বাসর ঘর,নিস্তব্ধ পরিবেশ।সাকিব এসে আস্তে অাস্তে খাটের পাশে দাঁড়ালো।শিউরে উঠা অবণীর দুু চোখ দিয়ে হঠাৎ অবিরাম জল গড়িয়ে পড়ছে।রাগ,অভিমান নয়তো কোনো অপরাধের অনুতপ্ততায়। সাকিব মৃদু হেসে বলল,”অনেক রাত হয়েছে,ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।”অবণী কিছুটা অবাক চোখে সাকিবের দিকে তাকালো।ছেলেটা আশ্চর্য রকমের বিস্ময় সৃষ্টি করে কোনো কিছু না বলে বারান্দায় গিয়ে বসলো।অবাক চোখে শুয়ে শুয়ে অবণী সাকিবকে বুঝার বৃথা চেষ্টা করছে।
একমনে ইজি চেয়ারটাতে বসে সাকিব সিগারেট টানছে।আজকের দিনটা সত্যিই আজব।মায়ের কথায় না দেখে অবণীকে বিয়ে করেছে সে।বিয়ের আগে কোনো কথা হয়নি।গাড়িতে আসার সময় অাশ্চর্যজনক ভাবে অবণী একটুও কান্না করে নি।যেন সেখান থেকে কোনোমতে বেরিয়ে আসলেই বাঁচে।বাসর ঘরে হঠাৎ অবণীর কান্না করা সাকিবকে ভাবাচ্ছে।নিশ্চয় মেয়েটা বাড়ির কথা মনে পড়ে কাঁদছে।
সিগারেট টানতে টানতে সাকিব কখন ঘুমিয়েছে তার নিজের মনে নেই।মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে সাকিবের।”তুই কি সারারাত এখানে ঘুমিয়েছিস?”
সাকিব জবাব না দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়।বিষয়টা বড়ই উদ্ভট লাগে অবণীর।স্বভাবগত কৌতূহলী হয়ে শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে মা উনার?”
সাকিবের মা বলল,”সাকিব তিথি নামের একটা মেয়েকে ভালবাসতো,মেয়েটি ও সাকিবকে খুব ভালবাসতো।বিয়ে ঠিক হয়েছিল তাদের কিন্তু একটা রোড এক্সিডেন্টে মেয়েটি মারা যায়।বিষয়টি সাকিব সহজে মেনে নিতে পারে নি।অন্ধকারে থাকতো সব সময়।সিগারেটে ভিতরটা পুড়িয়ে দিচ্ছে।অনেক কষ্টে তাকে তোদের বিয়েতে রাজি করিয়েছি।”
শুনতে শুনতে অবণীর চোখে অশ্রু দেখা দিলো।হায়রে ভালবাসা! কেউ হাজার চেষ্টায় পায় না আর কেউ পেয়েও হারিয়ে ফেলে।শাশুড়ি অবণী দু’হাতে হাত রেখে বলল,”আমাকে কথা দে মা,তুই আমার সাকিবকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনবি?”
মায়ের আকুলতায় না করতে পারলো না অবণী,কর্তব্যের বন্ধনে থাকা সম্পর্ক পালনের সাথে সাথে আরও একটি দায়ভার নিলো।
মায়ের বলা প্রতিটা কথাই কানে গেলো সাকিবের।একটু মৃদু হাসলো,এতটুকু মেয়ে কি দায়িত্ব নিবে তার?আত্মীয় স্বজনের সাথে আরও একটি ব্যস্ত দিন পার করলো সাকিব।ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই বোন অবণীকে ঘরে দিয়ে গেলো।সাকিব বিছানা ছেড়ে সোফায় যাবার উদ্বেগ করতেই, “আপনাকে উঠতে হবে না,আমি সোফায় শুয়ে পড়ছি।” সাকিবের সাথে অবণীর বলা প্রথম কথা। কন্ঠটা সাকিবের কাছে খুব মিষ্টি লাগলো।
-না,তা হয় না।আপনি বিছানায় ঘুমোন।
-আচ্ছা,ঠিক আছে।কাউকে যেতে হবে না।দুজনেই বিছানায় থাকি।মাঝখানে না হয় বালিশ দেয়া থাকবে?
একটু ভেবে সাকিব বলল,”আচ্ছা,ঠিক আছে।”
এক বিছানায় দুজন কিন্তু কেউ কথা বলছে না,কত অপরিচিত ওরা দুজন?
দিন যেতে থাকে,কিন্তু তাদের আচরণে পরিবর্তন হয় না।অল্প কথা বলা,আর গম্ভীরতায় ভরা তাদের সময়।তবে অবণী সাকিবের খুব কেয়ার করে।সাকিব আস্তে আস্তে অবণীর কেয়ারিং এ আগের দুঃস্বপ্ন থেকে বেড়িয়ে আসতে থাকে।সাকিব বুঝতে পারে সে অবণীর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে।লুকিয়ে লুকিয়ে অবণীর অগছালো চুলে মায়াময়ী চেহারা দেখতে সাকিবের খুব ভালো লাগে।অবণীর মুখে সচরাচর হাসি দেখা যায় না,চুপচাপ নিজের দায়িত্ব পালন করে যায়।বিষয়টি সাকিবকে খুব ভাবায়।
সাকিব সন্ধায় যখন ঘরে ফিরে দেখে অবণী বোনের মেয়ের সাথে খেলা করছে আর হাসছে, তখন সাকিব আর একবার অবণীর প্রেমে পড়লো।তাকে দেখে অবণী হঠাৎ চুপ হয়ে যায়।সাকিবের খুব ইচ্ছে অবণীকে নিজের মত করে সাজে দেখতে।তাই সাথে করে আনা নীল রং এর শাড়িটা অবণীকে উপহার দেয়।বিয়ের পর দেওয়া সাকিবের প্রথম উপহার কিন্তু অবণীর মুখে তেমন হাসি নেই।সাকিব অবাক হয় না।
রাতে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে অবণী।অনেক কষ্টে সাকিব অবণীকে শান্ত করে।হাতে হাত রেখে বাচ্চা মেয়ের মত ঘুমিয়ে যায় অবণী।স্পর্শটা সাকিবের কাছে খুব ভালো লাগে।মুখে হাসি নিয়ে সাকিব ঘুমিয়ে পড়ে।সকাল বেলায় অবণীর ভেজা চুলের পানির ছাঁটে ঘুম ভাঙ্গে সাকিবের।প্রথম বারের মত নিজের প্রকৃতির দেয়াল ভেঙ্গে অবণীর মিষ্টি মুখের মায়া চেহারায় প্রতি ভালবেসে সাকিব কাছে আসতে চায়।কিন্তু অবণী বাঁধা দিয়ে মন খারাপ করে সাকিবকে এড়িয়ে যায়।আজো সাকিব রহস্যে পড়লো।বড়সড় একটা রহস্য।
রাতের বেলা যখন সাকিব অবণীর প্রিয় আইসক্রিম নিয়ে রুমে ঢুকল,অবণী তখন কাঁদছিল।
-(শান্ত কন্ঠে)কি হয়েছে,কাঁদছো কেন?
-আমাকে ক্ষমা করে দেবেন, আমি আপনাকে ঠকিয়েছি।
-(মৃদু কৌতূহলী হাসি দিয়ে)মানে?
-আমি জানি, একটা মেয়ের কাছে স্বামীর ভালবাসার চেয়ে বড় সুখ আর কিছুই নেই।কিন্তু আমি আপনাকে আর ঠকাতে চাই না।
-স্পষ্ট করে বলো কি বলতে চাও?
-আমিও একদিন একজনকে ভালবেসেছিলাম।খুব ভালবেসেছিলাম।হয়ত নিজের থেকেও একটু বেশি।কিন্তু ভালবাসার মানুষটি নিজের স্বার্থটা হাসিল করে আমাকে রিক্ত করে চলে গেছে।প্রতারণার জালে আমি আমার সব হারিয়েছি।আপনাকে দেবার মত আমার কাছে আর কিছুই নেই।(কাঁদতে কাঁদতে)
সাকিবের ভেতরে যেন কিসের একটা বাতাস বয়ে গেলো।দমকা ঝড়ো বাতাস,যে বাতাসে সব সুখের প্রদীপগুলো যেন নিভে গেছে।ঠায় বসে পড়ল সাকিব।কাঁদতে থাকা অবণী বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।সাকিব কোনো কথা না বলে বেড়িয়ে গেলো।
রাতে আর বাড়ি ফেরেনি সাকিব।যখন ফিরলো,মায়ের কাছে শুনতে পেল অবণী সকাল হতেই ব্যাগ নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে।মায়ের কৌতূহল না মিটিয়ে পরিবারের কারো কোনো কথার জবাব না দিয়ে সাকিব রুমে এসে দরজা আটকে দিলো।খুব মনে পড়ছে,কিন্তু কেন এমনটা হলো তার সাথে?
সন্ধা হওয়ার আগ মূহর্তে সাকিব শশুড়বাড়ি এসে উপস্থিত হলো।এখানে এসে শুনলো সেই সকালে এসে অবণী দরজা বন্ধ করেছে কিন্তু এখনো খুলে নি।অবণীর মায়ের হাজার ডাকেও অবণী দরজা খুলে নি।
-অবণী?
-হুম।(কান্নাজড়িত কন্ঠ)
-দরজাটা খুলো।
-কেন?
-আমি এসেছি খুলবে না?
অবণী দরজা খুলল,
-কেন এসেছেন?ডিভোর্স লেটার দিতে?
-তোমার কি মনে হয় আমি কি এতটাই খারাপ?
-আমার মনে হওয়া না হওয়াতে কিছু আসে যায় না।
-ভালবেসে ফেলেছি যে।
-অভ্যাস হারিয়েছেন ভালবাসা নয়।আমার চেয়ে ভালো মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েন।দুঃখিত আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্য।
-ঐ,স্বার্থপর পুচকি মেয়ে।এত কথা কোথা থেকে শিখেছো?বলেছি ভালবাসি, তো ভালবাসি।আর কোনো কথা হবে না।বেশি কথা বলবে তো এক থাপ্পড়ে সবকটা দাঁত ফেলে দিবো।
(কাঁদতে কাঁদতে)সাকিবকে জড়িয়ে ধরল অবণী।
-আমিও যে দুষ্টু, দায়িত্ববান বরটাকে ভালবেসে ফেলেছি।
-তাহলে আমাকে ছাড়ার কথা কেন বললে?
-ভয় হয়,যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি?
-আপনি থেকে তুমি?বাব্বাহ !
-দেখেছো কি?আগে তোমাকে মানুষ করবো,কপালে অনেক কষ্ট আছে তোমার।
-হুম,আমিও আমার দুষ্টু-মিষ্টি পুঁচকি বউটার আদর-শাসন সবটুকু পেতে চাই।
-হুম,পাবে।
-ক্ষুধা লেগেছে খুব,সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয় নি।
-হুম,আমারো।দাঁড়াও আনছি।
-(পেছন থেকে ডাক দিয়ে)শুনো?
-কি?
-ভালবাসি খুব।
অবণী একটা প্রাণ খোলা মুক্তঝরা হাসি দিয়ে সামনে থেকে চলে গেল।বহুকালের অপেক্ষিত এই হাসির মাঝেই খুন হবার তীব্র ইচ্ছে সাকিবের।