টিউশনি শেষ করে ফিরে যাচ্ছি মেসে। মাথার উপর সূর্যটা এই দুপুরে দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে তাপ ঢেলে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনি বুঝি শরীরের চামড়া পুড়ে খসে পড়বে। ক্লান্ত শরীরটার ভার আর টানতে পারছে না এই পা দুটো। মনে হচ্ছে হুমড়ি খেয়ে রাস্তার উপর শুয়ে পড়ি। পায়ের জুতাটার অবস্থাও দশাসই। যেকোন মুহূর্তে শহীদ হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। জুতাটার কিছু হলে মাসের বাকি কয়েকটা দিন খালিপায়েই হাঁটতে হবে হয়তো। নাহ! আর হাঁটা সম্ভব না। তাই রাস্তার পাশেই একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু গাছের নিচে মনে হচ্ছে গরমটা একটু বেশি। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। একটু দূরেই একজন লোক ঠান্ডা লেবুর সরবত বিক্রি করছে। পানির সাথে আধা টুকরো লেবুর রস সাথে একটু বিট লবন। মন চাইছে একগ্লাস কিনে খাই। কিন্তু যখনই মনে হলো যে এখন মাসের শেষদিক তখনই ইচ্ছেটা মাঠে মারা গেল। একটা চা দোকান থেকে ঢকঢক করে দুইগ্লাস পানি খেয়ে নিলাম।
নাহ এবার আবার মেসের দিকে রওনা দিতে হবে।
বিকেলে আরো দুইটা টিউশনি আছে। এখন মেসে গিয়ে কিছুক্ষন বিশ্রাম না নিলে হয়তো টিউশনিতে যাওয়ার পথেই উল্টে পড়ে থাকতে হবে।
ভেবেছিলাম গোসল করে দুইঘন্টা ঘুমিয়ে নিব। কিন্তু আজ আর বোধহয় গোসল কপালে নেই। মেসে আজ পানি নেই। তাই গোসল না করেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কিন্তু এখানেও আরেক সমস্যা। মাথার উপর মনে হচ্ছে দোযখের চরকি ঘুরছে। ফ্যানের বাতাসটা যে এত গরম হতে পারে তা চিন্তার বাইরে। এদিকে পেটের ভেতর ইতিমধ্যেই ইদুরের দৌড় শুরু হয়ে গেছে।ইদুরগুলোকে থামাতে হচ্ছে।
খাটের নিচে দুইদিন আগে আধাকেজি মুড়ি এনে রেখেছিলাম। সেগুলো বের করেই গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলাম। এমন সময় আমার মান্ধাতার আমলের ফোনটা বেজে উঠলো বুঝতে পারছি প্রমিতি ফোন দিয়েছে।
– হ্যাঁ প্রমিতি বলো।
– কোথায় তুমি?(প্রমিতি)
– কোথায় আর থাকতে পারি বলো? নরকে বসে মুড়ি চিবোচ্ছি।(আমি)
– মুড়ি খাচ্ছো মানে? এখনো ভাত খাওনি?(প্রমিতি)
– আজ বুয়া আসেনি। তাই রান্না বন্ধ। এজন্যই মুড়ি খেয়েই পেট ঠান্ডা করতে হচ্ছে।(আমি)
– তুমি এখনি আমার সাথে দেখা করো। এখনি আসবে।(প্রমিতি)
– এখন তো আসতে পারবো না। একটু পরেই টিউশনিতে যেতে হবে। টিউশনি শেষে দেখা করি?(আমি)
– আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। এখনি তোমাকে আসতে হবে। দুপুরে না খেয়ে থাকবে কিভাবে?(প্রমিতি)
– না খেয়ে থাকার অভ্যাস আছে। আর তাছাড়া মুড়ি খেয়ে পানি খেলেই পেট ভরে যাবে। চিন্তা করো না।(আমি)
– আচ্ছা ঠিক আছে রাখছি আমি।(প্রমিতি)
আজ প্রমিতি এত সহজে মেনে নিলো বিশ্বাসই হচ্ছে না। ও খুবই জেদি মেয়ে। যা একবার বলবে তা করেই ছাড়বে। যেদিন শুনবে যে আমি দুপুরে বা রাতে খাইনি সেদিনই আমাকে হোটেলে নিয়ে গিয়ে সামনে বসিয়ে খাওয়াবে।
প্রথম প্রথম না খেয়ে থাকলেও প্রমিতিকে মিথ্যা বলতাম। কিন্তু প্রমিতি কিভাবে যেন টের পেয়ে যায়। তাই এখন আর মিথ্যা বলার চেষ্টা করিনা।
প্রমিতিকে বলেছিলাম মুড়ি খেয়ে পানি খেয়ে নিলেই ক্ষুধা চলে যাবে আমার ধারনা একদমই ভুল। এখন উল্টো ক্ষুধা আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
আমি শার্টটা গায়ে চাপিয়ে আবার মেস থেকে বের হলাম। ক্ষুধার কথা চিন্তা করে লাভ নেই। আমাকে টিউশনিতে যেতে হবে। মেস থেকে বেরিয়েই চমকে গেলাম। প্রমিতি মেসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রমিতির শেই রয়েছে তার কালো রঙের গাড়িটা। প্রমিতির চোখ লাল হয়ে আছে। বুঝতে পারলাম মেয়েটি হয়তো রেগে আছে।
– আরে প্রমিতি তুমি এ….
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রমিতি বললো, গাড়িতে উঠো তাড়াতাড়ি।
– আরে আমার টিউ…. (আমি)
– গাড়িতে উঠতে বলেছি তোমাকে দিগন্ত।(প্রমিতি)
আর কোন কথা বলার সাহস পেলাম না। চুপচাপ গাড়ির দরজা খুলে বসে পড়লাম।
প্রমিতি হঠাৎ বলে উঠলো, সামনে এসে বসো।
আমি পেছনের সিটে গিয়ে বসেছিলাম। প্রমিতি কঠোর কন্ঠে আমাকে সামনে এসে বসতে বললো। এতক্ষণে খেয়াল হলো আজ ওর গাড়ির ড্রাইভার আসেনি। আমি কোন কথা না বলে ভদ্র ছেলের মতো সামনের সিটে এসে বসলাম।
-আমাকে কষ্ট দিতে তোমার ভাল লাগে তাই না?
হোটেলে বসে ভাত খাচ্ছিলাম। প্রমিতিই আমাকে নিয়ে এসেছে হোটেলে। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা থাকার কারণে ভাত সামনে আসতেই আর ক্ষুধাটাকে চেপে রাখতে পারলাম না। তখনই প্রমিতি আমাকে কথাটা বলে উঠলো।
আমি কিছু না বলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। এখন আমি কিছু বললেই এখন প্রমিতি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে। তাই চুপ করে খেতে লাগলাম।
– এভাবে আর কতদিন চলবে দিগন্ত।(প্রমিতি)
– চুপ(আমি)
– তোমাকে ভালবেসে আমি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছি। এখন এই মায়াজাল থেকে বেরোতেও পারছি না।(প্রমিতি)
– চুপ(আমি)
– মেস তো অন্তত পাল্টাতে পারো? এখানে দুইদিন পরপরই তোমায় দুপুরে না খেয়ে থাকতে হয়। আর মাঝখানে আমাকে কষ্ট পেতে হয়। তুমি কি বুঝ না দিগন্ত? (প্রমিতি)
আমি এবার বলে উঠলাম, তুমি কেন কষ্ট পাও প্রমিতি?
প্রমিতি এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, সেটা যদি তুমি বুঝতে তাহলে এমন করতে না
আমি মাথাটা একটু নাড়িয়ে বললাম, তাও ঠিক আমি একটু কমই বুঝি।
– হ্যাঁ হয়েছে কথা কম বলে খাও।(প্রমিতি)
খাওয়া শেষে প্রমিতি আর আমার প্রিয় জায়গাটাতে গেলাম। প্রমিতি অন্যমনষ্ক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার থেকে একটু দূরে বসে আছে। হয়তো অভিমান করে আছে। আমি একটু কাছে গেলাম আর বললাম, আজ তোমার জন্য টিউশনি মিস হলো।
প্রমিতি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো, আমার জন্য এতটুকু পারবে না তুমি?
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললাম,শুধু টিউশনি কেন? তোমার জন্য প্রতিটা হার্টবিট মিস দিতে পারবো।
প্রমিতি এবার আহ্লাদী সুরে বললো, হয়েছে হয়েছে। কি কি পারো তা জানা আছে। পারো তো শুধু কষ্ট দিতে।
– কষ্ট দেওয়ার মাঝেও আনন্দ আছে প্রমিতি।(আমি)
– আচ্ছা আমাদের বিয়ে হওয়ার পর কি হবে?(প্রমিতি)
– কি আর হবে? এক ডজন বাচ্চাকাচ্চা হবে, তাদের নিয়ে ক্রিকেট টিম বানাবো। ওহ দুঃখিত! তুমি তো আবার ফুটবলের ভক্ত। আচ্ছা তাহলে ফুটবল টিম বানাবো।
আমার কথা শুনে প্রমিতি এমনভাবে তাকালো যে কিছুক্ষণ আগে খেয়ে আসা ভাতগুলো হজম হয়ে গেল।
– এভাবে তাকাও কেন? ভয় পাই তো।(আমি)
– চুপ করে বসে থাকো।(প্রমিতি)
– আচ্ছা ঠিক আছে বসে রইলাম।(আমি)
– কতদিন পর এভাবে তোমার সাথে বসে আছি বলতে পারো?(প্রমিতি)
– নাহ।(আমি)
– জানি পারবেও না। আচ্ছা এখন একদম কথা বলবে না। আমি তোমার কাঁধে মাথা রাখবো।(প্রমিতি)
– ঠিক আছে রাখো।(আমি)
প্রমিতি আমার কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। আর আমি তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে। আচ্ছা আমি কি ভুল দেখছি? পড়ন্ত বিকেলে রক্তিম আকাশে ওটা কি নীলার মুখ দেখা যাচ্ছে? হয়তো আমার চোখের ভুল।
কিন্তু মাঝে মাঝে ভুল দেখার মাঝেও একটা তৃপ্তি থাকে। এখন আমি সেই তৃপ্তিটাকেই উপভোগ করছি।