ক্লাশ টেস্ট শেষে কলেজের সামনে রাস্তার পাশে ছায়ায় বসে ফারিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একটা ফুলওয়ালী মেয়ে এসে দু’টো লাল গোলাপ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বল্লো,আপা নেন না! মুচকি হেসে বল্লাম,লাগবেনা খুকি। ও ফের বল্লো,নিন না আপা! ১০ টাকা দিয়ে একটা লাল গোলাপ নিয়ে খুকিটাকে আবার সেটা উপহার দিলাম। তখন সবচেয়ে দামী হাসিটা ওর মুখে ফুটে উঠলো।
লাল গোলাপটা বেশি বিক্রি হয় তাই না?(একটা পুরুষ কন্ঠ বলে উঠলো) তাকিয়ে দেখি লম্বা লম্বা চুল ওয়ালা একটা লোক।চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা,কাঁধে ঝোলানো দু’টো ব্যাগ।গলায় ক্যামেরা আর হাতে কাগজ-কলম। লোকটা কথা শুনে খুকিটা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ছুট্টে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি গুলোর দিকে গেলো কিছু ফুল বিক্রির আশায়। লোকটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বল্লো, বসতে পারি?
(সরকারী রাস্তায় বসতে আমার থেকে অনুমতি নিচ্ছে,নিজেকে মন্ত্রী মনে হচ্ছিলো।) জ্বি পারেন,বলে ফারিয়া বদের হাড্ডিকে কল দিতে থাকলাম। লোকটা কিছু একটা লিখতে লিখতে আমাকে জিগেস করলো,কিসে পড়েন? এমবিএস ১ম পর্ব ভালো।কমার্স কলেজেই? জ্বি। আমি অবশ্য গত ৫ বছর আগে আপনার এই পাঠ টা চুকিয়ে বেরিয়েছি এই কলেজ থেকেই। ও আচ্ছা। আমি অনিক,ভবঘুরে মানুষ।মাঝেমধ্যে দু’একটা লেখালেখির চেষ্টা করি।আপনি?
ফৌজিয়া, বেকার। দারুন টাইটেল দিলেন তো! আচ্ছা একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজচ্ছি আমি।আপনি যদি উত্তর টা দিতে পারতেন আমার অসমাপ্ত লিখাটা সমাপ্ত করতে পারতাম। কি? ভালোবাসার রং কি -ভালোবাসার কি রং বলুন তো? (হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে।) দেখুন পানির রং নীল আছে,আবার হালকা শ্যাওলা বাঁধানো সবুজ আছে, ডাস্টবিন এর কুচকুচে কালো পানি আছে।ঠিক মানুষের ক্ষেত্রে কালো,ফর্সা,শ্যম লা রং এর মানুষ আছে। তাহলে ভালোবাসার রং কি? কেমন এটার রং?
(লোকটা একনাগাড়ে বলে গেলো।অনেকটা পাগলের মতো ও মনে হলো) ম্যাম আপনি কি রাগ করলেন?Please don’t mind,আপনার ঠোঁটে আর ঠোঁটার নিচে তিল আছে।লোকে বলে এমন তিল ওয়ালারা নাকি প্রেম করে বিয়ে করে লোকটাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। আর মনে মনে ফারিয়া পইন্নির প্রেমের চৌদ্দগুস্টি কে গালি দিলাম। মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে পাগলের হাতে পড়তে হলো।
সেদিনের ঘটনার পর অনিক পাগলটার সাথে প্রায় ১৫ দিন পরে আবার দেখা হলো কলেজে। নিজেই এসে কথা বল্লো আপনাকে পেয়ে ভালোই হলো।সেদিন আপনাকে ওভাবে বলা বা প্রশ্ন করা আমার উচিত হয়নি। আপনি গোলাপ কিনছিলেন এবং রাস্তায় কারো জন্য অপেক্ষা করছিলেন ভেবেই। আসলে আমি আমার লেখার জন্যই বিরক্ত করেছিলাম।Sorry It’s ok. আমি ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম(ফারিয়া কে দেখিয়ে)
এরপর প্রায়ই দেখা হতো লোকটার সাথে ১০/১২ দিনের ব্যাবধানে।কোনদিন হয়তো নুরুল ইসলাম স্যারের কাছে, কোনদিন রাজিয়া ম্যামের কাছে, কোনদিন ফারুক স্যারের কাছে আসতেন লোকটা। আর কাকতালীয় ভাবে আমার আর ফারিয়ার সাথে দেখা হতো। লোকটার সাথে জানাশুনা বা কথাবার্তায় বুঝতে পারতাম,অনেকটা সরল প্রকৃতির। ভালোলাগতো উনার সাথে কথা বলতে। একদিন কথার ফাঁকে আবার জিগেস করেছিলেন,ভালোবাসার রং কি?
উত্তরে ফারিয়া বলেছিলো- নীল।তার কারণ,ভালোবাসার মানুষ গুলোকে নীল জামায় ভালো লাগে। আর আমার উত্তর ছিলো, “ভালোবাসার কোন রং আছে কিনা জানিনা।তবে মন থেকে যে রং টা ভালোবাসার রং বলে মনে হবে সেটাই ভালোবাসার রং। সেদিন অনিক সন্তোষজনক উত্তর পান নি। তিনদিন পরে ভালোবাসার রং এর খোঁজে আবার আসবেন এবং প্রয়োজনে স্যারদের জিগেস করবেন বলে চলে গেলেন।
বাসায় এসে ভাবলাম,হৃদয়ের রং লাল তাহলে ভালোবাসার রং নীল কেন?বিয়ে দুটো মানুষকে ভালোবাসার পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করে।সে ক্ষেত্রে মেয়েদের বেনারসি প্রায়ই লাল রং হয়।ভালোবাসার মানুষকে লাল গোলাপটাই বেশি দেওয়া হয়। রক্তের চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে প্রাণটা দেহের ভালোবাসা ত্যাগ করে ছেড়ে চলে যায়। তাহলে তো সব কিছু মিলিয়ে অংকের ফলাফল আসে, ভালোবাসার রং লাল। বেশ ফুরফুরে মেজাজ আবার কিছুটা অস্থিরতা নিয়ে তিনদিন শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে।
অবশেষে তিনদিন পর তাড়াতাড়ি কলেজের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম অনিকের জন্য। ২ঘন্টা অপেক্ষা শেষে তাকে দেখতে পেলাম রাস্তার ওপাশে। আমায় হাসিমুখে দেখে ইশারায় জিগেস করলো উত্তর পেয়েছি কিনা। হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলাম পেয়েছি বলে।
তারপর অনিকের একটা কল আসে মোবাইলে। কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলো এমন সময় দ্রুতগামী একটা ট্রাক অনিক কে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়।আর মূহুর্তে রাস্তাটা অনিকের শরীরের লাল রং এ রঞ্জিত হয়ে যায়। চিৎকার করে সেদিন বলে ছিলাম আমি, ভালোবাসার রং লাল।
কিন্তু অনিক তা শোনে নি।গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছিলাম অনিক শুনার জন্য।কিন্তু শোনে নি।আজ আর কেউ আমার গলার আওয়াজ শোনে না। কেউ শুনতে চাইলেও বলতে পারিনা,গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয়না।।