আয়েশার বুক ধক করে উঠলো। হঠাৎ এমন কিছু চোখে পড়বে তা সে ভাবেনি। বই গুলো ঠিক করে রেখে তাড়াতাড়ি কাগজ গুলো তুলে নিল। পুরোনো ডায়েরিতে রাখা হয়েছিল কাগজ গুলো,আজ বইপত্র ঘাটতে গিয়ে বের হয়ে গেল। কাগজ গুলো টেবিলের উপর রেখে আয়েশা ছুটে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আসলো। বুকে হাত দিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে।
চেয়ারে বসে কাগজ গুলো একটা একটা করে খুলে দেখতে লাগলো। আয়েশার চোখ ভিজে আসছে। কত বছর আগের লেখা। কত স্মৃতি জুরে রয়েছে কাগজ গুলোর মাঝে তা শুধু সে জানে। কাগজ গুলো দেখতে দেখতে একটা কাগজের লেখায় চোখ আটকে গেল–
“আমি আপনাকে কতটুক ভালোবাসি তা শুধু আমিই জানি স্যার। প্রতিদিন একটা করে চিঠি লিখি আপনার জন্য,ভাবি আপনাকে দিব। কিন্তু সাহস করে কোনদিন দিতে পারিনি। কাল আমার জন্মদিন ছিল। আপনি আসেননি। আপনাকে দুইবার বলা হয়েছিল আসার জন্য কিন্তু আপনি আসেননি। আমার রাগ হয়েছিল খুব আপনার উপর। বাবাকে বলেছিলাম আপনার কাছে আর পড়বো না আমি। পরে জানতে পারি আপনি অসুস্থ ছিলেন সেদিন। একশ চার ডিগ্রি জ্বরে বিছানায় পড়েছিলেন। অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন জানেন স্যার”
আয়েশা অবাক হলো নিজের এমন ছেলেমানুষির উপর। সে ভেবে পাচ্ছেনা তখন সে এতটা পাগল কিভাবে ছিল। আরো কিছু চিঠি রয়েছে। সেগুলো দেখা হলো না। আয়েশার মা খাবারের জন্য ডাকছে,দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি আয়েশার। কাগজ গুলো বইয়ের ভেতর রেখে দরজা খুলে খেতে চলে গেল আয়েশা।
রাতে খাবার সময় নেহাল সাহেব আয়েশার দিকে তাকিয়ে বললেন, ছেলেটা ভালো আছে তাই না রে মা?
আয়েশা খেতে খেতে বলল, হুম ভালোই তো।
বিয়ের পর দেশ-বিদেশ ঘুরবি। তোর জীবন একেবারে সেট হয়ে গেল। এখন শুধু আহাম্মকটাকে কিছু একটা করে দিতে পারলেই হলো। পড়াশোনা তো কিছু করেনা সারাদিন গল্প-কবিতা নিয়ে থাকে। এগুলো করে কি জীবন চলবে!
বাবা খেতে দাও তো। আর এগুলো কাকে বলছ? রফি ভাইয়া তো নেই এখানে।
নেই বলে কি বলা যাবেনা। আহাম্মক জন্ম দিয়েছি একটা।
এখন খাও। আর শুনো বিয়ে টিয়ে এখন হচ্ছেনা। ছেলেকে বলো প্লেন দিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে পাত্রী খুঁজে নিতে। আমি এখন বিয়ে করবো না।
কথা শেষ করে আয়েশা উঠে চলে গেল। প্লেটে ভাত রয়ে গেছে কিছু। নেহাল সায়েব একটু চিন্তিত বোধ করলেন। তার একমাত্র মেয়ে আয়েশা কোনদিন এমন ছিল না। ইদানীং বিয়ের কথা বলার পর থেকে সবার সাথে মেজাজ দেখিয়ে কথা বলছে। নেহাল সাহেবের মনে ক্ষীণ সন্দেহ আছে– আয়েশা হয়তো কাওকে পছন্দ করে,তাই বিয়েতে রাজি হচ্ছেনা। এই বয়সে মেয়ের পছন্দের মানুষ থাকবেনা তা হয় না। সময়টা পালটে গেছে। স্কুলের ছেলে-মেয়েরা পালিয়ে বিয়ে করছে,কয়েক মাস পর বাসায় ফিরে ছেলে বাবা-মাকে বলছে ‘আমাদের ভুল হয়ে গেছে। ওর পেটে আমার বাচ্চা আছে। মাফ করে দাও আমাদের।’ তার তুলনায় আয়েশা অনেক ভালো আছে। নেহাল সাহেবের খাবার শেষ করতে একটু কষ্ট হলো। তার মনে হতে লাগলো গলায় কিছু একটা আটকে আছে,কথা বলতে গেলেও তা বাধা দিচ্ছে।
ঘরে এসে আয়েশা খাতা কলম নিয়ে বসল। প্রতিদিনের মত আজকেও কিছু একটা লিখবে ভাবছে। কলম হাতে নিয়ে কোনকিছু না ভেবেই লিখল–
“মাঝ রাত্রিতে কারো গলায়,
ঘুম ভাঙে আমার
জানার পাশে দাঁড়িতে যাই
খুঁজি- কার গান!”
আয়েশা ভ্রু কুঁচকে নিজের লেখার দিকে তাকালো। কিসব আজেবাজে কথা এগুলো। কোন মানেই হয় না এই লেখার। তার মেজাজ হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেল। খাতা কলম ছুড়ে ফেলে দিল। খাটের এক কোণে কাঠের মধ্যে কলম দিয়ে একটা কিছু লেখা দেখতে পাচ্ছে। আয়েশা আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গেল লেখাটা দেখার জন্য। তার হাতের লেখা। লেখাটা দেখে আয়েশার চোখ ভিজে এলো।
নিউমার্কেটের সামনে দিয়ে আসার সময় একটা দোকানে সুন্দর দেখে একটা পুতুল দেখতে পেল আয়েশা। পুতুল নিয়ে খেলার বয়স তার নেই,বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে তার। পুতুলটা সামনে থেকে দেখার ইচ্ছে থাকলেও চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আগের মত হাঁটতে লাগলো আয়েশা। এমন সময় তার ঠিক পাশ দিয়ে একজন গিয়ে আবার তার দিকে ফিরে এলো। আয়েশা প্রথমে বুঝতে পারেনি ব্যাপার টা। লোকটা তার পাশ দিয়ে হাঁটছে। হঠাৎ লোকটা একটু থেমে গিয়ে বলল, আয়েশা না?
আয়েশা দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে তাকিয়ে দেখলো কে তার নাম ধরে ডাকলো। লোকটা আবার বলল, আমাকে চিনতে পারছো?
আয়েশা চিনতে পেরেছে। ইনি আরিফ স্যার। যার জন্য প্রতিদিন কত চিঠি লিখেছে সে,তাকে না চেনার কিছু নেই। আয়েশা ভ্রু কুঁচকে বলল, না। চিনতে পারলাম না ঠিক।
আমি আরিফ। তোমাকে ক্লাস এইটে প্রাইভেট পড়াতাম,মনে আছে?
ও হ্যাঁ চিনেছি।
কেমন আছো?
ভালো। আপনি? হাতে বল-ব্যাট যে! আপনার ছেলের জন্য বুঝি?
হ্যাঁ বলতে পারো ছেলের জন্য। তবে…
কি করেন আপনি এখন?
চাকরি পেয়েছি একটা। নেহাল চাচা কেমন আছে? ওনাকে আমার কথা বলো খুশি হবে অনেক।
জি আচ্ছা। আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।
আচ্ছা আয়েশা আমি যাই। আরেকদিন দেখা হলে বলো কাজে এসেছিলাম তো একটু!
আচ্ছা।
আয়েশা পেছন ঘুরে হাঁটতে লাগলো। তার চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে। চোখ মুছতেই আবার ভিজে যাচ্ছে। আজও কিছু বলতে পারলোনা সে,বলে আর কি হবে। স্যারের এখন হয়তো দুই তিনটা বাচ্চা আছে। তারা প্রতিদিন নানা ধরণের বায়না করে স্যারের কাছে। আয়েশার নিজের উপর রাগ হচ্ছে অনেক। কি হতো যদি আগেই বলে দিত স্যারকে তার মনের কথা! হয়তো তাদের একটা সংসার হতো। একটা ছোট্ট মেয়ে হতো। মেয়েটা সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করলে আয়েশা বকতো,তখন আরিফ এসে বলত “আহা বকছ কেন? আমার কাছে দাও তো ওকে” আয়েশার চোখ আবারো ভিজে এসেছে। সে হাত দিয়ে চোখ মুছে ফেলল।
আরিফ রাস্তা পেরিয়ে অটোতে উঠলো। আজ তার বোনের ছেলের জন্মদিন। তার জন্যই ব্যাট-বল কেনা। আরিফের মন একটু খারাপ হয়ে গেল। আয়েশার সাথে অনেকদিন পর দেখা হলো কিন্তু কথা বলতে পারলোনা সে। নিজের উপর চাপা অভিমান হচ্ছে তার। বাসায় গিয়ে আজও হয়তো মার মুখে শুনতে হবে “আরিফ বিয়েটা করলে কি হয় তোর? আর কতদিন এভাবে কাটাবি তুই?” কোন একটা কারণে বিয়েটা করতে চাচ্ছেনা আরিফ তা কাওকে বলতে চায়না,হয়তো নিজেকেও না।