“তারপরে…
সে চলে যাবার দিন বেশি কথা হল না। একদিন হুট করেই আমাদের দরজাই এসে কলিং বেল চাপল। আম্মু গিয়ে দড়জা খুলে দিল। তাকে দেখে বলল, ‘আরে রাজ বাবা যে! এস ভেতরে এসে বস। তারপরে কি খবর বল?’
সে বলল, ‘আসলে চাচী-আম্মু আসি…’
আম্মু বলল, ‘সে কি বাবা, আসি মানে কি?’
সে শুকনো হাসি হেসে বলল, ‘আসলে একটু সমস্যা হয়েছে। বাড়িতে যেতে হবে। সম্ভবত পড়াশোনাটা আর হবে না, তারপরেও চেষ্টা করব, দেখি কি করা যায়…’
আম্মু বলল, ‘টাকা-পয়শার সমস্যা হলে বলবে বাবা। চেষ্টা করব পাশে থাকার। এতদিন পাশাপাশি থাকলাম, তোমাকে ছেলের মত মনে করতাম। অনেকের সাথেই থেকেছি, কিন্তু তোমার মত কোন ছেলে পাইনি।’
সে বাবাকে দেখে বলল, ‘চাচা আসি তাহলে। নিজের শরিরের দিকে খেয়াল রাখবেন। বেশি উত্তেজিত হবেন না। ঠিকমত ঔষধ খাবেন।
আব্বু প্রায় কাদো কাদো হয়ে বলল, কি সমস্যা হয়েছে বাবা, সেটা তো বললে না?’
সে কিছু বলল না। অসহায়ের মত কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকল। এদিক-ওদিক দু-তিনবার চোখ বুলাল। সম্ভবত তার চোখদুটো কিছু খুজছিল। কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত জিনিস না পেয়ে সে চোখ নত করল। আমি এতক্ষণ আড়ালে থেকে সব লক্ষ করছিলাম। সে বাবা-মা’কে পা ছুয়ে সালাম করল। আম্মু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করল। বাবা অসুস্থ মানুষ হয়েও তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। সে চলে গেল। বাবা-মা দুজনায় কিছুক্ষণ মন খারাপ করে সোফায় নিশ্চুপ বসে থাকল। যেন তাদের আপন কেউ বা কিছু হারিয়ে গেছে।
আমার নাম রিফা। রিফা তামান্না। বাবা-মায়ের ১ম মেয়ে। আমার ছোট আরেকটা বোন আছে।
এই ছেলেটা গত ৯ মাস আগে আমরা যে বিল্ডিংয়ের ৬ তলায় থাকি, সেই ফ্লাটেরই ৭ তলায় ভাড়া এসেছিল। ওটাই শেষ তলা। তারপরেই ছাদ।
ছেলেটার সাথে আমার বেশি কথা হয়নি। মাত্র ২ বার, না না ৩ বার কথা হয়েছিল। ১ম বার সে ভুল করে আমাদের দড়জায় এসে কলিং চাপে। আমি গিয়ে দরজা খুলে দেই। সে আমাকে দেখেই বলে, ‘সরি, ভুলে কলিং চেপেছি’ বলেই আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই দৌড়ে উপরে চলে যায়। ২য় বারে তারসাথে কথা হয়, আমি তাকে আম্মুর রান্না করা স্পেশাল বিরিয়ানি তাকে দিতে গেলে। আম্মু তাকে দিয়ে আসতে বললে, আমি তাকে দিয়ে দেই। ব্যাস, এটুকুই। আর ৩য় বারে কথা হয় ছাদে। একদিন বিকেলে গিয়ে দেখি সে ছাদে বসে সিগারেট টানছে। আমাকে দেখেই সিগারেটটা ফেলে দেই। তারপরে ধোয়াটা হাত দিয়ে বাতাস করে দূড় করার চেষ্টা করে। আমি এগিয়ে যেতেই সে অপরাধীর মত মাথা নিচের দিকে করে ফেলে। আমি কিছুই না দেখার ভান করে তাকে বলি-
-আপনার নাম কি?
-রাজ, রায়হান রাজ…
-হি হি, এভাবে সিনেমা স্টাইলে না বলে সরাসরি রায়হান রাজ ও তো বলতে পারেন…
-আপনার নাম কি?
-রিফা তামান্না।
ব্যস এটুকুই কথা হয়েছে তারসাথে। তারপরেও সে ঘর থেকে চলে যাবার পরে যেন বুকের ভিতরে ভেঙ্গে চূড়ে গেল। হাহাকার করে উঠল। অন্তরটা কেদে উঠল। আমি বুঝতে পারলাম, আমার জীবনের বিশেষ কিছু হারাতে চলেছি। কেন জানিনা, আমারও ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। কান্না পেল। আসলে তারসাথে মাত্র তিনদিন কথা হলেও মনে হত যেন সে আমার বহুবছর আগের চেনা কেউ। আপন কেউ, এতটা কাছের আর আপন যে তাকে ছাড়া যেন আমাকেই কল্পনা করা যায় না। তার একটা গিটার ছিল। সে ভালো গিটার বাজাতে পারত না। তেমন কোন সুরও ছিল না। তারপরেও কি এক অদ্ভুত সুরে যেন সে গিটার বাজাত। সেটা আমার মন কেরেছিল। প্রায়ই ছাদে বসে তার গিটার বাজানো শুনতাম, আর মন্ত্র মুগ্ধ হতাম। সে আমাকে দেখত, তারপরে চোখ বন্ধ করে আবার বাজানো শুরু করত।
সে প্রায়ই আমাদের বিভিন্ন উপকার করত, বাবাকে ডাক্তারের কাছে আনা-নেওয়া। ঔষধ এনে দেয়াসহ আমাদের পরিবারের অনেক কাজ। একদিন হঠাৎ বাবার বুকে ব্যাথা উঠাই আমরা যখন ঘরে চিৎকার চেঁচামেচি করছিলাম সেদিনই প্রথম সে আমাদের উপকার করে। তারপর থেকে সে বাবা-মা’য়ের খুব কাছের, আদরের কেউ হয়ে যায়। আমাদের বাসাতে বিশেষ কিছু রান্না হলেই মা তাকে খাওয়াত।
আমার কেন জানিনা মনে হল, তার চোখদুটো হইত আমাকে খুজছিল। হইত কিছু বলবে, যেটা আমার মন আসা করে বসে আছে। আসলে তারপ্রতি আমার মায়া জন্মে গেছে, তাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি।
আমি গিয়ে তার রুমের দড়জায় দাড়ালাম। সে সবকিছু রেডি করে বেরুনোর প্রস্তুত হয়েছে। আমাকে দেখেই বিছানায় বসে পড়ল। কি যেন ভাবল! বুক পকেটে হাত দিল, আবার খালি হাত বের করল। এগিয়ে এসে বলল…
-ভাল থাকবেন, আমার কোন কথাই বা আচরণে দুঃখ-কষ্ট পেয়ে থাকলে মনে কিছু নিবেন না। নিজেদের খেয়াল রাখবেন। আপনার বাবার খেয়াল রাখবেন, নিজেদের কখনো দুর্বল অার একা ভাববেন না। সাহসের সাথে সব কাজ করবেন।
আমি হতাশ হয়ে গেলাম। মূহুর্তের জন্য বোবা হয়ে গেলাম। পাথরের মূর্তির মত দাড়িয়ে থেকে তার চলে যাওয়া দেখলাম। আমার ভিতর থেকে কেউ একজন চিৎকার করে বলছিল, যেও না প্লিজ। আমি তোমাকে ভালবাসি। এই ছেলে শুনছ না কেন? আবার কবে ফিরবে? আমি অপেক্ষায় থাকব কিন্তু…
আমার কথাগুলো মুখ দিয়ে বের হল না। সেটা মনের ভিতরই তিনচারবার প্রতিধ্বনি হল। আমি দৌড়ে গিয়ে রুমে ডুকেই দড়জা বন্ধ করে চিৎকার করে কাঁদতে থাকলাম।
দীর্ঘ ৬ মাস পরের কথা। আব্বু-আম্মুসহ আমরা কেউই তার কথা ভুলতে পারিনি। তারমত নতুন কাউকেও পাইনি। তবুও দিন থেমে থাকেনি। সে তার আপন গতিতেই চলেছে। রাজের জায়গা নতুন ভাড়াটে দখল করেছে। তাদের সাথে তেমন কথাবার্তা হয়না। আমিও ছাদে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। ছোট বোনটা নতুন ক্লাসে ভর্তি হয়েছে।
তো সেদিন বাবার ঔষধের জন্য খুব তাড়া করে রাস্তা দিয়ে হেটে ফার্সেসির দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ডেকে উঠল-
-রিফা…
কণ্ঠটা খুব বেশি শুনিনি। তবে আমার কাছে জন্মজন্মান্তরের পরিচিত মনে হল। মনে হল, আমার আপন কেউ, একেবারে খুব কাছের কেউ আমাকে ডাকছে। খুব আদর আর ভালবাসা মিশিয়ে ডাকছে। আমার অন্তর যেন এই ডাকটার জন্য বহুকাল ধরে অপেক্ষা করছিল। আমি প্রথমে পিছু ফিরে তাকালাম। তারপরে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। মনের ভুল ভেবে আবার সামনে চলতে যাব, ঠিক তখনই কিছু মানুষের হই,হুল্লোর, চেঁচামেচি আমার কানে এসে পৌছাল। আমি দেখলাম, কিছু লোক জটলা বেধে ঘিরে ধরেছে। লাল বর্ণের রক্ত বন্যা বইছে। ছুটে গেলাম সেখানে। গিয়ে যেটা দেখলাম, সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার চারিপাশ অন্ধকার হয়ে আসল, মূহুর্তের জন্য বয়ড়া হয়ে গেলাম। বাইরের কোন শব্দ আমার কানে পৌছাল না। আমি আরেকবার বাকরুদ্ধ হলাম, মূর্তির মত হয়ে গেলাম। দৌড়ে গিয়ে ছেলেটার নিষ্প্রাণ মাথা আমার কোলে রাখলাম। ততক্ষণে তার দেহে প্রাণ নেই। রাজের বুক পকেটে সাদা কিছু বেরিয়ে পড়েছে। আমি সেটা হাতে নিয়ে দেখলাম একটা চিঠি। অদূড়েই তার গিটারটা পড়ে ছিল। চিঠি আর গিটারটা নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম। কাউকে কিছু ববললাম না। আমাদের সম্পর্কটা অন্তরের, সেটা এ পৃথিবী মানবে না। আমার জামায় রাজের শরিরের তরতাজা রক্ত। বাড়িতে গিয়ে বললাম, রাজ ফিরেছে…
মা-বাবা খানিক খুশি হল। খুব আপন, প্রয়োজনীয় কিছু হারানো জিনিস ফিরে পেলে যেমন মুখে হাসির আভা ফুটে ওঠে। তাদের মুখে সেই আভা দেখা গেল।
রাজের গিটারটা মায়ের হাতে দিয়ে বললাম, এটাই রাজ, আর কখনো সে ফিরবে না। সে না ফেরার দেশে চলে গেছে…
মূহুর্তেই তাদের হাসিমাখা মুখ অন্ধকার, কালো মেঘের নিচে চাপা পড়ল!
আমি কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দৌড়ে রুমে গিয়ে দড়জা বন্ধ করে দিলাম। চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলাম……
প্রিয় রিফা,
কি বলে তোমাকে সম্বোধন করব আমি জানিনা। প্রথমেই দুটো ভুল করেছি, তার জন্য ক্ষমা করবে। প্রথমত প্রিয় বলে, আর দ্বিতীয়ত ‘তুমি’ বলে। তুমি বলাতে আবার রাগ কর নি তো? আসলে কিভাবে বলব, কি বলব আমি বুঝতে পারছি না। মাত্র ৩ মাসের ব্যবধানে তোমাকে এতটা ভাল লাগবে, এতটা নিজের করে ভাবতে শুরু করব, এভাবে আপন করে ফেলব আমি ভাবতেই পারি নি। কি ভাবছ? তোমার সাথে তো আমার কথাই হয়নি, তাই না?
না, আসলে তুমি জানো না, রোজই তোমার সাথে আমার কথা হয়। আমি তোমার সাথে কল্পনায় কথা বলি। তুমি যখন আমার গিটার বাজানো শুনতে আস, আমি জানি আমি বাজাতে পারি না। তারপরেও সর্বোচ্চ চেষ্টা করি ভালো করার। মাঝে মাঝে চোখ খুলে লুকিয়ে তোমাকে দেখি। মাঝে মাঝে কোন কাজ ছাড়াই তোমাদের রুমে যাই। যেদিন গিয়ে তোমাকে দেখি না, সেদিন আমার মন খারাপ হয়ে যায়। কি ভাবছ? কি আবোল-তাবোল বকছি তাইনা? আসলে আমার লেখার মত, বলার মত আর তেমন কিছুই নেই। আমি এমনিতেই কথা কম বলি। কিন্তু, তোমার সাথে কল্পণায় কথা বলা শুরু করলে শেষ করতে মন চাই না। আমি তোমাকে ভালবাসি, এবং তোমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাই। মূত্যুর আগে এবং পরেও তোমার সাথে থাকতে চাই। এই চিঠির উত্তর দিতে তাড়াহুরো করার কিছু নেই। তুমি ভেবে চিন্তেই উত্তর দিও। চিঠির উত্তর না বোধক হলে উত্তর দেয়ার প্রয়োজন নেই। দোয়া করি সারাজীবন সুখে থাকো, ভালো থাকো…
ইতি, রাজ, রায়হান রাজ…
০৭-০৮-১২ ইং
তারিখটা রাজ ভাড়া আসার প্রায় ৪ মাস পরের। রিফা কাদছে অঝোড়ে। সে চিৎকার করে বলতে চাই, চিঠির উত্তর লিখতে চাই, হ্যা ভালবাসি…
কিন্তু সে জানে না চিঠিটা কোন ঠিক কোন ঠিকানায় পাঠালে রাজের কাছে পৌছাবে…