বায়ুগ্রস্ত

বায়ুগ্রস্ত

– দেখ আদুরি একদম গলাবাজি করবি না। খুব চোপা হয়েছে তোর।

– ইঃ। আমার নাকি চোপা। আর উনি যে দুবেলা আমায় মুক করচেন তার বেলা ধুনো।

– কি সাঙ্ঘাতিক মিথ্যে কথা গো। তুই যে দুবেলা বাসন–কোসনে এঁটো লাগিয়ে রাখছিস। কাল এমন ঘর মুছেছিস পা’টা হড়কে আরেকটু হলেই –আমি বলেই এমন কাজ নিচ্ছি রে, অন্য বাড়ি হলে না ঝেঁটিয়ে দেবে।

– দ্যাখো পিসি ওসব ঝ্যাঁটানো আমায় শুনিও না বলচি। আমি বলেই দয়া করে করচি তোমার বাড়ি। নইলে তোমার যা ছুঁইছুঁই বাই কেউ করবে নাকো। এই তো সেদিনই সবু আমায় বলল “আদু, তুই বলেই ঐ বুড়ির বাড়ি কচ্চিস।আমি হলে পাত্তুম না।”

– কি? আমি শুচিবাই? সবু মানে তো ওই খগেন মাস্টারের বাড়ি কাজ করে যে বৌটা। ওতো বলবেই রে। মাস্টারের বৌটা যা নোংরা। ওরাই পারে ওই কাজ নিতে। আমি বাপু খুব পরিষ্কার। – একি? একি? কড়াইটা তো চাপ দিয়ে ঘষলিই না। ওই জন্যই পোড়াটা ওঠে না।

ঝগড়ার বিষয়টা মোটামুটি রোজই প্রায় একরকমের। দুবেলা না হলেও একবেলা তো বটেই। কোনোদিন একটু বাড়াবাড়ি হলে ওবেলা দুপক্ষই মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। রোজ সকালের এই ঝগড়াটায় কেউ কাউকে রেয়াত করে না। বয়স কাননবালার শরীরে থাবা বসালেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কণ্ঠস্বরটিকে ছাড় দিয়েছে। গলার জোরটা তার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আর আদুরিকে যে ওর বস্তির লোকেরা ঝগড়া লাগলে নিজের দলে টানার জন্য লড়ালড়ি করে, সে তো ওর বাজখাই গলাটারই জন্য। ঈশ্বর এত নির্দয় নন। অন্য দিকে মারলে একটা দিকে তিনি পুষিয়েই দেন। এই বিশ্বাসটুকুর জবরদস্ত নমুনা আদুরির ঐ গলা। ওপরওলার দেওয়া ক্ষমতাটুকু ব্যবহারে কোনও কিপটেমি নেই দুপক্ষেরই। আর ওদের এই ঝগড়াটাকে যোগ্য সঙ্গত দেয় বাগানের ছাতারেগুলো। গোটা বিশেক ছাতারে রোজই বাগানে আসে। নিজেদের মধ্যে ক্যাচরম্যাচর করে। ছাতারে আর মানুষের সমবেত ছাতারেবাজি বাড়ির বাইরের রাস্তা থেকেও শোনা যায়। রোজের পথচারীরা নির্বিকার মুখে চলে যায়। পুরনো ঝগড়াটায় তারা আর খোরাক পায় না। নতুন কেউ বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে থমকে যায় একটু।– বিরক্ত হয় এ বাড়ির মানুষগুলো। মানুষ বলতে সোম থেকে শুক্র কানন আর দিবাকর– বাড়িরকর্তা, আর শুক্রবার রাত থেকে সোমবার ভোরটুকু পর্যন্ত ওদের ছেলে আর বৌমা। দুজনেই কলকাতাবাসী। প্রাইভেট কম্পানির চাকুরে। সপ্তাহের ছুটির দিন দুটো বাড়িতেই কাটিয়ে যায়। দিবাকরও অবসর নিয়েছেন প্রায় চার বছর হলো। নিরীহ নিপাট শান্তিপ্রিয় মানুষ। প্রতিদিনের এই চেঁচামেচিটা ব্যাজার মুখে শোনেন। কখনো-সখনো গিন্নীকে বলেন ‘‘আহ্ কানু তুমিই থামো একটু, ভদ্রলোকের বাড়িতো নাকি!” বলেন বটে, কিন্তু যার উদ্দেশ্যে বলা তার কান পর্যন্ত ঐ কথাটুকু পৌঁছয় বলে মনে হয়না। পৌঁছলেও গুরুত্ব পায়না মোটেই।

 

গজর গজর করতে করতে কানন আলুর চুপড়িটা নিয়ে বসেছে, শুক্তো হবে। প্রতিটা সমান মাপের কাটতে হবে। কাননবালার মা ওকে শিখিয়েছিলেন যে রকম তরকারি সেই অনুযায়ী সবজি কাটা।নইলে স্বাদ হয় না রান্নায়। ছেলের বৌ ছুরিতেই অভ্যস্ত। আর এত মাপামাপি করে কাটতেও পারে না। তা হোক, বৌমার গুণ প্রচুর। সে নিয়ে শাশুড়ির চাপা গর্বও আছে একটু। কাননের গজগজানির কারণটা অন্য। কাল সকাল থেকে আদুরি কাজে আসেনি। দুপুরটা কোনোরকমে সেদ্ধ দিয়ে উতরে গেছে। বাড়ি আসার সময় রাতের খাবারটা ছেলে কিনেই এনেছিল। আজ শাশুড়ি-বৌমা মিলে রান্না করছে। সারা সপ্তাহ তো অফিস যেতে হয়। এই দুটো দিন যা ছুটি পায় একটু মেয়েটা। -“তাও কপালে নেই গো। সব হলো গিয়ে ঐ আবাগীর বেটির জন্য।”

– ওমা কি বিড়বিড় করছেন?

– কি আর। ভাবছি ওই আদুরির কথা। মুখপুড়ি ইচ্ছে করেই কাল থেকে আসেনি। জানে তো দাদা-বৌদি আসবে, মেলা কাজ। খুব দেমাক হয়েছে বেটির।

– আঃ মা ছাড়ুনতো, দুজনে মিলে ঠিক সামলে নেব। ওর হয়তো কোনো প্রবলেম–

– হাতি হয়েছে। কিস্যু হয়নি। তোমার নরম মন তাই সবাইকে সাদা দেখ বৌমা। যখন যা চাইছে তাইতো দিচ্ছি। এই তো শীতেই ওকে চাদর দিয়েছি, সঙ্গে ওর ছেলেটাকে হাফ সোয়েটার একটা। দেখুক গিয়ে কোন বাড়িতে আমার মতো দেয়। ওদের জাতটাই ওরমপারা। নেমকহারাম।

– ছিঃ মা এরকম বলবেন না। অভাবে পড়ে লোকের বাড়ি কাজ করছে। তা বলে কি ওদের সুবিধা অসুবিধা থাকবে না। হয়তো ওর বাচ্চার শরীরটরীর খারাপ হয়েছে।

ধমক খেয়ে কানন চুপ করে যায়। ভেতরে ভেতরে গজরাতে থাকে।তার বাড়ির লোকগুলো একটু বেশীরকমেরই ভালো মানুষ। নেহাত সে আছে। নইলে কবেই সংসার লাটে উঠত।যেমন ছেলে, বৌমাটাও জুটেছে ঠিক তেমনি। সব মানুষই নাকি ওদের কাছে সমান। বৌমার তো আবার কি সব নারী কল্যান সমিতি-টমিতিও আছে। ওই মেয়েদের উন্নতির জন্য নানারকম কাজটাজ হয় নাকি। মনটা খুব বড় মেয়েটার। কত মানুষের কথা ভাবে। কাননের তো নিজের সংসারটুকুর বাইরে অন্য কথা ভাবার সময়ই হয়না।- বৌমার প্রতি গভীর স্নেহে তার মনটা আর্দ্র হয়ে ওঠে। মনের আর্দ্রতা মেজাজটাতেও খানিক প্রলেপ বুলিয়ে গেল।

 

হাঁ করে আদুরির দিকে তাকিয়ে আছে কানন। বিস্ময়ের ঘোর এখনো কাটেনি। সকালে ডোরবেলটা বাজতে দরজাটা খুলে কাননের একটু সময় লেগেছিল চিনতে।-এক মাথা জ্বলজ্বলে সিঁদুর, গায়ে নতুন সুতির ছাপা, গলায় নকল সোনার চেন। ‘কে ?’ –ওমা এ যে আদুরি! এই সাত বছরে আদুরির এমন সাজগোজ একদিনের জন্যও দেখেছে বলে তার মনে পড়ে না। কপালের এক ফোঁটা ম্যাড়ম্যাড়ে সিঁদুর, সেলাই করা পুরনো শাড়ি, শুকিয়ে যাওয়া হাত দুটোয় বেমানান ঢলঢলে হলদে ছোপ পড়া শাঁখা -আদুরির এই ছবিই এত দিন ধরে কাননের চোখে ধরা আছে। আজকে হঠাৎ এই বেশে দেখে সে হকচকিয়েছে। সব থেকে অদ্ভুত হলো আদুরির মুখে লেগে থাকা নতুন কনের লাজুক হাসিটুকু। খড়খড়ে মেজাজের রুখু স্বাভাবের আদুরিকে খুব কমই হাসতে দেখা যায়। আর লজ্জা নামক বস্তুটার সঙ্গে যে ওর কস্মিনকালেও কোনো সম্পর্ক ছিল না, সে সম্পর্কে কানন প্রায় নিশ্চিত ছিল। যায় হোক, বেশ লাগছে দেখতে। – আদুরির বাজখাই গলাটায় তার চেতনা এল।

– রাগ করেছো গো পিসি কামাই করলুম বলে ?

– কি ব্যাপার রে?

কাননের গলায় ঝাঁজ নেই বরং একরাশ কৌতূহল।

– আমার সোয়ামী ফিরে এয়েচে গো। সেদিন কাজ সেরে ঘরে গিয়ে দেখি দাওয়ায় বসে। আমি তো হাঁআআআ। ভাবলুম সপন-টপন দেখছি বুঝি।

খুশি উপচে পড়ছে আদুরির মুখটায়। প্রায় বছর আটেক আগে তিন বছরের ছেলে আর বৌকে ফেলে পালিয়ে ছিল লোকটা। কোনো খোঁজ খবরই ছিলনা এতদিন।- প্রথম কাজে ঢুকেই কাননকে একদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল কথাগুলো।

– তা হ্যাঁ রে এতদিন ছিল কোথায় ?

– সে সব কথা আর জানতে চায়নি কো। নিজেই বললে কোন নাকি সার্কাস পাটির সঙ্গে ভিড়ে গেছিল। এতগুলো বছর ওদের সাথেই ঘুরেছে। আমি আর খোঁচায়নি। এতদিন পরে লোকটা ঘরে এয়েচে। ঝুপড়িতে সবাই বলচে “আদু রে তোর সিঁদুরের জোর আছে মাইরি।” তা আমি তো কম দেবতার কাছে মানত করিনি। ঠাকুর এতদিনে চোক তুলে চাইলেন।

ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে নাক টেনে আঁচলে চোখ মুছতে থাকে আদু। কাননের মনে কিন্তু একটা খোঁচ লেগেই থাকে। কৌতূহল মেটে না তার।

– তা এতদিন পরে ফিরে এল যে ?

ফ্যাঁচফ্যোঁচটা থমকায়। গলায় ঝাঁঝ মিশিয়ে বলে-

– এ আবার কি কথা গো পিসি? ঘরের মানুষ ঘরে ফিরবেনা তো যাবে কোতা শুনি।বৌ ছেলে ফেলে ঘর ছেড়েছিল। এতদিন খোঁজটুকুন ছিল না কোনো। এখন মনে পড়েছে তাই ফিরে এয়েচে। ছেলেকে জড়িয়ে ওই জোয়ান মানুষের সে কি কান্না। আমায় বললে “আদু ভুল করে ছিলুম এবার পাশ্চিত্তির করব, আমাকে মাফ দে।” এই শাড়িটা তো ছেলের বাপই দিল।

হাসির আতিশয্যে মুখের থেকে বড় সাইজের গুটখা চর্চিত দাঁতগুলো ঠেলাঠেলি করে বেড়িয়ে আসছে।

আদুরি ঝাঁটা হাতে কাজে লেগে যায়। কনক খানিক অন্যমনস্ক। এমনকি খেয়াল পর্যন্ত করলনা যে সোফার কোনটায় বে-আক্কেলে টিকটিকির ইয়েটা ঝাড়ু দেবার পরেও পড়েই আছে। অন্যদিন হলে ওই জিনিসটুকু নিয়ে কুরুক্ষেত্র বেধে যায়। আজ কারোরই ঝগড়া করার মেজাজ নেই। বাগানের ছাতারেগুলো পর্যন্ত এই হঠাৎ শান্তি চুক্তিতে খানিক মিইয়ে ছিল। রোদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ানো ভাবটা কাটিয়ে নিজেদের ক্যাঁচাকেঁচিতে মন দিয়েছে।

 

হটব্যাগটা হাঁটুর উপর চাপিয়ে দোতলার ব্যালকনিতে বসে আছে কানন। মুখটায় একরাশ বিরক্তি। এখান থেকে খগেন মাস্টারের বাড়ির সদর দরজাটা দেখা যায়। সবু কাজ করে বেরোলেই হাঁক দেবে। ওর সঙ্গে আদুরির খুব ভাব। ব্যাটা কাল বিক্কেল থেকে ডুব মেরেছে। সকালেও না আসাতে কাননকে সব কাজ করতে হয়েছে। অতগুলো বাসন মাজতে গিয়ে কোমর হাঁটুর ব্যাথাটা বেড়েছে। দিবাকর আলুসেদ্ধ মসুরসেদ্ধ আর ভাতটুকু করে নিয়েছে তাই দুপুরটা খাওয়া গেছে। নইলে যে কি—ওই সবু বেড়িয়েছে। কানন হাত বাড়িয়ে ডাকে ‘‘ও সবুউউউ সবু—এদিকে।”

নিচের বারান্দায় প্লাস্টিকের টুলে সবুকে বসতে দেওয়া হয়েছে। এঁটো বাসনমাজা কাপড়। কাঠের চেয়ার জল দিয়ে ধুলে নষ্ট হবার সম্ভাবনা। প্লাস্টিকে সে সমস্যা নেই। সবুর হাতে সুদৃশ্য চীনামাটির প্লেটে চানাচুর দুটো নারকেলনাড়ু একটা করে ক্ষীরকদম আর প্যাঁড়া। প্লেটটা যে এরপর বাতিলের খাতায় পড়বে সে তো বলা বাহুল্য। কিংবা আদুর কপালেও জুটতে পারে।

– তুমি বরং একটা চিকচিকি দাও পিসি। এগুলো বাড়ি নিয়ে যাই। অবেলায় গুগলির ঝাল দিয়ে মেখ্যে আর এক থালা ভাত খেয়চি। গলা দিয়ে আর কিছু নামবে না।

– আচ্ছা যাবার সময় দেব। আরও চারটে বাতাসা দিয়ে দেব নাহয়, তোর ছেলেরা খাবে।

গৌরচন্দ্রিকা শেষ। কানন আসল কথাটা পাড়ল। ধ্যানাই-প্যানাই করাটা কোন কালেই ওর আসে না।

– হ্যাঁরে আদুরি তো কাল থেকে কাজে আসেনি। কদিন আগেই বর এসেছে বলে কামাই। এরকম তো আর চলেনা।

– সে কি গো তুমি কিছু শোনোনি? গোটা তল্লাটে তো এখন এই কথাই চলছে।

– কেন রে? কি হয়েছে? আর শুনবোই বা কোত্থেকে? বুড়ো বুড়ি তো সারাদিন ঘরেই বসে আছি।

সবু টুলের উপর ঠ্যাং তুলে জমিয়ে বসেছে। মুখ খানিক সামনের দিকে ঝুকিয়ে আয়েশ করে খাপ খুলল –

– আদুর বরকে তো কাল পুলিশে ধরেছে।

– সেকি রে! কেন?

– পরশু রাতে নতুন গেরামের স্যাকরাদের বাড়ি ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। আরও চার জন ছিল ওই দলে। থানাতে নাকি আগে থাকতেই জানা ছিল। পুলিশ ঘাপটি মেরেছিল। বিকেলে ওর বর কাজ আছে বলে বেড়িয়েছিল। সকাল হতেও ফেরেনি দেখে ভাবল কি নিঘ্ঘাত কোথাও মাল টেনে পড়ে আছে। বেলা গড়ালেই পেটে টান ধরলে ঘর আসবে। তাই কাজে এয়েছিল। ফিরে গিয়ে দেখে ঘরে পুলিশ। আদুকেও থানায় নে গেছে।

– কেন? ও কি করেছে? ছাড়েনি এখনো?

কাননের গলার উৎকণ্ঠায় সবু অবাক হয় একটু। মনে মনে ভাবে বুড়ির যত ঢং। কাজের লোক বৈ তো নয়। মুখে বলে–

– কি আর বলব পিসি সবই গরিবের কপাল।

– ওর আত্মীয়স্বজন নেই কেউ, থানায় গিয়ে ছাড়িয়ে আনবে? তোরা তো খুব বন্ধু। যা একবার ।

সবু টুল থেকে প্রায় ছিটকে পড়ে।

– আমি! আমি গিয়ে কি করব? ও সব ঝামেলায় কেউ জড়ায় নাকি? চিকচিকিটা দাও পিসি, এক ঘর কাজ বাকি এখনো।

– আহা বোস না একটু। আসল কথাটাই তো বলা হয়নি এখনো।একটা ভালো কাজের মেয়ে যোগাড় করে দে মা। এরকম করে তো আর চলে না। সে এখন কবে ছাড়া পাবে।

সবু আবার টুলটা টেনে বসে। মুখে বেশ হনু গোছের ভাব। গলাটা একটু ঝেড়ে নেয়।

– মেয়ে তো ভালো পাওয়া মুশকিল, তবে তোমার জন্য আমি জোগাড় করবোখন। দেখি কাল সকালেই নে আসব। চিকচিকিটা দাও আর তিরিশটা টাকা ধার দাও না গো পিসি। একেবারে বাজার করে ফিরব। কালকেই দিয়ে দেব।

কানন ভেতর থেকে প্লাস্টিকের প্যাকেট আর টাকাটা এনে দেয়। সে বিলক্ষণ জানে টাকাটা আর ফিরবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে সে দুঃখটা তাকে বিচলিত করছে না খুব একটা। সে ভাবছে আদুরিকে থানায় ধরে রাখার কারণটা কি! তার সাংসারিক বুদ্ধিতে সে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। উঠে গিয়ে টুলটাকে স্নান ঘরের কলের নিচে নামিয়ে রাখে। কোন পথে যে অশুচি সংসারে ঢুকে পড়ে বলা যায় না।

কথা রেখেছিল সবু। সম্ভবত তিরিশ টাকার গুণেই, সকালবেলায় একটা মেয়েকে নিয়ে হাজির। তখন থেকেই কাজে লেগে পড়ল। কানন যদিও বলে রেখেছে আদুরি এলে মেয়েটাকে কদিনের টাকা মিটিয়ে দেবে। কিছুটা উপরিও দেবে। একথা শুনে সবু বলেছিল- ‘‘সে কি গো পিসি অন্য বাড়িতে তো আদুকে আর রাখবে না বলছে। কাল তো ওই উকিল বৌ আমায় ডেকেছিল। বলল ঝি না পেলেও ওই আপদকে আর রাখবে না। কবে কি হয়। হয়তো যার বাড়ি কাজ করবে তার বাড়িতেই সিঁদ কাটবে।’’– কানন বিরক্ত হয়ে ঠাকুরঘর যাবার নাম করে সবুকে কাটিয়েছে। মনের মধ্যে একটা খিচিবিচি চলছে।

সন্ধ্যাবেলায় শাঁখটা বাজিয়ে সবে ধুয়ে রেখেছে অতি পরিচিত বাজখাই গলায় পিসি ডাকটা শুনে হাঁটুর ব্যাথা ভুলে কানন তড়িঘড়ি নিচে নেমে এল।

এই দু দিনে আরও রোগা হয়ে গেছে শরীরটা। হাতের শাঁখা জোড়া আগের থেকেও বেমানান ঢলঢলে, শুকনো মুখটার মধ্যে চোখ দুটো আরো শুকনো।

– তুমি নতুন লোক রেখেছ পিসি ?

– খেয়েছিস কিছু? ও বেলার ভাত আর চচ্চড়ি আছে। খাবি?

– বিকেলে থানা থেকে ছাড়তে ঝুপড়িতে গিয়ে শুনলুম তুমি নাকি নতুন লোক রেখেচ। মাসিমাদের বাড়ি আগে গেসলুম। লোক পায়নি তাও আমায় রাখবেনে। আমার কি দোষ বলোতো ?

আদুরির বাজখাই গলাটা প্রথমবার কাননের কানে খুব করুণ আর দুর্বল শোনালো। সে ভেতর থেকে থালায় ভাত নিয়ে আসে। অস্বাভাবিক দ্রুততায় আদুরি ভাতটুকু গিলতে থাকে।

দুজনেই চুপ করে আছে। বোধহয় নিজেদের কথাটুকু বলার প্রস্তুতি । আদুরিই বলল-

– তাইলে কাল সকালে আসি পিসি ?

– আসবি? কিন্তু ওই মেয়েটাকে যে লাগিয়ে দিয়েছি রে।

– সে আমি জানিনেকো। তোমরা এরম করলে আমি কোথায় যায় বল দিকিনি। ও বাড়ির মাসিমা বলল আমি নাকি কোনোদিন ওদের বাড়িতেও সব্বোনাশ ঘটাব। মা কালির দিব্বি পিসি আমি এসবের কিচ্ছু জানতুম না। ভেবেছিলুম আমার কপাল ফিরেছে। কিন্তু এই মিনসে যে আমার কপাল পোড়াতে এয়েচে সে আমি টের পাইনিকো। যাকে ঠাকুর বানালুম সে আমায় ঠকালে। চুরি না করেই জেলে থাকলুম। মাসিমা দূর দূর করছে। এখন তুমিও।

মুখ নিচু করে আদু কাঁদতে থাকে। হাঁটু দুটো ভাঁজ করে বুকের কাছে ঠেকানো। কাননের কষ্ট হয়। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ওর যে জেলের কাপড়। ছুঁলে আবার স্নান করতে হবে। মুখে বলে ‘‘বেশ কাল সকালে আয় দেখছি।’’

কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে কানন বিছানা ছেড়ে উঠে এসে ব্যালকনিতে বসে। মনের মধ্যে চলতে থাকা টানাপোড়েনটা ঘুমোতে দিচ্ছে না। রাস্তার আলোগুলো রাত জেগে ডিউটি দিচ্ছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। অন্যদিন হলে এই নিশ্চুপ নিস্তব্ধতাটুকু ওর কাছে অসহ্য লাগত। ঘুমের সময়টুকু বাদে সে সারাক্ষণই কারো না কারোর সঙ্গে বকতে থাকে। কিন্তু আজকে এই শব্দহীন নির্জনতা তাকে খানিকটা স্বস্তি দেয়। সন্ধ্যের পর থেকে ঘুরেফিরে কেবলই আদুরির শুকনো মুখটা ভেসে উঠছে। ওর করুণ চোখ দুটো, গলার অসহায় আর্তিটুকু।

দিবাকর পাশের ঘর থেকে সব কথাই শুনেছিলেন। আদুরি চলে যেতেই কাননকে বলেছেন—“ওকে আর রাখার দরকার নেই কানু। নতুন মেয়েটা তো ভালোই। আগ বাড়িয়ে ঘরে ঝামেলা ঢোকানোর দরকার কি।’’ রাতে ফোনে বৌমারও প্রায় একই সুর। সে শাশুড়িকে বুঝিয়েছে ওদের নাকি কাজের অভাব নেই।ঠিক কিছু জুটিয়ে নেবে। আদুরিকে নিয়ে ভাববার কোন মানেই হয় না।– কানন খুব অবাক হয়েছে। ভেবেছিল বৌমা হয়তো আদুরির সমস্যাটা বুঝবে। কানন কাউকেই বোঝাতে পারেনা। তার সাংসারিক বুদ্ধি দিয়ে সে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনা, যে মেয়েটার কোনও দোষই নেই তাকে সবাই মিলে বাতিল করে দেবার কারণটাই বা কি। সব্বাইকে যেন একটা ছোঁয়াচে বাতিক রোগে ধরেছে। ছেলেকে নিয়ে একলা মেয়েটা তো না খেতে পেয়ে মরবে। অথচ এই কথাটা দিবাকররা কেউ বুঝছেনা। তবে কাননও বরাবরের একরোখা মানুষ। সে ঠিক করে দিবাকরকে রাজি করিয়েই ছাড়বে। বিয়ের পর থেকে বৌয়ের জেদের কাছে তিনি বরাবরই নতি স্বীকার করেছেন। কালকেও যে করবেন সে বিষয়ে কোন সংশয় নেই। –ব্যালকনি থেকে উঠে ঘরে আসে কানন। চোখ চলে যায় জানলার ধারে রাখা আরামকেদারার দিকে । পুষ্ট চেহারার একটা টিকটিকি সুরুত করে ওটার ওপর দিয়ে চলে গেল। খাটনির ওপর খাটনি। কাল ওটাকে ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে মুছে নিতে হবে। কানন নিজেও জানে সে খানিক শুচিবাই। ওর ছেলে বলে এটা নাকি মানসিক রোগ। ডাক্তার দেখালে অনেক সময় ঠিক হয়ে যায়। তাই কি? সত্যি, সংসারে কখন কার মধ্যে যে কোন অসুখের বীজ বাসা বাধে! এই প্রথমবারের জন্য কাননের মনে হলো ডাক্তার একটা দেখালে ক্ষতি তো নেই কিছু। সে ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করবে এটা আদৌ কোনো অসুখ কি?

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত