রুপাকে যখন বিয়ে করি সে ছিলো সাতচল্লিশ কেজি ওজনের, লম্বা, ছিপছিপে গড়নের ঊনিশ বছরের এক স্বপ্ন তরুণী।
আমার সাথে বিয়ে হওয়ায় আমার অসুস্থ মায়ের দেখা শোনা, ঘরের কাজ কর্ম, তারপর খুব তাড়াতাড়ি কনসিভ করায়, গ্রেজুয়েশন তার আর কমপ্লিট করা হয়নি। সংসারে জড়িয়ে গেছে পিচ্চি মেয়েটি।
সেজন্য অবশ্য সে আমাকে কখনোই দোষারোপ করেনি। আমি যে খুব বেশি বয়স্ক ছিলাম তা না, তার তুলনায় অবশ্য বয়স কিছু বেশিই ছিলো, আটাশ।
আমাদের বিয়ে পারিবারিক ভাবে হলে কি হবে, প্রেম ছিলো একশ ভাগ। রুপা’র সবকিছুই আমাকে আকর্ষণ করতো। তার হালকা পাতলা গড়ন, মেদহীন পেট, প্লাগ করা ভ্রু, ঠোঁটের নীচের গাঢ় কালো তিলটা, ওর চিকন কোমর, ওর নরম গলায় কথা বলা।
মোটকথা পুরা রুপাই আমার ক্রাশ ছিলো।
ওকে আমার হাতের উপরই ঘুম পাড়াতাম। শোবার সময় ওর ঠোঁটের নীচের তিলে চুমু না খেলে আমার ঘুম আসতো না। বাইরে যাবার আগে, এসে তার কপালে চুমু খাওয়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল আমার।
মা ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি সিঁড়ি ভেঙে ছাদে চলে যেতাম। পাটি বিছিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকতাম দু’জন। তারা গুণতাম, আর ভবিষ্যৎ টা দেখতে চাইতাম বিশাল আকাশের বুকে।
অনাগত সন্তানকে ভেবে আপ্লুত হতাম, তার নাম নিয়ে মিষ্টি মধুর ঝগড়া করতে করতে ভালোবাসায় হারিয়ে যেতাম।
আমি চাইতাম একটি কন্যা আর সে চায়তো, একজোড়া বাচ্চা, ছেলেমেয়ে যমজ!
জোড়া কলাও খেয়ে নিয়েছে সে, কি অদ্ভুত !
আমাদের একটা মেয়ে হলো, পূরণ হলো আমার আশা। মেয়ে ওর হাতে শুতো আর রুপা আমার হাতে।
কিন্তু এখন!
বিয়ের ঊনিশ বছর পর, তাকে আমার আর একটুও আকর্ষনীয়া মনে হয়না। এখন আমার সব অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে কবে, আমি নিজেও জানিনা।
এখন সে আর সাতচল্লিশ কেজি ওজনের ছিপছিপে তরুণী নেই, সাতষট্টি কেজি ওজনের একজন মোটা মহিলা।
এখন তার তিলটাকেও বেমানান মনে হয়। গলার নীচে মাংসের ভাঁজ দেখতে খুব বিশ্রী দেখায়। তাকে হাতের উপর নিয়ে কখন ঘুমিয়েছি মনে করতে পারিনা। শেষবার তারা কবে গুণেছি মনে করতে পারিনা। তার ভ্রু গুলোও জোঁড়া ভ্রু হয়ে কপাল ছেয়ে গেছে। তার পাতলা ভুঁড়িটা বড় হয়ে নীচের দিকে ঝুলে পড়েছে।
সপ্তাহ বা দশদিনে, খুব প্রয়োজন না হলে তার দিকে ফিরে শোয়াও হয়না, তাকে তেমন ছোঁয়াও হয়না।
কখনো সে পাশ ঘেষে আসতে চাইলে বলি,
“সরো তো রুপা, গরম লাগছে। তোমাকে দেখলেও গরম আরো বেশি লাগে। এক্সারসাইজ বা ডায়েট করতে পারোনা তুমি?”
“কিভাবে করবো? তিনটা বাচ্চাই তো সিজারিয়ান। একটু বেশি ব্যায়াম করলে সেলাইয়ে ব্যথা পাই।” অভিমানের সুরে বলে সে।
“এরপরও তোমার ওজন কমানো দরকার, অনেক মোটা আর সাথে বুড়িয়েছোও তুমি।” সত্যি কথায় বলি আমি।
মন খারাপ করেই হয়তো ও অন্য দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
আচ্ছা, ও কি তখন আগের কথা মনে করে চোখের জল ফেলে? জানিনা, জানতে ইচ্ছে করেনা। ও বড্ড বুড়িয়ে যাচ্ছে, আমার আর ভালো লাগেনা। আমি অন্যপাশ ফিরে মোবাইলে নাটক বা ফানি ভিডিও দেখে হাসি।
পরদিন, আমি বলি,
“তোমার কাপড় খুলে শোয়ার অভ্যাস পরিবর্তন করো রুপা, দেখতে ভালো লাগেনা। সব মাংসের দলা থপথপ করে। রাগ করোনা সত্যি বলছি।”
“কিন্তু একসময় তো তুমি তাই পছন্দ করতে!” সে অবাক হয়েই বলে।
“তখন তুমি সুন্দরী ছিলে।”
রুপা কি মন খারাপ করলো কথাটা শুনে? মিথ্যে তো কিছু বলিনি, আসলেই সে তখন অনেক সুন্দরী ছিলো। সেটাও তো সত্যি বললাম।
আরেকসময় বলি,
“রুপা, তোমার এতো ভ্রু কোত্থেকে এলো, প্লাগ করোনা?”
“না, সে তো পাঁচ বছর ধরে করছিনা।”
“কি! এতোদিন?”
“হ্যাঁ, তুমি খেয়াল করোনি!” (ও যেন খুব অবাক হয়।)
“কি জানি, তা করছো না কেনো? খুব বাজে দেখাচ্ছে কিন্তু।”
“শুনেছি অনেক গোনাহ, বেশি প্লাগ করলে পাগলও হয়ে যেতে পারে। আর বয়সও হচ্ছে না! ছেলে মেয়ে বড় হচ্ছে।”
একদিন তো বাড়াবাড়ি খুব বেশিই করে ফেলি হয়তো। অবশ্য তখন তা মনে হয়নি।
রুপা শুয়েছিলো। সে না জানে মতো আমি তার কিছু ছবি তুলি। ছবি দেখি আর হাসতে থাকি, আমার হাসি বন্ধই হতে চায়না।
রুপা জানতে চাইলে তাকে দেখায়।
বলি, “কাপড়বেধ করে বের হওয়া এতো বড় পেটের মালকিন আমার বউ, বিশ্বাস হয়?
বলো, আমার পাশে তোমাকে মানায়?? হাহাহা…”
হাসতে হাসতেই বলি।
রুপাও হাসে।
আচ্ছা, সেদিন কি সে কষ্ট পেয়েছিলো?
হাসির আড়ালে কি তার কান্না লুকানো ছিলো?
আরো ক’দিন পর মাথা ঘুরে পড়ে যায় রুপা। মেয়ে আমাকে ফোন করে জানায়। এসে দেখি, মাথায় পানি ঢালছে, আরো বেশি বুড়ি দেখাচ্ছে তাকে। চোখের নীচে একগাদা কালি।
“কি হয়েছে তোদের মায়ের?” জানতে চাই আমি।
“ক’দিন ধরে ডায়েট করছে, তাই বেশি দূর্বল হয়ে গেছে।”
মনে মনে অপরাধবোধ অনুভব করি, আমার জন্যই সে চেষ্টা করছে। তবে অতটুকুই।
তাকে বলি,
“ডায়েট করা তোমাকে দিয়ে হবেনা।”
“ব্যায়ামও তো করতে পারিনা, আর কিভাবে কি করবো?”
“দাঁড়াও ভেবে দেখি, হয়তো কোনো মেডিসিনে কাজ হতে পারে।”
“আচ্ছা।” বলে সে।
আমি বাইরের ছিপছিপে মেয়েদের দিকে তাকাই আর রুপা’র সৌন্দর্য্যের কথা ভেবে আফসোস করি। তবে তাকানো পর্যন্ত, খারাপ কিছু ভাবতে পারিনা। আমার নিজেরও মেয়ে আছে। তবে, এটা কি সব হাজব্যান্ড চায় না, ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে সুন্দরী, আকর্ষনীয়া বউয়ের আঁচল তলে বিশ্রাম নিতে?
আরেকদিন, আমার অফিসে পুরুষ মহিলা, কিছু জুনিয়র কলিগ বসে দেখি আলোচনা করছে। তারা আমাকে দেখেনি, খেয়াল করেনি। আলোচনার বিষয়বস্তু কিন্তু আমি।
এক নারী বলে, মিনহাজ সাহেবের বয়স কতো হবে?
আরেক নারী’র ভাষ্য,
“পঞ্চান্ন তো হবেই।
উনি যথেষ্ট বয়স লুকাবার চেষ্টা করেন , প্রতিদিন ক্লিন সেভ, ভালো ড্রেস আপ।”
এক পুরুষ সহকর্মী বলে,
“ধুর না, অতো বয়স হয়নি, বড় জোর পঞ্চাশ হবে।”
“না, না আরো অনেক বেশি হবে।” আরেকজনের মতবাদ।
“উঁহু , গত দুই বছর ধরে ডায়াবেটিস হওয়ায় ত্বক কিছুটা ঝুলে পড়েছে।”
“তবে এর চেয়ে বেশি দেখায়, তাই না?”
“হুম, মাথায়ও টাক পড়ছে।”
ওদের সবার মুখে, আমাকে ঘিরেই কথা’র ফুলঝুরি!
বলে কি এরা! তার বয়স মোটে সাতচল্লিশ! আর এদের মনে হচ্ছে পঞ্চাশ, পঞ্চান্ন!
তা কি করে সম্ভব?
মিনহাজ এর মন খারাপ হয়ে যায়। তাহলে সেও বুড়িয়ে যাচ্ছে! কই, রুপা তো কখনই বলেনি এ কথা। ও তো তাকে হাঁটতে বসতে বলে এসেছে। মন খারাপ করেই সন্ধ্যায় তিনি বাসায় যান।
বাথরুমের আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে চান বারবার।
সত্যিই কি তাকে পঞ্চাশ পঞ্চান্ন দেখায়?
অনেকক্ষণ নিজেকে দেখেন, আসলেই মাথার তালুটা চুল হীন, বেখাপ্পা দেখাচ্ছে, চামড়ায় আগের টাইট ভাব নেয়। বাথরুম থেকে বের হয়ে রুপাকে ডাকেন তিনি,
“রুপা, শোন তো।”
“কি?”
“আমার বয়স কতো, তুমি জানো তো, না?”
“হ্যাঁ, জানবো না কেনো? সাতচল্লিশ।”
“দেখতে কতো মনে হয়?” ভয়ে ভয়েই তিনি জানতে চান।
“সত্যি বলবো?”
“অবশ্যই সত্যি বলবে।” বললেও গলায় জোর কম।
তার মনে ভয় হয়, না জানি রুপা কতো বলে!
“আমার কাছে তোমাকে সবসময় জোয়ান মনে হয়, সাতচল্লিশ লাগেনা। মনে হয়….”
“কতো?”
লজ্জানত হয়ে সে বলে,
“পঁয়ত্রিশ, সাঁইত্রিশ মতো,
আমার নিজেকেই বড় লাগে তোমার চেয়ে।”
কি বলে এই মেয়ে! আমি সারাক্ষন তার দিন দিন অসুন্দর হয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলি।
আমি অবাক হই আর ভাবি, তার এতো এতো সৌন্দর্য দেখলাম না! সে চার বছর, আমার অসুস্থ মায়ের সেবা করলো। সিজার করে আমার তিনটা বাচ্চার জন্ম দিলো। তাদের, আমার পেছনে কতই না সময়, আদর, যত্ন, ভালোবাসা ব্যয় করলো। আমার সকালে অফিস থাকে বলে ছেলে মেয়েদের অসুস্থতায় অন্য রুমে নিয়ে সেবা করতো। আমার নিজের অসুখেও সে এতটুকু বিশ্রাম করেনি। কখনোই খাবার দাবার নিয়ে তাকে দু’কথা শুনাবার প্রয়োজন পড়েনি, সবসময় সব পারফেক্ট পেয়েছি। আমার দুই বছর ধরে ডায়াবেটিস হওয়ায়, খাবারের মেনু পরিবর্তন করে আমাকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করছে। কোনোদিন তাদের কাউকে এতোটুকু অপূর্ণতা বুঝার সুযোগ দেয়নি। বিছানায় ইস্ত্রি করা কাপড় পেয়েছি প্রতিদিন। এতো পরিশ্রম, এতো ত্যাগ! আর আমি কিনা সারাক্ষণ তার বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে তাকে বারবার ছোট করেছি!
ছি: এতোটা ছোট মন কিভাবে হলো আমার! রুপা’র সৌন্দর্য তো আমার কারনেই নষ্ট হয়েছে, আমার সন্তানদের জন্ম দিয়ে, তাদের দুধ খাইয়ে, তাই নয় কি?
আমি মনে মনে লজ্জিত, অনুতপ্ত হই। রাতের বেলা, আমি তাকে বলি,
“রুপা, একগাদা কাপড় পরে কিভাবে ঘুমাবে তুমি?”
“না থাক, কাপড় ছাড়া খারাপ দেখায়।”
“মোটেও দেখায় না।”
“দেখায়, আমি অনেক মোটা।”
“কে বলেছে, তোমার চেয়ে হাজারগুন মোটা মানুষ আছে। আর এমন সামান্য মোটা না হলে ভালো দেখায় না।”
“সত্যি বলছো?”
“অবশ্যই সত্যি।”
“রুপা, তুমি ঐ দিকে ফিরে শুচ্ছো কেনো? আমার হাতে আসো।”
“না, না, কি বলো! তুমি পারবেনা, ব্যথা পাবে হাতে।
” ব্যথা পাবোনা, আসো তো।” আমি বলি।
আমি তার ঠোঁটের নীচে তিলে চুমু খাই। আজ তিলটাকে প্রথম দিনের মতোই আকর্ষনীয় লাগছে। অনেক বছর পর আজ আবার মনে হচ্ছে রুপার মতো সুন্দরী মেয়ে পৃথিবীতে দুইটি নেই। রুপার চোখে পানি, সাথে আমার চোখেও…