বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে সেই কখন থেকে কলিংবেল বাজিয়েই চলেছি। কিন্তু মিষ্টি কিছুতেই দরজা খুলছে না। এই দিকে অফিস শেষ করে এসে ক্লান্ত আমি আর ঐ দিকে মিষ্টি দরজা কিছুতেই খুলছে না, মনে মনে বললাম সে কি পালিয়ে গেলো নাকি? ধুররর কি সব ভাবছি? তবে আর উপায়ন্তর না পেয়ে কাছে থাকা বাড়ির আরেকটা চাবি দিয়ে দরজা খুললাম।
দরজা খুলেই তো অবাক। ভাবছিলাম হেব্বি আজ ঝাড়বো মিষ্টিরে। কিন্তু দরজা খুলেই তো আমি অবাক। মিষ্টির দিকে না তাকিয়ে ঘরের চারিদিক আগে চোখ বুলিয়ে নিলাম। কিন্তু আমি যা দেখলাম সেটা দেখে অঙ্গান হবো হবো ভাব হচ্ছে। দেখলাম, টিভিটা কেউ তুলে আছাড় মারছে। সোফার মাঝে বালিশগুলো ছুড়ে মারা হয়েছে। খাবার টেবিলের প্লেট সব একজায়গায় রেখে ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমার প্রিয় শার্টগুলো এনে ফ্লোরে ময়লা মোছার কাপড় বানিয়েছে।
এসব দেখে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। তখনি মিষ্টির দিকে তাকালাম। দেখি চুল গুলো এলোমেলো করা। ফুপিয়ে কেঁদেয় চলেছে। আমি তো এসব দেকে অবাক। কিন্তু কেনো এমন হয়েছে? মিষ্টিকে কি ভূতে ধরলো নাকি? কথাটা জিজ্ঞেস করতে ওর কাছে যেতেই..
– ঐ কুত্তা, তুই যেন আমার কাছে আসবি না। (মিষ্টি)
– এ মা এইটা কি বলো তুমি? আমি না তো কে আসবে?
– ঐ চুপ বেশি কথা বলবি তো তোকে খুন করে চলে যাবো।
– আচ্ছা যেও, কিন্তু তার আগে বলো এসব কি করে হয়েছে?
– জানি না..
– মিষ্টি বউ আমার বলো না গো কি করে এসব হয়েছে, আর কেনই বা কাঁনতেছো?
– চুপপ..
– ওহহ বুঝতে পারছি তোমার ভুতে ধরেছে..
– ঐ তুই জানিস না কেন এমন করেছি?
– কই নাতো?
– যা তোর জানা লাগবে না। তোর খাবার বন্ধ আজ থেকে। আর আমার কাছেও আসবি না। আর মনে করে দেখ সকালে তুই যাওয়ার সময় কি বলে গেছিলি।
কথাটি বলেই মিষ্টি রুমে চলে গেলো। আর আমি অবাক এর উপর বড় অবাক হয়ে বসে আছি। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না কি বলে গেছিলাম ওকে? আর তার জন্যই বা এমন করলো? কিন্তু সেটা কী? আমার গোবর পুরা মাথায়, একটু চাটি মেরে দেখলাম মনে পড়ছে কিনা। তখনি মনে পড়লো.. আজ তো বাংলাদেশের খেলা। আর আমার বউ তো সাব্বির রহমানের সেই লেভেলের ভক্ত। কিন্তু কি বলেছি সেটা তো মনে পড়ছে না। তখনি দেখলাম মিষ্টি আবার রুম থেকে বের হয়েছে।
– এই নে তোর বালিশ..আজ এখানেই ঘুমাবি। আর রাতের খাবার বন্ধ। আর আমাকে যেনো ডাকবি না।
বলা নেই কওয়া নেই মিষ্টি এসে বালিশ মুখে ছুড়ে মেরে কথাটি বলে চলে গেলো? আর গেলো তো গেলো..হুমকি ও দিয়ে গেলো? এ কেমন বিচার? আর এ কেমন বউ? নাম মিষ্টি হলে কি হবে? পুরাই নিম পাতা। ধুম করে দরজা লাগিয়ে চলে গেলো রুমে। আর আমি আবারো বসে বসে ভাবছি কি বলেছিলাম। ঠিক তখনি মনে পড়লো, “আজ বাংলাদেশের খেলা হওয়াতে, আমার বউ সাব্বির রহমানের ফ্যান। তাই আজ অফিস এ যাওয়ার সময় বলে গেছিলাম মিষ্টিকে..
– মিষ্টি শোনো..(আমি)
– হুমম বলো বর..
– আজ না বাংলাদেশের খেলা সাউথ আফ্রিকার সাথে?
– হুমম তো??
– আজ তো সাব্বির আছে তাই না?
– হুমম তো?
(ওর কাছ থেকে একটু দুরে সরে এসে)
– তো আজ দেইখো, সাব্বির রহমান ১ রানে আউট হবে।
– কিহহহহহ?
– সরি ১ রান না, ০ রানে দেইখো মিডিল স্ট্যাম থাকবে না। হিহিহিহি..
– ঐ কুত্তা কি বললি তুই?? তোর একদিন কি আমার একদিন। আজ বাড়িতে আসিস তোর খবর আছে। আর যদি তোর কথা সত্যিই হয় তোর যে আমি কি করবো সেটা তুইও বুঝতে পারবি না।
– হিহিহিহিহি….বাই মিষ্টি মনা..
– ধুররর হ..বাসাতে যেন আর আসবি না। আমার সাব্বিরের নিয়ে বাজে কথা বলেছিস তোর কপালে দুঃখ আছে।
কথাটি বলে মিষ্টি চলে গেলো ভিতরে। আর আমিও চলে আসলাম অফিসে। যথারীতি কাজ করছি। তখনি বস এসে বলো..
– আবির আসো খেলা দেখতে হবে।
– কি খেলা স্যার?
– বাংলাদেশের খেলা।
কথাটি শুনেই স্যারের কেবিনে চলে গেলাম। স্যার হল আমার দূরসম্পর্কের শ্বশুর। তাই তিনি এত খাতির করেন। ওনার কেবিনে বসে খেলা দেখছি।
দেখবোই না কেনো? এটা যে আমাদের বাংলাদেশ। আর বাংলার প্রতিটা মানুষ আমি দেখেছি, বাংলাদেশের খেলা হলে দৈনন্দিন কাজও বন্ধ করে দেয়। আর আমি তো মিষ্টিকে রাগানোর জন্যই কথাগুলো বলেছিলাম। কিন্তু মনে মনে ঠিকই দোআ করে চলেছি। আজ যেন বাংলাদেশ জিতে। সবাই যেন তাদের সেরাটা দিয়ে জয় ছিনিয়ে আনুক।
খেলা চলাকালীন এ সাব্বির যখন ব্যাটে নামলো তখনি আমার কথাটা সত্যিই হয়ে গেলো? সাব্বির ১ রানে আউট?? ঠিক তখনি মাথাটা কেমন ঘুরতে লাগলো..মিষ্টির জন্য না,,বাংলাদেশের জন্য মাথাটা ঘুরতে লাগলো। কারন, আমরা সবাই জানি সাব্বির একজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান। কেমন যেন খারাপ লাগা শুরু হল।
– স্যার আমি আর খেলা দেখবো না।
– কেনো?
– ভালো লাগছে না।
আমি আর কিছু না বলেই চলে আসি সেখান থেকে। তারপর অফিস টাইম শেষ করে বাড়িতে এসে এই অবস্থা দেখলাম।
(রাত আটটার সময়)
রুমের দরজার কাছে দাড়িয়ে বললাম..
– ও বউ দরজাটা একটু খুলো না।।
– নাহ..
– আমার খুব খুধা লেগেছে।
– তো আমি কি করবো?
– আমি তো মাখিয়ে খেতে পারি না।
– ধুরর
– প্লীজ এমন করো না..আমি জানি তুমি ওনার ভক্ত। তাই বলে কি স্বামীর সাথে এমন অবিচার করবা? এটা কিন্তু ঠিক না।
– চুপপ করেন আপনি।
– প্লীজ দরজা খুলো..আমি তো মজা করে বলেছিলাম।
– দরজা খুলতে পারিরি,,কিন্তু আজ আপনি আমার সাথে ঘুমাবেন না।
– আগে তো খোলো…
তখনি মিষ্টি দরজা খুলে দিলো। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। বেচারা মনে হয় খুব কেঁদেছে। বললাম..
– সরি..
– আচ্ছা অন্তত খেতে তো দাও? ক্ষুধায় তো চোখে খালি আউট আউট দেখছি।
কোনো কথা না বলে মিষ্টি রান্না ঘরের দিকে গেল। একটু পরেই দেখলাম মিষ্টি খাবার নিয়ে আসলো..
– আসেন খেতে আসেন।
(দৌড়ে খাবার টেবিলে গেলাম)
– নেন খান।
গরুর মাংস প্লেটে দিয়ে বললো খেতে..
– মাখিয়ে দাও।
– পারবো না..
– কেনো?
– জানিনা…
– প্লীজ এমন করো না..সামান্য মজা করার জন্য এতটা শাস্তি দিও না।
আর কোনো কথা না বলেই মিষ্টি মাখাতে লাগলো। আর আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। কেদে কেদে পুরো কাদুনে বুড়ি হয়ে গেছে। অপলক তাকিয়ে থেকে বললাম..
– তুমি খাবে না??
– চুপপ করে থাকতে পারো না?
– আমি আর কিছু না বলেই চুপ চাপ খেতে বসলাম। আর মিষ্টিকে দেখলাম বেলকনির দিকে চলে যেতে।
(খাওয়া শেষ করে ওর কাছে গেলাম)
– মিষ্টি..
– (বাইরে তাকিয়ে আছে)
– শোনো না গো..
-……
– ও মিষ্টি… বউ আমার, কাঁদুনে বুড়ি, আমার টিকটিকে।
– চুপপপ..(ঝাড়ি মেরে)
আমি আর কিছু না বলেই ওর কাছে থেকে চলে আসলাম। আর ও ঐভাবেই দাড়িয়ে থাকলো। আমি আবার গেলাম ওর পাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে বাইরে তাকালাম
চারিদিক নিরাবতা, নিরাবতা ভেঙে বললাম..
– মিষ্টি, আমি জানি তুমি সাব্বিরের ফ্যান, অনেক বড় ফ্যান। তাই বলে নিজের হাজবেন্ড এর সাথে এমন করতে হবে? আমি তো সরি বলেছি। আর বিষয়টা পুরোই কাকতালীয়। আমি কি জানতাম নাকি উনি এভাবে আউট হবে? যাই হোক, আমি তোমাকে শুধু রাগানোর জন্য এমনটা করেছি।
– আমি শুনতে চাই না।
– শুনতে হবে তোমার কারন, এটা পাগলামো ছাড়া আর কিছুই না। এটাকে ভক্ত বলে না,,ভক্তের নামে পাগলামো বলে। যার প্রমান হলে তুমি।
মিষ্টি আমার দিকে তাকালো, তখনি আমি ওর প্রিয় লালচুড়ি(আসার পথে কিনে এনেছিলাম) বের করে বললাম..
– এটা তোমার জন্য, হয়ত এটা তোমার রাগেরর বা তোমার ভক্তপনার কাছে কিছুই না। কিন্তু এটাতে মিশে আছে অনেক ভালোবাসা। মিশে আছে অজস্র অনুভুতি।
যে অনুভুতিরা সব সময় ভালোবাসার মানুষটাকে আকড়ে ধরতে চাই। ঠাই পেতে চাই তার বাহুডোরে। তোমার কাছে সামান্য কিন্তু আমার কাছে এটি একটি ভালোবাসার মানুষের জন্য এক ভালোবাসার প্রতিক। চাইলে নিও, না চাইলে ফেলে দিও।
কথাটি বলে চুড়িগুরো ওর হাতে দিয়ে সোফাতে বালিশ রেখে শুয়ে পড়লাম। সহ্যের একটা সীমা আছে। এটা কেমন ভক্ত বলে আমি বুঝি না। সামান্য একটা মজার জন্য মিষ্টি এমন করলো। থাকুক ও ওর মত। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে গেলো বুঝতে পারিনি। তখনি মনে হলে আমার বুকে কারো মাথা। আর গেন্জিতে চোখের পানির ছাপ। ঠিক তখনি বুঝলাম এটা মিষ্টি।
– আমি খুব পঁচা তাই না? (মিষ্টি)
– কে বলেছে? (আমি)
– কে বলবে? আমি নিজেই।
– নাহ গো তুমি তোমার মিষ্টি বউ।
– সরি।
– কেনো? (আমি)
– তোমার সাথে এতটা খারাপ বিহেভ করার জন্য। মাফ করে দাও।
– হুরর পাগলি, এখানে মাফ চাওয়ার কি আছে? কাছের মানুষদের কাছে সরি বা মাফ চাওয়া লাগে না। তারা আগেই মন থেকে মাফ করে দেয়। আর সরি তো আমি বলবো ঐসব এর জন্য।
– নাহ ঐসব বাদ দাও..
– আচ্ছা চলো খাবে।
খাবার টেবিলে বসে আছি। মিষ্টিকে ভাত বেড়ে দিলাম। তখনি বললো..
– আজ আমাকে মাখিয়ে দাও।
– কিহহহ..
কথাটি শুনে ওর দিকে তাকালাম। আর ও মাথাটা নিচু করে হাতের চুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে নাড়িয়ে দেখছে আর মুচকি হাসছে। কখন যে আমি ভাত মাখিয়ে ফেললাম বুঝতেই পারিনি। আমি মাখাতে পারি না। কিন্তু মিষ্টির এই মিষ্ঠান্নতা দেখে কখন মাখিয়ে ফেললাম বুঝলাম না।
– এই নাও হা করো।
সে আমার দিকে তাকালো। তবে অবাক হয়েই তাকালো। হয়ত ভাবছে আমি কিভাবে মাখালাম।
– কি হল হা করো? (আমি)
মিষ্টি খাচ্ছে আর চুড়ি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তাকে তখন দেখতে বেশ লাগছে। তাই আমিও ওর দিকে তাকাচ্ছি আর খাইয়ে দিচ্ছি।
“কাছের মানুষদেরকে নামীদামী কোনো গিফট দেয়া লাগে না। সামান্য কিছুতেই তারা খুশি হয়। কারন, এই সামন্যতমের মাঝে মিশে থাকে এক পবিত্র ভালোবাসা। যেটা দামী জিনিষেও আদায় করা যায় না”