অসম্ভব খুশি

অসম্ভব খুশি

আমার মেয়ে রিয়া হওয়ার বছর তিনেকের মাথায় আমি অযথাই মারা গেলাম। শুধু মারা গিয়েই ক্ষান্ত হলাম না। রিয়ার বাবা মাথার উপর রিয়াকে এক প্রকার চাপিয়ে দিয়ে গেলাম। একে তো তার বাচ্চাকাচ্চা লালন পালনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তার উপর সারাদিন অফিসের কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকে। আমি মারা যাওয়ার পর রিয়াদ নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। তার সন্তান এবং তাকে ছেড়ে আমি যে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবো এক মুহূর্তের জন্যেও তা বাপ বেটি কেউই ভাবেনি। ফলাফলস্বরূপ গভীর রাতে বাপ বেটি দুজনে মিলে কান্নাকাটি করে। পার্থক্য এটুকুই মেয়ের কান্নার আওয়াজ দেয়ালে প্রতিধ্বনি তোলে, আর বাবার কান্নার আওয়াজ শোনা যেত না।

আমি মরে যাওয়াতে রিয়াদ আক্ষরিক অর্থেই বিপদে পড়লো। রিয়া এখনো দাঁড়াবে দাঁড়াবে করছে। এটা ওটা হাতায়। মেয়েকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম বলে নাকি রিয়ার কথা ভেবে কে জানে, রিয়াদ দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা মাথায়ও আনেনি। কোনো আয়ার হাতে বাচ্চাকে রেখে দিয়ে সে নিশ্চিন্তে অফিস করতে পারবে না।তাই আমাদের রিয়াকে ও একাই বড় করার সিদ্ধান্ত নিলো।

অফিস এবং রিয়া, দুটো একসাথে সামলানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিলো রিয়াদের পক্ষে। সে অফিসে যাওয়ার সময় রিয়াকে বেবিকেয়ার হোমে রেখে আসতো। অফিস সেরে রিয়াকে নিয়ে ফিরত। আগেই বলেছি রিয়া তখন হাঁটবে হাঁটবে করছে। রিয়াকে হাঁটা শেখাতে রিয়াদের সে কি তোড়জোড়! নিজের পায়ের উপর দাঁড় করিয়ে, হাত বাড়িয়ে ডেকে ডেকে ছোট্ট রিয়াকে হাঁটা শেখালো সে।

রিয়া আধো আধো মুখে যেদিন রিয়াদকে ‘বাবা’ বলে ডাকলো সেদিন রিয়াদ খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়েছিলো। অফিস থেকে ফিরে সবে সে রিয়াকে খেলতে দিয়ে খেতে বসেছে। রিয়া অস্ফুটভাবে একবার ডেকে উঠলো ‘বাবা’। ব্যস! বাবার কি আর খাবার মুখে রোচে! মেয়েকে কোলে নিয়ে সাধ্যসাধনা করে আবারো বাবা ডাক শুনে সাধ মিটলো তার। সেদিন রাতে সে আনন্দে খেয়ে উঠতে পারেনি।

বছরের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের ছোট্ট রিয়া বেড়ে উঠতে লাগলো। আমার চেহারা তার মনে থাকার কথা না! আমার ছবির সামনে এসে সে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকতো। রিয়াদ যখন আমার ছবির দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে হুটহাট চোখের জল ফেলতো, আড়ালে দাঁড়িয়ে রিয়ামণি আমার উপর অভিমান করতো। তার বাবার কান্নার কারণ যে আমি এটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারতো না। আহ! আমার বেচারা মেয়েটা!

টুকটুক করে আমার মেয়েটা স্কুলে ভর্তি হলো। রিয়াদ মেয়ের টিফিন, স্কুলড্রেস নিয়ে একটা কাহিনী করলো। রিয়ার ‘ফার্স্ট ডে এট স্কুল’ প্যারাগ্রাফটা যাতে পরবর্তীতে মিথ্যে কোনো কাহিনীর আলোকে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসতে না হয় তাই সে ঘটা করে রিয়াকে মনে রাখার মত স্কুলের প্রথম দিনটি দিলো। বাবার বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরেই পায়ে পায়ে হেঁটে স্কুলে গেলো রিয়া।

পড়াশুনার ধাঁচটা রিয়াদের কাছ থেকেই পেয়েছে। মেয়ে যেদিন পরীক্ষায় প্রথম হল সেদিন রিয়াদ সে কি খুশি। আমার কাছে এসে বলে, “দেখলে! তোমার মেয়ে তোমার মত মাথামোটা হয়নি! রিয়া হয়েছে আমার মত।” আমি ভীষণ খুশি হলাম। বেঁচে থাকলে অবশ্য রিয়াদের এ কথার তীব্র প্রতিবাদই করতাম।

স্কুল কলেজ পেরিয়ে মেয়েটা কখন যে বড় হয়ে গেলো রিয়াদ বা আমি কেউই টের পেলাম না।অথচ মনে হয় দুদিন আগেই ফ্রক পরে এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াতো।

রিয়াদের বয়সও বেড়েছে। পেটের বেরিয়ে যাওয়া ভুঁড়ি আর মাথায় পাকা চুলের আনাগোনা অন্তত তাই বলে। রিয়া এরইমধ্যে একদিন শাড়ি পরে রিয়াদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,”বাবা, মায়ের পুরনো একটা শাড়ি বের করে পরেছি। দেখো তো কেমন লাগে?”

রিয়াদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো, আমি নিজেও রিয়াকে দেখছিলাম। বাহ! মেয়েটাকে আমার ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। রিয়াদের বোধহয় এই সৌন্দর্য সহ্য হলো না। সে ‘ভারী মিষ্টি লাগছে’ বলেই আড়ালে চোখের পানি ফেললো।

আমাদের রিয়া চোখের আড়াল হতে শুরু করলো আস্তে আস্তে। সে তার বাবার সাথে হাসি তামাশা করে না, বসে দুটো কথা বলে না। রিয়াদ সবই লক্ষ করলো। কিন্তু কিছু বললো না। সেদিন রাতে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রিয়া ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার সময়ও রিয়াদ টের পেল। সে রিয়াকে বাধা দিলো না। রিয়া বেরিয়ে যেতেই রিয়াদ শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো। আমার ছবির কাছে এসে সে কান্নায় ভেঙে পড়লো।

”মায়া, আমাদের দুজনকে সেই ১৭ বছর আগে ফেলে গিয়ে তুমি যে অন্যায় করেছো, সে অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করো তবে এখন। আমার কষ্ট এই না যে রিয়া আমাকে এভাবে ডুবিয়ে গেছে! আমার কষ্ট এই যে মেয়েটাকে না দেখে আমি একটা দিনও কিভাবে কাটাবো? তোমার হাত একবার আমার দিকে বাড়িয়ে দাও, মায়া! তোমার সাথে আমি উপরে বসে রিয়াকে দেখতে চাই!”

রিয়া স্টেশনে বসে আছে। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে বেচারি মেয়েটা। দুদিনের আবেগে সাড়া দিয়ে বাবাকে রেখে সে কি এভাবে যেতে পারে?

রিয়াদের কষ্ট দেখতে পারছিলাম না। আমার বাড়ানো হাত ধরেই যদি সে ভালো থাকতে পারে তবেই তাই হোক। লোখচোখে সে হয়তো হয়ে যাবে মৃত। কিন্তু সে আমার মত দেখবে সে আমাদের রিয়াকে। আমি নিজের হাত বাড়িয়ে দিলাম।

এমন সময় দরজা খোলার শব্দে রিয়াদ মুখ তুলে চাইলো। রিয়া এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ”বাবা, আমার হাতখানা ধরো দেখি। আকাশে বিরাট চাঁদ উঠেছে। বাপ বেটি মিলে আজ চাঁদ দেখবো।”

অসম্ভব খুশি আমাকে ঘিরে ধরলো। নিজের হাত গুটিয়ে নিতেই দেখলাম রিয়াদ হাসিমুখে রিয়ার বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরতে এগিয়ে যাচ্ছে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত