“মারে ভাত দিবি নাহ্? ”
ছেলের কথা শুনে সুফিয়া বেগম আচঁলে মুখ লুকালো। আজ চার দিন হলো ঘরে খাবার নেই। বাপ মরা এই ছেলের খুদা মিটাবে কিভাবে? তবুও হাসি মুখে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বললো,,,” তুই থাক আমি পাশের বাসা থেকে ভাত নিয়ে আসি “মায়ের কথায় ছেলের মুখে হাসি ফুটলো। মায়ের আচল ধরে বললো,, মা নাক টেনে দেখ ওই বাড়িতে কত ভালো ভালো রান্না হয়েছে, আমার জন্য একটু বেশি করে আনিস, আর শোন তুই আবার সব খেয়ে নিস নাহ্। ছেলের কথার কোন উওর না দিয়েই ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়লো সুফিয়া বেগম। ছোট একটা বস্তিতে থাকে মা ছেলে।
কয়েকদিন থেকেই গায়ে খুব জ্বর, তাই কাজে যেতে পারে নি। পাড়ার নরেন ডাক্তার নাড়ি দেখে বললো,,,কত খাটবে নীলের মা, নিজের শরীরের দিকে তো একটু নজর দেও। দু বেলা ভালো মন্দ কিছু খাও। ডাক্তার বাবুর কথায় উওর না দিয়ে মুছকি হাসলো সুফিয়া। ছেলেটার গায়ে জামা নেই ভালো। কয়েকদিন থেকে খুব বায়না করেছে এবারের ঈদে একটা নতুন জামা তার চাই। ছেলেকে আশা দিয়ে রেখেছে কিনে দিবে। এখন নিজের শরীরের দিকে নজর দিতে হবে নাহ্। মনকে বুঝ দেয় নিজে নিজে। সামনেই এক ব্যবসায়ীর বাসা। আজকে নাকি ওই বাসাতে কার বিয়ে। কত ভালো ভালো খাবার রান্না হয়েছে নিশ্চয়! তা তো হবেই বড় লোক বলে কথা, ভালো ভালো খাবার না পেলে কি বিয়ে হবে?? গেটের কাছে যেতেই,,, এই এখানে কী হুমমম??? যাও যাও স্যার দেখলে সমস্যা।
দাড়োয়ানের কথায় সুফিয়া একটু সাইটে সরে গেলো। তারপর বাসার ভিতরে উকি দেওয়ার চেষ্টা করলো কেউ আসছে নাকি এই দিকে। নাহ্ কেউ নেই সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। এই সুযোগে দাড়োয়ানের কাছে এসে বললো,,,ভাই আমারে কিছু খাবার দিবেন? ছেলেটা না খেয়ে আছে। আমার শরীরটা ভালো নাহ্ তাই কাজেও যেতে পারি নি।সুফিয়ার কথা শুনে দাড়োয়ান আশে পাশে লক্ষ করলো ভালো ভাবে। তারপর হাতের ইশারাতে আরও কাছে ডেকে বললো,,,বোন তুমি একটু দাড়াও আমি তোমার জন্য ভাত আর ডাল নিয়ে আসি হবে তো?? দাড়োয়ানের মুখে আশার বানী শুনে দুই চোখটা চকচক করে উঠলো।
মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উওর দিলো। খানিকক্ষন পর একটা পুটলিতে করে কিছু খাবার দিলো সুফিয়ার হাতে। আর কোন কথা নাহ্ বলে পা চালিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাটা দিলো। ছেলেটা খুব খুশি হবে খাবার পেয়ে। ঘরে ডুকতেই নীল মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,, মা আমার জন্য ভাত এনেছিস? চোখটা ছলছল করে উঠলো সুফিয়ার। ছেলেকে আরও শক্ত করে ধরে বললো,,, হ্যাঁ বাবা এনেছি,চল খাইয়ে দিই। মারে তুই ভালো ভালো খেয়ে আমার জন্য এইগুলো আনছিস তাই নাহ্? যাহ্ আমি খাবো নাহ্ মরে যাবো।
ছেলের কথায় সুফিয়ার মনটা হুহু করে কেদে উঠলো। চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বললো,,,নারে সোনা, আমি খাই নি দেখ আমার পেট খালি। নীল মায়ের পেটটা ভালো করে টিপে দেখে বললো,,,,খাস নি মা?? আয় তোকে খাইয়ে দিই। ছেলেও কাদে মাও কাদে। মারে তুই কাদিস কেন? ছেলের কথায় চোখের পানি মুছে বলে, কাদি নি সোনা আয় খাইয়ে দিই। বলেই এক লোকমা ছেলের মুখে তুলে দেয়। নীল চিবুতে চিবুতে বলে,, মারে আয় আমিও তোকে খাইয়ে দিই। বলেই মায়ের মুখে ভাত তুলে দিলো। ছোট্ট হাতের ভাত মা মুখে নিলো ঠিকই কিন্ত গলা দিয়ে তার নামছে নাহ্। মা রে বড় লোকেরা অনেক ভালো ভালো খাবার খায় তাই না? হ্যাঁ বাবা তারা তো বড় লোক। তুই চিন্তা করিস নাহ্ মা আমিও বড় হয়ে তোকে ভালো ভালো খাবার খাওয়াবো।
ছেলের কথার কোন উওর নেই মায়ের কাছে। রাতে সুফিয়ার জ্বর আরও বেড়ে গেলো। ছেলেকে বুকে নিয়ে বললো,,,জাদু সোনা, মাকে ছাড়া একা থাকতে পারবি নাহ্?কেন তোকে ছাড়া থাকবো কেমনে??? তুই জানিস নাহ্ তোকে জড়িয়ে নাহ্ থাকলে আমার ঘুম আসে নাহ্।জানি তো আমার জাদু টা আমাকে ছাড়া ঘুমাতেই পারে নাহ্। মারে একটা গল্প শুনাবি?পাগল টা কি গল্প শুনাবো? শুনা নাহ্ একটা গল্প,রাজকন্যার গল্প। রাজপত্র পুঙখিরাজ ঘোড়ায় কিভাবে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে???আচ্ছা মা রাজপত্র দেখতে কেমন গো? ওরা কি সোনার তৈরি???
ছেলের কথায় হেসে বললো,,, পাগল সোনার হবে কেন, ওরাও মানুষ তোর মত। আমার নীল সোনার মত। আচ্ছা কেমন গো?? মস্ত বড় বাড়িতে থাকে ওরা বড় বড় চুল কত সুন্দর দেখতে একক্কেবারে তোর মত দেখতে। হিহি মারে আমিও রাজকুমার হবো। বড় হো তুইও হবি। বড় হলেই রাজকুমার হয় বুঝি?? হয় তো??? বাবা কী রাজ কুমার ছিলো মা? আর তুই রানী??
না তবে তুই রাজ কুমার হবি। এবার ঘুমা আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। মারে তোর গা এতো গরম কেন? ডাক্তার কাকু কি বলেছে শুনিস নি? ভালো ভালো খেতে হবে। কালকে তোর জন্য ঔষুধ আনবো। মজিদ দাদু বললো ওর দোকানে কাজ করলে টাকা দিবে। নাহ্ বাবা লাগবে নাহ। তুই পড়ালেখা করবি অনেক বড় হবি তারপর আর আমাদের দূঃখ থাকবে নাহ্ কোন। আচ্ছা মা এবার গান শুনা আমি ঘুমাই।
সুফিয়া ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে,,,ঘুম যাও জাদুরে ঘুম যাও সোনা রে তুই যে আমার সোনা জাদু সকাল হলো। সূর্য উঠলো কিন্তু সুফিয়া উঠলো নাহ্।
নিয়ে যাওয়া হলো কবরস্থানে। ছোট নীল আজ বড় হয়েছে,,,মায়ের পাশে ছাড়া ঘুমাতে পারে নাহ্, তাই মায়ের কবরের পাশেই রাতে ঘুমায়। মাকে ছাড়া যে তার ঘুম হয় নাহ্।
সমাপ্ত