“ওগো বউ শোনছো”
” আরেকটা বার যদি এইসব ওগো বলে ডাকিস তাহলে তোকে এই ছুরিটা দিয়েই খুন করবো।”
গতকাল ৩ মাস হলো স্নিগ্ধার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে কিন্তু এখনো কোন ফুলশয্যা হয় নি। ফুলশয্যা তো দূরের কথা,শান্তিতে একটুও শয্যাও হয় নি। দেখলেন না একটু ভালবেসে ডাক দিলেই তেলে বেগুলে জ্বলে উঠছে। বিয়ের প্রথম রাত থেকে আমাকে সোফায় ঘুমাতে হচ্ছে। চলেন একটু ফ্ল্যাশব্যাক থেকে ঘুরে আসা যাক।
বিয়ের সব কাজ সম্পূর্ণ করে যথারীতি আজ আমাদের বাসর রাত। আমি রুমে ডুকে দরজাটা বন্ধকে স্নিগ্ধার কাছে গেলাম। ওরে কিছু বলার আগে আমি বই নিয়ে ওর সামনে বসলাম। প্রায় ৩০ মিনিট ওর সামনে বইটা নিয়ে আমি পড়লাম। ও চুপচাপ বসেই রইলো। তারপর আমি বললাম,
— রাত না জেগে ঘুমিয়ে পড়ো। আজ দত্তা গল্পটা সম্পূর্ণ শেষ করে ঘুমাবো।
আমার কথায় কিছু না বললেও একটা অজানা লুকে তাকালো। আমি এতে বিচলিত না হয়ে আবার গল্প পড়ায় মনোযোগ দিলাম। তখন স্নিগ্ধা খাট থেকে নেমে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় আমার শরীরের সাথে স্পর্শ হলো। আমি মুহূর্তেই ওর হাতটা সরিয়ে দিলাম।
— কি হলো? আপনাকে ধরলে কি হলো?
— মেয়েদের স্পর্শ আমার পছন্দ না। (মাথাটা নিচু করে)
— মানে?
— কিছু না। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসে ঘুমিয়ে পরো।
— হুম।
ও ফ্রেশ হয়ে এসে আমার পাশে বসলো তবে স্পর্শ করলো না। পরে বলল…
— মেয়েদের স্পর্শে আপনার সমস্যা কেন? আগে কি কারো সাথে রিলেশন ছিল?
— না আমি কোন মেয়ের সাথেই চলাচল করি না।আমার তো ছেলে ভাল লাগে।
— মানে??(শকড)
–( আমি চুপ হয়ে রইলাম)
— মানে আপনি একটা “গে”( গে মানে যে ছেলে অন্য ছেলের প্রতি দুর্বল)।
আমি চুপচাপ বসে রইলাম। সিগ্ধা যা ইচ্ছা বলতে লাগলো। এটাই স্বাভাবিক। যদি কোন মেয়ে বাসরঘরে প্রথম শুনে তার স্বামী মেয়েদের নয় বরং ছেলেদের প্রতি দুর্বল তাহলে সেটা মানসিক চাপের সৃষ্টির কারন। সিগ্ধা কেঁদে দিয়েছে। আর বলতে লাগলো…
— আপনাকে দেখে প্রথমেই আমার ভাল লেগেছে। আপনার বডি,চেহারা কোনটায় মেয়েলী স্বভাব নেই কিন্তু আপনি সেই ছিঃ। আমি পারবো না আপনার মত ছেলের সাথে জীবন পার করতে। বিয়ের আগে আপনার সাথে আমার কথা বলে নেওয়া উচিত ছিল। এখন তো আপনার থেকেও নিজের উপর বেশি রাগ হচ্ছে। আপনি আমার সামনে থাকবেন না। যান ওই সোফায় গিয়ে ঘুমান। আমার জীবনটা নষ্ট করে দিতে একটা বার কি নিজের কাছে খারাপ লাগে নি। আর কোন দিন আপনি আমার কাছে আসবেন না। সব সময় সোফায় থাকবেন। বিড়াল কোথাকার।।
এই হলো আমার বিয়ের রাতের প্রথম গল্প। সেইদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের মাঝে অনেক দূরত্ব। যদি আমি সব সময় ওরে ভালবেসে ওগো বউ বলে ডাকি তবে ও আমাকে “তুই” বলেই ডাকে। যাক গে, বউ মানুষ একটু রাগ করবে এটাই স্বাভাবিক।
কিছুদিন পর স্নিগ্ধারছোট ভাইয়ের বিয়েতে স্নিগ্ধাকে নিয়ে ওদের বাসায় গেলাম। বাসার সবার সাথে আমার সম্পর্ক অনেক রসালো কিন্তু স্নিগ্ধার চোখে আমি বিষ। হঠাৎ এক সময় দেখলাম স্নিগ্ধা ওর এক বোনের সাথে কেদেঁ কেদেঁ কথা বলছে। আমি রুমে ডুকতেই ও চোখ মুছে ফেলে। তখন ওর বোন আমাকে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। যা বুঝলাম তা হলো আমাকে নিয়েই স্নিগ্ধা যা বলার বলছে। তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।
বিয়েতে কতটুকু মজা হয়েছিল জানি না তবে আমি মজা করলেও স্নিগ্ধা মন মরাই ছিল। বিয়ের কাজ শেষ করে স্নিগ্ধাকে নিয়ে আমি আবার বাসায় ফিরে আসি। রাতে খাটে বসে বই পড়ছিলাম তখন স্নিগ্ধা বলল…
— খাট থেকে যা। আমি এখন ঘুমাবো।
— সিগ্ধা আমি তোমার স্বামী আর তোমার থেকে বয়সেও বড় আমাকে তুই করে বলতে খারাপ লাগে না।
— খারাপ! ফানি কথা তাই না। তোকে তুই করে বলা উচিত।
— দেখো স্নিগ্ধা এইসব ঠিক হচ্ছে না কিন্তু?
— তুই আমার সাথে কি এমন ঠিক করেছিস বলতে পারিস? ৩ মাসের উপর হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে। এর মাঝে একবারও তুই আমায় ছুঁয়ে দেখেছিস। যখন আমাদের বিয়ের ১ বছর পার হবে আর সবাই আঙ্গুল তুলবে ঘরে নতুন সদস্য নেই কেন? তখন তো সবাই আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে আমি বন্ধ্যা।
–স্নিগ্ধা ( চড় বসিয়ে দিলাম)
স্নিগ্ধা কেঁদে চলেছে। আমার এখন কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। তখন স্নিগ্ধা আবার বলতে লাগলো।
— এই একটু আধটু না মেরে, পারলে একেবারে মেরে ফেললেই তো পারিস। সব ঝামেলা মিটে যায়।
আমি আর কথা না বলে রুমে থেকে বেরিয়ে চলে গেলাম। এখন সব দোষ আমার দিকে আছে। আসলে স্নিগ্ধা যা ভাবছে তা নয়। কিন্তু আমি স্নিগ্ধাকে বুঝাতে পারছি না। আমারও ইচ্ছা করে স্নিগ্ধার কাছে যেতে তবে আমি তো প্রতিজ্ঞা বদ্ধ, যত দিন না স্নিগ্ধা ওর ফুফাতো ভাইয়েই কাছে সরি বলছে ততদিন আমি ওর কাছে যাবো না।
সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই নিজেকে ছাদে দেখে অবাক হলাম। সারা রাত ছাদেই ঘুমিয়েছি কিন্তু স্নিগ্ধা একবারের জন্য আসলো না। যাই হোক,আমি রুমে গিয়ে দেখি স্নিগ্ধা এখনো ঘুমাচ্ছে। আমি ওর পাশে বসে ওরে খুব কাছ থেকে দেখতে লাগলাম। মেয়েটাকে বড্ড মায়বী লাগছে। ইচ্ছে করছে আলতো করে ওর চুল গুলো মুখ থেকে সরিয়ে দেই।
হঠাৎ ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল আর সরে গেল। হয়ত হঠাৎ ভয় পেয়ে গেছে। আমাকে দেখে কোন রকমে কাপড় ঠিক করে নিয়ে বলল…
— কি হয়েছে?
— রেডি হয়ে নাও। আজকে একজনের সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাবো তোমায়।
— কোথায়?
— যেখান থেকে আমাদের গল্পের শুরুটা হয়েছে সেখানে। নাও তারাতারি ফ্রেশ হয়ে নাও।
— হুমম
স্নিগ্ধা একটু অস্বাভাবিক ভাবে বাথরুমে চলে গেল আর আমি রেডি হতে লাগলাম।
একটা পার্কে আমি আর স্নিগ্ধা বসে আছি। তখনই স্নিগ্ধার ফুফাতো ভাইটা আসলো। স্নিগ্ধা ওর ভাইকে দেখে আমার দিকে তাকলো। আমি বললাম…
— তোমরা একটু বসো। আমি তোমাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি।
— হুম।
আমি ওদের থেকে আড়ালে গিয়ে বসে ওদের কথা শুনতে চাইলাম। আসলে স্নিগ্ধার ফুফাতো ভাই হলো কমন জেন্ডার। যাকে আমরা মজা করে “গে” বলে থাকি। সেটা ওর দোষ নয়, ওর শরীরে জন্মগত মেয়েলী হরমোর বেশি। যেটা সম্পূর্ণ উপরওয়ালার দান। এতে ওর কোন হাত নেই।
এক পর্যায় স্নিগ্ধা বলতে লাগলো।
— রাফি সরি রে ভাই। আসলে তোর সাথে তোর সমস্যা নিয়ে অনেক মজা করতাম।তোকে একবার চরও মেরেছি। পারলে আমায় মাফ করে দিস।
— এসব বলিস নে বোন।
তখন আমি ওদের সামনে গেলাম। স্নিগ্ধা আমাকে দেখা মাত্র চোখ মুছতে লাগলো।
তখন আমি বলতে শুরু করলাম…
— স্নিগ্ধা মনে পড়ছে আমি পরিবারের সাথে যেদিন তোমাকে দেখতে গিয়ে ছিলাম ওইদিনের ঘটনা। ওইদিন আমি তোমাদের বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম তখন ভুলবশত তোমার রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন মনে হয় রাফি তোমার মেকআপ বক্স থেকে কিছু গালে লাগাচ্ছিল তখন তুমি রাফিকে “গে” বলে একটা চড় মারো। আমি তখন আলাদা ভাবে রাফির সাথে কথা বলে জানতে পারি তুমি কমন জেন্ডারদের দেখতে পারো না। আমার ইচ্ছা ছিল তোমাকে বিয়ে করবো না কিন্তু তখন বাবা মা তোমাকে পছন্দ করে বলে আমি আর না করতে পারি নি। তাই সেদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা নেই রাফির কাছে তোমাকে মাফ চাওয়াবো আর আজকে সেটা পেরেছি। আমরা সবাই মানুষ। প্রতি টা মানুষের শরীরে কোন না কোন রোগ আছে। তাই বলে সে কি সমাজ থেকে বহির্গত। তেমনি রাফির মত হাজারও ছেলে মেয়েলী হরমোনের স্বীকার। যেটা সাধারন মানুষ খারাপ দৃষ্টিতে নিয়েছে আর হ্যা আমার কোন এই সমস্যাটা নেই। তোমাকে মাফ চাওয়ানোর জন্য তোমার সাথে নাটক করতে হলো। তাই সরি।
আমার কথা শেষ হতেই স্নিগ্ধা আমায় জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো।
— আমি নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছি। আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ। আর কখনো কারো সমস্যা নিয়ে মজা করবো না। সবাইকে সমান চোখে দেখবো।
— কান্নার কিছু হয় নি। নিজের ভুল বুঝতে পারাটাই সব থেকে বড়। তুমি বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক।
এরপর রাফির সাথে নাস্তা করে ওরে বিদায় দিয়ে বাসায় চলে আসলাম। আজ থেকে আমাদের জীবনটা নতুন মোড় নিবে।