গুড়ুম গুড়ুম মেঘ ডাকছে। বর্ষার এই সময়টা যেন কেমন। সক্সল না দুপুর,একদমই বুঝা যায়না। এই দিনগুলি কাঁথা মুরি দিয়ে ঘুমানোর পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক দিন। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না, গরিবের ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখতে নেই। আলিফের চোখের sutter যেন খুলতেই চাইছে না। জেগে জেগে ঘুমানোর মাঝে বেশ একটা মজার ব্যাপার আছে,গরিব হলেও এতোটুকু মজা পাওয়ার অধিকার তার নিশ্চয় আছে। কিন্তু মাকে সেই কথা টা বুঝাতে ২৫ বছর হয়ে গেল,তবুও বুঝতে চান না। মায়ের ডাকাডাকি শুনে বাধ্য হয়ে জাগ্না ঘুম থেকে জেগে উঠতে হোল।
– মাঃ মুখ-হাত ধুয়ে আয়, নাস্তা দিচ্ছি।
আলিফ নাস্তার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। এই বাসায় যে নাস্তা গুলো হয়,বোধ করি আর কোথাও তা হয়না।
কখনো বাসি তরকারি দিয়ে মুড়ি,কখনো মিষ্টিআলু,কখনো রুটি দিয়ে আলুভর্তা….আরও কতো কি!!! আজকের ঘটনা মোটামুটি ভয়াবহ। বাসায় কিচ্ছু নেই খাওয়ার মতো। নিম্নবিত্ত পরিবারের এই এক সমস্যা,সকাল বেলা নাস্তা করার মতো বিলাসিতা তাদের কপালে প্রতিদিন জুটে না। মা হাতে ৫০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বাজার আনতে বললেন।
– আলিফঃ মা,তোমার কি মনে হয় এই টাকায় বাজার করা সম্ভব? বাজারে যে আগুন লাগছে তুমি জান না?
– মাঃ সবই তো জানি, কিন্তু কি করব বল? মাস শেষে সেলাইয়ের যে ৪০০০ টাকা পাই আর তোর tutionir যে কটা টাকা পাশ। সেটা দিয়ে কিভাবে আমি সংসার চালাই বল? আরেকজন তো ওই পারে গিয়ে বেঁচে গিয়েছেন,আর কোনও দায়িত্ব নাই,আমরা কিভাবে চলবো,কি খাব তার কোনও বাবস্থা করে গেছেন তোর বাবা? সব তো আমাকেই সামলাতে হয়, নাকি?
– আলিফঃ আমি সবই বুঝি মা। আচ্ছা,দেখি কি করতে পারি।
বাজারের উদ্দেশে বের হবার একটু পরই ঝম-ঝমিয়ে বৃষ্টি এল। একটা ছাতা কেনা দরকার। তা না হলে tutioni, versityতে যেতে খুব সমস্যা হয়। আলিফের ছাত্র আবার বেশ বিটকাল। ভেজা অবস্থায় ওকে দেখলে ওর মাকে বলবে, আম্মু আম্মু,স্যার না আজ উনার গার্ল ফ্রেন্ড এর সাথে বৃষ্টিতে ভিজেছে। Aunt এসব কথায় খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে তোয়ালা এনে দিবেন। মহিলা খুবই ভাল। প্রতিদিন আলিফের নাস্তার খরচটা বেঁচে যায়। আর তাছাড়া উনার কল্যাণেই আলিফ আরও একটা tutioni পেয়েছে। ওই টাকা দিয়ে সংসারে সাহায্য করতে পারে। আর নিজের পড়াশুনা বিভিন্ন বৃত্তির টাকা দিয়ে চালিয়ে নেয়।
এসব ভাবতে ভাবতে আলিফ একটা ছাপরা চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথার চুল গুলি একদম ভিজে গেছে। হাত দিয়ে যেই কয়েকবার চুল ঝাড়ল, অমনি পাস থেকে একটা নারী কণ্ঠের শ্লেষ্মা মিশ্রিত কথা শুনতে পারল…
-এই যে মিস্টার, বৃষ্টির জল থেকে বাঁচতে এখানে আসলাম,এখন কি আপনার মাথার পানিতে ভিজতে হবে নাকি?
আলিফ কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাড়ায়। ও কি ভুল শুনল? এত সুন্দর একটা মেয়ে এভাবে কথা বলে কিভাবে? আল্লাহ জন্মের পূর্বে তার আত্মাটা কি চিরতার পানিতে ভিজিয়ে রাখছিলেন নাকি? মেয়ের মা-বাবাই বা কেন জন্মের পর মেয়ের মুখে একটু মধু তুলে দিলো না? উনাদের মেয়েকে রূপের দিক থেকে অনায়েশে ৮০ দাওয়া যায়,কিন্তু কণ্ঠ টাই সব শেষ করে দিয়েছে। এত রাগ ওই সুন্দর মুখে মানায় না।
-কি ব্যাপার? হাবার মতো তাকিয়ে আছেন কেন? এখন কি স্প্যানিশে অনুবাদ করে বলতে হবে?
– ওহ…sorry.আসলে আমি আপনাকে লক্ষ্য করিনি। লক্ষ্য করলে মাথা ঝাড়তাম না,আপনাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতাম। আপনাকে ছুঁয়ে যেতে না পারলে আজকের এই বৃষ্টি মুখ লুকাক ওই মেঘের ফাঁকে,এত সুন্দর রূপের আঁধার ছুঁয়ে যেতে না পারলে দূর হয়ে যাক সে চোখের সামনে থেকে….।
হায় হায়,এসব কি বলছে আলিফ? হটাত করে অনুভব করল,আশেপাশের কয়েকটা রাগান্বিত চোখ তারদিকে তাকিয়ে আছে। তার মানে সে যা বলেছে,অবশ্যই বলা উচিত হয়নি। আরে,তার কি দোষ? সুন্দর কে তো সুন্দর বলা পাপ না।
– আপনার সাহস তো কম না। রাস্তায় দাড়িয়ে আপনি eve-teasing করছেন? আপনি জানেন আপনাকে এখনি আমি মার খাওয়াতে পারি?
-না মানে দেখুন,আপনি সত্যি অনেক সুন্দর। আপনার রাগ কম থাকলে আপনাকে মোটামুটি খুব বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দরি বলা যেত।
এই কথা বলার পর আলিফ আর সেখানে থাকার সাহস করেনি। বাংলাদেশের মানুষ আর কিছু না হোক,মানুষ পেটাতে ব্ল্যাক বেল্ট। এইতো সেদিন শবই বরাতের রাতে পিটিয়ে মেরে ফেলল ৬ তরুণকে। ২ দিন পর সেই লিস্ট এ আলিফ নিজেকে কল্পনা করতে চাইছে না। এরচেয়ে যেই বৃষ্টির কল্যাণে আজ ওই সুন্দরীর দেখা পেল,সেই বৃষ্টির হাতে নিজেকে সঁপে দিতে অনেক বেশি আনন্দিত অনুভব করল। মনের ভিতরে কোথায় যেন মনে মনে একটা স্বপ্ন গাঁথা হয়ে গেল-মেয়ে,তুমি যেখানেই থাকো না কেন,তোমার হাত ধরে একদিন আমি ভিজবই।
সেই রাতে আলিফের খুব জ্বর এসেছিল। তার গা থেকে যেন আগুনের হল্কা বেরুচ্ছিল। এমন সময় সেই সুন্দরী কোথা থেকে যেন উদয় হোল।
– ইসশ,তুমিটা যে কি? একটা ছাতা কিনলে কি এমন ক্ষতি হয়? এখন জ্বরে কেমন কষ্ট হচ্ছে..।দাড়াও,আমি মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছি।
– আলিফঃ ছাতা কিনে ফেললে কি আর তোমার সাথে সেদিন অভাবে দেখা হতো আর আহ তুমি আমার মাথায় পানি ঢালতে?
– থাক সেসব কথা। চিন্তা করোনা,কিচ্ছু হবেনা তোমার।
– আলিফঃ আমি সেটা জানি,তুমি আমাকে ঠিক আগলে রাখবে। কিন্তু আমি সুস্থ হলেই যদি তোমার আদর হারিয়ে ফেলি?
-যাও,বাজে বকো না তো। তোমায় আমি আমার চারপাশে ছুটে চলা খরগোশের মতো দেখতে চাই,এভাবে অসুস্থ হয়ে নুটুর পুটুর হয়ে থাকলে চলবে? চোখ বন্ধ কর,পানি দিয়ে দিচ্ছি।
কিছুক্ষণ পর আলিফ চোখ খুলে দেখে মা মাথায় পানি ঢালছে আর কাঁদছে।
-আলিফঃ মা তুমি এভাবে কাঁদো কেন? কি হইছে?
-মাঃ কিছু না বাপ,তুই অসুস্থ হইলে আমার দুনিয়াটা আন্ধার হয়ে আসে রে। তুই ছাড়া যে আমার কেউ নাই। তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হ।
চোখ দুটি জলে ভরে আসে আলিফেরও। তাদের এই ছোট্ট পরিবারে তারা দুইজনেই সব। বাবা তো সেই কবেই চলে গিয়েছেন পরপারে।
আলিফ আজ প্রায় ৬ দিন পর vercity যাবে বলে বেরুল। এই শহরে বাসগুলো আছে জন্যই তার মতো গরীব মানুষগুলো অল্প টাকায় চলতে পারে। নিউ মার্কেটের কাছাকাছি এসে হটাত ওর চোখ পরে নীল ক্ষেতের পাশের ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে চলা সেই সুন্দরীর দিকে। গন্তব্য হতে পারে DU. আর যদি তাইই হয়, তাহলে তো কেল্লা ফতে। আলিফ বাস থেকে নামার আগেই জোরে করে টান দিয়ে বাস বেরিয়ে গেল। কিন্তু যেই এক পলকের জন্য আজ তাকে দেখতে পারল,কেন যেন মনের কোথায় লিখা হয়ে গেল-মেয়ে,তোমার সাথে আমার আবার দেখা হবে,হতেই হবে।
কয়েকদিন জ্বরের কারণে tutiony miss হইছে। এই মাসে যদি বেতন কম দেয় তাহলে খবরই আছে। যে হারে সব নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে,তাতে আরও কয়েকটা tutiony জোগাড় করা খুব জরুরি হয়ে পরেছে।
আলিফের ছাত্রের নাম সাকিব। বাংলা ছিনেমার কিং সাকিব খানের চেয়েও নিজেরে over smart মনে করে। কিন্তু আলিফ কিছু বলে না।কারন যেকোনোভাবেই হোক,এই tutioniটা তার ধরে রাখতেই হবে। নাহলে পেট চলবে কেমনে?
কিন্তু এখানে আরও একটা সমস্যা আছে। সাকিবের বড় বোন জেবা may be তাকে পছন্দ করে। যদিয়ও আলিফ মেয়ে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না। তবুও জেবার দৃষ্টিতে সম্মানের চেয়েও যেন বেশি কিছু একটা আছে,যেটাকে ভালবাসা বলে সংজ্ঞায়িত করা যায় কিনা তাই নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আজ মনে হয় ভাগ্য বিধাতা আলিফের ঠিক পিছে পিছে চলছেন। তা না হলে এমন হবে কেন? কলিং বেলের আওয়াজ শেষে দরজা দিয়ে এক রমণীর প্রবেশ,এবং তাকে দেখা মাত্রই যেন আলিফের হার্ট একটা বিট মিস করল। এও কিভাবে সম্ভব? যার কথা ভেবে ভেবে আলিফের অন্তর বাহির অস্থির,সেই রমণী এখন তার সামনেই! নিজেকে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে ফেলে আলিফ…।
রমণীর নাম লাবনি,জেবার বান্ধবী। DUতে জেবার সাথে গণিত 1st year এ পরে। যাক,এতোটুকু জেনে আলিফ খুশি হোল খুব। নিজের ক্যাম্পাস এর মেয়ে বলে কথা। আর তাছাড়া যখন লাবনি জানতে পারল যে আলিফ DUতে পদার্থ 4th year এ পড়ছে,তখন অন্তরে যেই বিষ বাক্যই থাক না কেন, মুখে atleast তা প্রকাশ করল না। এই ৫ মিনিট সময়টা আলিফের জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় বলে মনে হোল।
– সাকিবঃ স্যার, নিউটনের 3rd lawটা মনে আছে?
– আলিফঃ আব্বার জিজ্ঞস। প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।
– সাকিবঃ exactly.এখন তাহলে বলুন তো,4th lawটা কি?
আলিফ কোনদিন এমন প্রশ্ন শুনে নি। চুপ মেরে গেল। পদার্থ কি তবে তাকে একটা বাচ্চা ছেলের কাছে অপদার্থ বানাতে যাচ্ছে! আতি পাতি করে মনের বইয়ের পাতা উলটিয়ে খুঁজার চেষ্টা করল,আসলেই এমন কিছু আছে কিনা। বলা যায়না,যেভাবে বিজ্ঞান এগুচ্ছে,তাতে নিউটনের 4th law বের হওয়া খুব বেশি অস্বাভাবিক না সম্ভবত।
– আলিফঃ আমি জানি না,তুমিই বল।
– সাকিবঃ সেটা হোল-ক্রিয়া হলেই প্রতিক্রিয়া হবে,যদি এবং কেবল যদি ক্রিয়া ধাক্কা দিয়ে কাজ করার মতো যথেষ্ট তেজি হয়।
আলিফ পুরাই চুপ…..
– সাকিবঃ বুঝলেন না স্যার? আপনাকে দিয়ে আসলে কিছুই হবেনা।
– আলিফঃ মানে কি? তুমি কিন্তু খুব দুষ্টু হয়ে গেছ।
-সাকিবঃ স্যার,লাবনি আপুকে দেখে যেমন হটাত আপনার চেহারা লাল হয়ে গেল,তাতে আপনার কোনও দোষ নেই। লাবনি আপু খুব বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দরী। যে কেও তাকিয়ে থাকবে। নিউটন বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এরকম situation এর জন্য এই সুত্র দিতেন।
এই পিচ্চি ছেলের পাকামোর কাছে সেদিন আলিফ থমকে গিয়েছিল। আসলেও তো তাই। সে ঠিক বুঝতে পারছিল তার হার্ট যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল ক্ষণিকের জন্য। নাহ,এখন সে আর এসব নিয়ে ভাবতে পারছেনা। তাই সেদিনের মতো চলে আসলো।
সময় গুলো কিভাবে যেন উড়ে উড়ে যাচ্ছিল। হ্যাঁ,এছাড়া আর কি বলবে? কিভাবে যেন লাবনিকে ছাড়া ৮ দিন ৬ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। ব্যাপারটা এমন না যে আলিফ চেষ্টা করেনি লাবনির মুখোমুখি হবার। আসল ঘটনা হোল,জেবার ভয়ে গণিত বিভাগের সিঁড়ি মারাতে পারেনি। আজ কেন যেন হটাত করেই TSC তে আসা। চন্দন,আরিফ,লিখন আর বিনু-এই কয়জনের সাথেই আলিফের উঠা বসা। এদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হোল,এরা সবাই খুবই simple,আরিফের মতই টাকা রোজগার করে পরিবার চালায়। আড্ডার রস জোগাতে থাকে বাদাম আর চা। হটাত যেন কি মনে হতেই অজান্তে লাল মামার চায়ের দোকানে হাল্কা নীল জামা পরা একটা মেয়ের দিকে নজর যায় আলিফের। আরে,এটা তো লাবনি। আশেপাশে জেবা নেই দেখে সাহস করে আলিফ এগিয়ে যায়।
– আলিফঃ আকাশের পানে চেয়ে ছুঁতে না পাবার বেদনায় আর হাহাকার নয়,যখন এক টুকরো আকাশ নেমে আসে এই ধুলো বালি ভরা দুনিয়ায়,তখন হায় এই মন চায় একটু খানি যদি হতো কথার উপায়।
– লাবনিঃ আরে আলিফ ভাই,পাগল টাগল হয়ে গেলেন নাকি?
– আলিফঃ না,এখনও হইনি,কিন্তু সব উপসর্গ দেখা দিয়েছে।
– লাবনিঃ হুম তাই তো দেখতে পারছি,সাহিত্য করে কথা বলছেন খুব
– আলিফঃ কি আর বলবো বল? এত সুন্দর মেঘলা বিকালে চোখের সামনে যখন এক টুকরো নীল এসে হাজির হয়, তখন আমার মতো দুর্বল চিত্তের মানুষগুলো কেন যেন খুব অসহায় feel করে। নিজের অজান্তে মনের ভিতরের চাপা দীর্ঘশ্বাস গুলি যেন মুহূর্তেই কাব্য হয়ে ঝরে পরে। সে যাই হোক,কি খবর তোমার?
– লাবনিঃ আমি আছি এইতো। আচ্ছা,আপনি আমাকে দেখলেই এমন করেন কেন?
– আলিফঃ কই,আমি তো কিছু করিনা। নিজের অজান্তে যেন কি হয়ে যায়। মনে হয় যেন…….
– লাবনিঃ কি,থামলেন কেন?
– আলিফঃ নাহ,থাক। আরেকদিন বলবো। আজ আসি,tutiony আছে
আরেকদিন দেখা বাস স্টপেজ এ। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে যখন মোটামুটি লাবনি sure আজ বাস পাবে না,তখনি আলিফ ওকে দেখতে পেয়ে রিকশাতে লিফট দেয়। কেন যেন মনে হচ্ছিল,এটাই হওয়ার কথা। ওর পাশে তো লাবনীরই থাকার কথা। গল্প করতে করতে দুইজনে বেশ ভালভাবেই versity তে পৌছায়। সেই রাতে একফোটা ঘুম আসেনি আলিফের। সমস্ত চেতনা জুড়ে যদি সে খেলা করে বেরায়,তাহলে ঘুম আসবে কিভাবে? এতদিন নিজেকে খুব শক্ত ছেলে বলে মনে হতো নিজেকে। কিন্তু আজ কিভাবে যে সে লাবনির প্রতি দুর্বল হয়ে গেল তা নিজেও বুঝতে পারছেনা। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আলিফ। কিন্তু ঠিক তক্ষুনি তার মনের বাস্তববাদী কোনও সত্তা হুংকার দিয়ে বলে,গরিবের কি প্রেম করা মানায়? যার নুন আনতে পান্তা ফুরায়,সে কিভাবে star kabab এ প্রেম করবে?
আরে ধুর,আরও খোঁজ নিতে হবে ওর ব্যাপারে।
সাকিবের কাছ থেকে জেনেছে,লাবনির মা-বাবা নেই। মামার বাসায় থেকে পড়ালেখা করে। tutiony করে নিজের খরচ চালায়। এতটুকুই যথেষ্ট ছিল জানার জন্য।
– লাবনিঃ এই যে শুনছেন?
মাথা ঘুরিয়েই আলিফের মনটা ভাল হয়ে গেল।
কই যান আপনি?
– আলিফঃ এইতো একটু লাইব্রেরিতে কাজ ছিল।
– লাবনিঃ আরে,কি আজব! আমিও তো যাচ্ছি। আচ্ছা চলেন একসাথে যাই…
কাজ শেষে দুইজনে যখন বের হোল,সন্ধ্যা হয় হয়। গোধূলির আবীর রঙ লাবনির কালো চুলে কেমন যেন একটা লাল আভা তৈরি করেছে,শুধুই তাকিয়ে থাকতে মন চায়।
– আলিফঃ আচ্ছা লাবনি,বল তো,গোধূলির মাহাত্ত কিসে?
– লাবনিঃ আমি জানি না তো।
– আলিফঃ শেষ বিকেলের সোনালী আভা আর আসন্ন রাতের আঁধার মানুষের মুখটাকে করে তোলে রহস্যময়, ঠিক যেমন এখন আমি আছি রহসসের চাদরে আবৃত।
– লাবনিঃ কেন এমন মনে হোল আপনার?
– আলিফঃ আজ এই সন্ধ্যাটা আমার জীবনের সেরা সন্ধ্যা। কারণ গত কয়েকদিন যার কারণে আমার ঘুম হারাম হয়েছে,আজ তাকে গোধূলি বেলায় দেখব,এতো আমার স্বপ্নেরই বাস্তব প্রতিচ্ছবি। আমি জানি,আমার মাঝে এমন কিছুই নেই,যা কাউকে মুগ্ধ করে। আমার মতো গরীব পরিবারের ছেলেদের এসব ভাললাগা,ভালবাসা মানায় না। আমাদের পৃথিবীটা অনেক বেশি বাস্তব। কিন্তু প্রত্যেকের ভিতরে যে মনটা আছে,এঁকে control করা খুবই শক্ত। আমি কখনই আমার অনিশ্চিত জীবনের কালো ছায়ার সঙ্গী করতে চাইনি কাউকে। কিন্তু আজ কেন যেন নিজের সব সীমাবদ্ধতাকে কাঁচ কলা দেখিয়ে তোমাকে বলতে ইচ্ছে করছে,আমার সঙ্গী হবে কি? হয়তো তোমাকে আকাশ চুম্বী দালানে রাখতে পারব না। কিন্তু দুইজনে এক আকাশের নিচে রাত তো জাগতে পারব। হয়তো তোমাকে দামি কিছু কিনে দিতে পারব না, কিন্তু তোমাকে খুশি রাখার আপ্রান চেষ্টা করব। হয়তো গাড়িতে করে তোমায় নিয়ে ঘুরতে পারব না,কিন্তু বিশ্বাস কর,ছোট্ট রিক্সাটাকে হয়তো আমরা আমাদের আনন্দ ভ্রমনের সঙ্গী করতে পারব। প্রথম যেদিন বৃষ্টি ভেজা তোমায় দেখেছিলাম, তখনি মনের মাঝে তোমার জায়গা পাকা হয়ে গিয়েছে। আর আজ যখন তুমি আমার সামনে দাড়িয়ে এই কথা গুলো শুনছো,মনে হচ্ছে-জীবনে আর কি আছে? যদি নিজের ভাললাগার কথা বলতে না পারলাম,তবে কেন এই বেঁচে থাকা? আজ তোমায় সব বলতে পেরে আমি মুক্ত। আমি জানি না তোমার মাঝে কি চলছে। আমি এটাও জানিনা ভুল করলাম কিনা। তবে শুধু এটা জানি,আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। তোমায় পাব কিনা জানি না,কিন্তু তোমায় আমি হারাতে চাইনা। তোমার জীবন তুমি আমার সাথে জড়াবে কিনা তা তুমিই জান।
এই ঘটনার পর আরও আনেকগুলো দিন কেটে গিয়েছে। লাবনি এত সহজে হ্যাঁ বলেনি। অনেকটা সময় নিয়েছে। তবে গোপনে জেবার কাছ থেকে জানা গিয়েছে যে,লাবনিও আলিফের প্রতি বেশ আগ্রহী ছিল সেই প্রথম থেকে। কিন্তু মেয়েদের তো বুক ফাটে,তবুও মুখ ফুটে না। তাই কিছু জানাতে পারেনি। আর হ্যাঁ,জেবাকে একজন মহীয়সী নারী বলতেই হবে, কারণ লাবনির জন্য সে তার ভাললাগাকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। জেবার জন্য পাত্র খোঁজার ভার সবার উপরে দেওয়া হোল।
ওদের দিনগুলি বেশ কেটে যাচ্ছে। দুইজনেই যা রোজগার করছে,পরিবার চালানোর পাশাপাশি নিজেদেরও বেশ চলছে। দুইজনে সারাদিনের বাস্ততা শেষে যখন একটু ফ্রি হয়,তখনি নিজেদের মেলে দেয় প্রকৃতির পানে। ভাল কথা…৬ দিন আগে ঢাকার বুকে রাত ৮ টার দিকে যে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল,সেই বৃষ্টিতে আলিফ আর লাবণী হাত ধরে ভিজেছিল অনেকক্ষণ। লাবনির পরনে ছিল একটা হাল্কা নীল শাড়ি। ঠিক যেন এক টুকরো আকাশ নেমে এসেছিল আলিফের পৃথিবী জুড়ে….।
(দুইদিন সময় বের করে গল্পটা লিখতে গিয়ে কোনও একজনকে খুব কম সময় দিয়ে ফেলেছি। হে মহিমান্বিত নারী… আপনার কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি আজ যতটুকুই লিখলাম,আপনার অনুপ্রেরনা ছিল শতভাগ।)