছিলাম। শেষমেশ মেয়েটা নিজের ইচ্ছে পূরণ করছে। নিলাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল। মনেপ্রাণে চেয়েছি ওর মনস্কামনা পূর্ণ হোক। মা প্রথমে গাইগুই করেছিল। আমি আমলে নেই নি। বলেছিলাম, ঘরের বউ উচ্চশিক্ষিত ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখেছো কি? পাশের বাসার রিনা আণ্টি রিতিমতো ইর্ষা করবে তোমাকে দেখে। “ধুর তোর যা কথা না “, বলে মা চোখ রাঙ্গিয়েছিল।
আমার এখন বিয়ে না করার কারণ টা খুব বড় কিছু না। নিলা কয়েকদিন হলো দেশে এসেছে। যথারীতি ওদের বাসা থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে বিয়ে কি হবে। আমি না করে দিয়েছি। কারণ অবশ্য ওদের বলিনি। ওরাও কিছু বলেনি। মেয়ে উচ্চশিক্ষিত, ভালো জামাইয়ের আশা তারা করতেই পারে। আমি সামান্য চাকুরি করি। আহামরি তেমন কিছু না। আর নিলা পি এইচ ডি কৃত উচ্চশিক্ষিতা। ওর আমার মাঝে ফারাক এখানেই।
অফিসের ক্যান্টিনে বসে আছি। আমার মুখোমুখি নিলা বসে আছে। আমি ইতিউতি তাকাচ্ছি। মাঝেমাঝে নিলার দিকে তাকালে বুঝতেছি, ও আমার দিকে বাঁকাভাবে দেখছে । প্রচণ্ড অনিচ্ছাসত্ত্বে ও ওর সাথে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি। প্রায় জোড় করে টেনে হিচরে নিয়ে এসেছে। আজকে নিলাই প্রথম কথা বলল, ‘আপনাকে দেশে এসেই ফোন দিয়েছি। ওখানে থাকতে ই-মেইল করেছি, মেসেঞ্জার এ নক করেছি কিন্তু সবখানে ব্লক! কারণ টা কি জানানো যাবে?’
– না, তেমন কিছু না। কাষ্ঠ হেসে বলি।
– তেমন কিছু না মানে! বাবা যখন আপনাদের বাসায় বিয়ের কথা বলে পাঠালো না করে বসলেন কেন?
আমার চুপ থাকা দেখে নিলা বলল, ‘যেচে অন্যের উপকার করার স্বভাব আপনার এখনো যায়নি?’
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম।
– তুমি বাসায় গিয়েছিলে?
– না গিয়ে উপায় ছিল না। আর না হলে জানতাম কিভাবে আপনার উপকার করার কথা?
আমি হাসি। নিলা বলল, ‘তাহলে এবার আমার কি উপকার করছেন?’
– খুব সহজ ব্যাপার। আমার এক বিসিএস ক্যাডার বন্ধু আছে। ওর সাথে কথা বলেছি। অতিশীঘ্র তোমাদের বাসায় যাবে তারা।
– আর আপনি?
– আমি কি? কোথায় তুমি আর কোথায় আমি?
নিলা ঝুকে আমার কাছে এগিয়ে এলো। ওর হাত আমার হাতের মধ্যে রেখে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে গলার স্বর নিচু করে বলল, একটা কাজ করুন রানু সাহেব। আপনার বন্ধুকে দাওয়াত দিন, আপনার আমার বিয়েতে।