স্বপ্নের শেষ সিঁড়ি

স্বপ্নের শেষ সিঁড়ি

‘এক সময় অনেক স্বপ্ন দেখতাম। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবো। কাঙ্খিত স্বপ্নের শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পৃথিবীকে শুনাবো স্বপ্নছোঁয়ার গল্প। এখন আর স্বপ্ন দেখি না; কারণ স্বপ্ন দেখে ক্লান্ত হয়ে গেছি। কোনোকিছুই এখন আমাকে আন্দোলিত করতে পাওে না। ভালো থাকবেন। হয় তো আর কখনোই কথা হবে না।’

এটাই ছিলো ওর শেষ রিপ্লাই। এরপর থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফেসবুকসহ সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ওর খোঁজে আমি পাগল হয়ে উঠলাম। যাদের সঙ্গে ওর ভালো সম্পর্ক ছিল আমি ঢাকায় গিয়ে তাদের সবার সঙ্গে দেখা করেছি। কেউ বলতে পারে না, সে কোথায় আছে, কেমন আছেন। যার প্রোফাইলটা একটু পরপর না দেখলে আমি স্থির থাকতে পারি না। এমন একটা মানুষের নিরুদ্দেশ নীরবতাতে আমি কি করে ভালো থাকি? ওর স্ট্যাটাসের প্রতিটা অক্ষরে যেন না পাওয়ার আক্ষেপ।

ওর সঙ্গে আমার গত তিন বছর যাবৎ পরিচয়। ওর নাম সুমি, আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। কখনো ফোনে কথা হয়নি। চ্যাট হয় রোজ। কয়েক জায়গায় টিউশনি করে। ব্যস্ত থাকে। দিনে ফেসবুকে পাওয়া যায় না। রাত দশটার পর অনলাইনে আসে। তখন ওর সঙ্গে চ্যাট হয়, তাও হাতেগুনা টাইমের মতো। পরিচয় লগ্ন থেকে যতবার জিজ্ঞেস করেছি, কখনো শুনতে পাইনি ও ভালো আছে। একটাই কথা, ভালো নেই। আমি ওর দুঃখী দুঃখী ভাবটার প্রেমে পড়ে গেছি। ও ভালো থাকে না কেন, এই কৌত্হুলটা আমাকে সবসময় তাড়া করে।

‘আপনি তো আমাকে এখনো বন্ধু ভাবতে পারেননি?
‘যদি বন্ধু না ভাবতাম তাহলে কি রাত জেগে আপনার সঙ্গে চ্যাট করতাম!’

‘আপনি ভালো থাকেন না কেন? এই একটা প্রশ্ন হাজারবার করার পরও উত্তর পাইনি।

‘দেখুন, এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা আমি কখনোই দিতে পারবো না।’
‘আমি জানতে চাই আপনার অস্থিরতার কারণ। যদি না বলেন তাহলে আমি আর কখনো আপনার সঙ্গে কথা বলবো না। এই কথাটা সেন্ট করে ফোনটা বন্ধ করে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।

সকালে ঘুম থেকে জেগে ফোন হাতে নিতেই দেখতে পেলাম একসঙ্গে অনেক মেসেজ। ম্যাসেঞ্জারে পড়তে থাকি-
“ক্লাস এইটে যখন পড়ি তখন নাজমা নামের এক বান্ধবীর বিয়ে হয়। সেই থেকে শুরু হলো সহপাঠী মেয়েদের বিয়ে। আর আমি এটা সেটা গিফট্ নিয়ে ওদের বিয়ে খেতে থাকি। আমি অনেক চঞ্চল ও মিশুক প্রকৃতির ছিলাম, তাই ক্লাসের সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল। অবশেষে আমরা তিনজন ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম। এসএসসি’র মতো ইন্টারেও ভালো রেজাল্ট করলাম। আমাদের পাড়ায় তখন আমিই একমাত্র অবিবাহিত। সমবয়সী বন্ধুদের সবাই দুই-একটা সন্তানের মা। ওরা স্বামী-সন্তান সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি আমার স্বপ্নের হাতছানিতে স্বপ্নছোঁয়ার পথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পথিক।

পৃথিবীতে সব বাবা মা’ই সন্তানের ভালো চায়। আমার বাবা মাও তার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। অনেক বড় ঘরের ছেলে। অস্ট্রলিয়া প্রবাসী। মাসে অনেক টাকা রোজগার। এমন ছেলে কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাননি। ছেলের বাবা মা’সহ ছেলেটা আমাকে দেখতে এলেন। দেখে একটি হীরের আংটি পরিয়ে দিলেন। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই আমাকে মোহিত করতে পারেনি। বার বার ইয়াকুব স্যারের কথাগুলো মনে ভাসতে লাগলো।

ইয়াকুব স্যার। আমাদের গ্রামের হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমার মাথায় হাত রেখে স্যার বলেছিলেন, ‘মা’রে থেমে যাসনে যেন, তোকে অনেক দূর যেতে হবে। তুই পারবি মা, তুই’ই পারবি আমাদের এই পাড়াগাঁয়ের নাম উজ্জ্বল করতে।
বাবা মায়ের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করার পর আমি সফল হলাম। বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর বেশকিছুদিন আব্বা আম্মা আমার সঙ্গে কথা বলেননি।

রেজাল্ট ভালো ছিল। কোনো পরীক্ষাতেই আমার রেজাল্ট খারাপ ছিল না। পাড়া গাঁয়ে থেকে এসে ঢাকায় এক ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। একসময় বুঝতে পারলাম; সংসার চালিয়ে আমদের ভাই বোনগুলোর পড়ার খরচা দিতে কষ্ট হতো। বাবা আমাদেরকে তা বুঝতে দিতেন না। ঢাকায় এসে দেখলাম আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা টিউশনি করে পড়ার খরচ চালাচ্ছে। এই ব্যপারটা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। আমিও টিউশনি করতে লাগলাম। বাবার কাছ থেকে আর টাকা আনতে হয়নি।

প্রেমের প্রস্তাব কয়েকটা পেয়ে গেলাম। আমি কাউকে পাত্তা দেইনি; কারণ আমাকে আমার স্বপ্নের শেষ সিঁড়ি অবধি পৌঁছতে হবে। না জেনে প্রেমে পড়ে যাই তাই কোনো ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব পর্যন্ত করিনি। ভালোবাসার মানুষটা যদি ছলনা করে সেটা সইতে পারবো না আমি ।

পাড়াগাঁয়ের মেয়ে আমি, কারো সঙ্গে প্রেম করলেও সেটা সাফল্যের মুখ দেখবে না। শুধু কল্পনার রং তুলিতে হৃদয়ের পটে এঁকে গেছি অচেনা সেই মুখ, যাকে আল্লাহ শুধু আমার জন্য পাঠাবেন।

অনার্স শেষ করে চাকরির জন্য এখানে সেখানে আবেদন করতে থাকি। মাসে দুই-একবার বাড়িতে যেতে হয়। বেশ কয়েক জায়গা থেকে আমাকে দেখতে আসে। বেশিরভাগই সৌদি, মালায়শিয়া, দোবাই প্রবাসী ছেলে। তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু; যখন দেখি ওদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসিও না। মাস্টার্স করছি এমন একটা মেয়ে কি করে ওদের হাতে জীবনটা ছেড়ে দেই?
দেখতে দেখতে স্বপ্নের সেই কাঙ্খিত পথ পারি দিয়ে স্বপ্নের শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে।

আমি খুঁজছি সেই সুখ; যে সুখের হাতছানিতে ছিলো আমার বিরামহীন ছুটে চলা। কিন্তু কোথায় সে সুখ? এখানে তো বিষণতা আর হতাশা ছাড়া আর কিছুই নেই। যেটুকু সুখ; উচ্ছ¡াস আছে তা তাদের জন্য। যারা জন্ম থেকে সুখি । আমার মতো পাড়াগাঁয়ের মধ্যবিত্ত মেয়েদের জন্য নয়।

ক্রমশ’ই যেন মনের আনন্দগুলো বিষণœতার দখলে চলে যেতে লাগল। পৃথিবীর কোনো কিছুই আমাকে আনন্দ দিতে পারে না। নিরাশার কষাঘাতে দিন থেকে দিন কেমন যেন হয়ে যেতে লাগলাম। কারো সঙ্গে কথা বলা; আড্ডা মারা; ঘুরে বেড়ানো এসব কিছুই ভালো লাগে না। জীবন চলার পথে কি যেন হারিয়ে এসেছি; যা এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না। হয়তো আর কখনো ফিরে পাবো না। ভালো থাকবেন।

সুমি আর কথা বলে না; নিশ্চুপ থাকে । হয় তো চুপ থাকা তার এক প্রকার অভ্যেস হয়ে গেছে। এখনও ইচ্ছে হয়; তার বিষণ্ণতাকে বুকে পেতে নেই। খুব করে ইচ্ছে হয়; আমার সবকিছু দিয়ে তাকে সহজ আর সুন্দর করে তুলি।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত