আমাকে আরেকটা সুযোগ দেয়া যাবে?
~ না।
~ কেন দেয়া যাবে না। মানুষ মাত্রই তো ভুল। মানুষ ভুল তো করবেই। তাই বলে কি তাকে ভুল শুধরানোর আরেকটা সুযোগ দেয়া যায় না।
~ না।
~ কেন দেয়া যায় না। আমি তোমাকে ভালোবাসি আক্কু।
~ কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসিনা।
~ কেন তুমি আমাকে ভালোবাসো না। তুমিই না একদিন বলেছিলে আমাকে ছাড়া তোমার জীবন অচল। তাহলে আজ কেন আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো।
~ কারণ আমার জীবনে দখল দেয়ার অধিকার তুমি হারিয়ে ফেলছো।
~ আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না আক্কু।
~ তাহলে মরে যাও।
~ আক্কু প্লিজ আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও।
আমি মেয়েটার কোনো কথা না শুনেই সামনের দিকে হাটা ধরলাম। পিছনে মেয়েটা কান্নারত সুরে অনেকবার আক্কু আক্কু বলে ডাকছিলো।
তবে তার সম্বোধনটা আমার কানে পৌঁছার আগেই বাতাসের সাথে মিলিয়ে যায়। আমি একবার ও আর পিছনে ফিরে তাকায়নি।
কারণ যদি আবার মেয়েটির প্রতি আমার মায়া জন্মে যায়। যদি আরেকবার আমি তার প্রেমে পরে যাই।
যদি আরেকবার আমার মন তাকে নিয়ে স্বপ্ন বাধে। না আমি এ হতে দিবোনা।
আমি এখন একা বাঁচতে চাই। হালকা বাতাসে খট করে ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্ক আমার চাইনা।
প্রেম ভালোবাসা এগুলা ত্রাসের খেলা।
এ খেলায় নিজেকে দ্বিতীয়বারের মত জড়াতে চাইনা।
..
..
রাস্তার একপ্রান্তে হাটতে হাটতে হঠাৎ পূর্বের স্মৃতিগুলি মনের কৌটায় উদিত হলো। কিছু কালো অতিত আমাকে বারবরের মত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
যা ভুলার মত শক্তি আমার মত কোনো মানুষ ও রাখেনা। এইত কিছুদিন আগের কথা….
কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে একটা মেয়েকে দেখে আমি এই সর্বপ্রথম পাগল হয়ে গেছিলাম।
শ্যাম বর্ণের মেয়ে হলেও মুখের মধ্যে কেমন যেন মায়া মায়া ভাব ছিলো। যা তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
সে যখন হাসতো তখন আমার কাছে মনে হত যেন মুক্তা ঝড়ছে। হাসার সময় তার দাঁতগুলি সূর্যের আলোর ন্যায় চমকাতো।
আর গালে ঠোল পরার দৃশ্যটা দেখে মনে হয়েছিলো এযে আমার স্বর্গের রাণী। আমি অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলাম।
টানা টানা একজোড়া চোখ। ইচ্ছে হচ্ছিলো তখনি এই চোখের অতল সাগরে ডুবে মরি। আহ আমার স্বর্গের পরী।
নবীনবরণ অনুষ্ঠান কখন যে শেষ হলো তা ঠেরই পেলাম না। ছাত্র ছাত্রীদের ভিড়ে মেয়েটিও যেন কোথায় উধাও হয়ে গেলো।
সমস্ত কলেজ জুড়ে মেয়েটিকে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। নাহ সেই চেহারার দেখা কোথাও মিললো না।
অবশেষে মন খারাপ করে বাড়িতে চলে আসলাম।
..
পরেরদিন টাইম হতেই আমি কলেজে উপস্থিত।
বন্ধু নামের হারামীগুলা আমারদিকে ফ্যালফ্যাল করে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন মনে হচ্ছে আমি মাত্র শুক্রগ্রহ থেকে অবতরণ করেছি।
আমি তাদের এসবে আর মনযোগ দিলাম না।
আমার মন তো রাজকুমারী কে নিয়ে ব্যস্ত।
চোখজোড়া তার অবয়ব খুজাতে। আর কানগুলা তার পায়ের আওয়াজ শুনাতে। এক দৃষ্টিতে কলেজের গেইটের দিকে তাকিয়ে আছি।
মন যে আর বাধা মানছে না। কারোর জন্য অপেক্ষা করা যে কতটুকু কষ্টকর তা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি।
তারপরও প্রিয় মানুষের জন্য এইটুকু অপেক্ষা তো করা যায়-ই তাইনা। ক্লাস শুরু হয়ে গেলো এখনো তার আসার কোনো খবর নেই।
আমিও হাল ছাড়ার পাত্র নই। অপেক্ষা করেই যাচ্ছি করেই যাচ্ছি। মন বারবার কেঁদে উঠছিলো এই ভেবে যে ওর কিছু হয়নি তো।
আজকের মত ক্লাস শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু মেয়েটা এখনো আসলো না।
হৃদপিণ্ডে ভারী চাপ অনুভব করলাম।
ইচ্ছে হচ্ছিলো মাথার সবগুলা চুল ছিঁড়ে ফেলি।
সেদিন ও বাড়ি ফিরে আসলাম। কোনো কিছুতে মন বসছিলো না। সমস্ত রাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলাম।
বারবার মনে একটা প্রশ্নই জাগতেছিলো ওর কিছু হয়নি তো।
এভাবে দু’দিন পর্যন্ত চলতে লাগলো। আমার অবস্থাও এই দু’দিনে বেশ অবনতির দিকে।
চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো।
অবশেষে আমার বন্ধু রেহানের কাছ থেকে মেয়েটার ঠিকানা যোগাড় করলাম।
কাগজে লিখা দেখলাম নাম শাকি। বাসা নং তারপর রোড নং।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমি ইতিপূর্বে মেয়েটার নাম সম্পর্কে ও অবগত ছিলাম না।
..
আমি তড়িতগতিতে শাকিদের বাসায় উপস্থিত হলাম। কর্নিংবেল চাপতেই এক ভদ্র মহিলা দরজা খুলে দিলেন। এবং বললেন…
~ কাকে চাই
~ আন্টি আমি সাকির ফ্রেন্ড।
~ ওহ। বাবা ভিতরে এসো।
~ আন্টি শাকির কি হয়েছে। কয়েকদিন থেকে কলেজে আসছে না যেন।
~ কয়েকদিন থেকে তার একটু জ্বর বাবা তাই কলেজে যাচ্ছেনা। তুমি তার রুমে একটু বসো।
আমি তোমার জন্য কফি নিয়ে আসছি।
~ ঠিক আছে আন্টি।
আমি শাকির রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।
চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝড়ছিলো। নিষ্পাপ চেহারায় এক অন্যরকম মায়া তার। এই তিনদিনে শাকি অনেক শুকিয়ে গেছে।
আমি তার চেহারার দিকে তাকাই আর চোখের নূনাজল মুছি। শেষ পর্যন্ত আমার শাকিকে এভাবে দেখতে হলো।
মনেমনে বললাম বিধি আমার শাকির সব কষ্ট আমাকে দিয়ে দাও। তার বদলে আমার শাকিকে সুস্থ করে দাও।
আন্টির পায়ের আওয়াজ শুনে চোখমুখ সব মুছে ফেললাম যাতে আন্টি কিছু টের না পান।
আন্টি কফির কাপ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন. ..
~ একি বাবা? তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে। চলো ভিতরে চলো।
~ জ্বি না আন্টি ও ঘুমিয়ে আছে। তাই ওকে জাগানো ঠিক হবেনা।
~ একি তোমার চোখে পানি কেন?
~ এসব কিছুনা আন্টি। আমি এখন আসি আন্টি।
~ আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।
~ আল্লাহ হাফিজ আন্টি।
~ আরে যাওয়ার আগে নাম তো বলে যাও।
~ আমার নাম আক্কু।
~ অকে বাবা আল্লাহ হাফেজ।
আন্টির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম।
প্রতিটা সেকেণ্ডে সেকেণ্ডে আমার কষ্টগুলো আরো তীব্র হতে লাগলো।
হাজারো রকমের ভাবনা মনে উদয় হতে লাগলো যদি আমার শাকির কিছু হয়ে যায়। তাহলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো।
আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো তখন। কোনোমতে কান্না তামিয়ে চোখে জল ছিটিয়ে বসে রইলাম।
এভাবে বসে বসে রাত কাটিয়ে দিতাম। আর সকাল হলেই কলেজে গিয়ে শাকির জন্য অপেক্ষা করতাম।
ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করে তার বাসায় চলে যেতাম আর টু মেরে সে কিভাবে আছে তা জেনে নিতাম।
এ কয়েকদিনে আমার অবস্থাও দিন দিন অবনতি হচ্ছে। বন্ধুরা বলেছে এভাবে না খেয়ে থাকলে রাতে না ঘুমালে আমি নাকি মারা যাবো।
আমি তাদের এসব কথার কোনো পরওয়া করিনা। আমার সাকির জন্য অন্তত আমি বেঁচে থাকবো।
..
১০ দিন পর হঠাৎ এক সকালে রেহান কল দিয়ে বললো শাকি নাকি আমার সাথে দেখা করার জন্য কলেজের ক্যাম্পাসে আপেক্ষা করছে।
আমার মনে তো আনন্দের জোয়ার বইতে লাগলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো ফ্লোরে কতক্ষণ নাচতে থাকি।
কতক্ষণ পর মনে হলো শাকি আমার জন্য অপেক্ষা করতেছে। আর আমি চাইনা আমার প্রিয়া এভাবে আমার জন্য অপেক্ষা করুক।
তাই হাতের কাছে শার্টটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাহিরে আজকে কোনো রিক্সা ও নেই।
সুতরাং এখন ২৫ মিনিটের রাস্তা দৌড়ে পাড়ি দিতে হবে। আমার শাকি আমার জন্য অপেক্ষা করতেছে ।
এইভেবে আমি দৌড় শুরু করেছিলাম। আর কখন কিভাবে যে ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছলাম তা টেরই পাইনি।
ক্যাম্পাসে এসে দেখলাম শাকি আকাশের দিকে কি যেন দেখছে। চেহারায় রোগা রোগা ভাবটা এখনো প্রস্ফুটিত।
রোগা রোগা ভাবটা এখনো কাটেনি। ঘড়ির দিকে তকাতেই দেখলাম ২৫ মিনিটের রাস্তা আমি ১৫ মিনিটেই পাড়ি দিয়েছি।
সাকি আমাকে বললো…..
~ আপনি এভাবে হাপাচ্ছেন কেন?
~ চোরি করতে গেছিলাম তো, তাই ধরা খেয়ে ফেলছি।
~ কি চোরি করতে গেছিলেন শুনি?
~ তোমার মন চোরি করতে গেছিলাম।
~ আপনি তো অলরেডি আমার মন চোরিই করে ফেলছেন।
~ তাহলে আর দেরি কিসের। আমি পাগলের বুকেই তো তুমি পাগলির জায়গা। অতঃপর বুকটা প্রশস্ত করে দিলাম।
~ শাকি বুকে লাগার পরিবর্তে গালে থাপ্পড় বসিয়ে বললো আর কিছু বলবা না?
~ উঁহু। লাভিউ (গালে হাত দিয়ে)
~ টু।
..
আমি আর শাকি একে অপরকে খুব বেশী ভালোবাসতাম। একে অপরকে কখনো এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে যেতাম না।
রাগ অভিমান করে আমরা অনেকদিন যাবৎ কথা বলতাম না।
তারপরও আমাদের ভালোবাসার মধ্যে কোনো কমতি দেখা দেয়নি।
ঠিক আগে যতটুকু পরিমাণ একে অপরকে ভালোবাসতাম ততটুকু পরিমাপ এখনো একে অপরকে ভালোবাসি।
একে অপরকে যদিও সব সময় আমরা বুঝতে পারিনা। তারপরও আমরা দুই আত্মা এক দেহ।
আজ সেই মানুষটিকে কাঁদিয়ে একা ফেলে চলে আসছি। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম সবকিছু ভাগাভাগি করে বহন করবো। কিন্তু ভাগ্য তা হতে দিলোনা।
..
একটা পিচ্চি ছেলের ডাকে বাস্তবে ফিরলাম । ভাইয়া ভাইয়া বলে একটা পাঁচ টাকার নোট চাইতেছিলো ছেলেটা।
সারা রাত চলে যাচ্ছে অথচ সে নাকি এখনো কিছুই খায়নি। আমি আমার হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত ১২:৩০ বাজে।
চারিদিকে শুনশান নীরবতা । কয়েকটা ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ ছাড়া কিছুই শুনা যাচ্ছেনা।
সিলেট শহরের ল্যাম্পপোস্টগুলি অনবরত জ্বলতে আছে। চল্লিশ মিনিটের রাস্তা পাড়ি দিলেই সিলেট।
পিচ্চিটাকে জিজ্ঞাসা করলাম কি নামরে তোর? উত্তরে বললো আশরাফুল ।
আমি তার হাতে একটা পাঁচশত টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললাম এই টাকাটা রাখ। আর শাকির জন্য দোয়া করবি। এই বলে তাকে বিদায় দিলাম।
সিলেটের দিকে হেটে চলছি। গন্তব্য একটা কাপড়ের দোকান। আসার সময় একটা দোকান থেকে সাথে করে কাফন কিনে নিয়ে আসলাম।
শাকির ভয়েজটা আরেকবার স্মরণ করলাম। কি মধুর ভয়েজ ছিলো তার। আরেকটা গুণ আছে তার আনলিমিটেড হাসা।
..
ঘড়ির দিকে তাকাতেই ডাক্তারের ভবিষ্যৎ বাণী স্মরণ হলো । ডায়েরীটা হাতে নিতেই চোখ থেকে অশ্রুঝরা শুরু হয়ে গেলো।
শেষপ্রান্তে কলম চলালাম প্রিয় শাকি অনেক কথা তোমাকে বলার ছিলো অনেক পথ উভয়ে অতিক্রম করার ইচ্ছে ছিল।
কিন্তু ডাক্তার বলেছে আমি ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত। আমার আয়ু আর মাত্র ১ ঘন্টা বাকি। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
জানো আজ না খুব কাঁদছি । কিন্তু কেউ আমার চোখের জল মুছে দিলোনা। এই দেখ শাকি আমি কাঁদছি।
আমার কান্নার পানি ডায়েরীর প্রত্যেকটা পৃষ্টাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। আমাকে ক্ষমা করে দিয়। এই বলে আমি চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগলাম।
আমার কান্না দেখে সেদিন আকাশ ও কাঁদছিল। বুকের ব্যথা ক্রমশ বাড়ছিলো। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম।
শেষবারের মত আমি আরেকটিবার শাকির চেহারা স্মরণ করলাম। আমি জানি এই মুহূর্তে শাকি ও কাঁদছে ।
আর মনে মনে আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। আমার চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসতেছে।
শ্বাস নিতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। চোখজোড়া গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হল। আর সেখানেই আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ হয়।
মরার সময় ও আমার চোখগুলা থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরছিলো।
..
আমি জানি শাকি আমার মৃত্যুর সংবাদ শুনে বেহুঁশ হয়ে যাবে। ডায়েরীর হেড লাইনে লিখে রাখছিলাম শাকি যেন ডায়েরী পড়ার সময় না কাঁদে।
তবুও আমি জানি শাকি কাঁদবে। আমি জানি তার কান্নার পানি গাল বেয়ে ফ্লোরে পরবে। কিন্তু আমি তাকে সান্তনা দিতে পারবো না।
তার চোখের জলগুলি মুছে দিতে পারবো না। শাকি আজ একা। চির একা।
আমার লাশের পাশে শাকি চিৎকার দিয়ে কাঁদবে আর বলবে আক্কু উঠো প্লিজ।
তবুও আমি তার কথা শুনবো না। শাকি বারবার বলতে থাকবে। আক্কু প্লিজ উঠো। অবশেষে মাটিতে লোটিয়ে কাঁদতে থাকবে।
আমার আত্মা বলবে তাকে একটু কাঁদতে দাও। তবুও সে খুশী থাকুক। আমি চাই শাকি ভালো থাকুক।
সব সময় ভালো থাকুক।