সুমাইয়া আমাকে দেখলেই লজ্জারাঙ্গা হয়ে মাথা নিচু করে হাটার গতি কমিয়ে দেয়। আর আমি কোনোরকম পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করি। এই বয়সে ছেলে মেয়েদের মনে এক ধরনের আনন্দ খেলা করে। সে আনন্দে অন্যদেরও ভাসাতে চায়।
আমি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। মানুষের পছন্দ অপছন্দ দুটোই আছে। সুমাইয়াকে আমার মোটেও পছন্দ নয়। কালো ছিপছিপে মেয়েটা আমাকে দেখলেই চুলের একাংশ আঙ্গুল দিয়ে ঘুরিয়ে কানের ওপাশে রাখে। ওড়না টেনে ঠিক করে মাথা নিচু করে আড়চোখে তাকায়। তখন নিশ্চয় সুমা মনে মনে বলে, “এই ছেলে, একটু তাকাও আমার দিকে। দেখো আজ আমাকে আগের চেয়ে একটু সুন্দর লাগছে কিনা।”
আমি অবশ্য কারো মন পড়তে পারিনা। কিন্তু আমি সুমাইয়ার দিকে দ্বিতীয়বার তাকাইনা কখনোই। এমনিতেই পেছন ছাড়েনা, আর দুই তিনবার যদি তাকাই তাহলে বাড়ি এসে উঠবে।
বিকেলে যাচ্ছি ফুটবল খেলা দেখতে। সুমাইয়াদের বাড়ির সামনে দিয়েই রাস্তা। সুমা তাদের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে দুটো মেয়ের সাথে কথা বলছে। মেয়ে দুটোকে আগে কখনো দেখিনি। সুমাইয়ার কলেজের বান্ধবী হতে পারে। আমি দূর থেকে স্পষ্ট দেখেছি, সুমাইয়া তার বান্ধবীর হাত ধরে ঝাড়া দিয়ে ফিসফিস করে কী যেন বলছে। হয়তো বলতে পারে, “এই দেখ, দেখ আমার ও আসছে।”
‘ও’ অক্ষরটি একটি শব্দও বটে। বাংলা ভাষার ছোট শব্দ।
আমি দাঁতে কিড়মিড় করে হাটছি। ওদের পাশ দিয়ে যাবার সময় কে বলছিল, “মোটামোটি চলে, তেমন সুন্দরনা দেখতে।”
কিঞ্চিত অপমানবোধ নিয়ে চলে গেলাম। সুমাইয়াকে সরাসরি কিছু কথা বলা দরকার। যেন আমার পিছনে আর ঘুরঘুর না করে। তাকে আমার পছন্দ নয়। আমি সুন্দরী কোনো মেয়েকে পছন্দ করব, সুমাইয়ার মত কালো মেয়েকে না।
আম্মু ফুল পিঠা বানানোর আয়োজন করলেন। নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী পিঠার মধ্যে ফুলপিঠা অন্যতম। অনেকে নকশী পিঠাও বলে। আমার বেলা করে ঘুম থেকে উঠার অভ্যেস। ফুল পিঠা অনেকে একসাথে বসে বানায়। এক বাড়ির পিঠা অনেকে মিলে বানিয়ে দেয়। আমি বাড়ি ভর্তি পিঠা বানানোর কারিগরদের কিচির মিচিরে ঘুম থেকে জেগে উঠেছি। চোখ কচলিয়ে বাইরে এসে দেখি এলাকার মেয়েরা গোল হয়ে বসে পিঠা বানাচ্ছে। আম্মু রুটির মত বেলে দিচ্ছে আর মেয়েরা খেঁজুর কাটা দিয়ে নকশা আঁকছে। আমিও নকশা আঁকতে পারি। তবে মেয়েদের মত এত সুন্দর হয়না। আমি প্রতি ইদের মৌসুমে কয়েক পিঠায় ইদ লিখে নকশা আঁকি। পাশের বাড়ি ছোট মেয়েটি বলেই উঠল, “শ্রাবণ ভাই ইদ পিঠা বানাবেন না?”
আমি কিছু না বলে নলকূপের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল, মেয়েদের ভীড়ে সুমাইয়াও পিঠা বানাচ্ছে। আড়চোখে মিটমিট করে আমার দিকে তাকায়। কিছু চুল সামনে এসে চোখের উপরে পড়ে আছে। এখন ইচ্ছে করছে সুমাইয়াকে দাড় করিয়ে চোখের সামনে আসা অবাধ্য চুলগুলোকে ফুঁ দিয়ে পেছনে সরিয়ে দেই।
হঠাৎ তন্দ্রা কাটল মনে হচ্ছে। কী ভাবছি এসব? সুমাইয়াকে তো আমার পছন্দই না।
কয়েকদিন ধরে সুমাইয়াকে ঘনঘন আমাদের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। আম্মুর সাথে ভালো ভাব জমিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। আমি খুব ভালো করেই জানি আমাকে দেখার একটা ফন্দি এঁটেছে মেয়েটা। বাড়ি থেকে যখন বাইরে বের হই তখনও আড়চোখে তাকিয়ে থাকে। বাড়ি ফেরার পথে প্রায়ই দেখি রাস্তায় দাড়ানো। যেন আমার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণছে। সেদিন তো রাতে সুমাইয়াকে আমাদের বাড়ি দেখে অবাক হয়ে গেছি। মেয়েটা এমন করছে কেন?
পরে আম্মুর কাছে শুনি, সুমাইয়া বাটিতে করে শুটকি তরকারি নিয়ে আসছে।
জামগাছে (S+S) লিখা দেখে রাগে ফোঁসতে থাকি। এটা নিশ্চয় সুমাইয়ার কাজ। সে কী বুঝাতে চায়? শ্রাবণকে ভালোবাসবে? এত সোজা না আমার ভালোবাসা পাওয়া। আজই এর একটা বিহিত করতে হবে। মেয়েটা বড্ড বেড়ে গেছে।
পথেই পেয়ে গেলাম। নিশ্চয় আমাদের বাড়ি যাচ্ছে। পথ আগলে দাড়িয়েছি।
-এই সুমাইয়া দাড়াও।
আবার আগের মত সামনের চুলগুলো হাত দিয়ে কানের পিছনে সরিয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়েছে।
-আমার পিছনে ঘুরঘুর করো কেন? আড়চোখে তাকিয়ে থাকো। মুচকি মুচকি হাসো। আমার মা’কেও পটিয়ে ফেলেছো। আজ জামগাছে এস + এস লিখে রাখছো। বাহ, সুমাইয়া + শ্রাবণ। আয়না আছে ঘরে? নিজেকে ঐশ্বরিয়া ভেবে বসে আছো মনে হয়। আর যেন আমার পিছনে ঘুরঘুর করতে না দেখি।
সুমাইয়া মাথাটা ঈষৎ উপরে তুলল। তার চোখ ছলছল করছে। এবার সুমাইয়া মুখ খুলল,
-আমি কখনোই আপনার পেছনে ঘুরঘুর করিনা। আপনাকে ভালোলাগে সত্যি। কিন্তু আপনার কাছে ভালোবাসা চাওয়ার দুঃসাহস আমার নেই। আমার ঘরে আয়না আছে। আমি ঐশ্বরিয়া মনে করিনা নিজেকে। আমি যে কালো সেটা দেখার মত চোখও আমার আছে। কাকতালীয়ভাবে রাস্তায় দেখা হয়ে যায়। আমি হাটার গতি থামিয়ে মাথা নিচু করি। আপনি চলে গেলে আবার স্বাভাবিক হই। আপনাকে ভালোলাগে তাই সামনে পড়লে লজ্জা লাগে। আপনাদের বাড়ির পিঠা বানানোর দিন আপনার মা বলছিলেন বেশিক্ষন কাজ করলে নাকি কোমড় ব্যথা করে উনার। আমি সারাদিন টইটই করে ঘুরি। তাই যখন সময় পাই একটু কাজ করে দেই। আর জামগাছের লেখা আমি লিখিনি। সুজন লিখেছে। সে আমাকে পছন্দ করে। আমি তাকে পাত্তা দেইনা বলে গাছে, দেয়ালে এসব লিখে রাখে। আপনার পিছনে ঘুরে লাভ নেই জানি। আমি ঘুরিওনা আপনার পিছনে আর ঘুরবওনা।
সুমাইয়া হনহন করে যেদিক থেকে এসেছিল আবার সেদিকে চলে যাচ্ছে। আমাদের বাড়ি যাবেনা। মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তাকে অপমান করেছি, আবার আমাদের বাড়ি যাবে কেন? আবার মনে মনে ভাবতেছি, অপমানতো নিজেই হলাম। এতদিন ভাবতাম সুমাইয়া আমাকে ভালোবাসে আর এখন শুনি জুয়েলকেই সে পাত্তা দেয় না। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিনা কিছুতেই। কেন যে বলতে গেলাম কথাগুলো।
দুদিন ধরে আমি সুমাইয়াকে দেখিনা। আমাদের বাড়িও আসেনা। রাস্তাদিয়ে আগে যেতে আসতে দেখতাম। দু’দিন ধরে ইচ্ছে করেই রাস্তা দিয়ে বারবার আসা যাওয়া করছি তবুও সুমাইয়াকে দেখিনা। গত পরশু একবার দেখেছিলাম। আমাকে রাস্তায় দেখে আবার দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেছে। মেয়েদের কত অভিমান, চিন্তা করাও বড় দায়।
মধ্যরাতে ঘুম থেকে স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম। স্বপ্নে দেখলাম সুমাইয়ার বাবা তার চোখের সামনে আসা চুলগুলো কেটে দিচ্ছে। আর সুমাইয়া হাত পা ছড়িয়ে কান্না করছে। আমার খুব করে ইচ্ছে করছে চুল কাটায় বাঁধা দিতে।
এমন অদ্ভুত স্বপ্ন কেন দেখলাম জানিনা। তবে গত দুদিন ধরে সুমাইয়াকে না দেখে ওর কথাগুলো সারাক্ষন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই হয়তো একটা কল্পনার আবরণ তৈরী হয়েছে।
কিন্তু একটা ইচ্ছেও হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে এখন এই রাতেই সুমাইয়াকে ডেকে বাইরে নিয়ে আসি। তারপর তার চোখের সামনের চুলগুলোকে ফুঁ দিয়ে পেছনে সরিয়ে দেই। আবার কী ভাবছি এসব আমি? উফপ, সুমাইয়ার কথাই বারবার ভাবনায় আসে কেন? তাহলে আমি কি সুমাইয়াকে…
না, না। আমি কেন সুমাইয়াকে ভালোবাসতে যাব? কিন্তু আমার ভিতরের মনটা ভিন্ন কথা বলে। যে দু’দিন ধরে সুমাইয়ার কথা ভাবায়, রাত দুপুরে জাগিয়ে তুলে। কিন্তু আমি যদিও ভালোবাসি সুমাইয়াতো আমাকে ভালোবাসেনা। জুয়েলকেই পাত্তা দেয়নি সে।
রাব্বিদের ঘরের দেয়ালে সুজন কী যেন লিখছে। ওর পাশে গিয়ে দাড়িয়ে দেখি আবার এস + এস লিখছে। রাগ দেখিয়ে বললাম, এখন মুছবি তুই এটা।
সে পাল্টা প্রশ্ন, যদি না মুছি? আমি কী লিখলাম তাতে তোর কী সমস্যা?
বলার সাথে সাথে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলাম। রাব্বির মা আর রাব্বি বেরিয়ে এল। সুজন মাটি থেকে উঠে আমাকে ধরতে যাবে তখন রাব্বির মা এগিয়ে এল। ‘এই কী হয়েছে’ বলে থামাতে চাইল। আমি বললাম, “দেখেন পুরো এলাকায় এসব লিখে মানুষের দেয়াল নষ্ট করছে।”
রাব্বির মা দেয়ালে লেখা দেখে তিনিও রেগে গেলেন। এতে আমি সমর্থন পেলাম। কিন্তু চলে আসার সময় ভাবছি, আমিতো দেয়ালে লেখার জন্য রাগ দেখাইনি। অন্য কারণে দেখিয়েছি। তার মানে আমি কী সুমাইয়াকে…
উফপ, সুমাইয়া আসে কেন বারবার মনে?
একটু পর মাগরিবের আজান হবে। আমি বাসায় ফিরছিলাম। সুমাইয়া মাথায় ওড়না দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। আজ হাটার গতি কমায়নি। হনহন করে বাড়ি ফিরছে। আমার দিকে আজ আড়চোখে একবারও তাকায়নি। আমি নিজেই বারবার তাকাচ্ছি। তার চোখের সামনে অবাধ্য চুল। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে ফুঁ দিয়ে চুলগুলো পিছনে সরিয়ে দেই। সুমাইয়ার সামনে দাড়ালাম। সে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে পড়েছে। আমি একটু কাছে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ ফুঁ দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিলাম। সুমাইয়া মাথা উঁচু করে আমার দিকে একবার তাকাল। একটা মুচকি হাসি দিয়ে দৌড়ে বাড়ি চলে গেল। এটা আমি কী করলাম? সত্যিই কি তবে আমি এই কালো মেয়েটার প্রেমে পড়েছি?
সুমাইয়াকে ভূতের মত দেখাচ্ছে। কালো চেহারার মুখটিতে স্নো মেখে সাদা বানিয়ে রেখেছে। স্নো ত্বকের সাথে মিশেনি, ভেসে আছে। লাল লিপস্টিক দিয়েছে। লাল রঙা লিপস্টিক আমার কখনোই পছন্দ না। চরাঞ্চলের মানুষের পছন্দের রং লাল। তারা বাড়ি থেকে শুরু করে, গায়ের কাপড় চোপড়ও লাল ব্যবহার করে।
সুমাইয়া গুটি গুটি পায়ে জামগাছের নিচে আসছে। কাকে দিয়ে যেন শাড়ি পরেছে। পেটের দিকের কুচির জন্য পেট ফুলে আছে। আমি কাছে গেলাম। সুমাইয়া লজ্জারাঙ্গা মুখটি ঢাকতে না পেরে নিচে তাকিয়ে আছে।
ভালোবাসার মানুষটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে। আর আমার কাছে সুমাইয়াকে ভূতের মত লাগছে। যদিও আমি ভূত বা পেত্নি কখনো দেখিনি। এমন মনে হবার প্রধান কারণ সুমাইয়ার সাজগোজ। না সাজলেই সুমাইয়াকে সুন্দর লাগে, অসম্ভব সুন্দর। কেন যেন মনে হয় কালো মেয়েদের সাজতে হয় না। না সাজলেই তাদের প্রকৃত সুন্দর ভেসে উঠে।
আমি কাছে গেলাম। সুমাইয়ার দৃষ্টি তখনো মাটির দিকে। আমি দুই হাতে তার দুই গাল ধরে মাথা সোজা করলাম। সুমাইয়া লজ্জায় চোখ বন্ধ করে রেখেছে। পৃথিবীতে যত লজ্জা আছে তার নব্বই ভাগই মেয়েদের দখলে।
-চোখ খুলো সুমাইয়া।
আমার কথা শুনে সুমাইয়া মিট মিট করে তাকাচ্ছে। তার গাল ছেড়ে দিলাম। আমিও তাকিয়ে আছি তার চোখে। চোখ বন্ধ করে রাখার কারণে চোখের নিচের অংশে কিছুটা কাজল লেপ্টে আছে। দুটি চোখে আজ তার খুশির জোয়ার। অথচ যেদিন আমি তাকে বলেছিলাম, আমার পিছন পিছন ঘুরবেনা। সেদিন সুমাইয়ার চোখে ছিল উছলে পড়া ঢেউ। চোখের কোণ ভিজিয়ে মেয়েটি সেদিন চলে গিয়েছিল। অথচ যেদিন আমি তাকে ভালোবাসার কথা জানালাম, সেদিনও এমন লজ্জা পেয়েছিল।
যেদিন প্রথম সুমাইয়ার চোখের সামনে আসা চুল ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিয়েছি। সেদিনই বুঝতে পেরেছি মনের অজান্তে আমি সুমাইয়াকে ভালোবেসেছি। তার পরদিন থেকে সকাল বিকাল তাকে দেখার জন্যই অপেক্ষার প্রহর গুণতাম। রাতে স্বপ্ন সাজানোর সময় মাঝপথে আটকে যেতাম। সুমাইয়া সুজনকে পাত্তা দেয়নি। আমি সুমাইয়াকে অপমান করেছি। তারপরও সে আমাকে ভালোবাসবে? দু’দিন পর এই জাম গাছের নিচেই তাকে আমার ভালোবাসার কথা জানাই। হাতে কোনো গোলাপ ছিল না। ছিল কচুরিপানা ফুল। সেদিন আমার ভালোবাসার কথা জানিয়ে যখন তার কাছে জানতে চাইলাম আমাকে ভালোবাসে নাকি, তখন লজ্জারাঙ্গা মুখে জানিনা বলে ফুলটি নিয়ে মুচকি হেসে দৌড়ে পালিয়েছে। মেয়েদের সব কথা মুখ ফোটে বের হয়না। কিছু কথা দুই ঠোটের কাছে এসে আটকে থাকে। সে কথাগুলো প্রিয়জনদেরই বুঝে নিতে হয়।
সুমাইয়া নিরবতা ভেঙ্গে বলল, “এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার লজ্জা করে।”
আমি চোখ গুটিয়ে নিলাম। আমার হাতকে পিছনে নিয়ে রেখেছি। সুমাইয়ার দুই গালে ধরার ফলে দুই হাতই কিছুটা সাদা হয়ে আছে। এখন মনে হচ্ছে স্নো এর উপর পাউডারও দিয়েছিল। আমি সুমাইয়ার দিকে আবারো তাকালাম।
-সুমাইয়া, সাজগোজ প্রতিটা মেয়ের প্রাপ্য। তুমি আজ আমার জন্য সেজেছো। কিন্তু বিশ্বাস করো, না সাজলে তোমাকে আরো বেশি সুন্দর লাগে। আর এখন এই স্নো, পাউডার আর লাল লিপস্টিকে ভূতের মত লাগছে।
সুমাইয়ার চোখে পানি। হাতের উল্টো পৃষ্ঠে চোখের পানি মুছতে গিয়ে আরো খারাপ অবস্থা। সাদা পাউডারের উপর চোখের পানিতে ভাসা লেপ্টানো কাজল। এবার না হেসে থাকতে পারলামনা। সুমাইয়ার কান্নার গতি বেড়ে গেল।
-আপনি আমার সাথে মজা করেছেন। আমি কাঁদি আর আপনি হাসছেন। আমাকে ভূতের মত লাগে। আমি আগেই জানতাম, আপনার ভালোবাসা পাবার যোগ্য আমি নই। আপনাকে ভালোবাসি বলে আমাকে নিয়ে এভাবে মজা করলেন? হাসি তামাশা করছেন? আর কখনো আসবনা আপনার কাছে।
কথাগুলো বলে দৌড়ে চলে যাচ্ছে সুমাইয়া। আমি পেছন দিয়ে ডাকলেও সাড়া দেয়নি। ভূতের মত দেখা যায় কথাটা বলা মোটেও উচিত হয়নি। মেয়েদের প্রশংসা করতে হয়। সুন্দর না লাগলেও বলতে হয় তোমাকে অপরূপ সুন্দর লাগছে। তখন তারা লজ্জারাঙা হয়ে বলবে, “একটু বাড়িয়ে বলছেন।”
আর যদি কেউ বলে অসুন্দর। তাহলে সুমাইয়ার মত কেঁদে বুক ভাসাবে। এখন আমি যে কী করি? কীভাবে যে সুমাইয়ার রাগ ভাঙ্গাব কে জানে। আমি আবার কারো রাগ ভাঙ্গাতে পারি না। আমার ছোট বেলার বন্ধু শামীম একবার আমার সাথে রাগ হয়েছিল। তার রাগ কীভাবে ভাঙ্গাব আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মোড়ের চায়ের দোকানে শামীমকে চা খেতে দেখে একবার চায়ের দাম দিয়ে চলে এসেছি। চারদিন পর আমি চা খেয়ে বের হয়ে বিল দিতে গিয়ে শুনি কেউ একজন আমার বিল দিয়ে চলে গেছে। শামীমের রাগ ভাঙ্গেনি। একদিন পাঁচ ইঞ্চি গাঁথুনির দেয়ালে বসা ছিল শামীম। আমি গিয়ে সাথে বসেছি। সে কথা বলে না। আমি পকেট থেকে আলপিক চকলেট বের করলাম। আমি এখনো বাচ্চাদের মত চকলেট খাই। হাতে চারটা চকলেট। আস্তে করে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, “শামীম চকলেট খাবি?”
আমার দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে বলে, “আমি না তোর সাথে রাগ করে আছি? আগে রাগ ভাঙ্গা, তারপর খাব।”
কিন্তু রাগ কীকরে ভাঙ্গায়? এই শামীম রাগ ভাঙ্গে কীকরে?
শামীম আমার হাতে চারটি চকলেট নিয়েই হাটা শুরু করল। আমিও তার পেছন পেছন গিয়ে গলাগলি করে হাটা শুরু করলাম। কিন্তু সুমাইয়ার সাথে গলাগলি করে হাটা যাবে না।
পকেটে চকলেট আর প্রাণ তেতুল চাটনি নিয়ে ঘুরতেছি। সুমাইয়ার দেখা আর পাচ্ছিনা। মেয়েরা টক খুব পছন্দ করে। পাশের এলাকায় তেতুল গাছ থাকলেও উঠার সাহস নেই। তাই তেতুলের চাটনি নিয়ে এসেছি। কিন্তু যার জন্য এনেছি তার দেখা মিলেনি।
সকালে একবার দেখেছিলাম বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। আমাকে যেতে দেখে আবার বাড়িতে ঢুকে গেছে।
সুমাইয়ার পেছনে আমি হাটতেছি। আমাকে এখনো দেখেনি। দেখলে দৌড়ে পালাতে পারে। হুট করে আমি সামনে গিয়ে সুমাইয়ার পথ আগলে দাড়িয়েছি।
সুমাইয়া ডানে একবার বামে একবার সরে যাবার চেষ্টা করলেও আমি পথ ছাড়িনি। চকলেট আর প্রাণ চাটনি জোড় করে হাতে দিলাম। সাথে সাথে ঢিল মেরে চকলেট আর চাটনি ফেলে দিছে।
পাশ দিয়ে এলাকার এক মুরব্বি যাচ্ছিল। তিনি হঠাৎ বললেন, “রাস্তা ঘাটে এসব করে বেড়ায় আজকাল ছেলেগুলো। আজই বিচার দেব তোর বাবার কাছে।”
আমি উনার কাছে গিয়ে বললাম, “দাদা এখন আপনি আমার কথা বলে দিবেন বাবার কাছে। এখন আপনার বয়স হয়েছে। আমার মত বয়স থাকতে আপনারও নিশ্চয় কাউকে ভালো লাগত। আপনিও কারো জন্য এমন করতেন। তখন কেউ আপনার বাড়িতে বিচার দিলে কেমন লাগত? ”
দাদা চোখ মুছতে মুছতে চলে যাচ্ছে। বুঝা গেল দাদার গল্পটা বিরহের। দিয়েছি পুরোনো কথা মনে করিয়ে। আর কারো কাছে কিছু বলবেনা।
এই ঘটনা দেখে সুমাইয়া মুখে একহাত দিয়ে কোমড় দুলিয়ে অট্টহাসিতে লুটিয়ে পড়ছে। আমি চকলেট আর তেতুল চাটনি তুলে আবার সুমাইয়ার হাতে দিয়েছি। এবার আর ফেলে দেয় নি। শুধু বলেছে, ভূতরা এসব খায় বুঝি? ভূত তো ঘাড় মটকায়। বলে হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে। রাগ মনে হয় নেই আর। কাল জাম গাছতলা গেলেই বুঝা যাবে রাগ আছি নাকি নাই।
বড় খালার মেয়ে এসেছিল সকালে। এবার দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। ছোটবেলা অনেক মারামারি করতাম তার সাথে। নাম সানজিদা। বিকেলে আমার জাম গাছের নিচে যাওয়ার কথা। সুমাইয়া আসবে। কিন্তু সানজিদা বায়না ধরেছে তাকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে যেতে হবে। বাড়ির কাছে কোথাও ফুচকা বিক্রি করেনা। আমার সাথেই হেটে যাচ্ছে সানজিদা। যাব মোড়ের দোকানে। হঠাৎ চোখ গেল সামনে। জামগাছের নিচে সুমাইয়া দাড়ানো। আমার ভিতরে ভূমিকম্প হচ্ছে।
সানজিদা পাশে হাটছে আর বলছে, “তুমি অনেক বদলে গেছো। আগের মত নেই তুমি। আগে কত ভালো ছিলে। যা খাইতে চাইতাম তাই এনে দিতে। আর আজ ফুচকা খাওয়ার জন্য কতকিছু বলে রাজী করাতে হল।”
আমার মনে হচ্ছিল আমি সানজিদার মুখ চেপে ধরি। কারণ সুমাইয়া প্রায় সব কথাই শুনছে। একবার পেছন ফিরে দেখি সুমাইয়া হাতের উল্টো পৃষ্ঠে চোখের পানি মুছতে মুছতে যাচ্ছে। এই সারছে। নিশ্চয় উল্টাপাল্টা কিছু ভেবে বসে আছে। মেয়েদের এই একটা স্বভাব। তার ভালোবাসার মানুষের সাথে যে কোনো মেয়ে থাকুক, আত্মীয় থাকুক, সন্দেহ তারা করবেই। সুমাইয়ার এবারের রাগ আর ভুল যে কীভাবে ভাঙ্গাব ভেবে কূল পাচ্ছিনা। আমি আবার কারো রাগ ভাঙ্গাতে পারিনা।