অনেক্ষণ যাবত রানীকে OTতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাজ বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে, বলা যাবে না, শুধু পায়চারী করছে, ভয় করছে ওর খুব। কিন্তু পরমুহূর্তেই ছোট্ট সোনা আসবে ওদের মাঝে কথাটা ভাবতেই নিজের অজান্তেই মুখে এক চিল্টি হাসি ফুটে উঠলো আর ডুব দিলো ভাবনাতে,
আমি রাজু। তবে রানী আমাকে রাজ হিসেবে ডাকতেই বেশি পছন্দ করতো। আমার নিজেরো ডাকটা শুনতে অনেক ভাল্লাগতো। বাবা মা ত অনেক আগেই টা টা বাই বাই বলে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। চাচার কাছে থেকেই, আজ আমি এখানে, এই অবস্থাতে। চাচতো ২ ভাই আছে আমার, একটা এসএসসি দিবে, আর একটা ইন্টার। আপনজন বলতে একমাত্র ওরাই আছে। অনেক টা পরিশ্রম করেই আজ আমি একটা কলেজের লেকচারার এর পদে আছি।
বাবা মাকে সব সময় মিস করতাম। মানুষ বলে, যার বাবা নেই তার অর্ধেক পৃথিবী শূন্য , আর যার মা নেই তার পুরো পৃথিবী টাই শূন্য। আমার ত বাবা মা কেউ নেই, আমার কাছে সবকিছুই শূন্য ছিলো।
রিলেশন, সম্পর্ক, এগুলোতে আমি ছোট থেকেই ছিলাম না। ছোট থেকে বলছি কারন
আমি যখন ক্লাস 10 এ পড়ি, তখন একটা মেয়ে আমার প্রতি দূর্বল, ছিলো। দূর্বল ছিলো ব্যাপার টা বুঝেছিলাম ওর কথা, আচরনে। আমি আর্ট পারতাম, পারতাম বললে ভুল হবে, এখনো পারি কিন্তু ব্যাস্ততায় সময় হয়ে উঠে না। আমি যখন কিছু আর্ট করতাম, তখন আর কেউ না হোক, ওই মেয়েটা আমার পাশে এসে বসতো। আমি আন-ইজি ফিল করতাম, কিন্তু বলতে পারতাম না। আরো অনেক ভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম, এগুলো আমার ভাল্লাগতো না জন্য একদিন স্যারকে ডেকে বলে দেয়। তারপর থেকে মেয়েটা আর আমার ব্রেঞ্চ টাতে বসতো না। ইভেন, আমার সামনেও আসতো না।
ব্যাপার টাতে আমার খারাপ লাগেনি, বরং ভালোই লেগেছিলো।
কলেজে এসেও একজনের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে, মেয়েটা ছিলো বড়লোক বাবার একমাত্র আদুরে কন্যা।
অনেক বিরক্ত করতো মেয়েটা, একদিন ব্লেড নিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে যায়,
— ভালোবাসবা কি না??( মেয়েটা)
— পাগলি হয়েছো তুমি??( আমি)
— ভালোবাসবা কি না?? যদি উত্তর হ্যা না হই ত, ব্লেড টা হাতের কাছে ধরে, দেখছো কি করবো??( মেয়েটা)
— মেয়েটার এমন ব্যাবহারে আমার মাথায় রাগ উঠে যায়, তখন আবার আমি ছাত্ররাজনীতিতে বড় পর্যায়ে ছিলাম।
মেয়েটার কাছে গিয়ে, হাত থেকে ব্লেড টা নিয়ে,
— তোমার কষ্ট করতে হবে না, আমি কেটে দিচ্ছি।
— মেয়েটার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম।
ওইদিনের পর থেকে মেয়েটাকে আমার আশে পাশেও কখনো দেখিনি। মনে মনে হাসতাম এই ভেবে যে, ভালোবাসার দাবি নিয়ে আইলো, আর কাঁটা পেয়ে চলে গেলো।
ইউনিভার্সিটি তে যেই মেয়েটার সাথে আমার কথা হতো, ও অনেক ভালো স্টুডেন্ট ছিলো+অনেক সুন্দরী ও ছিলো। পড়াশোনার ব্যাপারে আমায় অনেক সাহায্য করতো, আমি ছাত্র টা ততটা ভালো ছিলাম না আবার খারাপ ও ছিলাম না, মানে মাঝামাঝি ছিলাম। গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট করার পর, ওর সাথে শেষ দিনে কথা বলার সময় বুঝতে পেরেছিলাম ও আমার প্রতি দূর্বল ছিলো, তবে আমি ডিরেক্ট না করে দিয়েছিলাম কারন আমার তখন কোন অবস্থায় ওকে এক্সচেপ্ট করা সম্ভব ছিলো না।
এরপরে আর তেমন কোন মেয়েকে আমার নিয়ে তেমন কোন ঘটনা নেই।
তবে যেই ব্যাপার টা আমার মনে সবসময় থাকতো, আর তা হলো, যে আমার স্ত্রী হয়ে আসবে মানে আমার রানীসাহেবা, তার জন্যই সব ভালোবাসা যত্নে গুছিয়ে রাখবো, হ্যা রেখেছিলাম ও। প্রতিরাত শুধু আমার রানীসাহেবার কথা ভেবে মুচকি হেসে ঘুমাতাম। আবার সকালে উঠেও তার কথাই চিন্তা করতাম যে এমন সকালে আমি ওকে ঠিক কি কি করবো, কেমন ভাবে হাসাবো, ওর হাসি মুখ দেখবো।
কল্পনায় আমি আমার রানীসাহেবার সাথে কথা বলতাম। ব্যাপার টাকে সাইকো বলতে পারেন৷ বাট আমার কাছে সুন্দর কিছু মুহুর্ত মনে হতো।
শুধু ভাবতাম, কবে আমি আমার রানীসাহেবা কে পাবো?? এখন ও কোথায় আছে?? কি করছে?? আচ্ছা ও কি আমার কথা ভাবছে??
প্রশ্ন গুলো মনে মনে করতাম আর নিজেকে নিজেই বলতাম তুই একটা পাগল, সাইকো জানিস হা হা হা। তবে আমি এইটা চাইতাম যে, যার জন্য আমি কোন মেয়েকে কখনো এক্সচেপ্ট করিনি, সে যেনো আমার মতোই হই, মানে কোন সম্পর্কে যেনো সে না জড়ায়। ভাবতাম, আমার সব ভালোবাসাটুকু আমি যেমনে ওকে দিবো, ঠিক একিভাবে ওর সবটাজুড়ে শুধু আমি থাকবো।
এর কয়েক বছর পরেই আমি আমার রানীসাহেবা কে পেয়ে যায়। হ্যা, আমার রানীসাহেবা, যাকে নিয়ে আমার পুরো ভাবনা, যাকে নিয়ে আমার পুরো স্বপ্ন, আমার ভালোবাসা।
বাসর রাতে, রুমেতে ঢুকে বেডের চারপাশে শুধু হাটছিলাম। শুধু এটাই মনে হচ্ছিলো যে, আমি পেয়েছি, আমার রানীসাহেবা কে।
কিছুসময় পায়চারী করে, বউ এর সামনে গিয়ে দাড়ালাম,
— নামো…( ওকে বেড থেকে নামতে বললাম)
— ও ত আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে, রাগে না কিন্তু। অবাক, আর ভয়ে।
— কি হলো নামো…( আমি)
— কিছু না বলে চুপচাপ নেমে, আমার সামনে দাড়ালো।
আমি আর এক সেকেন্ড ও ওয়েট না করে, ওকে কোলে তুলে নিলাম।
— এই এই কি, কি করছেন??( রানীসাহেবা)
— চুপ, কোন কথা হবে না। ( আমি)
— রানু চুপ করে গেলো, আর পরে যাবে ভেবে আমার গলাটা, ২ হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
আমি ত ২ ভাবে পাগল হয়েছিলাম, ১মোত ওর কন্ঠে, আর ২, আমার যেই স্বপ্ন টা ছিলো, এখন ঠিক সেইটাই হচ্ছে ভেবে,
আর কিছু না ভেবে ওকে কোলে করেই বাহিরে চলে এলাম। সিড়ি বেয়ে, যখন উপরে উঠছিলাম তখন ওর দিকে একবার তাকিয়ে দেখি ও আমার দিকে চেয়ে আছে, মলিন সে চাহনি, হইতো মায়া লাগছে জন্য, হা হা
ছাদেতে নিয়ে এসে, দোলনার উপরে বসায়ে দিলাম, তারপর ওর পাশে বসে পড়লাম তবে দোলনা তে না, ছাদের ফ্লোরেতে। তারপর ওর কোলের উপর মাথা রেখে চাঁদ এর দিকে তাকালাম।
কিছু সময় পরে, আমার মাথায় কারোর হাত এসে পড়লো, বুঝতে পারলাম আমার পাগলি টা আমার চুল গুলো নাড়ছে, মুচকি হেসে দিলাম, তারপর পাশে রাখা গিটার টা হাতে নিয়েই বাজানো শুরু করলাম,
— গান বলো,( আমি)
— আ, আমি??( রানু)
— হুম,( কিন্তু)
— কিন্তু আমিতো.. (রানু)
— গান পারো.. ( আমি)
— রানু হালকা হেসে দিলো, কিন্তু সেই হাসিটা যে আমার হ্রদয়ের মাঝখানে এসে লাগবে বুঝতে পারিনি। এত মিষ্টি হাসি ওর। আচ্ছা এই টা ত আমি আমার কল্পনা তে রেখেছিলাম না, কথাগুলো ভাবছিলাম আর গিটারে টুং টাং আওয়াজ করছিলাম, হঠাত
**অনেক সাধনার পরে আমি, পেলাম তোমার মন,
পেলাম খুজে এ ভুবনে আমার আপনজন,
তুমি বুকে টেনে নাও না প্রিয় আমাকে, আমি ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমাকে,**
এইটুকু বলেই থেমে গেলো রানু।
আমি হতবম্ব হয়ে ওর দিকে চেয়ে আছি, এতটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছি যে গিটার টাও বাজাতে ভুলে গেছি।
— আমার দিকে তাকিয়ে, হালকা হেসে, এইটা কিন্তু চিন্টিং হলো…
— আমি ঘোর টা থেকে বেরোয়ে, কেম্নে??
— আমিতো গায়লাম কিন্তু আপনি ত গীটার বাজালেন না..
— জিহবা তে কামড় দিয়ে, ইস রে সরি। ভুল হয়ে গিছে,
— মেয়েটা আবার হেসে দিলো।
আর আমি চেয়ে রইলাম ওর দিকে।
সকালে ঘুম থেকে রানু ওঠার আগেই আমি উঠে পড়ি, কারন আমার কল্পনায় থাকা কাজের মধ্যে এটি একটি।
উঠে ফ্রেস হয়ে এসে, রানুকে ডেকে তুললাম, ও ঘুমের জন্য ঠিকমতো আমার দিকে তাকাতেও পারছে না। আমি হেসে দিলাম।
তারপর ওকে কোলে করে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে বসিয়ে দিলাম, নিজে ট্রুথব্রাশে পেশ লাগিয়ে ওর মুখে দিতেই ও চোখ বড় বড় করে নিলো, হইতো এখন পুরো জেগে গিছে।
এবার জোরেই হেসে দিলাম।
ওয়াশরুম থেকে ওকে রুমে নিয়ে এসে বেডে তে বসায়ে দিলাম। ও শুধু আমার দিকে চেয়ে আছে, হইতো ভাবছে, এটা কি মানুষ নাকি??
ব্রেকফাস্ট নিয়ে রুমেতে ঢুকলাম,
ও চুপ করে আছে, আর আমি ওর নিরবতা দেখে মনে মনে হাসছি।
— শোনো….(আমি)
— জি, বলুন( রানু)
— আমায় তুমি বলবা, আপনি না হুম??( আমি)
— রানু হালকা করে মাথা নাড়ালো,
— আর তুমি আমার রানীসাহেবা, ( আমি)
— অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে, অদ্ভুত কথার ফল হইতো এইটা।
— হেসে দিলাম,
প্রতিদিন কলেজ থেকে বাসায় ফেরার পথে ওর জন্য গোলাপ নিয়ে যেতাম। ও রুম খুলে আগে গোলাপ দেখতে পেতো, আর ওর মুখের হাসিটা দেখা ছিলো আমার ভালোলাগার মুহুর্ত।
— মাঝখানে একদিন গোলাপ আনতে ভুলে যায়,
ওইদিন সারারাত ও আমার সাথে কথা বলেনি। অনেকবার সরি বলেছিলাম, তারপরেও কোন কাজ হয়েছিলো না। পরের দিন ডাবল এনে ওকে খুশি করেছিলাম।
ওর প্রয়োজনীয় কোন কিছু লাগলে আমাকে বলতো, কখনো অপ্রয়োজনীয় কিছুর জন্য আবদার করতো না। আমি ওকে ওর হাতখরচের জন্য কিছু দিতে চাইলেও নিতো না। শুধু বলতো, তুমি আমার ব্যাংক ব্যালেন্স, যখন লাগবে, তুমি আছোতো, নিয়ে নিবো।
পাগলি টা যে আমায় কতটা ভালোবাসতো সেটা প্রতিটা মুহুর্তে বুঝতে পারতাম, ক্লাস টাইমে বার বার কল দিতো, আমি একটুও বিরক্ত হতাম না বরং ভালো লাগতো এটা ভেবে যে, পাগলি টা এখন আমায় অনেক মিস করছে।
যেদিন ১ম জানতে পারি যে আমাদের দুষ্ট পরি আসবে, ওইদিন এতটা পরিমানে খুশি হয়েছিলাম যে ওকে কোলে নিয়ে পুরো বাড়িতে ঘুড়েছিলাম। আনন্দে যখন আমার চোখে পানি চলে এসেছিলো, ও তখন আমার চোখ থেকে পানি মুছিয়ে, আমার বুকের সাথে লেপ্টে রয়েছিলো,
আমি তখন ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি।
মাঝেমাঝে চেকাপের জন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম। একদিন ডাক্তার বললো, আপনার স্ত্রীকে যতটা বেশি সম্ভব কেয়ারে রাখবেন। ওনার প্রেগন্যান্সিতে প্রব্লেম আছে,
— আমার মুখ শুকায়ে গেছিলো ওনার এই কথা শুনে। রানুর দিকে তাকাতে দেখি ও হাসছে, আমার তখন রাগ উঠে যায়।
বাসায় এসে সারাদিন ওর সাথে কথা বলিনি। ও শুধু আমার পেছনে পেছনে একটু কথা বলার জন্য ঘুরেছে, কিন্তু আমি বলিনি।
শেষে সরি বলে কান্না করে দেয়, আর ফ্লোরে বসে পরে।
যেই আমি ওর মন খারাপ টাকে সহ্য করতে পারতাম না ওর কান্না দেখে আমার নিজের চোখেই পানি চলে আসে। ওর কাছে গিয়ে আমি শুধু সরি সরি বলে যায়,
একটু পরে ও আমার দিকে তাকিয়েই হেসে দেয়,
অদ্ভুত, পাগলি একটা বলে কপালে চুমু দিলাম।
OT র, রুমের লাইট অফ হয়ে গেলো। আমার মনের ভেতর কেমন যেনো ভয় ঢুকে গেলো।
এতক্ষণ ভাবনাতে ছিলাম জন্য বুঝতেই পারিনি, আমার পাগলি টা প্রায় ৫ ঘন্টা যাবত OT তে রয়েছে,
ডাক্তার বেরোতেই,
— আমার রানী কেমন আছে??( আমি)
— ডাক্তারের মুখ কেমন যেনো মলিন, আমার কাধেতে হাত রেখে, আই এম সরি। আপনার বাচ্চাকে বাঁচানো গেলেও আপনার স্ত্রীকে আমরা….
ডাক্তারের কথা শেষ করার আগেই আমি OT র রুমেতে ঢুকে যায়।
সাদা কাপড়ে আবৃত রানীর পুরো শরীর। পাশেতে নার্সের কোলে বাচ্চা টা কান্না করছে।
নার্স আমার দিকে তাকিয়ে,
বাচ্চাটার ভাগ্য টাতে মায়ের একফোঁটা দুধ ও জুটলো না, নার্সের চোখেতে পানি।
আমি আরেকটু এগিয়ে কাপড় টা সড়ায়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
তারপর হাত দিয়ে ওর মুখ টা ছুতেই সামনের সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে এলো।
আনিতা ডায়রিটা বন্ধ করে নিলো। চোখ থেকে পানি ঝড়ছে ওর। বাবার পাশে বই টা রাখতেই,
—কান্না করো না মামনি.. (রাজ)
— আনিতা বাবা বলেই রাজ কে জড়িয়ে ধরলো জোরে জোরে কান্না করছে আনি। রাজ ওকে সান্ত্বনা দিতে পারছে না। পারবেও না।
আজ প্রায় ১৮ টা বছর পার হয়ে গেলো তোমায় ছাড়া, রানীসাহেবা। ছাদেতে, দোলনার পাশেতে বসে দোলনার উপর মাথা টা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো।
ফিরে আসো না, আর একবার, আমার রানীসাহেবা। প্রতিদিনের মতো আজ ও চোখের জল বাঁধ মানলো না..