আজকাল কোন কিছুই যেন ভাল লাগেনা সিয়ামের। প্রত্যেকটা ব্যাপারেই অরুচি হয়। মা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে খুব। কিন্তু সিয়াম এখনও প্রস্তুত না। বদ্ধ জীবনে আবদ্ধ এতো তারাতারি হতে চাচ্ছেনা। এমনিতেই অন্যমনস্কের মানুষ। নিজের শার্টের রং’ই মনে থাকেনা। ছোট বেলা থেকে এটা একটা বদ অভ্যাস বলা যায়। কদিন আগেও মা বলতো। চাকরী-বাকরী কিছুই তুই করতে পারবিনা। অমন অলস ছেলের কাছে কেউ নিজের মেয়ে বিয়ে দিবেনা। যদিও কথাগুলো মা মন থেকে বলতোনা। যেই না কপালে একটি চাকরী জুটেছে এখন মা ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বাড়িতে বউ আনতে উঠেপড়ে লেগেছে। বিবাহিত বন্ধুরা বলে। বন্ধু বিয়ে করে মরিস না। অবিবাহিত বন্ধুরা বলে। বন্ধু বিড়াল মারতে এতো দেরী করিসনা। বয়স পেরোলে আবার বয়স আসবেনা। পাঁচ গ্রাম পরে সরদার বাড়ি। বাড়িতে বিয়ে সমান একটি মেয়ে আছে। ঘটকের সাহায্যে জানলো সিয়ামের মা। মা একদিন সময় করে মেয়েকে দেখে আসে। মা’য়ের বেশ পছন্দ হয়েছে। মেয়ে দেখতে শুনতে ভালই। বংশের নামডাকও বেশ চওড়া। সিয়ামকে তাঁর মা বলেছিলো। তোর কোন পছন্দ থাকলে বল। আমরা ব্যাবস্থা করবো। সিয়াম না করে দিয়েছিলো। এজন্য মা তারাহুরু করে সব ব্যাবস্থা করছেন। পাত্রীর সাথে সিয়ামের একবার কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো। খুব বেশি কথা হয়নি। কথা বলিয়ে দেওয়ার কারণটা ছিলো যদি পাত্র পাত্রীর অমত হয় একজন অপরজনকে দেখে। পাত্রী তার চরিত্র পবিত্র বলেই তুলে ধরেছিলো। সিয়াম কিছু বলার আগেই সংযোগ বিয়োগ হয়।
মানে কথা বলার সময় শেষ। যদিও আজকালকার সময় তবুও ফোন নাম্বারের আদান-প্রদান হয়নি। খুব একটা বিয়েতে অমত নেই সিয়ামের। তবুও মনে কিরকম খটকা লাগছে। অন্ধকার অন্ধকার বিরাজ করছে। এতোদূর পর না বলাটা ঠিক মনে করছেনা সিয়াম। মা’য়ের সম্মানের কথাটাও ভাবছে। সব ভেবে আর না করা হয়নি। বিয়ের দিন ধার্য করা হলো। আসছে ত্রিশ তারিখ রবিবার। যদিও মুসলিমদের বিয়ে তবুও একটু আধটু শানাই বাজলো। কবুল বলার সময় সে কি কান্না শারমীনের। গাড়ি করে আসার সময় সিয়াম শারমীনের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেই বসে। সিয়ামের বুকে ধকধক করছে। কেমন যেন শ্বাসটা বসে যাচ্ছে। অন্যরকম অনুভূতির মধ্যে অন্যরকম খারাপ লাগছে। কি যেন সামনে ভয় দাঁড়িয়ে আছে। সিয়াম এ ব্যাপারটা কারো কাছেই বলেনি। বন্ধুবান্ধবদের সাথে গল্প করার ফাঁকে মা কানে টান দিয়ে মনে করিয়ে দিলো আজকে তোর বিয়ে হয়েছে। বাসর রাত। একটা মেয়ে ঘরে বসে আছে। তোদের গল্প করার জন্য সারাজীবনই তো আছে। কিন্তু এ রাতটা কি সারাজীবনে আরেকবার আসবে। সিয়াম লজ্জায় চুল কুঁচকাচ্ছে। বড় খাটের মধ্যেখানে নববধূর ঘোমটা দিয়ে বসে থাকার কথা। কিন্তু নববধূ ঘোমটা সরিয়ে মুখ লুকিয়ে আছে। সিয়াম গিয়ে পাশে বসলো। কান্না করার শব্দ শুনতে পেলো। সিয়াম কিছু বলতে যাবে তখনি নববধূ বলে উঠলো।
– আমার কিছু কথা আছে আপনার সাথে।
সিয়াম একটে নড়েসড়ে বললো।
– জ্বী বলুন।
নববধূ নিজের চোখের পানি নিজেই মুছতে মুছতে বললো।
– আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবোনা।
সিয়াম অবাক হলো। তবুও নরম স্বরে বললো।
– কেন?
– আমি আরেকজনকে ভালবাসি। আমি আমার পরিবারে বলেওছিলাম। কিন্তু মেনে নেয়নি। পড়ালেখা আছে। আপাদত বেকার। ভাল একটা ছেলে। শিমুলের মতো ছেলে আমি আর দুটো দেখিনি।
– এসব কথা এখন কেন বলছেন? বিয়ের আগে বললেই হতো। বিয়ের পরে এখন এসবের মুল্য কী?
– বলতে তো পারতাম। কিন্তু বাবা অসুস্থ। মাঝপথে বিয়ে ভেঙ্গে গেলে যদি স্ট্রোক করে।
– অদ্ভুত ধরনের মেয়ে আপনারা। বিয়ের আগে আপনার বাবাকে বোঝিয়ে বললেই পারতেন।
– আমি বিয়ে করা বউ আপনার। আমার উপর সবটা অধিকার আপনার আছে। শরীর ভোগ করতেও কোনো বাধা নেই। কিন্তু আমার মন প্রাণ আমি শিমুলকেই দিয়ে রেখেছি। মন থেকে আপনাকে কখনোই স্বামীর স্থানটা দিতে পারবোনা।
সিয়ামের মাথা ধরে গিয়েছে। চিনচিন ব্যাথা করছে। কি বলবে বোঝতে পারছেনা। এই ভয়টাই তাঁকে এতোদিন তাড়িয়ে বেরিয়েছে। মা’য়ের কথাটা ভেবে অনেক অনেক কষ্ট হচ্ছে। ব্যাথা হচ্ছে বুকে। এক পায়ের নূপুর কিনে রেখেছিলো সিয়াম। কিন্তু হলো কি! মন বিয়ের আগেই কিরকম না উত্তর দিয়েছিলো। অনেক্ষন ভেবে বললো।
– শিমুল কি করে এখন? আপনাকে বিয়ে করবে এখন? আপনার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
– আমাদের ভালবাসার বিশ্বাস আছে। একটা চাকরী পেলেই আমরা বিয়ে করে নেবো।
সিয়াম না হেসে পারলোনা। যে মেয়ে বাবা স্ট্রোক করবে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে বলে ভাবে সে মেয়ে যদি পালিয়ে যায় বিয়ের পর তখন বাবার কি হবে ভাবতে পারছেনা। অন্ধকার ভালবাসা!
– বাহ। খুব ভালো। চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন। আমি আপনার শরীরে টাচ করবোনা। আর আপনার আজ আমার সাথে থাকার দরকারও নেই। আমি আজকে থেকে অন্য রুমেই থাকবো। মা’কে কিভাবে সামলাতে হবে তা আমি দেখবো। কিন্তু আপনার বাবার ব্যাপারটা কি করবেন? আপনি আবার অন্য কাউকে বিয়ে করলে উনি কি খুশি হবে?
– আপনার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনি আমার বাবাকেও মানাতে পারবেন।
– সুতরাং এই দাঁড়ালো যে আপনাদের এক করে দেয়ার দ্বায়িত্বটা সমস্থ আমার?
– প্রত্যেক্ষ-পরোক্ষভাবে তো এই দাঁড়াচ্ছে।
– মানুষ ভালবাসার জন্য কত কিছু করে। আমি আপনাদের জন্য এটুকু করবো নিশ্চিত থাকুন। ফোনে শিমুলের সাথে যোগাযোগ রাখুন। চাকরীর ব্যাপারটা দেখুন। আমি বাহিরের বিষয় গুলো দেখছি।
অভয় পেয়ে শারমীন খুব খুশি হলো। সিয়াম বাসর ঘর থেকে বাহিরে চলে আসে। যেহেতু নিজের বাড়ি তাই অন্য রুমে চুরি করে গিয়ে শুয়ে পড়তে অসুবিধে হয়নি। সকালে মা দেখে ফেলে সিয়ামকে ডাকতে এসে। বধু একা ঘরে সিয়াম নেই। কোন জবাব দিচ্ছিলো না শারমীন তারমধ্যেই সিয়াম এসে একটা গল্প সাজিয়ে ব্যাপারটা কাটিয়ে নিলো। এরকম অদ্ভুত বাসর রাত গল্পতেই হয় নাকি আমি জানিনা। আজকে সকালের সূর্য উঠার সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় স্বামী স্ত্রীর অভিনয়। সিয়ামের বিশ্বাস হয়েছিলো তাদের ভালবাসা সত্যতা আছে। দুজন দুজনকে বিশ্বাস করে ভালবাসে। উপর দিয়া নিতুন দম্পতীর মতোই লাগে। অভিনয়টা কেউ বোঝতে পারেনা। সিয়াম নিজের কথা ভেবে একটুও কষ্ট পায়না। মাঝে মাঝে মা’য়ের জন্য জোর করেই সম্পর্কটা রাখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু জোর করে তো আর সব কিছু সম্ভব না। দারুণ একটা গল্প সাজিয়ে সিয়াম অন্যরুমে থাকছে। কেউ কিছু বোঝতে পারছেনা। সিয়াম এতোটা বোকাও না। যতটা না মানুষ ভাবে। আবার মক্কার খেজুরও না। তবে সহজ সরল একটা মানুষ। সব সময়ই সত্য কথা বলার চেষ্টা করে। মাঝে মধ্যে মিথ্যে বলেনা এমন মানুষ খোঁজে পাওয়া যাবেনা। শতভাগ সত্য কেউ বলেনা। খুব দরকার নাহলে মিথ্যের সাহায্য নেয়না। শারমীন সিয়ামের ব্যাপারে সব কিছু শিমুলকে বলে। সিয়ামের সাথে কথাও হয় শিমুলের। চেষ্টা করছে চাকরী নিতে। হয়ে গেলে শারমীনের সাথে বিয়েটাও হয়ে যাবে। হয়তো কোন সাধারণ বিয়ে হবেনা তাদের। সিয়াম শারমীনের বাবাকে বোঝিয়ে বলে।
– শিমুল ছেলে হিসেবে খারাপ না। দুজন দুজনকে খুব ভালবাসে। আমি হয়তো শারমীনকে নিয়ে ঘর করতে পারি। কিন্তু সংসার হবেনা। আপনাকে ভয় পেয়েছে বিদাই নিজের ইচ্ছের বিরুদ্বে বিয়েতে রাজি হয়েছে।
উত্তরে বাবা কিছু বলেনি। এক সপ্তাহ পর বাবা হা সুচক কিছু না বললেও ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে তা স্পষ্টত। এরি মাঝে শিমুলেরও একটা চাকরী হয়ে যায়। সব ঝামেলা প্রায় শেষ। বাকি আছে শুধু সিয়ামের মা’য়ের ব্যাপারটা। সিয়াম চিন্তায় পড়ে গেলো। সিয়ামের মা’য়ের যদি কিছু হয়! কিছুদিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইঙ্গিতের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করলো কিন্তু কোন কাজ হলোনা। সিয়াম আর শারমীন বুদ্ধি করে তারা ঝগড়া করবে তখন তো আলাদা হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবেনা। কিন্তু তার আর দরকার পরলোনা। সিয়ামের মা ব্যাপারটা বোঝে ঠিক। কাল শারমীনকে ষ্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসবে সিয়াম। একয়দিনে স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক ইত্যাদি কোন সৃতি না হলেও বন্ধু সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। একটু খারাপ লাগবে স্বাভাবিক। শিমুল দাঁড়িয়ে আছে। শারমীনকে দেখে চোখে মুখে আনন্দের ঝড় স্পষ্টত । দৌড়ে এসে শারমীনকে জড়িয়ে ধরবে আগে স্বাভাবিক কিন্তু না। দৌড়ে এসে সিয়ামকে আগে জড়িয়ে ধরলো। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে শিমুলের। যাওয়ার সময় শারমীন বলে যায়।
– আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে আপনি আপনার থেকেও অনেক ভাল একজনকে পাবেন। জানি কথাটা আপনি কোনরকম শান্তনা হিসেবে ভাববেন। কিন্তু না আমি আমার হৃদয় থেকে বলছি।
সিয়াম মুচকি হাসে। রাতে কাগজ পত্রের সব ঝামেলা শেষ হয়। আজকে কাজী অফিসে বিয়ে করবে তারা। সিয়াম শুধু আল্লাহর কাছে দোআ করে। এতো ত্যাগ এতো মানুষের স্বপ্ন উল্টিয়ে যাদের জন্য সব করলো। তাদের যেন কমপক্ষে সুখী রাখে। তাহলেই সিয়ামের ত্যাগ সার্থক হবে। এটাকে হয়তো ত্যাগ বলা যায়না। এখন সব কিছু স্বাভাবিক। শিমুল রাতে ফোন করেছিলো। তারা খুব খুশি এবং সুখে আছে। দুজনেরই তাদের এক হওয়ার পিছনে সিয়ামের নামটা আগে মনে হয়। সিয়াম কাজে মন দেয়। বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর মা আরেকটি মেয়ের কথা সিয়ামকে বললো। সিয়াম হেসে উড়িয়ে দেয়। বিয়ে করে আর কি হবে? তবে মা মেয়ের ব্যাপারে সব জেনে পীড়াপীড়ি শুরু করে দেয় খুব বেশিই। সিয়াম আবারো বলে। আমার কোন দ্বিমত নেই তবে মেয়ের ব্যাপারে আগে সব কিছু জেনে নাও। সবার আগে নিজের সম্মতি আর ভালবাসার ব্যাপারটা । এ ব্যাপারে সব ঠিকঠাক আছে। তবুও সিয়াম আরো পরে বিয়ে করতে চায়। একটা দখল গেলো মাত্র। কিছুদিনের বিশ্রাম যায়। সামনের মাসে অফিসের ছুটি এক মাসের। চাকরীর জীবনে এমন ছুটি আর পাবে বলে মনে হয়না। তাই বিয়েটা এখনি করলে অসুবিধে হয়না বরংচ বেশ ভালই হয়। সিয়ামের প্রথম বিয়ের কাহিনিটা পাত্রীসহ সবাইকে বলেই বিয়েটা হচ্ছে। মিথ্যে দিয়ে সম্পর্ক শুরু হওয়া সম্পর্ক বেশিদিন টিকে না। তার উপর সারা জীবনের ব্যাপার। মেয়ের ছবিও ছিলো মা’য়ের কাছে। সিয়াম দেখেনি। প্রথম দেখা ছাদনাতলেই হোক। কবুল থেকে সিয়ামের বাড়ি পর্যন্ত মেয়েকে দেখার কোন অবস্থাও ছিলোনা যদিও বর। লম্বা ঘোমটা টেনে জয়া বসে আছে। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। সিয়াম ভাবলো কথা বলার জন্য সারাজীবন তো পরেই রয়েছে আজ নাহয় ঘুমানো যাক। তবে এক পায়ের নূপুরটা দেয়া হয়নি। সিয়াম ঘোমটা সরিয়ে অবাক! শারমীনের কথা ঠিক না বেঠিক তা বোঝছে না কিন্তু এরকম চাঁদের মতো এক সুন্দরী সিয়ামের বউ হিসেবে বাসর ঘরে বসে আছে। জয়া লজ্জায় মুখটা নিচের দিকে করে রেখে বারবার ঘোমটা দিচ্ছে। সিয়াম বললো।
– কিছু মনে না করলে আপনার এক পা একটু বাড়িয়ে দিবেন?
নবযৌবনাবধূ কিছু বললোনা চুপ করে বসে আছে। সিয়াম বোঝতে পারলো প্রথমেই পা’য়ের কথা বলেছে এজন্য মনে হয় সংকোচ হচ্ছে। সিয়াম আবারো বললো।
– এক পায়ের নূপুর। অনেক আগের কেনা। ভেবেছিলাম বাসর ঘরে বউকে পরিয়ে দিবো। প্রথমবারের কথা তো জানেনই। এবারও কি সম্ভব হবেনা?
কথাটা শুনে নববধূ বোঝতে পারলো। এক পা সামনের দিকে এগিয়ে দিলো। পায়ে আলতা। মেয়েদের পায়ে লাল রং অনেক সুন্দর দেখায়। তা যত কালো মেয়েই হোকনা কেন। সিয়াম পা’য়ে নূপুরটা পরিয়ে দিলো। এখন পর্যন্ত জয়া কোন কথা বলেনি। এতো লজ্জা আবার ভাল না! আবার লজ্জা নারীর ভূষণ। লজ্জা বিহীন নারী আর ঢেউ হীন সমুদ্র একই কথা। সিয়াম একটু শব্দ করেই বললো।
– আপনি কি কথা বলতে পারেন না বোবা?
এবার নববধূর মুখ খুললো। মুখ লুকিয়েই বললো।
– হুম।
সিয়াম একটু দুষ্টুমী স্বরে বললো।
– যাক বাচা গেলো।
– জ্বী।
– রাত অনেক হয়েছে। ক্ষিদে পেয়েছে মনে হয়? সারাদিন তো আর পেটে কিছু পরেনি।
– নাহ আমার ক্ষিদে পায়নি।
– ঘুমানো যাক তাহলে? আমি লাইট অফ করে দিচ্ছি।
সিয়াম লাইট অফ করে দিলো। দুজনে ঘুমের দেশে। সকালে সিয়াম আগে উঠে। কেউ জয়াকে ডাক দেয়নি অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে ভেবে। গল্প তো মাত্র শুরু । বিয়ের দুদিন পর শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গেলো তারা। তারা বলতে সিয়ামের শ্বশুর বাড়ি আর জয়ার তো বাপের বাড়ি। সিয়াম জয়ার থাকার ঘরে গিয়ে বোঝতে পারলো মেয়েটা ভীষন বই পাগলী। নাহলে ঘরে এতো বই পত্র থাকতোনা। একটা ডায়েরী টেবিলের উপরে খুব যত্ন করে রাখা আছে। বোঝা যায় জয়া ছাড়া কেউ ডায়েরীটায় ধরে না। জয়া তার মা’র সাথে রান্নাবান্না করছে। সিয়ামেরও একটু ডায়েরীটা দেখার কৌতহুল হলো। যদিও অন্যের জিনিষ অনুমতি না নিয়ে খুলাটা মনে হয় ঠিক হবেনা। আবার ভাবলো এখন এটা আমার স্ত্রীর। স্ত্রীর মানে আমার, আমার মানে স্ত্রীর। সিয়ামের এমনিতে উপন্যাস পড়ার একটা নেশা আছে। সাহিত্যের স্বাদ আসলেই অন্যরকম। ডায়েরীটা খুললো। শেষ পাতা থেকে দেখে আসছে। জয়ার কি কি পছন্দ খাবার-দাবার পোশাকাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু কিছু কষ্টের দিনেরও লেখা আছে। তবে খুব কম। অল্প অল্প করে লিখা প্রতি পৃষ্টায়। যাক ভালই হলো এই সুযোগে জয়ার ভাল লাগা মন্দ লাগা গুলো জানতে পারছে। শেষের থেকে প্রায় শেষের পৃষ্টা মানে প্রথম দিকের পাতায় চোখ আটকে গেলো সিয়ামের। শিরোনামটা ছিলো। “প্রিয় রাজপুত্র” দেখেই আরো কৌতহুল জাগলো সিয়াম পড়তে শুরু করলো।
প্রিয় রাজপুত্র
এইযে আমি তোমাকে অর্থের রাজপুত্র বলিনি। মনের রাজপুত্র বলেছি। আমার কাছে না মনটাই আসল এবং প্রকৃত ব্যাপার। আমি জানি তুমিও মানুষ। তোমারও ভুল ত্রুটি আছে। তুমি যেমনই হও না কেন। আমি তোমাকে আমার মতো করে ঠিক করে নিবো। আমি কথা কম বললেও যখন বলা আরম্ভ করি তখন কিন্তু থামিনা। তুমি আবার আমাকে পাগলী ভেবোনা। একটু মানিয়ে নিবে। আমি রাগ করবো, অভিমান করবো যদি তুমি রাগ, অভিমান ভাঙ্গাও তো। নাহলে আমি রাগও করবোনা অভিমানও করবোনা। জবা ফুল আমার অনেক পছন্দ তোমার কিন্তু এটা জানতে হবে। টাকা পয়সার অভাব দুজনে মানিয়ে নিবো একসাথে। কিন্তু ভালবাসা আর আদরের অভাবটা কখনোই মানবোনা। মানবোনা! মানবোনা মানে মানবোনা! তুমি অগোছালো হলেও সমস্যা নেই। আমি গুছিয়ে দিবো। সারাজীবন বুকে আগলে রাখতে হবে। আমি হয়তো তোমার কাছে মাঝ রাতে আইস্ক্রিম খাওয়ার আবদার করবোনা। কিন্তু চাঁদ দেখার বায়না করবো। তুমি কিন্তু না করবে না। তখন কিন্তু আমি অনেক কষ্ট পাবো। বৃষ্টিতে ভেজার আবদার করবোনা। কারন বৃষ্টিতে ভিজলে যদি তোমার জ্বর আসে। তুমি নানা অজুহাতে আমার কাছে আসার চেষ্টা করবে। আমি তোমাকে দুষ্টু বলবো। হয়তো বলবো এই সবসময়ই ভাল্লাগেনা যাও তো। তুমি কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করবেনা। মেয়েরা বাচেই এটুকু নিয়ে। আমাকে তোমার রাজরাণী করে রাখতে হবেনা। শুধু ঝড়ের সময় হাতটা ছেড়ে দিয়োনা। মাঝরাতে ঝগড়া হবে। কিন্তু এই মনে করে তুমি কিন্তু দূরে রাগ করে শুয়ে থেকোনা। আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাবে। সকালে তো আর এসব মনে থাকবেনা। ইচ্ছে করে টিপটা বাকা করে রাখবো। তুমি তারপর নিজের হাতে ঠিক যায়গায় টিপটা দিয়ে বলবে। এতো কিছু পারো আর টিপটা সবসময়ই বাকা হয় কেনো? তোমার ছোঁয়ার বাহান। সারাদিন কি খেয়েছো, কি করেছো, কি ভাবছো সব আমার সাথে শেয়ার করবে। আমিও করবো। তুমি কিন্তু বিরক্ত হবেনা। রাগ উঠলে একটা থাপ্পড়ও দিতে পারবে সহ্য করতে পারবো। কিন্তু পরে আমাকে অনেক অনেক গুন বেশি আদর করতে হবে । শাষন করবে, বকবে, ভালও বাসবে। নাহ তোমাকে আর কিছু করতে হবেনা এতটুকুই। কি পারবেনা?
পারবেনা লিখে বড় করে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়েছে। অনেক বড় ব্যাপার! তার উপর মেয়েদের মন। অল্পতে খুশি আবার চাঁদ, সূর্য এনে দিলেও মন ভরবেনা। এমন সময় জয়ার ডাক।
– এইযে শুনছেন? মা ডাকছে খেতে।
সিয়াম তারাহুরু করে ডায়েরীটা আগের জায়গায় রেখে দেয়। খাবার টেবিলে সব বেরে রেখে দেয়া আছে। সিয়াম বসে আছে। মুখে কিছু নিচ্ছেনা। শ্বাশুড়ি মা বুদ্ধীন্দ্রিয় দিয়ে বোঝতে পেরে জয়াকে টেবিলে রেখে চলে যায়। সিয়াম মনে মনে ভাবলো। আগের মানুষের মাথায় বুদ্ধি অনেক। সিয়াম বললো।
– তুমি খেয়েছ?
জয়া মাথা নাড়িয়ে বললো না।
– তাহলে আমার পাশে একটু বসো।
জয়া লজ্জা পেলো।
– নাহ। মা আছে বাসায়।
– তুমি বোঝবানা। মা এজন্যই এখান থেকে পকাৎ। বসো না।
জয়া পাশের চেয়ারে বসলো। সিয়াম আস্তে আস্তে বললো।
– আমার ডায়েরীতে লেখা আছে। আমি আমার রাজরাণীর হাতে তুলে ছাড়া খাবোনা। কি পারবেনা?
জয়ার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। লজ্জায় নাকমুখ লাল হয়ে গেলো। কত গোপন ব্যাপারটা জেনে গেলো। কেনো যে লুকিয়ে রাখলোনা ডায়েরীটা।
– এখনি খাওয়াতে হবে?
– হুম। নাহলে আর স্বাদটা পাবোনা। আর দেখো এই দিনটাও তো আর জীবনে আসবেনা। তাই মিস করতে চাইনা। কি খাইয়ে দিবেনা?
জয়া মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো।
– হুম।
– এইতো আমার লক্ষী।
একটুপর সিয়ামও জয়াকে খাইয়ে দেয়। রাতে ঘুমানোর আগে জয়া বসে চুল আঁচরাচ্ছে। সিয়াম শুয়ে শুয়ে ফোন চাপার অভিনয় করে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। মেয়েদের চুল ছড়ানো থাকলে সত্যিই অন্যরকম লাগে। ঘুমানোর আগে সিয়াম বললো।
– তোমার চুলগুলো অনেক সুন্দর।
– ইশ। কালো চুলও সুন্দর?
– ইশ বললে কেন? দেখো কাবা শরীফ কালো। কাবা শরীফ কি সুন্দর না?
– চুপ। এতো কথা বলেনা। ঘুমান।
– তাহলে আমার মুখে চাপ দিয়ে ধরে রাখো।
– কেনো?
– তোমার সাথে থাকলে আমার সারাক্ষণই গল্প করতে ইচ্ছে হবে।
– একটা গল্প শুনান তো। আমার ঘুম আসছেনা।
– তাহলে এতো দূরে কেন কাছে এসো। সমরেশ মজুমদারের একটা কথা জানো তো? যত কাছে থাকবে তত ঝগড়া কম হবে। যত কাছে তত আপন।
– নিজে বুকে নিতে পারেন না? আমি যাবো কেনো?
– আচ্ছা ঠিকাছে। ঘুমাও গুড নাইট।
– শুভ রাত্রি।
ঘুমিয়েছে জয়া। সিয়ামের মনে আছে মাঝ রাত্রিরে ঝগড়া হবে কিন্তু মনে রাখা চলবেনা কারন সকালে ভুলে যাবে। তাই বুকে টেনে আগলে রেখে দুজনে ঘুমের দেশে। কালকে শ্বশুর বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে চলে যাবে দু’জন। যাবার সময় একটু মন খারাপ হলো জয়ার। চোখের কোণে পানি টলমল করছিলো। আসার সময় কিছু বই কিনে নেয় সিয়াম। ছোট গল্প, উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বই। প্রামাণ্য সালাউদ্দিন। বিলু কবিরের সহ আরো কিছু। অফিসের ছুটির আর আজ বাদে এগোরো দিন বাকি। এর পরে আর চাইলেও ছুটি দিবেনা। তাই হানিমুনও সেরে ফেলা উচিৎ। জয়াকে জিজ্ঞেস করা হয় তার কি পছন্দ। পাহাড় না সমুদ্র। মেয়েটা পানি ভয় পায়। তাই পাহাড়। রাঙ্গামাটি যাওয়ার সব ব্যাবস্থা শেষ। হোটেলও বুকিং করা হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু লম্বা একটি ভ্রমন। সিয়ামের কাঁধে মাথা রেখে বাহিরের প্রকৃতির সুন্দর্য দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পরেছে জয়া। ঘুমের মাঝে এক অদ্ভত সুন্দর্য দেখা দেয় মেয়েদের। ছেলেদেরও কম নয়। সিয়াম চোখের কাজল দেখছিলো। অচেনা অজানা এক মায়ায় পড়ে বারবার নতুন করে। যতবার না চোখের প্রেমে পড়ে। অনেক্ষণ পর জয়ার ঘুম ভাঙ্গলো হঠাৎ। চোখ ক্যাঁচলিয়ে দেখে উপরে ছাদর দেয়া। আসলে হালকা শীত লাগছে তাই সিয়াম চাদরটা মুড়িয়ে দিয়েছিলো। জয়া বললো।
– খুব খেয়াল রাখেন আমার দেখছি।
সিয়াম উত্তর দিলোনা। বাহিরে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। আবার ডাক দিলো।
– এইযে কোথায় হারিয়ে গেলেন?
সিয়ামের খোঁজ হলো।
– ভাবছি।
– কি ভাবছেন?
– শারমীনের কথা। শারমীন যাবার সময় বলেছিলো আমার কপালে নাকি আমার থেকেও ভালো কেউ অপেক্ষা করছে। কথাটা একশোতে হাজার সত্যি হয়ে গেলো।
– নাহ। এভাবে বলা ঠিক না। ভুল শুদ্ধ নিয়েই মানুষ। আমিও তো মানুষ।
– তুমি না অনেক ভাল।
– হয়েছে আর বলতে হবেনা। আমি আকাশে উড়ছি।
– আমাকে সঙ্গী করে নাওনা।
– আমি তো আপনার আকাশে উড়ছি।
– তাহলে তোমার আকাশে আমাকে একটু উড়তে দাও।
– আমার আকাশটা তো আপনার । আর আমি আপনার আকাশেই উড়ছি।
– তোমার সাথে কথায় পারা যাবেনা। ক্ষিদে পেয়েছে?
– না। আপনার?
– না।
হোটেলটা বেশ চওড়া। চার তলার। সিয়াম আর জয়ার রুম পড়ে দ্বিতীয় তলায়। জানালা খুললে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। পাহাড়ের পর পাহাড়। তারপর আবার পাহাড়। বেশ বড় বাথরুম। আর খাটের কথা তো বলাই লাগেনা। যতই হোক হানিমুনের বিষয় তো। জয়া প্রথমেই ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর সিয়াম। বাসা থেকে মা ফোন করেছিলো পৌঁছেছে কি না। আজকে সন্ধা হয়ে গিয়েছে আর বেরোবে না। দুজনে খেয়ে ঘুম। সবসময়ই বাতাস থাকার কারণে হালকা শীত পড়ে। তাই এক কম্বলের নিচে, বুকে বুক, একজনের পা’য়ের উপর আরেকজনের জোরাজোরি করে ঘুমিয়েছে। খুব সকাল। জয়া উঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু সিয়াম ছাড়ছেনা। বললো।
– অফিস নেই, কাজ নেই। আমরা বাসায়ও না। এক্ষনি উঠতে হবে তোমার?
জয়া কিছু বললোনা। কিছুক্ষণ পর মুখ ঘুরিয়ে বলে।
– যদি আপনার শরীর খারাপ করে বেশি ঘুমুলে?
সিয়াম একটু হাসলো।
– নাহ করবেনা।
তারপর বেশ খানেক সময় আবারো দুজন ঘুমালো। হোটেলের একজন ছেলে এসে গুড মর্নিং বলে নাস্তা দিয়ে যায়। সিয়াম নিজের হাতে খায় না। জয়াও নিজের হাতে খায় না। বোঝতেই পারছেন কি হয়েছে তারপর। অনেক জায়গায় ঘুরাঘুরি করলো হাতে হাত রেখে। এখানকার নামকড়া কিছু খাবার খাওয়া হলো। দূপুরে বাহিরেই খাওয়া হয়েছে। কিছু সুন্দর মুহুর্ত একসাথে পাড় করে দুজন। সন্ধার দিকে যখন হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। মাঝপথে সিয়াম দেখলো দুজন হাত ধরে ব্রিজে দাঁড়িয়ে নিচের পানি আর পাশের পাহাড় দেখছিলো। সিয়ামের চোখ আটকে যায় এজন্য যে মেয়েটাকে শারমীনের মতো মনে হলো। কাছি গিয়ে এক্সকিউজ মি বলতেই দুজনে মুখ ঘুরালো । নাহ সিয়ামের ধারনা সত্য। শারমীন আর শিমুলই তো। সে কি কাণ্ড। কেউই বিশ্বাস করতে পারছেনা এভাবে দেখা হয়ে যাবে। একই হোটেলে তারা আবার পাশাপাশি রুম। কাকতালীয় ব্যাপার! যাক ভালই হলো। জয়া আর শারমীন এক হলো। শিমুল আর সিয়াম একটু আলাদা হয়ে সিগারেট ধরানোর সুবিধা হলো আরকি। যদিও সিগারেট কারোরি অভ্যেস না । তবুও ইচ্ছে করে একদিন নাহয় হলো। শিমুল বললো।
বিয়ের পর কষ্ট করে টাকা জমিয়ে এখানে আসা। শারমীনের নাকি সম্পর্কের শুরুতেই স্বপ্ন ছিলো দুজনে একসাথে পাহাড় দেখবে। এটুকু তো পূরণ করতে পারে। বেশ ভালই হলো। চারজন একসাথে ছবিও তুললো। সন্ধা পাড় হয়ে যাচ্ছে এক্ষনি হোটেলে ফিরতে হবে। চারজন একসাথে হোটেলে ফিরে এলো। রাতে চা’র আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। কেউ গল্প বলছে। কেউ গ্রামের কিচ্চা বলছে। শিমুল রবিন্দ্র সঙ্গীত শুনালো। অনেক সুখের মুহুর্ত একসাথে কাটায় সবাই। শিমুলদের একদিন আগেই ফেরার কথা কিন্তু সবাই একসাথে ফিরবে বলে থেকে যায়। সবাই কেনাকাটা করে। গাড়িতেও অনেক মজা করে। ভিবিন্ন বিষয় নিয়ে যুদ্ধ চলে। শিমুলরা নেমে যায়। অনেক জোরজারি করে সিয়াম আর জয়াকে কিন্তু সময় হলোনা আরেকদিন। বাসায় ফিরলো। গাড়ি থেকে নেমে দুজনে এক দীর্ঘশ্বাস নিলো। মা’র চোখে জল। কালকের পর থেকে অফিস করতে হবে সিয়ামের আবার ব্যাস্ততা। কয়েকমাস পর জয়া গর্ভবতী। এখন খাবার দাবার সহ রোজকার একটি রুটিন তৈরি করে দিয়েছে সিয়াম। ঠিক এভাবেই চলতে হয়। নাহলে অনেক বকা শুনতে হয় জয়ার। সময় যেন কাটেনা। দিন যেন পাড় হয়না। রাতে শুয়ে আছে দুজন। সিয়াম একটু সরে হাত ধরে।
সিয়াম বললো।
– একটা আবদার করি?
– হুম। বেশি কিছু করতে পারবোনা কিন্তু।
– আরে তোমাকে কাজ করতে হবেনা। একটু তুমি করে বলো।
জয়া লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
– পারবোনা।
– দুদিন পর আমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছো আর এখনো তুমি করে বলতে পারছোনা। কি কপাল আমার।
আবার মুখ ঘুরিয়ে এনে বললো।
– তুমি করে বলতে হবে কেন?
– যাও লাগবেনা।
বলে সিয়াম হাতটা ছেড়ে মশারি টাঙ্গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো। জয়া হাসছে মনে মনে। আবার অনেক লজ্জাও হচ্ছে। ডাক দিলো।
– এইযে।
সিয়াম শব্দ করলোনা।
– হাতটা ছেড়ে ঘুম হবে?
সিয়াম এবারো চুপ। ভান করছে ঘুমিয়ে আছে।
– একবার ডাকবো হবেনা?
সিয়াম মাথা নাড়িয়ে বললো না।
– তাহলে কতবার ডাকতে হবে?
সিয়াম মুখ ঘুরিয়ে বললো।
– সারাজীবন। না পারলে বলার দরকার নেই।
– এই জোর করছেন কেন হুম? সময় হলে বলবো।
– কয়টা বাবু হবার পর সময় হবে শুনি?
– কয়টা মানে? একটা ছেলে একটা মেয়ে। এতো লাগবে কেন?
– তুমি যদি তুমি করে বলো আরকি।
জয়া সিয়ামের হাত ধরে বললো।
– চোখ বন্ধ করেন।
সিয়াম চোখ বন্ধ করলো। জয়া সিয়ামের কপালে চুমু দিয়ে বললো।
– তোমাকে যে অনেক অনেক বেশি ভালবাসি। তুমি ছাড়া এখন আমার জীবন আলোহীন। এবার ঘুমাও তো।
সিয়াম চোখ খুলে জয়ার দিকে তাকাতেই জয়া লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সিয়াম বললো।
– চোখে চোখ রেখে বলতে পারোনা?
জয়া মাথা নাড়িয়ে বললো।
– না।
– ওরে আমার লজ্জাবতী রে।
কদিন ধরে মা’য়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। এদিকে জয়া কোন কাজ করতে পারবেনা। মামাতো বোন আছে সিয়ামের। তাকে আনা হলো। তারও পরিক্ষা শেষ ছুটির সময় বেশ ভালই হবে। হঠাৎ একদিন জয়ার ব্যাথা। হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থা খুব বেশি ভাল না। সবাই খুব চিন্তিত। ডাক্তার অনেক্ষণ পরে এসে বললো। অভিনন্দন। মেয়ে সন্তান হয়েছে। সবাই চিন্তা ঝেড়ে ফেলে খুশিতে আত্মহারা। কিছু মুহুর্ত আছে মা মেয়ের যা সারাজীবন ধরে রাখে। মাঝ রাতে একবার দুবার করে অনেকবার প্রস্রাব করে দেয় জারা। শেষ মুহুর্তে সিয়াম নিজের বুকে তুলে নেয়। জয়া বললো।
– আপনার ঢান্ডা লাগবে তো।
সিয়াম ভ্রু কুঁচকিয়ে বললো।
– তোমার বোঝি ঢান্ডা লাগেনা? আমিও তো মেয়ের বাবা। আমার কোলেও তো প্রস্রাব করার অধিকার আছে কি বলো?
– পাগল একটা। আচ্ছা আপনি একটু রাখেন আমি চেঞ্জ করে আসছি।
সিয়াম জারাকে দেখছে। অনেকটা মা’র মতো হয়েছে। নাকটা শুধু সিয়ামের মতো। মেয়েটা চোখ দিয়ে যেন অনেক কিছু বলছে। এক্ষনি কেঁদে দিবে মনে হচ্ছে।
– এই শুনছো?
ডাক শুনে জয়া দৌড়ে এসেছে।
– একটু সময় রাখতে পারেন না? কাঁদে কেন?
– যা বাবা। মেয়ে কাঁদে আমার দোষ?
– হুম আপনারই তো।
সিয়াম মুখ কালো করে শুয়ে আছে। জয়া মিঠমিঠি করে হাসছে। পরেরদিন হঠাৎ মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়। জ্ঞান ফিরছেনা। হাসপাতালে নেয়া হলো। সিয়াম হাসপাতালে পাইচারি করছে। ডাক্তার কিছুক্ষণ পর এসে বললো কিডনিতে কি যেন সমস্যা জরুরী অপারেশন করাতে হবে। টাকার ব্যাবস্থা সিয়াম করলো। কিন্তু আবার রক্ত লাগবে। রক্ত পাওয়া যাচ্ছেনা। এখন রক্ত না দিলে না বাচার সম্ভাবনাই বেশি। জয়া রক্তের গ্রুপ শুনে বললো।
– আমারও তো এই গ্রুপের রক্ত চলেন আমি রক্ত দিবো। সিয়াম একটা থাপ্পড় মারে জয়ার গালে।
– এখন রক্ত দিলে তোমার কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছো? তার উপর জারার?
জয়া স্বাভাবিক ভাবেই বললো।
– কিছুই হবেনা। একটু নিয়ে চলেন না।
সিয়াম রেগে একাকার। অবুঝ কতটা হয় মেয়ে মানুষ বোঝতে পারলো। অবশেষে রক্ত মিলে পাওয়া গেলো। মা সুস্থ হয়। অনেক টাকা ঋণ পরে যায়। গ্রামের যেটুকু জমি বাকি ছিলো তা বিক্রি করে পরিশোধ করে। অবশ্য সব টাকার প্রয়োজন পরেনি। বাকি টাকা জমা রেখে দেয়। মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে আজকে তাঁর ষষ্টতম জন্মদিন। কিন্তু আজকেই সিয়ামের যত কাজ পড়লো। সন্ধার সময়ও বাসায় ফিরতে দেরী হলো। মা মেয়ে সবাই মুখ গুমরো করে বসে আছে। তারাহুরু করে সিয়াম আসতে গিয়ে বাসের সীটের লোহার সাথে ধাক্কা লেগে কপালে একটু কেটে গেছে। সিয়াম দৌড়ে সবাইকে এনে কেক কাটার ব্যাবস্থা করলো। কেক কাটা হলো সবাই উইশ করলো। জয়া খুব বেশি কথা বলেনি। রান্নাঘর থেকে মলমের বোতলটা এনে বললো।
– কপালে কি হয়েছে আপনার?
– ঐ কিছুনা। একটু দাগ হয়ে গিয়েছে।
– একটু না? নিশ্চয় তারাহুরু করতে গিয়ে লেগে গিয়েছে?
– আরে কিছু হয়নি বাদ দাও তো।
জয়া সিয়ামের কপাল মুছে মলম লাগিয়ে দিলো। রাগী চোখে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে আছে। সিয়াম বললো।
– সরি। আসলে আজকে একটু বেশি কাজ পড়ে গিয়েছিলো।
– একটু দেরীতে আসলে কি অমন হতো? শুধু শুধু কপাল কাটলেন।
– দেখিনি তো লেগে গেছে।
– আর এমন করবেন না।
জারা দুদিন ধরে নানু বাড়িতে যাওয়ার জন্য খুব বলছে। সিয়ামের সময় নেই। মেয়েটা বাবাকে ছাড়া যাবেও না। শেষমেশ না পেরে মা মেয়েই গেলো। তাই আজকে বাড়িটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সিয়াম বাসায় ফিরে ফোন দিলো।
– কেমন আছো?
– অনেক ভাল। আপনি?
– ফোনেও কি তুমি করে বলা যায়না? চোখে তো আর তাকাতে হচ্ছেনা।
– বলা যায় কিন্তু কেউ যদি শুনে?
– বোকা মেয়ে। আচ্ছা জারা কোথায়?
– আছে নানুর সাথে।
– একটু ডেকে দাও তো অনেকক্ষণ হলো কথা হলোনা।
– আচ্ছা আমি ডাক দিচ্ছি।
জয়া জারাকে ডেকে এনে ফোন দিলো।
– আম্মু কেমন আছো তুমি?
– ভালোনা। তুমি থাকলে ভাল থাকতাম।
– খেয়েছো?
– না একটুপর। রান্না তো হয়নি। তুমি খেয়েছো?
– খাবো একটুপর।
– মিস ইউ আব্বু।
– ওরে বাবারে। মিস ইউ টু আম্মু।
জারা জয়ার কাছে ফোন দিয়ে নানুর কাছে চলে গেলো।
– এখনি খেয়ে নিন ঠিকাছে?
– ক্ষিদে পায়নি।
– জানি ক্ষিদে পেয়েছে।
– আচ্ছা বাদ দাও। বলোনা আমি কে?
– কেমন প্রশ্ন হলো? আপনি মানুষ।
– ধুরু তুমি বোঝোনা।
– আচ্ছা আমি কে?
– তুমি? তুমি তো আমার। আচ্ছা থাক ক্ষিদে পেয়েছে খেয়ে বলি?
– আচ্ছা। আল্লাহ হাফেজ।
গল্পের বউ।
[সমাপ্ত]