সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা শোভনের।আপাতত স্কুলের টেস্ট পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে।জোরদার একটানা পড়া আর বাবা-মায়ের বকুনি শুনতে-শুনতে শুভর মাথাটা কেমন পাগল-পাগল লাগছে।কখনও মা বলছে-
”শুভ সামনে বই খুলে অন্য দিকে মন দিও না।এতে সরস্বতীর অপমান হয়।”
কখনও বাবা বলছে-
”ও ছোঁড়া আমার মুখে চুনকালি দেবে তবে ওর শান্তি।”
সাথে-সাথে মা বলে উঠছে-
”আহা!চুপ কর তো।সবসময় ছেলেটাকে অমন করে বোলোনা!তোমার মুখে কি ভাল কথা নেই গো!”
এরপর বাবা-মায়ের কথা কাটাকাটি চলছে কিছুক্ষণ।কার জন্য ছেলেটা কতটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আরও নানা গম্ভীর উত্তপ্ত আলোচনা—-।এইসবের মাঝে সহজ সত্যি কথা হল শুভর মোটেই পড়ায় মন বসছে না।দুদিন আগে শুনেছে পাশের বাড়ীর শ্রীময়ী মাধ্যমিকের পর মুম্বাই চলে যাবে।ওর বাবা নাকি ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে।সেই থেকে মনের ভেতরটা কেমন অস্থির-অস্থির করছে শোভনের।শ্রীময়ী আর শোভন দক্ষিণ কলকাতার একই পাড়ার বাসিন্দা।একসাথে খেলাধুলো করতে-করতে ওদের বেড়ে ওঠা।খুনসুটি-ঝগড়া আরও কত কি পাগলামিতে ভরা ওদের ছোটবেলা।কিছুদিন ধরেই শুভর মনের ভেতর কি একটা উথাল-পাথাল চলছে ও ঠিক বুঝতে পারছে না।চেনা শ্রীময়ী কেমন যেন অচেনা হয়ে উঠেছে ওর কাছে। শ্রীময়ীর এলোমেলো চুলগুলো,টিপটা,
চোখের কাজলটা,ফ্রকের ভাঁজটা—কি একটা ভাললাগা—নেশার মত যেন—বার-বার শ্রীময়ীকে দেখতে ইচ্ছে করে শুভর।স্বপ্নে ওর আনাগোনা।কেন যে এরকম হয়?এইসব সাতপাঁচ ভাবনা গুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করলেই সব পড়া কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ওর।
কিছুদিন আগে শুভর একজন বন্ধু অঞ্জন তার চেয়ে দু ক্লাস উঁচুতে পড়া দেবীশ্রীদি কে কি একটা চিঠি লিখেছিল।সেই চিঠি পড়ল গিয়ে স্যারেদের হাতে।কি কান্ড!বন্ধুমহলে হাসাহাসি,গার্জেন্সমহলে কানাকানি ,গালাগালি।স্যারেরা বলেছিল-
”এইসব অ্যাডাল্ট ব্যাপার এখন থেকে মাথায় ঘুরলে আর পাশ করতে হবে না।”
সেই থেকে অঞ্জনকে সকলে একটু বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করেছিল।শুভদের বন্ধুর গ্রুপটাও একটু এড়িয়ে চলত ওকে। দেবীশ্রীদিরও বাড়ী থেকে একা বেরোনো ফোন ধরা বারণ হয়ে গেছিল।তখন শুভ মনে-মনে এই ভেবে গর্ববোধ করেছিল যে-
”আমি অনেক ভাল। এইসব মেয়েদের চিঠি-ফিটি লিখিনা বাবা!”
কিন্তু আজ হঠাৎ সন্ধ্যে থেকে কেমন চিঠি লেখার ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে শুভর মনে।টেস্ট-পেপারে ছিল বন্ধুকে জন্মদিনের নিমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি লেখার কথা।কিন্তু শুভ শ্রীময়ীকে একটা চিঠি লিখে ফেলল।যাকে বলে লাভ লেটার।সেটাই ছিল শুভর জীবনে লেখা প্রথম প্রেমপত্র।সেটাই প্রথম সেটাই শেষ।যদিও এখন চিঠি লেখার চল তেমন নেই।তবু মনের কথা প্রকাশ করতে প্রেমপত্রের বিকল্প নেই। বাংলা পড়তে শুভ বরাবরই ভালবাসে।বাংলায় হায়েস্ট নম্বর ওর বাঁধাধরা।কিন্তু ও জানে ওর বাবা-মা ওকে সায়েন্সই পড়াবে আর তাই উচ্চমাধ্যমিকের পর আর শোভনের বাংলা পড়া হবে না।যাইহোক শুভ লিখল আমার শ্রী, লিখে আবার কাটল।তারপর আবার নতুন করে লিখল-
প্রিয়তমা শ্রী,
কেমন আছিস শ্রী?আমি ভাল নেই।আমার মনটা ভাল নেই রে।আমার মনে হচ্ছে আর পড়াশোনা হবে না।কি যে হল আমার!তুই আমার ছোটবেলাকার প্রিয় বান্ধবী।তুই খুব ভাল।তুই কতটা ভাল তা তোকে আমি বোঝাতে পারব না।চাঁদের আলো যেমন রাতের অন্ধকার দূর করে তেমনি তোর ঐ চাঁদমুখ দেখতে-দেখতে আমার মনের সব অন্ধকার দূর হয়ে যায়।তোর কপালে তারার মত জ্বল্-জ্বল্ করে যে টিপটা সেদিকে অবাক হয়ে চেয়ে দেখি আমি।তোর চোখের কাজলে আমার মনের ঘর মায়াময় হয়ে ওঠে।মনে হয় ভালবাসার ঋণে তুই আমাকে ঋণী করেছিস।আগে কখনও এমন মনে হয়নি।আমি জানিনা ভালবাসা কি!কিন্তু বিশ্বাস কর আগে কখনও এমন অনুভূতি হয়নি।আজ অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে তোকে কিন্তু সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।কিছুই গুছিয়ে বলে উঠতে পারছি না।জানিস যখন তুই কথা বলিস আমার ভাল লাগে,যখন তুই রাগ করিস তাও আমার বেশ লাগে।যখন তুই কথা না বলে মুখ ফিরিয়ে থাকিস তাও ভাল লাগে,তুই যখন তোর খাবার থেকে খেতে-খেতে আমাকে খাইয়ে দিস তখনও কেন জানিনা কেমন একটা ভাল লাগায় মনটা ভরে যায়।ইদানীং খেলার চেয়ে চুপ করে তোর গা ঘেঁষে বসতে বেশ লাগে।বেশ লাগে তোর গা থেকে ভেসে আসা চন্দন পাউডারের গন্ধটা।কেন এমন হয় জানিস রে তুই?আচ্ছা একেই কি ভালবাসা বলে?পড়ার বইয়ের ভেতর তোর মুখটা দেখতে পাই কেন বলতো আজকাল?তোরও কি এমন হয় রে শ্রী?কিছু মনে করিস না।ভাবিস না আমি বাজে ছেলে।পড়া ফাঁকি দিয়ে মাকে লুকিয়ে তোকে চিঠি লিখলাম।উত্তর দিবি।
ইতি
তোর শুভ।
এই চিঠি পড়ে যে কেউ একবাক্যে স্বীকার করে নেবে অল্প বয়সের একটা ডেপো ছেলে উচ্ছন্নে যাওয়ার পথে।বয়ঃসন্ধির আবেগ ছাড়া এ চিঠিকে আর কিছুই বলা যায় না।ক্লাসে পড়াশোনা না করা ফেল মার্কা ছেলেরা যেমন কিসব চিঠি, পদ্য এইসব লেখে।এইটা যেন অনেকটা সেরকম।কিন্তু এইসময়কার মনের আকুলতাটা বড়রা ঠিক বোঝে না।বুঝলেও কেমন দাবিয়ে দেয়।যেটা এই বয়সী ছেলে-মেয়েদের আরও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।এইসময় মনটা একফোঁটা ভালবাসার জন্য চাতক পাখির মত আকুল হয়ে থাকে।—-সবেমাত্র লেখাটা শেষ হয়েছে আর শুভর মা এসে পেছন থেকে খপ্ করে চিঠিটা তুলে নিয়েছে।
”দেখি-দেখি কি লিখছিস?বাহ্ বেশ ভাল পড়াশোনা হচ্ছে তো!প্রেমপত্র লিখছেন বাবু!এই ভাষাগুলোই পরীক্ষার খাতায় লিখিস মনে হয়!তাই হায়েস্ট নম্বর পাস।কান মুলে ছিঁড়ে দিতে হয় তবে যদি মাথা থেকে প্রেমের ভূত নামে।নাক টিপলে দুধ বেরোয় আর বাবু প্রেমপত্র লিখছেন।এই চিঠি আমার লকারে থাকবে।বেশী কথা বললে বাবাকে সব বলে দেব।আর আজ থেকে তোর শ্রীময়ীর সাথে মেলামেশা বন্ধ।”
শুভর ফর্সা চোখ-মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।কান দুটো গরম হয়ে গেল।বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগল।
”না মা না! আর কখনও এমন করব না।শ্রীময়ীর সাথে কথা বলা বন্ধ করিয়ে দিও না।আমি ঠিক মন দিয়ে পড়ব।কথা দিচ্ছি।”
মা সেসব কথা শুনল না।চিঠিটা নিয়ে গড় গড় করে চলে গেল।অসহ্য বেদনা বুকে নিয়ে টেস্ট পরীক্ষা শেষ হল।শেষ হল মাধ্যমিক। মাকে লুকিয়ে শ্রীময়ীর সাথে চলল লুকোচুরি খেলা।কিন্তু চিঠির কথা কিছু আর বলা হয়ে উঠল না ওকে।তবু যেখানে নিষেধ সেখানেই যে আরও দুর্বার আকর্ষণ।কিছু তো করার নেই।এমনই নিয়ম এই বয়েসের।শুভর রেজাল্ট বেরোলো।পরীক্ষার ফল ভাল হলেও আশানুরূপ হল না।মা-বাবা দুজনেই বেশ করে কথা শোনাতে লাগল শুভকে।
ক্রমে শ্রীময়ীদের মুম্বাই চলে যাবার দিন এগিয়ে এল।শুভ ভাবল যে করেই হোক চিঠিটা শ্রীময়ীকে দিতেই হবে।এর মধ্যেই একদিন সুযোগ মিলল।মা ভুল করে আলমারি খুলে রেখে দোকানে বেরিয়ে গেল।বাবা অফিসে।শুভ জানত কোথায় মা সব কাগজ রাখে।সেখান থেকে পেয়ে গেল চিঠিটা।তার মনের প্রেমের কথামালা।শ্রীময়ী পড়বে।ভাবতেই কেমন রোমাঞ্চ হতে লাগল মনের ভেতর।এক ছুট্টে চলে গেল শ্রীময়ীদের বাড়ী।শুভ বলল-
”কি রে যাওয়ার জন্য সব গোছ-গাছ রেডী?”
– ”হ্যাঁ রে।”
-”শোননা তোকে একটা জিনিস দেব।আমি চলে যাবার পর দেখবি।অনেকদিন আমার কাছে ছিল তোকে দেওয়া হয়নি।আর কোনোদিন দেখা হবে কিনা তো জানিনা।”
-”কি জিনিস রে?দেখি!দেখি!”
-”না এখন না।”
-”আর দেখা হবে না কেন?লোকে তো কত বোম্বে-দিল্লী করছে।তুইও যাবি বেড়াতে আমাদের বাড়ী।এই নে মুম্বাইয়ের আমাদের ঠিকানা আর ফোন নম্বর”
শুভর মনে হল গলাটা কেমন বুঁজে যাচ্ছে।কথা বলতে পারছে না।তাড়াতাড়ি চিঠিটা শ্রীময়ীর হাতে দিয়ে হনহন করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল।
শ্রীময়ী কত ডাকল।
”শুভ শুভ, দাঁড়া দাঁড়া, চলে যাসনা।”
কিন্তু শুভ আর দাঁড়াল না।শ্রীময়ীরা চলে গেল।যাওয়ার দিন শুভ দেখল শ্রীময়ীর চোখে শ্রাবণ মেঘ ঘনিয়ে এসেছে।ঘন-ঘন ধারায় ভেসে যাচ্ছে শ্রীর হৃদয়-মন।কিছু যেন বলতে চেয়েছিল শ্রী।কিন্তু সাথে সকলে ছিল তাই মনে হয় কিছু বলতে পারল না।শ্রীময়ীর চলে যাওয়ার পর শুভ মনের ব্যথাটা ক্রমে অসাড় হতে-হতে হারিয়ে গেল মনের গোপনে।কৈশোরের স্বপ্নিল প্রেম বাস্তবের ধুলোমাখা ঝড়ে কোথায় উড়ে গেল কে জানে!বিষাদের চাঁদ-খানা মন আকাশের আড়ালে কখন যে ডুবে গেল টের পেলনা কেউ।
জীবন থেমে থাকেনা।নতুন- নতুন তরঙ্গ ওঠে জীবন সায়রে।পুরোনো ঢেউ তলিয়ে যায়।আর আঠেরো বছরের জীবনে তো সবই রঙীন। এর মধ্যে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার সময় তার সাথে আলাপ হল শ্রীরূপা মিত্রের।নামের শুরুতে শ্রী। এই শ্রী শব্দটাই বড় দুর্বলতার জায়গা শুভর।তাই ভগবানও যেন বেছে-বেছে এমন শ্রীমন্ডিত করে তুলতে চায় তাকে।কি খেলা যে খেলতে চায় ভগবান শুভর সাথে সে ওপরওয়ালাই জানে!প্রথম প্রেম শ্রীময়ী, দ্বিতীয় প্রেম শ্রীরূপা।আসলে শ্রীরূপাই শুভতে মুগ্ধ।প্রেম এসেছে শ্রীরূপার দিক থেকে।তারই সব তাগিদ।অপরূপ রূপ-লাবণ্য নিয়ে শুভর জীবনে বিরাজ করতেই এসেছে যেন শ্রীরূপা।তাই শ্রীরূপার রূপের আগুনে পুড়তে লাগল শুভর জ্বলন্ত যৌবন।
কিছু-কিছু বিষয়ে শ্রীময়ীর সাথে বড় মিল শ্রীরূপার।শুভর কেন যে এমন মনে হয়!সত্যিই কি মিল নাকি শুভ মিল তৈরী করে নিতে চায় মনে-মনে।এক এক সময় কেমন অসহ্য লাগে শুভর।শ্রী-শ্রী-শ্রী।উফ্! শুভ এইবার পাগল হয়ে যাবে মনে হয়।এইতো শ্রীরূপাকে নিয়ে বেশ আছে সে।তাহলে কেন মনে-মনে শ্রীময়ীকেই এখনও খুঁজে যাচ্ছে শুভ?এক-এক সময় মনে হয় শুভর তার বোধহয় ভাল-মন্দ কোনো অনুভূতিই নেই।মনটা কেমন অনুভূতিহীন।শ্রীরূপার প্রতি ভালবাসা কি ঠিক সেই অর্থে আছে? নাকি একটা ঝোঁক?নাকি এই অস্থির সময়টাকে অন্যমনস্ক হয়ে কাটিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা শুধু!শুভ ভেবেছিল শ্রীময়ীকে ভুলে যাবে-ভুলে গেছে হয়তো।কিন্তু প্রতিটা সময়ে কেন মনে পড়ে ওকে?রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এলে কেন ওর মুখটা ভেসে ওঠে?কেন মন প্রাণ তোলপাড় করে খুঁজে চলে শ্রীময়ীকে?
ওদের ফোন নম্বরে কত ফোন করেছে পায়নি।মনে হয় কেন শুভর মুম্বাই তো বেশী দূর নয় একবার ঠিক চলে যাবে ও।এখনকার দিনে কারোর সাথে যোগাযোগ করাটা তো আর তেমন কঠিন না।কিন্তু কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে মেয়েটা।ওদের আত্মীয়-স্বজনরাও ওদের কোনো খবর দিতে পারেনা।মুম্বাই থেকে উবে গেল নাকি মেয়েটা।যদি একবার দেখা হয় শ্রীময়ীর সাথে।তবে শ্রীরূপার সাথে জড়িয়ে পড়ল কেন শুভ?এত তুলনাই বা কেন করে মনে-মনে ও শ্রীরূপাকে শ্রীময়ীর সাথে!শুভ ঠিক বুঝতে পারে না।খুব বড়লোক শ্রীময়ীরা।বড়লোক বলেই কি শুভর মনের সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম ভাবনাগুলো ঠিক বোঝে না শ্রীরূপা?ও যে অনায়াসে সব পেয়ে অভ্যস্ত।তাই মনটা অগভীর।শুভকে বোঝার চেষ্টাও করেনা।তবে কিসের ভালবাসা শুভর?শুধু কি রূপ আর অর্থ?নাকি শ্রী নামটুকুর পেলব দুর্বলতা?শ্রীরূপা আর ওর পরিবার কি প্রচুর অর্থ দিয়ে কিনে নিতে চায় শুভকে?নিজের মনে-মনে গড়া প্রশ্ন-উত্তরের পর্বে শুভ মাঝে-মাঝে দিশেহারা হয়ে যায়।
”এই ছোঁড়া তোমার ঘর জামাই হবে।ওর দ্বারা আর কিছু হবে না এই আমি বলে দিলাম।”
শুভর বাবা মাঝে-মাঝে রাগ করে।মা থামাতে চায়।আসলে বরাবরই শুভর বাবা বড় নেগেটিভ মাইন্ডের।এদিকে মাস্টারস্ টা শেষ হওয়ার পর থেকেই শুভকে শ্রীরূপার বাড়ী থেকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া হয়।সমবয়সীদের প্রেমের ক্ষেত্রে এইটা একটা সমস্যা।মেয়েদের বয়েস বেড়ে যায় এদিকে ছেলেরা চাকরি পায়না তখনও।ঠিক সেরকমই ব্যাপার। শুভ বেকার ছেলে বিয়ে করবে কি-করে।এখনও যে মাস্টার্স এর রেজাল্ট বেরোয়নি।তারপর আর যদি কিছু পড়াশোনা করে শুভ! তারপর তো চাকরি!সে চাকরি করতে এখনও কত দেরী কে জানে।কিন্তু শ্রীরূপার বাবা বললেন-
”কোনো চিন্তা নেই।যেখানে বলবে সেখানেই তোমার চাকরি হবে।এখন শুধু বিয়েটা কর।আর বেশীদিন বিয়ে ফেলে রাখা যাবে না।”
শ্রীরূপার বাবা বিচক্ষণ মানুষ জানেন আজকাল সম্পর্কগুলো বড় তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে যাচ্ছে।তাই এত তাড়াহুড়ো।পাত্র হিসেবে শুভ সুপুরুষ,ভদ্র,সভ্য,বিনয়ী,
লেখাপড়ায় ভাল আর কি চাই।বাকীটা তো তার নিজের হাতে।তার তো অগাধ ক্ষমতা।শুভ ইতস্ততঃ করছে দেখে শ্রীরূপার বাবা শুভকে মুম্বাইতে একজনের কাছে পাঠালেন।তিনি নাকি ভাল জায়গায় ওর কাজের ব্যবস্থা করবেন।পাশাপাশি যাতে ইচ্ছেমত পড়াশোনা চালাতে পারে তার ব্যবস্থাও করবেন।শোভন যাবে মুম্বাইয়ের হাভেলীতে।যথাসময়ে শুভ ট্রেনে চেপে বসলো।যথাসময়ে পৌঁছে গেল মুম্বাই।ঠিকানা অনুযায়ী হাভেলীতে যে ভদ্রলোকের কাছে যাওয়ার কথা সেখানে পৌঁছে গেল শুভ।বিরাট বাড়ী লিফটে করে চারতলায় উঠে গেল।বেল বাজাল দরজায়।একজন ভদ্রলোক দরজা খুললেন।বয়স পঞ্চাশের কাছে হবে।
”কাকে চাই?”
”মন্ডলবাবু আছেন?”
”আমি কলকাতা থেকে এসেছি শোভন বসু। বলরাম চক্রবর্তী আমাকে পাঠিয়েছেন।”
ও আচ্ছা আচ্ছা এসো এসো।আমিই মন্ডলবাবু।বলরামবাবু আমার খুব পরিচিত। বিসনেসের ব্যাপারে বহু বছরের জানাশোনা আমাদের।তোমার কোনো অসুবিধে হবে না।এখানেই থাকবে তুমি।আমি কাল তোমাকে ফ্যাক্টরী আর অফিসে নিয়ে গিয়ে কাজ বুঝিয়ে দেব।এখন কিছুদিন এখানে থেকে কাজ করবে।বেশীদিন নয় যাতে আরও কিছু পড়ার ইচ্ছে থাকলে সেটা শেষ করতে পারো সেটাও দেখব আমি।তারপর কলকাতার অফিসে—-সে যাইহোক এখন রেস্ট নাও।খাওয়া দাওয়া কর।— শ্রী শ্রী এই দাদাকে সব বুঝিয়ে দাও।ঘর দেখিয়ে দাও।”
শুভর বুকের ভেতর ধড়ফড় করে উঠল।এখানেও শ্রী!কে এই শ্রী?শ্রী নামটা শুনলেই ওর এমন হয় কেন?শ্রীরূপার নামের আগেও তো শ্রী আছে।তবু শ্রী শুনলেই ওর শ্রীময়ীর কথা মনে হয় কেন?মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে নাকি শুভ?পৃথিবীতে কি শ্রী নামের অন্য কাউকে থাকতে নেই!
মন্ডল বাবু একটু পরে রেডী হয়ে বেরিয়ে গেলেন।যাওয়ার আগে বলে গেলেন-
”আমি কাজে বেরিয়ে গেলাম।শ্রী তোমার দেখাশোনা করবে।সন্ধ্যেতে ফিরে কথা হবে।আজ আর কোথাও বেরোতে হবে না।তবে ইচ্ছে হলে বাড়ীর বাগানে, সামনের মার্কেটে ঘুরে আসতে পার।নয়তো ঘরে গান শুনো মুভি দেখ।সব ব্যবস্থা আছে।”
মন্ডলবাবু চলে গেলে ভিতর থেকে শ্রী নামের মেয়েটি বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিল।একি!হঠাৎ একঝলক মেয়েটিকে দেখে শুভর মনে হল ওর বুঝি হার্ট ফেল করে যাবে!এত মিল শ্রীময়ীর সাথে।হবহু যেন সেই চেহারা!সেই মুখ!সেই চোখ,গায়ের রঙ সেই একঢাল চুল!শুধু মেয়েটির চোখে যেন এক অপরিসীম বিষাদভরা ক্লান্তি!এই কঠিন জীবনের বোঝা টানতে-টানতে ভারাক্রান্ত। দুজনেই-দুজনের দিকে চেয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ।নীরব সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে হাভেলীর এই বিলাসবহুল বাড়ীর ওপরের তলায়।কে যে প্রথমে কথা বলবে বুঝতে পারছিল না কেউই।দুজনের একজন ভাবছে এ কি শোভন?অপরজন ভাবছে এই কি শ্রীময়ী?কিন্তু পরিচয়ের পর্বে কেউ যেতে সাহস করছে না।এই মুহূর্তটা যদি মিথ্যে হয়ে যায়!
শুভই কথা বলল প্রথম-
”আপনাকে খুব চেনা লাগছে আমার।”
শ্রী নামের মেয়েটি বলল-
”আপনাকেও চেনা লাগছে আমার।আপনি কি কলকাতা থেকে আসছেন?দক্ষিণ-কলকাতার বাসিন্দা কি আপনি?”
শুভ বলল হ্যাঁ।
”আচ্ছা-আপনি দক্ষিণ কলকাতা চেনেন?কলকাতা গেছেন কখনও?”
”মেয়েটি বলল আমার জন্ম বড় হওয়া সবই সেখানে।ভাগ্যের ফেরে আমি আজ সব ছেড়ে এখানে।”
এইটুকু শোনার পর অনায়াসেই ধরে নেওয়া যায় এই মেয়েটিই শ্রীময়ী পাল।কিন্তু শুভর কেমন স্বপ্ন দেখার মত মনে হচ্ছিল।তাই বলল-
”কেন ভাগ্যের ফের কেন?”
শ্রীময়ী বলল-
”শুভ তুই আমাকে এখনও চিনতে পারিসনি।আমি কিন্তু তোকে একবার দেখেই চিনেছি।”
”তুই এখানে কিভাবে?তোর বাবা-মা কোথায়?শ্রী তোকে আমি এতদিন ধরে কতবার পাগলের মত ফোন করেছি জানিস তুই? একবারও পাইনি।খালি বলেছে ঐ নামে কেউ সেখানে থাকে না।তোর বাড়ীর পাশে যারা থাকত সেই পারুলকাকীমারাও কিছু বলতে পারেনি।তুইও যোগাযোগ করলি না।আমি যে তোকে—-।”
শুভর গলা ধরে যায়।এমন একটা সন্ধিক্ষণে কেন দেখা হল শ্রী র সাথে?কি করবে শুভ?এইবার কি সত্যিই পাগল হয়ে যাবে সে?মনে হচ্ছে মনের ভেতর একটা অপ্রতিরোধ্য ঝড় উঠেছে,প্রলয়ে সব ধ্বংস হয়ে যাবে বুঝি এই ঝড় থামানোর সাধ্য তার নেই।
”বল বল শ্রী কেন করলি আমার সাথে তুই এরকম?ইচ্ছে করলে একবারও কি যোগাযোগ করতে পারতিস না?নাকি চাসনি আর আমার সামনে আসতে?ভুলতে চেয়েছিলি আমাকে?চিঠিটা পেয়ে ঘৃণা এসেছিল মনে?বল বলতেই হবে তোকে!”
শ্রীময়ী যা বলল তা হল এইরকম-
”আমরা মুম্বাই পৌঁছানোর পথে আমাদের ট্রেনে একটা বিরাট অ্যাক্সিডেন্ট হয়।অন্যদিক থেকে একটা ট্রেন এসে আমাদের ট্রেনে ধাক্কা মারে।কাগজে বেরিয়েছিল, টিভিতেও দেখিয়েছিল খবরটা।কিন্তু কেউ ভাবনি ঐ ট্রেনে আমরা আছি।এই ঘটনায় বাবা-মা চিরদিনের জন্য কোথায় হারিয়ে গেল আর খুঁজে পেলাম না।আমি যে কেমন করে গভীরভাবে আহত হয়ে, অজ্ঞান হয়ে মৃত্যু এড়িয়ে বেঁচে রইলাম জানিনা।হয়তো তোর সাথে দেখা না হয়ে আমার মরণ নেই!যাইহোক পরেরদিন কি তারও কদিন পরে জানিনা ,দেখলাম অসংখ্য আহত মানুষদের ভেতর হাসপাতালে আমি শুয়ে আছি।এই মন্ডলবাবু ভদ্রলোক রূপসী আহত যুবতী মেয়েটাকে তুলে নিয়ে এসেছিল হাসপাতালে।আমার জীবন দান করেছে তো তাই আমাকে মন্ডল খুউউব ভালবাসে জানিস শুভ।এত ভালবাসা তুই আমাকে দিতে পারতিস না।তুই আমাকে সিঁদূর শাঁখা দিয়ে খাঁচার পাখির মত বন্দী করে রাখতিস।আর জীবন মন্ডল আমাকে মুক্তি দিয়েছে।আমার যৌবনের বদলে আমাকে কত টাকা দিয়েছে জানিস?তুই পারতিস না! পারতিস না!আমাকে বিলাসবহুল বাড়ী দিয়েছে,গাড়ী দিয়েছে।যখন মাঝে-মাঝে মন্ডল নিজের সাজানো বৌ ছেলে-মেয়ের সংসারে সুখী জীবন যাপন করতে চলে যায় তখন আমার জন্য রেখে দিয়ে যায় নিশ্ছিদ্র রাতের অন্ধকারে এক অসীম একাকীত্ম!কত ভালবাসা বল তো শুভ!কি দিতিস তুই আমাকে?আমি যাতে হঠাৎ মা না হয়ে যাই তার কতরকম ব্যবস্থা করে রেখেছে মন্ডল।বয়েস টা নয় একটু বেশী।কিন্তু ভালবাসার কি বয়েস আছে বল?তুই তো একটা চিঠি লিখেছিলি তার উত্তরটুকুও দেবার অবসর পাইনি আমি!কত উত্তর সাজিয়েছি মনে-মনে,কত খাতার পাতা ভরে গেছে তোর জন্য লেখা চিঠিতে-কবিতাতে!কি করবি রে আর পড়ে?ছিঁড়ে ফেলব সব!এই শরীর তো বিকিয়ে গেছে!তোর জন্য রাখতে পারিনি রে যত্ন করে!কিন্তু এই দেখ তোর সেই চিঠিটা সবসময় বুকের ভেতর আগলে রাখি।তাই সেদিন সব হারিয়েও এইটা রয়ে গেছিল হৃদয়ের কাছে!এর প্রতিটা লাইন আমার মুখস্থ।চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি!”
এক নিঃশ্বাসে বলে চলে শ্রী।শ্রীর চোখের জলে শুভও ভিজতে থাকে।দুটো শরীর দুটো মন কাছাকাছি এসেছে আজ এত বছর পর।তবু হৃদয় ভেঙ্গে টুকরো-টুকরো হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু হৃদয় ভাঙ্গার শব্দ কেউ শুনতে পায় না যে!শুধু ফল্গুধারার মতন যন্ত্রণার ধারাটা বইতে থাকে—আর বইতে থাকে!