এভাবে কলেজ পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় অন্য একটা কলেজে আসতে হবে কখনো ভাবতেই পারি নি।
সবাইকে ছেড়ে নতুন জায়গায় আসাটা কারো জন্যই আনন্দের হতে পারে না। তাই গত তিনদিন ধরে খুব খারাপ লাগছে।
গ্রামে থাকাকালীন মন খারাপ হলে নদীর পাড়ে গিয়ে একদৃষ্টে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
কিন্তু ইট পাথরের কোলাহলময় শহরে সেটা অসম্ভবই বলা যায়।
গত তিনদিন ধরে নিকোটিনের ধোয়ায় নিজেকে পোড়াচ্ছি তবে আশ্চর্যের বিষয় একটুও কষ্ট হচ্ছে না।
.
আমি তুষার। গ্রামের ছেলে। গ্রামীন মুক্ত আলো বাতাসময় পরিবেশেই বেড়ে ওঠা। শিক্ষাজীবনও শুরু গ্রামের একটি প্রাইমারী স্কুলে।
ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় মোটামুটি ভালো ছিলাম। যার ফলোশ্রুতিতে শিক্ষকদের ও বন্ধুবান্ধবদের প্রিয় ছিলাম।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর অনেককিছু বুঝতে শিখলাম। জীবনের মানেটা কি সেটা নবম শ্রেনিতে উঠে বুঝলাম।
তখন বয়স ছিল চৌদ্দ বছর। এটি বয়ঃসন্ধির মাঝামাঝি সময়। এই বয়সটা উঠতি ছেলেমেয়েদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
কেননা এই বয়সে ছেলেমেয়েদের শারীরিক ও মানসিক উভয় পরিবর্তনই হয়।
তারা অনেককিছু বুঝতে শিখে এবং কেউ কেউ দুঃসাহসীক কাজে ঝুকি নিতেও দ্বিধা করে না। এই বয়সটাকে আবেগের বয়সও বলা যায়।
কারন এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আবেগ জিনিসটা বেশি মাত্রায় লক্ষ্যনীয় হয়। কেউ কেউ ভিত্তিহীন ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে যায়।
একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে নিজের মধ্যকার আবেগকে যতটা পরিমান নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছি।
.
দেখতে দেখতে কলেজ জীবনে প্রবেশ করলাম। কলেজটা আমাদের গ্রাম থেকে একটু দূরে।
প্রথমে দুইতিন জন ছাড়া বাকি সব সহপাঠীরাই অপরিচিত ছিল। আস্তে আস্তে সবার সাথেই ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
কলেজে এসে নতুন একটা নাম পেয়েছিলাম “অদ্ভুত”। আসলে আমার আচার আচরন কিছুটা অদ্ভুত টাইপের। সহজে আমাকে কেউ বুঝতে পারে না।
তবুও কেন জানি সহপাঠী, কলেজের বড় ভাই থেকে শুরু করে সবারই প্রিয় ছিলাম।
পড়াশুনায় মোটামুটি ভালো হওয়ার জন্য অনেকেই আমার কাছে আসত পড়াশুনা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা করার জন্য।
তবে আমি সবসময়ই চেষ্টা করতাম যতটা সম্ভব মেয়েদের থেকে দূরে থাকতে।
.
কিন্তু কিছুদিন ধরে আমার আসে পাশে একটি মেয়ের উপস্থিতি লক্ষ্য করি। আমি যতটা সম্ভব মেয়েটাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছি।
তবুও মেয়েটা আমার পিছু ছাড়ছে না। পড়া বোঝার বাহানায় আমার সাথে কথা বলা শুরু করে। মেয়েটি অনেক মিশুক প্রকৃতির।
ওর নাম অয়ন্তিকা দাস অন্তি। সবাই অন্তি বলে ডাকে। আমাদের সাথে একই শ্রেনিতে পড়ে। মেধাবী ছাত্রী বিধায় সবার প্রিয়।
উচ্চতা মাঝারি ধরনের। গায়ের রং শ্যামলা হলেও চেহারায় মায়াবী ভাব আছে। যা একজন ছেলেকে আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।
আস্তে আস্তে দুজন বন্ধু হলাম। এত তাড়াতাড়ি কিভাবে পরিবর্তন হলাম তা নিজেই বুঝতে পারলাম না।
পড়াশুনা, আড্ডা প্রায় সব জায়গায়ই আমাদের দুজনকে একসাথে দেখা যেত।
যেহেতু আমি ওর ক্লোজ তাই অনেক বড় ভাইরা আমাকে অনুরোধ করতো ওর সাথে রিলেশন করিয়ে দেবার জন্য।
আমি সবাইকে না করে দেয়ায় তারা ভাবতে থাকে অন্তি আর আমার রিলেশন আছে। যদিও এতে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না।
তবে বেশ কিছুদিন ধরে অন্তির ভিতর পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। ও আগের থেকে অনেক বেশি আমার কেয়ার করা শুরু করে।
কথায় কথায় কিছু একটা বুঝাতে চাইত। আমি জানতাম ও আমাকে পছন্দ করত আমিও যে করতাম না তা নয়।
কিন্তু নিজের জীবনের লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়া যাবে না বিধায় ওর সাথে মেলামেশা কমিয়ে দেই।
এমনকি একটানা ৫ দিনের মত কথা বলা বন্ধ করে দেই।
.
দিনটা ছিল রবিবার। টিফিন টাইমে মাঠে বসে ছিলাম। আসে পাশে অনেকে ছিল।
অন্তি হঠাৎ কোথা থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে যে ও আমাকে অনেক ভালবাসে।
আমি এই ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সাথে সাথে ওকে ছাড়িয়ে বাসায় চলে আসি।
” আসলে মেয়েরা মাঝে মাঝে এমন দুঃসাহসিক কাজ করে যা আমাদের কল্পনার বাইরে।”
আমিও ওর উপর দূর্বল হয়ে পড়ি। এটা কখনো কাউকে বুঝতে দেই নি।
পরিবারের কথা ভেবে নিজের দূর্বলতাকে কাটিয়ে কলেজ পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেই।
কারন অন্তির পরিবার ভালই প্রভাবশালী তাই ওইখানে থাকলে আমার আরও সমস্যায় পড়তে হত। এখন আবেগের বশে আমাকে পছন্দ করছে।
কিন্তু আমি চলে গেলে এই আবেগ কাটিয়ে উঠতে ওর সমস্যা হবে না। তিনদিন হল নতুন একটা জায়গায় এসেছি।
কলেজ ছেড়ে আসার পর অনেকেই ফোন দিছে। আমি এভাবে হঠাৎ করে কলেজ ছেড়ে চলে আসবো কেউ সেটা ভাবে নি।
অন্তিও কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করছিলো তাই নিজের সিম কার্ড পরিবর্তন করে ফেলি।
কারন কথা বললেই আবার মায়ায় জড়িয়ে যেতে পারি। আমাকে ভালবাসাটা ওর অপরাধ ছিল না কিন্তু আমারো কিছু করার ছিল না।
.
সবকিছুকে মাটি চাপা দিয়ে নতুন কলেজ, নতুন পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছি।
এই কলেজেও ভাল কিছু বন্ধু পেয়েছি যারা আমাকে সবসময় সাহায্য করে। তবে মেয়েদের কাছ থেকে সবসময় দূরে থাকি।
এটা নিয়ে অনেকের মনে কৌতুহল কিন্তু কখনো কেউই কিছু জানতে পারে নি। আমি আমার মত করে এগিয়ে যেতে থাকি।
দেখতে দেখতে এইচএসসি পরিক্ষা শুরু হয়। ২ বিষয় বাদে অন্য সব পরিক্ষা গুলাই ভালো হয়।
.
আস্তে আস্তে সময় পার হতে থাকে। পরিক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হই।
নিজের খরচ চালানোর জন্য ২ টা টিউশনিও যোগার করি।এভাবেই দিনগুলো ভালই সামনে এগুতে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নিজেকে ভালোভাবে তৈরি করতে থাকি। মাঝে মাঝে আগের বন্ধুদের কাছ থেকে অন্তির খবর নিই।
ও নাকি আর আগের মত নাই। বেশিরভাগ সময় মনমরা হয়ে থাকে। বাসা থেকে এখন কম বের হয়।
এগুলো শুনে সত্যিই ওর জন্য অনেক খারাপ লাগছে। আমিই ওর এই অবস্থার জন্য দায়ী কিন্তু আমার কিছুই করার নেই।
নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার শিকলে আমি আটকে আছি। যখনই ওর কথা মনে পড়ে তখনই সিগারেটের ধোয়ায় নিজের কষ্টগুলোকে উড়িয়ে দেই।
এতে একটু হলেও নিজেকে হালকা মনে হয়।সিগারেট খাওয়া প্রথম শুরু করি যেদিন কলেজ পরিবর্তন করে নতুন জায়গায় আসি ওইদিন।
যে ছেলেটা ভাবত সিগারেট খাওয়া ভালো না, সিগারেট খেলে শরীরের ক্ষতি হয়, সেই ছেলেটা আজ প্রায়ই প্রতিদিনই সিগারেটের ধোয়া উড়ায়।
জীবনটা কত অদ্ভুত। টিউশনির টাকা দিয়ে জীবনযাপন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রায়ই প্রতি মাসের শেষের দিকে হাতে টাকা থাকে বিধায় একবেলা খেয়ে কাটাতে হয়। কোনো কোনোদিন না খেয়েই দিন পার করে দেই।
এই বিষয়গুলো কখনই কাউকে বুঝতে দেই নি।
জীবন কতটা কষ্টের, এই জীবন সংগ্রামে টিকে থাকা কতটা কঠিন তা একজন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানই ভালো জানে।
.
এর মধ্যে এইচএসসি পরিক্ষার রেজাল্ট বের হয়। অল্পের জন্য জিপিএ -৫ মিস করি। রেজাল্টের দিন অনেক কেদেছি।
ভাবছিলাম নিজের লক্ষ্য থেকে হয়তো অনেক পিছিয়ে গেছি। দেখতে দেখতে ভার্সিটি ভর্তি পরিক্ষা কাছে আসায় পড়াশুনার চাপ অনেক বেড়ে গেছে।
নিজেকে যতটা সম্ভব ভালোভাবে প্রস্তুত করতে থাকি। কিন্তু বিপত্তি ঘটল ভর্তি পরিক্ষার দুদিন আগে।
হঠাৎ অনেক অসুস্থ হই। হাতে যা টাকা আছে তা ভর্তি পরিক্ষা দিতে যাওয়ার জন্য রেখেছিলাম। তাই আর ডাক্তার দেখানো হলো না।
যার ফলে প্রথম ভার্সিটি ভর্তি পরিক্ষা দেয়া হলো না। এতে মন অনেক খারাপ হয়ে যায়। ৪ দিনের দিন সুস্থ হই।
৩ দিন পর আরেকটা ভার্সিটিতে পরিক্ষা আছে। তাই দিনরাত পড়াশুনা করি। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত অল্পের জন্য চান্স পাই নি।
এতে অনেকটা ভেঙে পড়ি।
ভাবছি আর কোনো ভার্সিটিতে পরিক্ষা দিবো না। কিন্তু নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভেঙে পড়লে চলবে না।
তাই আরো তিনটা ভার্সিটিতে পরিক্ষা দেই। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যাই। ভর্তি পরিক্ষার চাপে অন্তির কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম।
.
অনেকদিন বাড়িটিতে যাওয়া হয় না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম কয়েকদিনের জন্য বাড়ি থেকো ঘুরে আসি। পরেরদিনই বাড়ির পথে রওনা দিলাম।
গ্রামটা সেই আগের মতই আছে। বিস্তৃত ধানের ক্ষেত, সবুজ গাছগাছালির সমারোহ। শুধুমাত্র রাস্তাঘাটের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।
আগের মাটির রাস্তাগুলোতে ইট দেয়া হয়েছে। আসার পথে কয়েকজনের সাথে দেখা হলো। বাড়ির সবাই আমাকে দেখে খুশি হলো।
এতটা পথ জার্নির ফলে ক্লান্ত তাই কিছু খেয়েই ঘুমিয়েছি। বিকেলে কয়েকজন বন্ধু আসল দেখা করতে। আমার আসার খবর ওরা আগেই পেয়ে গেছে।
ওদের সাথে একটু হাটতে বের হলাম। করিম চাচার চায়ের দোকানে আড্ডা দিলাম। অনেকদিন কলেজের ঐদিকে যাওয়া হয় না।
না যাওয়ার কারন অন্তিই। কিন্তু আজ সিদ্ধান্ত নিলাম অন্তিদের এলাকায় যাবো। বন্ধুদের নিয়ে পুরনো কলেজের দিকে আসলাম।
ভাবছিলাম অন্তির সাথে দেখা হবে না। কিন্তু বাজারে ওর মায়ের সাথে দেখে কিছুটা থমকে গেলাম।
কারন এই অন্তি আর আগের অন্তির সাথে অনেক তফাৎ।
চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে, আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গেছে। ওকে এই অবস্থায় দেখে অনেক খারাপ লাগলো।
তবে একটা জিনিস ভালো লাগছে যে ও আমাকে দেখতে পায় নি। দেখতে পেলে ওর কষ্টটা আরো বেড়ে যেতো। তাই দ্রুত ওখান থেকে কেটে পড়ি।
কয়েকদিন বাড়িতে থাকার পর আবার ব্যস্তময় শহরে চলে আসি।
.
নতুন শহর, নতুন ভার্সিটি, অচেনা মানুষদের ভীরে নিজেকে গুছিয়ে নেয়া চেষ্টা করি।
ক্লাস, প্রাইভেট, পড়াশুনা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মিলিয়ে সময় ভালোই কাটতে থাকে। মাঝে মাঝে অন্তির কথা মনে পড়ে।
ওর কথা মনে পড়লে ছাদে গিয়ে একাকী আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। দেখতে দেখতে এক বছর কেটে যায়।
একদিন এলাকার এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলল আগামী সপ্তাহে নাকি অন্তির বিয়ে। খবরটা শোনার পর কতটা খারাপ লাগছে বলে বোঝানো যাবে না।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই শেষবারের জন্য অন্তিকে দেখতে যাবো। ওর বিয়ের দিন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেই। তবে বাড়ির কাউকে জানাই নি।
কারন এবার আর বাড়িতে বাড়িতে যাবো না। অন্তিকে দেখেই আবার শহরে চলে আসবো। সন্ধ্যা ৭ টা। অন্তিদের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছি।
কিন্তু এখানে বেশি সময় থাকা যাবে না। আমাদের এলাকার লোকজনও বিয়েতে আসতে পারে।
এরমধ্যে বরযাত্রী চলে আসাতে তাদের সাথে ভিতরে প্রবেশ করি যাতে কেউ বুঝতে না পারে।
অন্তিকে আড়াল থেকে বধুর বেশে একবার দেখেই ওখান থেকে বেড়িয়ে পড়ি। পথে বসে কতসময় কেদেছি তার হিসেব নেই।
অতঃপর রাতেই শহরে উদ্দেশ্যে রওনা দেই……….
.
মধ্যবিত্তদের ভালোবাসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এভাবেই চোখের সামনে হারিয়ে যায় কিন্তু তাদের কিছুই করার থাকে না।
কারন তাদের সবসময়ই কঠিন বাস্তবতাকেও সহজে মেনে নিতে হয়।