মিহিনকে যখন আমি ফোন দিলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে।দিনের আলো নিভে এখন সোডিয়ামের আলোতে রাস্তাগুলো অন্যরকম রুপ ধারন করেছে।এসময় রাস্তাগুলো বেশ ব্যাস্ত থাকে, ভরে যায় গাড়িতে।কাজ শেষে একটু শান্তির আশায় সবার গন্তব্য এখন বাসার দিকে।
অবশ্য মিহিনদের বাসার এই রাস্তায় খুব একটা গাড়ি দেখা যায় না।মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ির শব্দ শোনা গেলেও সেটাও খুব একটা বেশি না।আমি মিহিনদের বাসার সামনে এসে একটু দোটানায় পড়ে গেলাম।ওকে ফোন দেবো, নাকি মেসেজ।
কিছুক্ষন আগে যখন মিহিনকে ফোন করেছিলাম তখন ওর কণ্ঠে ছিল বিষণ্ণতার ছাপ।আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলেছিলাম,
-নাস্তা করেছো?
মিহিনের দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত কণ্ঠে তখন ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো,
-কেও বানিয়ে দেয়নি।
মিহিনের এই কথাটা শুনে কেমন যেন ভেতরটা কেপে উঠলো।কথাটা সহজ হলেও এর ভার সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।আর ছিলও না।
ফোনটা কাটতেই আম্মা এসে নুডুলসের সাথে চা দিয়ে বললো,
-দেখ তো চায়ে চিনি ঠিক আছে কি না?
আম্মার কথায় আমি চায়ের কাপটা হাতে নিলাম।ভালবাসায় মেশানো নাস্তা বানিয়ে দেওয়ার জন্যে আমার বাসায় আমার মা থাকলেও মিহিনের জন্যে কেও নেই।তাই ওর কষ্টটাও একটু বেশি।আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম,
-একটা বক্সে নুডুলস দাও তো।
আমার কথায় আম্মা কি বুঝলো জানি না।তবে মুচকি হেসে বললো,
-এভাবে না নিয়ে বাসায় এনেও তো খাওয়াতে পারিস।
কথাটি বলে আম্মা আর দাড়ালো না,চলে গেলো।অবশ্য মিহিনের সাথে যে আমার একটা ভাল বন্ধুত্ব আছে এইটা আম্মা বেশ ভালভাবেই জানেন।কিন্তু সম্পর্কটা যে একটু অন্যরকম এইটা জানেন কি না আমার জানা নেই।
আমি আর কিছু না ভেবে মিহিনকে ফোন দিলাম।ও কি এখনও মন খারাপ করে আছে।দু বার রিং হতেই মিহিন ফোনটা ধরলো।হয়তো হাতেই ছিল।আমি কিছু বলার আগেই মিহিন বললো,
-তুমি এসময়,এখানে?
মিহিনের কথায় আমি কিছু বললাম না।তারমানে মেয়েটা আমাকে আগেই দেখেছে।
মিহিনদের বাসাটা তিন তলায়।আর ওর রুমটা আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক আমার সামনে,উপরের দিকে।অবশ্য এখান থেকে ওর রুমের বেলকুনিটা স্পষ্টই দেখা যায়।আমি বেলকুনির দিকে তাকাতেই একটা অবয়ব দেখতে পেলাম।অন্ধকারে এখান থেকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে ওখানে কেও দাঁড়িয়ে আছে।আমি একটু চুপ থেকে বললাম,
-একটু নিচে আসবে?
মিহিন কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
-আসছি।
কথাটি বলেই মেয়েটা ফোনটা কেটে দিল।আমি আবারও বেলকুনির দিকে তাকালাম।তবে এখন আর সেই অবয়বটা দেখতে পাচ্ছি না।
শুনেছি গার্লফ্রেন্ড নাকি বয়ফ্রেন্ডের জন্যে রান্না করে নিয়ে আসে কিন্তু আজ আমার সাথে উল্টোটা হলো।তবে এতে আনন্দের পরিমানটাই বেশি।
মিহিন আমার সামনে এসে দাড়াতেই ওকে পাশের বেঞ্চে বসিয়ে দিলাম।এসময় এখানে খুব একটা লোক দেখা যায় না।এলাকাটা বেশ নিরিবিলি।আমি নুডুলসের বক্সটা সামনে এনে ওর পছন্দের চকলেট আইসক্রিম আর চিপস পাশে রেখে দিলাম।কিন্তু এখানে এভাবে খাওয়াটা কি ঠিক হবে,এসব ভাবতে ভাবতে আমি মিহিনের দিকে নুডুলস বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-হা করো?
মিহিনকে খায়িয়ে দেওয়ার সময় ওর চোখের কোনে জমে থাকা পানি আমার চোখ এড়ালো না।তবে এখন আমি ওদিকে তাকাতে চাই না।আর তাকানোর সাহস ও নেই আমার।
নুডুলস শেষে আইসক্রিমের বাটিটা আর চিপস মিহিনের হাতে দিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম,
-কান্নাতে তোমাকে একদমই মানায় না।বাইরে বেশ শীত,যাও বাসায় যাও।
আমার কথায় মিহিন কিছু বললো না।আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রইলো।মিহিনের এই তাকানোটা আমার কাছে বেশ পরিচিত।এর অর্থও আমার জানা।আমি কিছু বলার আগেই মিহিন আস্তে করে বললো,
-আমার সাথে হাটবে একটু?
মিহিনের কথায় আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই মেয়েটার গোমরা মুখে হাসি ফুটে উঠলো।মিহিনের মুখে এই হাসিটা দেখার অপেক্ষাতেই ছিলাম।
সোডিয়ামের আলোতে মিহিনকে আজ অন্যরকম লাগছে।কিছুক্ষন আগেও যে মেয়েটা গোমরা মুখে বসে ছিল এখন ওকে দেখে সেটা একদমই বোঝা যাচ্ছে।ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাস এই শীতেও কেমন যেন ভাল লাগছে।একটু এগুতেই মিহিন আমার হাতটা শক্ত করে ধরে একটু রাগি গলায় বললো,
-হাতটাও ধরতে পারো না।এটাও কি বলে দিতে হবে।
মিহিনের কথায় আমি মুচকি হাসলাম।আমার হাসি দেখে মিহিনের ঠোটের কোনেও মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো।আমি কিছু না ভেবে মিহিনের হাতটা আরও একটু শক্ত করে ধরলাম আর মনে মনে বললাম,
এই হাতটা আর ছাড়া যাবে না।কোন ভাবেই না,কোন মতেই না।