প্রেয়সীর বিয়েতে এসেছি, বেশ আনন্দিত লাগছে, ফুরফুরা মনোভাব আর বিয়ের আমেজ দুটোই আমাকে বেশ রোমাঞ্চকর কিছু উপহার দিতে চাচ্ছে। মেয়েটির সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো মাত্র কয়েকবছর গাণিতিক হিসাবে বছর ছয় হবে আর কি। এতগুলো বছরে মেয়েটাকে অনেক জালিয়েছি। এখন আর আমাকে সহ্য করতে পারেনা। বিয়েটা তার মা বাবার পছন্দেই করতেছে, কিন্তু প্রেম কিন্তু আমাদের দুজনের পছন্দেই ছিলো। আজ বিয়ে করার সময় পরিবার স্ট্যাটাস, ধনী গরীব, উচ্চতা গায়ের রং সব কিছু মেপে দেখে বিয়ে করতে যাচ্ছে। কিন্তু প্রেমের বয়স টা এমন ছিলোনা, কিছু মিষ্টি প্রলাপ, আর ভালোবাসার গল্পই যথেষ্ট ছিলো। তখন স্বপ্ন গুলো তালপাতার ঘরে সাজানো হয়, ইচ্ছাগুলো নদীর পাড়ে বালুর উপর লেখা হয়, গান গুলো গিটারের তারে বাধা হয়, আর স্বপ্ন গুলো একজনের চোখে তাকিয়ে আরেকজন সাজায়।
কিন্তু বিয়ের সময় এগুলো সব পালটে যায়, তখন ইটের তৈরি দালান চাই, তিনবেলা খাবার চাই, অঙ্গবস্ত্র চাই, গান নয় এবার টাকা রুজির সন্ধান চাই। একসময় যে স্বপ্নগুলো খুবই মধুর হয় বিয়ের কথা আসতেই তা ধুসর বালুচর হয়। তখন মিষ্টি কথায় আর পেট ভরেনা, নদীর পারে বালুর কনাকেও মনে হবে, বালুর কনা না হয়ে ভাতের চাল হয়ে যা, রান্না করে ক্ষুধা মেটাবো।
এসব কথাই ভাবছিলাম, শিলা এসে আমার কাধে হাত দিয়ে বলতে লাগলো, কিরে বিয়ে বাড়িতে এসেছিস একটা নাচ হবে নাকি। আমি না নাচলে কে নাচবে। চল তুই আর আমি পার্টনার হয়ে নাচি।
তাকে নাচের অফার করতে মুচকি হাসি হাসলো। সে অনেক দিন ধরেই আমার সাথে নাচের পরিকল্পনা করে রেখেছিলো, কারন আমাকে সে অন্যচোখে দেখে ঐ আর কি ভালোবাসার চোখে। শিখা আমার লাইফে থাকার কারনে কখনো বলতে সাহস করেনি, কিন্তু শিখার বিয়ের কথা শুনে, অনেক হ্যাপিলি কন্ঠে বলেছিলো “তাহলে আমার রাস্তা এবার ক্লিয়ার।” তার ইংগিত বুঝতে কিন্তু আমার খুব বেশি কষ্ট হয়নি। এর আগেও এমন অনেক ইংগিত পেয়েছিলাম, কিন্তু নজরে নেইনি।
শিলার হাত ধরে মঞ্চের সামনে উপস্থিত হলাম, সৈকত ডেক্সসেট পরিচালনা করছিলো, জোরে আওয়াজ দিয়ে বললাম, “মেরি ইয়ার কি সাদি হে” গানটা প্লে কর। সৈকত অবাকতর চোখে আমার পানে তাকালো, গানের শব্দ কমিয়ে,
-নাঁচবি নাকি তুই?
-হ্যাঁ
-পাগল টাগল হলি নাকি।
-আরে বেটা তুই গান লাগা পাগল হবে তোর সালা, বিয়ে বাড়িতে নাচবো না তবে কি কাঁদবো?
সৈকত কোন কথা না বাড়িয়ে গান খুঁজতে লাগলো, এক সময় আমার পছন্দের গানটিই প্লে করলো, আমি আর শিলা নাচতে লাগলাম, আমার সাথে তাল মিলিয়ে শিলাও কোমর দুলিয়ে নাচ যেই না শুরু করলো, বিয়ে বাড়িতে যেন জান ফিরে আসলো, সবাই হৈহুল্লোড় করতে লাগলো, ছেলেরা শিষ দিতে লাগলো, অর্ধবয়স্ক পুর্নবয়স্ক সবাই বিয়ের আমেজ গ্রহন করতে লাগলো। টানা সাত মিনিটের নাচের পর দুজনেই হাফাতে লাগলাম। এরইমধ্যে দরজার দিকে নজর পড়লে শিখাকে দেখলাম, সেও নাচ আর গান উপভোগ করলো কিন্তু নাচ শেষ হতেই তার চোখের কোনে পানি ঝরে পড়তে দেখালাম। আমার নজর পড়াতে সে নিজেকে আড়াল করলো, কিন্তু তার মায়াবী মুখের উজ্জলতাহীন নীল কষ্ট দেখতে আমার কষ্ট হয়নি।
বিকেলবেলা বিয়ের বরযাত্রী আসলো এখনো বর কে আমি দেখিনি এখন দেখতে পাবো দেখে মনটা আনন্দিত বটে। গেটের কাছে মেয়েদের মাঝখানে গিয়ে গেট ব্লকে দাড়ালাম। বর এবং তার আত্মীয় ভিতরে ঢুকতে চাচ্ছে কিন্তু ঢুকতে দিবেনা টাকা ছাড়া। এই সুযোগে বর কে দেখেনিলাম। আমার মত কালো না বেশ ফর্সা, লম্বা আমার থেকে তিন চার ইঞ্চি বেশীই হবে, আমার মত ভাংগা শরীর না বেশ স্বাস্থ্যসম্মত শরীর আর চেহারায় রয়েছে নুরের ঝলক। অবশেষে শিখার বর যে আমার থেকে দেখতে শুনতে বেটার তা কনফার্ম হলো। শিখা তবে ভালো ছেলেই পেতে যাচ্ছে। এই ভেবে হাসিমুখেই সেখান থেকে কেটে আসলাম।
পরে জানলাম দশ হাজার টাকা আদায় করে বর কে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। ভালোভাবেই বিয়ের সব কাজ শেষ হলো। এখন সন্ধ্যাভোজ চলছে আমি খাদেমদারি তে নেমে গেলাম, সবাইকে হাসিমুখে খাওয়াচ্ছি, গানের শব্দে মাঝে মাঝে ঢুংকো দিয়ে যাচ্ছি বন্ধুদের। আমার বন্ধু বান্ধব আমাকে সন্দেহের চোখেই দেখেছি পুরো বিয়ের অনুষ্ঠান জুড়ে। তাদের ধারনা আমি অনেক কষ্টে আছি, আমি যা করছি সব কিছুই নাটক।
কিন্তু আমি শিখার কাছে কথা দিয়েছিলাম, আমি কোন নাটক করবোনা তার বিয়েতে মন থেকে আনন্দিত হয়ে তার বিয়েতে অংশগ্রহণ করবো। তার বিয়েতে সবচেয়ে বেশী মাস্তি আমি করবো। তাই সব কষ্টগুলোকে পুরানো ডায়রীতে লিপিবদ্ধ করেই এসেছি।
বরযাত্রীরা এবার বৌকে নিয়ে যাবে, কেন যেন এই কাজটাই করতে আমার খারাপ লাগতেছিলো, এরই মধ্যে শিলা এসে আমাকে জানালো শিখা নাকি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। আমিও শিখার কাছে গেলাম, ভেবেছিলাম দৌড়ে এসে আমাকে জরিয়ে ধরে কাদবে কিন্তু ভাবনাটা ফিল্মি টাইপ, তাই সে আর বাস্তব হলোনা। ফরমাল ভাবে আমাকে বললো আমার থেকে অনেক ভালো মেয়ে পাবে তুমি, তোমার পছন্দমতো কাউকে বিয়ে করে হ্যাপি হও। ভালো থেকো।
মেজাজ টা কেন যেন বিগরে গেলো, কর্কশ শব্দেই বলে উঠলাম, যখন জানতে তোমার থেকে ভালো মেয়ে আমার জন্য রয়েছে ছয় বছর আগেই বলে দিলে পারতে। এখন কেন বলতেছো সেই ছয় বছর ফিরিয়ে দাও পারলে।
কথাটি বলে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করেছিলাম কিছু বলবে ভেবে। কিন্তু পরে আর একটি শব্দ নসিব হলোনা, যা নসিবে হলো তা হচ্ছে তার চোখের পানি। ইচ্ছে করছিলো চোখের পানি মুছে দেই কিন্তু অন্যের বউয়ের গায়ে হাত দেওয়া ঠিক হবেনা ভেবে সেখান থেকে চলে আসলাম।
বাহিরে আসার পর শিখার বাবার সাথে দেখা হলো, সেও এক বিরাট ডায়ালগ মেরে বসলো, “যদি তুমি কিছু একটা করতে তবে আমি একবার ভেবে দেখতাম, কিন্তু বেকার ছেলের কাছে তো আর মেয়ে দেওয়া যায়না, তাছাড়া শিখার থেকে অনেক ভালো মেয়ে পাবে তুমি।
মেজাজ এমনি খারাপ ছিলো, মনে মনে বলছিলাম, যদি বাবার বয়সী না হতি তবে এক্ষুনি তোর নাক ফাটিয়ে ফেলতাম।
নিজেকে সামলে বলতে লাগলাম, আংকেল যেভাবে বলতেছেন আপনি কখনো বেকার ছিলেন না মনে হয়? জন্ম টাই কি ব্যবসায়ী হয়ে নিয়েছিলেন। তাছাড়া আপনার ইতিহাস সব কিছুই জানি আপনার মেয়েই আমাকে বলেছে আপনি কিভাবে চা এর দোকান থেকে সুপার সপের মালিক হয়েছেন। তাছাড়া আপনার বিয়েটাও প্রেমের ছিলো, যখন আপনি বিয়ে করেছেন চা দোকান ছাড়া কিছু ছিলোনা, তখন যদি আন্টি আপনাকে বলতো আমার থেকে ভালো মেয়ে তুমি পাবে, তখন বুঝতেন ব্যথাটা কোথায় লাগে। আপনি দুই বছর প্রেম করেই বিয়ে করেছেন আর আমি ছয় বছর প্রেম করে তাকে বিয়ে দিয়ে গেলাম, এখন আপনি ভাবেন মেয়ে কোথায় সুখে থাকতো।
আপনারা নিজেদের সময়তে ষোলআনা দেখবেন। আমাদের বেলাতে ষোলকলা, যোগ্যপাত্র খুজে মেয়ের বিয়ে দিলেন দোয়া করি সে সুখী হোক। কথা গুলো বলে উত্তরের আশায় থাকলাম না। সোজা গেটের সামনে এসে বন্ধুদের সাথে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষন পর শিখা আসলো, সাথে স্ব পরিবার। সবাই মিলে তাকে বিদায় দিলো, আমিও আমার বন্ধু বান্ধবের সাথে বাসায় চলে আসলাম।
শিখা কে হারিয়েছিলাম তা পরিবারের জন্য। আমার কোন পরিবার নেই কারন আমি এতিম। জন্মের কয়েক বছর পরেই বাবা চলে যান, মা জন্মের সময়তেই গত হয়েছে। খালাই আমাকে মানুষ করেছে। বাবার কিছু দলিল দস্তাবেজ যা ব্যাংকের কাছে জমা সেগুলোর ইন্টারেস্ট প্রতিমাসে যা আসে তাই দিয়ে জীবন চলে যাচ্ছে। তার পরিবারই আমাকে মেনে নিতে পারেনি, শিখাও তাদের কষ্ট দিতে পারবে না বলে তাদের পছন্দে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে। শিখার ধারনা তার বাবা মায়ের অনেক ঋন আছে তার উপর এটা সত্য কথা। তাদের মন ভাংতে পারবেনা, এই ধারনাতে হয়ত সে ভুলেই গিয়েছিলো এই এতিমের বুকেও একটি মন আছে। তখন থেকে মরার সখটা খুব চেপে বসে। হাসির আড়ালে যে নাটক আমি সাজিয়েছিলাম অন্ধকার ঘরে সেটা ততই বিষধর সাপ হয়ে আমাকে দংশন করতেছিলো।
তখন সব কিছুতেই মরতে ইচ্ছে করে। ভালোবাসা হারালেও মরতে চাই, অভাবে থাকলেও মরতে চাই, স্বপ্ন ভেংগে গেলেও মরতে চাই। এই নিয়ে কয়েকবার ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম মরবোনা, বরং দুদিন কোন জ্ঞান থাকবে না। এই ফার্মগেট এর ছাত্র হোস্টেলে সিংগেল রুমের দরজা বন্ধ করেই অজ্ঞাত ভাবে ঘুমিয়ে থাকবো। কেউ ঠিকানা জানেনা তাই খোজ নিতে আসবে তেমন কোন ভয় নেই। মাঝে মাঝে হলিক্রস স্কুলের সামনে থেকে রঙ চা খেয়ে আসা ছাড়া আমার দ্বিতীয় কোন কাজ রয়েছে বলে মনে হয়না। তবুও ভালো লাগে হলিক্রস রোডে গেলে দেখা যায় অনেক উপজাতি মানুষ, ভিন্ন ধর্মের মানুষ, নিজ জাতের মানুষ, নিজ ধর্মের মানুষ। কেউ চার্চ থেকে উপাসনা করে বের হয়, কেউ মসজিদ, কেউ কলেজ থেকে। অসংখ্য ভিড়ের এই রাস্তার মধ্যেও নিজেকে অসহায় লাগে। তখন আবার মরতে ইচ্ছে করে কিন্তু মরতে পারিনা ভিতু মানব কিনা তাই হয়ত।
আচ্ছা মরতে চেয়েও মরতে না পারা মানুষগুলো কিভাবে বেচে থাকে? এদের বেচে থাকার মধ্যে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে, তাই তারা বার বার বেচে যায়। তেজগাও রেললাইনের উপর দিয়ে চোখ বন্ধ করে হাটছিলাম, একবারে পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছি ঘুমের ওষুধ নয়, ট্রেনের ধাক্কাই আমাকে আমার গন্তব্য পৌছে দিবে। কিন্তু ট্রেনের হুইসেল শুনেই বুক ধরফর করে উঠলো যত্রতত্র করে রেললাইন থেকে নেমে মাটিতে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঝিকঝিক শব্দ তুলে ট্রেন চলে গেলো, আমি অবাক চোখে তা দেখে নিলাম। কিন্তু মরতে পারলাম না।
মনের মাঝে অসংখ্য প্রশ্ন জমা। কবে মরবো এই প্রশ্নটা মনের ভিতর কুড়ে কুড়ে খায়। আমরা খুব অদ্ভুত প্রানী মরণ একদিন নিজেই এসে হানা দিবে জেনেও মরতে চাই, কেউ কেউ হয়ত অতি সাহসীকতা দেখিয়ে আত্মহত্যাও করে কিন্তু তারাও ভয় পায় মৃত্যুকে। মৃত্যু এমন এক সত্য যা বরণ করে নিতেই হবে, না চাইলেও নিতে হবে, তারপরেও মরার সময় আসলে মানুষ ভয় পায়, তখন হুট করেই তাদের অবাঞ্ছনীয় জীবনটা গোলাপের মত সুন্দর আর সৌরভময় হয়ে উঠে। তখন আবার বাচতে চায় আরেকবার পৃথিবীকে দেখতে চায়, সুযোগ পেলে আরেকবার প্রেমের বুলি বলতে চায়, আরেকবার চায় বাবার শাসন, মায়ের ভালোবাসা, প্রেয়সীর অপেক্ষা। তখন কোন ভাবেই তা পাবেনা, তখন মরতেই হবে, হাজার আকুতি বেচে থাকার থাকলেও একটি সত্য তখন বাচার কোন রাস্তা নেই, মরতেই হবে এটাই শেষ সিদ্ধান্ত প্রকৃতির।
দিন দিন অসহ্য যন্ত্রনার ভুক্তভোগী হচ্ছিলাম, অন্যদিকে শিখা নতুন সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমার কথা হয়ত মনেই হয়না তার। যাইহোক শান্তনা এই ভেবে সে হয়ত ভালোই আছে। মাসখানেক কোন বন্ধুদের সাথে দেখা হয়নি কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি, কেন জানি সব কিছুতেই অসহ্য লাগে। এতদিন মোবাইল অফ ছিলো অন করতে অনেক গুলো ম্যাসেজ এসে জমা হলো ইনবক্সে, শিলা, শিখা, সৈকত, জাহাঙ্গীর এরা সবাই ম্যাসেজ করেছে আমার খবর নিতে শিখার ম্যাসেজ পড়লেই বিরক্তি এক ভাব আসে।
কেমন আছো, ঠিকমত চলাফেরা করবে, খাওয়া দাওয়া মিস করবে না, আই মিস ইউ।
ম্যাসেজের উত্তর এভাবে দিতে ইচ্ছে করছিলো, “বেচে আছি জেনে নাও। চলাফেরা অন্ধকার ঘর আর টয়লেট পর্যন্ত রয়েছে, নিজের স্বামীকে ঠিকমত রান্না করে খাওয়াও, আমার কথা ভাবতে হবেনা, আমাকে এত বেশী মিস করিও না যেন স্বামীর মনে হয় তাকে আদর কম করো।”
কিন্তু এমন কিছুই করলাম না, হুম লিখে একটা ম্যাসেজ সেন্ড করে মোবাইল অফ করে দিলাম।
আজকাল এই দেশ আর মনে ধরছে না, এখানে কেউ মন বুঝেনা কষ্ট বুঝেনা, ভালোবাসাও বুঝেনা। সিদ্ধান্ত নিলাম বাহিরের দেশে চলে যাবো, তখন মালয়েশিয়া যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। চার লক্ষ টাকায় চুক্তি হলো এক এজেন্টের সাথে বাবা মাও নেই ভাই বোন ও নেই জায়গা বিক্রি করে টাকা গোছালাম। মাস পাচেক পর ভিসা রেডি হলো, ফ্লাইট এর দিন সকল বন্ধুবান্ধব কে ফোন দিলাম, সবাই এয়ারপোর্ট এ আসলো, দুচোখ খুজছিলো শিখাকে যদি সে আসে, অবশ্য তাকেও ম্যাসেজ করে জানিয়েছিলাম।
সবাই আমার এমন সিদ্ধান্তে হতাশ হয়ে গেলো, বিশেষ করে শিলা। শিলার রাস্তা বুঝি এখনো ক্লিয়ার হলোনা, শিলা আমাকে বললো তুই আর আমার হলিনা, তখন গালভর্তি হাসি নিয়ে বললাম,
দেখ সৈকত কিন্তু তোকে অনেক আগে থেকে ভালোবাসে সৈকত কে বিয়ে করে ফেলিস সুখে থাকবি। আমার মুখে কথাটি শুনে সবাই অবাক হলো, অনেকে বিশ্বাস করলোনা সৈকত শিলাকে ভালোবাসে, তখন সৈকতের পাঠানো হোয়াটসাপ এর রেকর্ডিং ম্যাসেজটা সবাই কে শোনালাম, যেখানে সৈকত শিলাকে কত ভালোবাসে সেই কথা আমাকে জানাইতেছিলো।
সৈকতের চেহারা সেদিন দেখার মত ছিলো, লাল টকটকে হয়ে গিয়েছিলো লজ্জায়। এরই মধ্যে হাতের ঘরিতে এক ঘন্টা বাকি আছে ফ্লাইটের দেখে দ্রুত ইমিগ্রেশনে ঢুকে যেতে লাগলাম। বার বার পেছন ফিরে তাকাতে লাগলাম ভাবলাম শিখা আসবে কিন্তু আসেনি। এরই মধ্যে মোবাইল এ টেক্সট ম্যাসেজ আসলো, নীল শার্টে ভালো লাগছে তোমাকে। হেভ এ সেইফ জার্নি, আই মিস ইউ। আমি কাচের ফাক দিয়ে উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু আমার বন্ধুদের ছাড়া কাউকে দেখতে পেলাম না। ইমিগ্রেশন ক্রস করার পর শিলা ম্যাসেজ দিলো “শোন শিখা এসেছিলো সাইডে বোরখা পড়ে ছিলো, আমাকে প্রমিস করিয়েছিলো আমি যেন তোকে না বলি, সে নাকি তোকে চোখের জলের সাথে বিদায় দিতে পারবেনা। মেয়েটা তোকে সত্যিই ভালোবাসে। ভালো থাকিস রাহুল।
তখন আমি একবার বের হতে চেয়েছিলাম কিন্তু ইমিগ্রেশন অফিসার বললো, এখন বের হলে আর ঢুকতে দেওয়া হবেনা। মাইকিং ও হয়ে গেলো মালয়েশিয়া যাত্রীদের বিমানে উঠার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। তখন আর কি করার মোবাইল অফ করে বিমানে চড়ে বসলাম। শিখা কে শেষবারের মত দেখার ইচ্ছা এতই প্রবল ছিলো এর তৃষ্ণা পৃথিবীর সমস্ত পানি ঢুকে নিলেও মিটবেনা। কিন্তু এক প্রকার স্থলজ প্রানী আছেনা, যারা পানি সামনে রেখেও পান করতে পারেনা তৃষ্ণাতেই মারা যায় আমার অবস্থা তেমনি হলো। দুচোখ বয়ে ঝর্ণা বইতে চাইলো। রুমাল টা চোখের উপর ডলতে ডলতে বলতে লাগলাম, এ কিছুনা হয় এমন।
মালয়েশিয়া আসার দুবছর পর্যন্ত কারো সাথে যোগাযোগ করলাম না। দুবছর পর অনেক বন্ধুদের সাথে ভিডিও কলে কথা বললাম, শিলা সৈকত কে বিয়ে করেছে। শিখার নাকি একটি মেয়ে হয়েছে নাম তাবাসসুম রেখেছে।
দেখতে দেখতে মালয়েশিয়া তে কেটে গেলো দশ বছর। আমার সকল বন্ধুবান্ধব কাজে ব্যস্ত, সবাই ম্যারিড, কেউ জব কেউ ব্যবসা করে এখন। কেউতো টিচার হয়েছে। এইতো আমার জীবনের সংক্ষিপ্ত কাহিনী। বলে একটি দীর্ঘ নিশ্বাস নিলাম। পাশেই বসা ছিলো আমার স্ত্রী নাইসা, মালয়েশিয়ান মেয়ে সে। এখানে আসার আট বছর পর তার প্রেমে পড়ি পরের বছরেই বিয়ে করে মালয়েশিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাই। নাইসা ঠিকমত বাংলা বলতে পারেনা তারপরেও ভাংগা ভাংগা করে বললো, “সবাই ব্যবসায়ী, কর্মজীবী হয়েছে আর আপনি কি হয়েছেন মিঃ রাহুল” গালভর্তি হাসি নিয়ে বললাম “আমি তো তোমার হাজবেন্ড হয়েছি” কথাটি বলে তাকে বুকে টেনে নিলাম।
এরই মধ্যে এয়ারপোর্ট এর মাইকিং হলো বাংলাদেশ যাবার গাড়ি নাকি রেডি, থুক্কু ফ্লাইট নাকি রেডি উড়াল দেবার জন্য। আমি আর নাইসা বাংলাদেশে আসতেছি ছুটিতে। আবার এক কাপ চায়ের সাথে সব বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠতে।
জীবন এভাবেই চলতে থাকে, কখনো হারিয়ে, কখনো খুজে পেয়ে। তবু জীবন খুব সুন্দর, সুন্দর এই দুনিয়া, কষ্টও সুন্দর, বেদনাও সুন্দর, সুখও সুন্দর, সুন্দর সুখ খুজে বেড়ানোর চেষ্টা, ভয়ংকর সুন্দর মরে যাবার প্রতিজ্ঞা করে রেললাইন থেকে আবার ফিরে আসা। আসলেই জীবন সুন্দর… তাহলে চলুক না এভাবেই এই সুন্দর জীবন, কোন আপত্তি নাই।