ভাইয়া

ভাইয়া

ভাইয়াআআআ….??

লাস্ট কোনদিন এভাবে ঢংগী সুরে কারো মুখ থেকে ভাইয়া ডাক শুনছি মনে নাই। নাহ মনে পড়েছে, পরশুদিন শুনেছিলাম এমন ডাক। কে হতে পারে ভাবতে ভাবতে পিছনে তাকাতেই দেখি নেহা দাড়িয়ে আছে। এত্ত আদর করে ডাকছে মনে হইছে আমি ওর জমজ ভাই। এইটা কোনো কথা হইলো?? মানুষ মানুষ রে এভাবে ভাইয়া ডাকে??

একবছর আগের কথা আমি চাকরিতে জয়েন করার পর থেকেই মা বাবা, পরিবারের সবাই আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলো। খাইতে গেলে বলে বিয়ে কবে করবি? ঘুমাইতে গেলে বলে বিয়ে কবে করবি? এমনকি ঘুম থেকে উঠার পর ও জিজ্ঞেস করে “বাবা বিয়ে সাদির কথা কিছু ভাবলি??”। সেদিন শুক্রবার ছিলো, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বসতেই দেখলাম আব্বু আমার মাথার পাশে বসে ছিলেন। আমার ঘুম ভাংতে দেখে জোর করে একটু মুচকি হেসে বললেন “ঘুম ভাংছে বাবা?”। এমন অন্ধ মানুষ ও পৃথিবীতে আছে, ভাবা যায়??

আমার উত্তর না পেয়ে নিজে নিজেই বলতে লাগলেন “তোর রহিম আঙ্কেল এর কথা মনে আছে? তার মেয়ের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছি। নেহা যেহেতু তোর কলেজেই পড়ে, আসা করি চিনতে পেরেছিস। আজকে সন্ধায় ডেট ফিক্সড করেছিলাম ,তোকে জানানো হয়নি। যাকগে সে কথা, তোর জানা না জানাতেও কিছু যায় আসেনা, রেডি থাকিস।” আব্বু কি বলল না বলল আমার কিছুই মাথায় ঢুকলো না। শুধু এতটুকু বুঝতে পারলাম ওই ঢং করে ভাইয়া ডাকা মেয়েটার সাথে আব্বু আমার বিয়ে ঠিক করেছে। যখনি দেখবে ভাইয়া ডেকে আমার মাথা খাবে। সেদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘোরের মাঝে ছিলাম। কি থেকে কি হলো কোথা থেকে কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বিকেলে কয়েকটা বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম পালাবো। সুযোগ বুঝে পালিয়েও গেলাম।

তারপর বাড়ি ফিরেছিলাম ২৩ দিন পর। এখন সব কিছু ঠিক আছে। কিন্তু ঠিক নেই ওই একটা জিনিস, কয়দিন পরপর নেহা বাসায় আসবে, ভাইয়া ডাকবে। এটা ওটা বলে আবার চলে যাবে। বাসা আসা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো কিন্তু ইদানীং রাস্তায় অফিসেও আমার পিছু নেয়। আমি রাগি চোখে একপলক তাকিয়ে থেকে ডাক দিলাম, “ওই ছেমরি এদিকে আয়” নেহা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। বললাম “ভাইয়া কি শব্দ হ্যা?? শরম লাগেনা ডাকতে? আমার সাথে না তোর বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো??”

নেহা ভয়ে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে আছে। কিছু বলতে চায় কিন্তু ভয়ে বলতে পারছে না। মেয়েটা আমাকে ভয় ও পায়?? ওকে রেখে বাসায় চলে আসলাম। কিছুক্ষণ পর মায়ের গলা শুনতে পেলাম “কিরে মা কত্ত দিন পর আসলি, এতদিন কোথায় ছিলি? শরীর খারাপ নাকি তোর?” অথচ পরশুদিন ও এসে আমাকে ভাইয়া ডেকে গেছে। বুঝতে পারলাম আমার কাছে বকুনি খেয়ে মায়ের থেকে শান্তনা নিতে এসেছে।

প্রায় সপ্তাহ খানেক পর একদিন কলেজে গেলাম কয়েকটা বন্ধু মিলে আড্ডা দিতে। অফিস থেকে খেলার জন্য দুই দিনের ছুটি নিয়েছি। পাশের এলাকার সাথে ফুটবল খেলা আছে। কলেজ ছুটির পর নেহা যখন সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো প্রথমে খেয়াল করেনি আমাকে। দেখলাম সোজা হেটে চলে যাচ্ছে। অন্য একটা মেয়ে আমাকে দেখালো। নেহা আমাকে দেখেও কিছু বলল না। কলেজের বাইরে চলে গেলো।

ব্যাপারটা আমার কাছে একদম ভালো লাগেনি। হঠাৎ কি হলো? যেখানেই দেখে এটা ওটা প্রশ্ন করে আমাকে জালিয়ে মারে, আজকে দেখেও কিছু বলল না? অদ্ভুত তো? আমার মন খারাপ হচ্ছে কেন? সাফিন ডাক দিয়ে বলল “তানভীর তুই বাম সাইডে স্ট্রাইকার থাকবি, বাপ্পি তোকে বেকআপ দিবে, আর সুজন তুই মিডে খেলিস”। আমি আবার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মগ্ন হয়ে গেলাম। হঠাত সেই ঢংগী সুরে ভাইয়া ডাকটা শুনতে পেলাম। আমাদের থেকে কিছুটা দূরে নেহা দাড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষণ আগে যে মন খারাপ ভাবটা ছিলো এখন সেটা একদম উবে গেছে। সেখানে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা বাসা বেধেছে। কিভাবে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতেছি না। সব আমার কন্ট্রোল এর বাহিরে। নেহার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, কি? ৫০ টাকা দাও। ফুচকা খাবো, আজকে টাকা আনতে ভুলে গেছি। আমি কেমন আবুলের মত পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে দিলাম। একবার ধমক দিতেও মন চাইলো না। বন্ধুদের কাছে ফিরে যেতেই শালারা টিটকারি শুরু করে দিয়েছে। আজকে এমনটা কেন করলাম সেটা ভাবতে ভাবতেই অর্ধেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারলাম না।

অফিস থেকে বাড়ির দূরত্ব প্রায় বারো কিলোমিটার। এর মধ্যে এক কিলোমিটার হাটতে হয়। বাস থেকে নেমে হেটে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। কলেজ ক্রস করার সময় দেখলাম নেহা একটা ছেলের সাথে কি জানি কথা বলতে বলতে কলেজ থেকে বের হচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার হাসছে। আমার অনেক রাগ হলো। আমি গেইটের সামনে দাড়িয়ে থাকলাম। নেহা আমার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে অথচ আমার দিকে তাকাচ্ছে না?? একটু দূরে যেতেই ডাক দিলাম নেহাকে। নেহা সামনে আসতেই বললাম, ওইসব ছেলেদের সাথে মিশবি না। অনেক খারাপ ছেলে।

নেহা শান্ত চোখে আমার দিকে তাকালো। অবাক হচ্ছে মনে হয় আমার পরিবর্তন দেখে। বলল, কি সব বলছো ভাইয়া, ও আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। অনেক ভদ্র ছেলে। আর মিশলেই বা তোমার কি??আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। চলে আসলাম। একবার পিছু ফিরে দেখলাম, নেহা মুচকি মুচকি হাসছে।

আমারো কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। রাগ হচ্ছে আবার খুশি ও লাগছে। এতসব ফিলিংস একসাথে আসে নাকি?? কি জানি!! আমার এখন রাত কাটে নির্ঘুম। গান শুনলে আগে রিমিক্স গান শুনতাম। এখন পুরো মিউজিক প্লেয়ারে তাহসান, মিনারের রোমান্টিক গানে ভরতি। নেহাকে এখন আগের মত ধমক দিয়ে কথা বলতে পারিনা। ওর সাথে কথা বলতে গেলে শরীর কাপাকাপি শুরু হয়ে যায়। কি থেকে কি বলে ফেলি ঠিক নেই তাই বেশি কথা বলতেও পারিনা। দিনে ওর সাথে যা যা করি রাত হলে সব চোখের সামনে ভাসে। আমি কি প্রেমে পড়ে গেছি?? ধুর, এত কিছু হওয়ার পরেও মানুষ কনফিউজড থাকে কিভাবে?

সোফায় বসে টিভি দেখছিলাম। নেহা ৯দিন পর আমাদের বাসায় আসলো। আজকে অনেক সাজগোছ করে এসেছে। খাটি বাংলায় যাকে বলে আটা ময়দা মেখে এসেছে। সরাসরি একবার তাকিয়েছিলাম। কেমন জানি নেশা ধরে গিয়েছিলো। আর তাকাইনি। কি থেকে কি হয়ে যায় বলা যায় না। আজকাল নিজের প্রতি নিজের কন্ট্রোল থাকেনা। নেহাদের কলেজ থেকে পুজার বন্ধ দিয়েছে।

তাই বায়না ধরেছে ঘুরতে যাবে। আমাকে নিয়ে! জানে যে সরাসরি আমাকে বললে যেতে রাজি হবো না। তাই আম্মুর কাছে গেছে আমাকে রাজি করাতে। মেয়েটার ছেলে মানুষী দিন দিন অনেক বেড়ে যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রহিম আঙ্কেল সামনে পড়লেন। বিয়ে থেকে পালানোর পর থেকে আমার সাথে রেগে থাকলেও আমার ফেমিলির সাথে সম্পর্ক আগের মতই আছে উনার।

নেহাকে উদ্দেশ্য করে বললেন “কোথায় যাচ্ছিস?” নেহার চোখে মুখে ভয় বিরাজমান। ও কিছু বলছেনা দেখে আমি বললাম “না মানে আঙ্কেল একটু ঘুরতে বের হইছি” উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নেহার দিকে তাকিয়ে বললেন “সন্ধার আগে আগে বাসায় চলে আসবি, বেশি ঘুরাঘুরির দরকার নেই বাইরে পরিস্থিতি ভালো না। বিয়ে থেকে পালিয়েছে, বলা তো যায়না তোকে আবার কোথায় রেখে পালিয়ে যায়” কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে যে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। রহিম আঙ্কলে চলে গেলো। এরমধ্যে নেহা একটা কথাও বলল না।

পুজা উপলক্ষে মেলা হচ্ছিলো। নেহাকে নিয়ে সেখানে গেলাম। আমার অফিসের কাছাকাছি জায়গাটা। একটা টেডিবিয়ার কিনে দিলাম। মেলায় ঘুরাঘুরি শেষে সন্ধার দিকে বাসায় রওনা দিলাম আমরা। বাস থেকে নেমে হাটতে থাকলাম। ওদের বাসার কাছাকাছি আসার পর নেহা হঠাত দাড়িয়ে গেলো। আমিও দাড়ালাম। আমার সামনে এসে বলল, “আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলে ভালো হত তাই না ভাইয়া, আমি তোমার বউ হতাম। বাসে তোমার পাশে বসার পর তোমার কাধে মাথা রাখতে ইচ্ছে করছিলো খুব, অধিকার নেই বলে রাখতে পারিনি।

আমি কি দেখতে খুব খারাপ? কেন চলে গেছিলা সেদিন??” কথাগুলো কেমন ভাবেই যেন বলল নেহা, এতদিন ওর ভিতর ছেলেমানুষি স্বভাবটাই দেখেছি। আজকে বুঝতে পারলাম ওর ভিতরে অন্যকিছু ও আছে। উত্তরে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। নিজের মধ্যে অপরাধ বোধ কাজ করছিলো অনেক আগে থেকেই। আজকে সেটা দ্বিগুণ হলো। লক্ষ করলাম নেহার চোখে পানি চিকচিক করছে। নেহা চোখের পানি মুছে বাসার দিকে পা বাড়াতেই আমি বললাম , “ওই ছেমরি শোন” নেহা আবার আমার কাছে আসলো। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। বললাম আমাকে ভাইয়া ডাকবি না।

নেহা কিছু না বলে চলে যাচ্ছে আবার। কিছুদূর গিয়ে আমাকে ডাক দিয়ে বলল “ভাইয়া শুনেন”আমি এগিয়ে গেলাম নেহার কাছে। কাছে গিয়ে দাড়াতেই বলল “ভাইয়া, আমি আর তোমাকে ভাইয়া ডাকবো না” আমি নেহার হাত ধরে কাছে টান দিয়ে নিয়ে আসলাম।

ওর দুই কাধে আমার হাত রেখে বললাম “বাসর রাতটা আসতে দে, তোর ভাইয়া ডাকার প্রতিশোধ আমি নিবো” নেহা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ওদের বাসার দিকে দৌড়ে চলে গেলো।

আমার নিজের মধ্যেও কেমন জানি একটা ফিল হচ্ছিলো। জীবনের নতুন একটা অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে যে!!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত