কনে দেখা

কনে দেখা

বিকালের দিকে প্রছন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছিল প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্তই ছিল। দুপুরের দিকে বাইক নিয়ে বের হয়েছিলাম আর চিরচেনা সেই ফ্রেন্ডের অফিসে গিয়েই জড়ো হলাম একে একে সার্কেলের সবাই। সার্কেলের সবাই একত্রিত হওয়া মানেই সবার অন্ধকার জগৎকে তুলে আনা। প্রতিদিনকার মত আজকেও তাই হল।

তবে আজকে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় বন্ধু রাফসানের পালিয়ে বিয়ে করার কথা, আর নিজ পকেটের টাকা দিয়ে তাদের পালাতে সাহায্য করা অফিসের মালিক বন্ধু মাহমুদের বীরত্ব। সার্কেলের মাঝে রাফসানই ছিল মোস্ট ট্যালেন্টেড প্লে বয়, জীবনে কতটা প্রেম করেছে তার হিসাব তার নিজের নিকটও নাই। কিন্তু শেষে এসে থেমে গেল সালমা নামক এক মেয়ের নিকট। হয়তো এটাই ছিল রাফসানের সত্যিকারের ভালোবাসা। প্রায় ছয়মাসের মত সম্পর্ক ছিল তাদের, আমরা সার্কেলের সবাই অবাক তার প্রেমের দীর্ঘ স্থায়িত্ব দেখে। যে ছেলেটি মাসে সর্বনিম্ন দুবার প্রেমিকা পরিবর্তন করে সে ছেলেটির সম্পর্কের স্থায়িত্ব এতদিন। ভীষণ পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল তার মাঝে, দূরন্তপনা ছেলেটি হয়েছিল ভীষণ আনমনা। ভালোবাসা সত্যিই পারে একটি মানুষের মাঝে পরিবর্তন এনে দিতে। রাফসানের চরিত্রও পরিবর্তন হয়ে গেল, বিয়ের পিড়িতে ও বসে গেল।

সার্কেলের প্রথম উইকেট পতন রাফসানকে দিয়েই হল। দ্বিতীয় উইকেটের শিকার কে হবে তা নিয়ে সবার মতামত আলাদা। তবে সর্বোচ্চ সংখ্যক মতামত ছিল মাহমুদ টার্গেট করেই। সার্কেলে সবার মাঝে একমাত্র ইয়াছিনই একজন সফল ব্যাবসায়ী এবং কর্মক্ষেত্রে সে ভালো অবস্থানেই আছে বলা যায়। কেউ কেউ হাত তুলেছিল ছানাউল্লাহর প্রতি, কিন্তু বেচারার সরাসরি কথা তিনি কখনো বিয়েই করবে না। ভালোবাসত একজনকে, আর তার ভালোবাসার গল্পটার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী একমাত্র আমিই। মেয়েটাও পাগল ছিল প্রায় ছানাউল্লাহর জন্য।

কিন্তু ছানাউল্লাহ অপারগ ছিল, তার ভালোবাসার মানুষটিকে বিয়ে করার কোনো উপায় ছিল না তার হাতে, এক পর্যায়ে মেয়েটির বিয়েই হয়ে যায় প্রবাসী এক পাত্রের সাথে। শোকেই পাথর হয়ে বেচারা এখন বিয়ে না করে বাকী জীবন কাটানোর জন্যই প্রস্তুত। আড্ডা চলছে আমাদের আর এরই মধ্যে পশ্চিমাকাশে কালো মেঘ এসে হানা দিয়েছে, মুষলধারে বৃষ্টিও শুরু হয়ে গিয়েছে। গ্রামে বৃষ্টি হওয়া মানে বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া। ভারত বনাম আফগানিস্তান এর খেলা চলছে আর এই মূহুর্তেই বিদ্যুৎ গায়েব বাড়ি থেকে ইতিমধ্যে ফোন এসেছে, ইফাত কই তুই বাড়িতে আয় দ্রুত কথা আছে। বৃষ্টির দোহাই দিয়া তখন কল কেটে দিয়ে আবার মেতেছিলাম আড্ডায়।

আড্ডার মাঝেই সন্ধ্যাকালীন ভোজনের জন্য শহীদের বিখ্যাত হোটেলে যাওয়া। সেখানে গিয়ে সবাই একেকজন যেন এমন খেলা বিশারদ যে সবার আলোচনা ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের ও হার মানাবে। নাস্তা শেষেই চা পানের জন্য আজাদের দোকানে যাওয়া, চা আর দই এর জন্য আজাদের দোকান সবার পছন্দের প্রথম স্থানে। সেখানে চা খেয়ে বের হয়ে বাড়ি ফেরার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েছিলাম তখন দেখা ভাই/বন্ধুসুলভ এক স্যারের সাথে। কলেজ জীবনেই তিনি আমাদের ক্লাশ নিয়েছিলেন। ওনার সাথে সম্পর্কটা বন্ধুর মতই। বয়স প্রায় ত্রিশ পার হয়েছে কিন্তু এখনো অবিবাহিত তিনি। ওনার সাথে দেখা হলেই বিয়ে করার জন্য উস্কানি মূলক কথা বলাই যেন আমাদের মুল লক্ষ্য থাকে। এরই মধ্যে বাবার ফোন এলো- কিরে কই তুই বাবা, বৃষ্টি তো থেমে গেল বাড়িতে আসবি কখন.?

বলেছিলাম – আসতেছি বাবা স্যারকে বিদায় দিয়ে পার্কিং থেকে বাইক বের করে স্টার্ট দিয়ে পিলিয়ন হিসাবে ছানাউল্লাহ কে নিয়ে বাড়িতে চলে আসা, ছানাউল্লাহ সহপাঠী,বন্ধু, এবং কাজিনও বটে। বাড়িতে এসে দেখি ছোট খাট একটা পারিবারিক সমাবেশ। বাবা, মা, আন্টি, চাচা, চাচী এবং কাজিন মিলে একটি মহাসমাবেশই গড়ে উঠেছে। বাইক রেখে সমাবেশে যোগ দিতেই চাচা বললো – শুনো ইফাত, তোমার জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম। এটা তো জানো তোমার আম্মু অসুস্থ, তোমার কোনো বোন নাই বা অন্য কেউ নাই যে তোমার আম্মুকে সাহায্য করবে। আর তুমি পরিবারের বড় সন্তান সেটাও জানো। বড়সন্তান হিসেবে পরিবারের প্রতি তোমার কি কর্তব্য সেটাও তোমাকে বলতে হবে না, পড়াশুনা করো শহরে থাকো সবকিছুই বুঝো। তাছাড়া তোমার আম্মুকে সাহায্য করার জন্য কাউকে না কাউকেই প্রয়োজন।

চাচার কথাবার্তায় আমার বুঝা হয়ে গেছে কি ঘটতে চলছে আমার কপালে। মানে সার্কেলের সেকেন্ড উইকেট এর শিকার আমিই হতে যাচ্ছি। স্বাধীন জীবন থেকে এক পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করার জন্য আমাকে নিয়ে মহাষড়যন্ত্র চলছে। চাচা আবার বললো- আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে বিয়ে করাতে চাই। আমার বন্ধুর মেয়ে ইন্টারমেডিয়েট ১ম বর্ষে পড়ে, মেয়ে দেখতে সুন্দরী এবং লম্বা। তোমার পছন্দ হবে শিউর। মেয়েরা এক বোন এক ভাই, মেয়েই বড় আর বাবা আর্মি অফিসার যশোর ক্যান্টেনমেন্ট এ আছে। উনারা আগে যশোর ক্যান্টেনমেন্টেই থাকতো কিন্তু পড়াশুনার সুবাধে বর্তমানে ঢাকাতেই থাকে। মেয়ে যাত্রাবাড়ি শামসুল হক খান স্কুল এন্ড কলেজে পড়ে। এখন আমরা চাচ্ছি কাল মেয়ে দেখতে যাবো, তুমিও আমাদের সাথে যাবে।

ওদের গ্রামের বাড়ি পানিয়ালা, আমরা চাচ্ছি তুমি অমত করবে না। চাচার কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, কি এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন আমি একদিকে ক্যারিয়ার, নিজের স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে, এবং ভালোবাসা। যদিও বর্তমানে ভালোবাসার মানুষটির সাথে খুব একটা সুসময় যাচ্ছে না তবুও ভালোবাসা ত । অন্যদিকে নিজের পরিবার এবং মায়ের অসুস্থতা। কি করবো আমি? চাচা জোর দিচ্ছে আমার সিদ্ধান্ত কি? আমি বললাম- আমার সময়ের প্রয়োজন, আমার ক্যারিয়ার এখনো বাকী এখন এসব কিভাবে কি?

চাচা বললো- পারিপাশ্বিক অবস্থা চিন্তা করে দেখো আর সিদ্ধান্ত নাও আমি বললাম – আই নিড টাইম চাচা বললো – কাল আমাদের সাথে চলো তারপর যত সময় দরকার তোমার ততই সময় পাবে। বাবা বললো – কাল তাহলে আমরা কনে দেখতে যাচ্ছি। আমি কিছু না বলেই বাসা থেকে বাহিরে চলে গেলাম। কি করবো না করবো তা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। দুটো রাস্তার মধ্যখানে আমার অবস্থান, কোন পথে যাবো কি করবো তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রয়োজন সময়। রাস্তায় গিয়ে ফোন দিয়ে ছানাউল্লাহ কে ডেকে ওর সাথে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করলাম । ছানাউল্লাহ বললো কাল যা তুই কনে দেখতে বাকীটা পরে দেখা যাবে।

এরই মধ্যে আবার বাবার ফোন, চাচা কথা বলছে – কাল যাচ্ছো তো আমাদের সাথে? আমরা মেয়ের বাবাকে জানানোর জন্যই অতি দ্রুতই তোমার সিদ্ধান্ত যাচ্ছি। আমি তখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই বললাম- জ্বী, যাচ্ছি। রাস্তার পাশে বসে আছি, আর ভাবতে লাগলাম কেন যে আসলাম এবার বাড়িতে । বাড়িতে না আসলে হয়তো এমন কিছু ঘটতো না । ফোনের নেট অফ ছিল, অন করার দেখি ভার্সিটির বান্ধুবি শৈলীর ম্যাসেজ – কিরে ইফাত তুই ক্যাম্পাসে আসিস না কেন? আমি রিপ্লায় দিলাম – রবিবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। তুই ভালো

আছিস? সে রিপ্লায় দিলো – না ভালো নেই, রবিবার বেঁচে থাকলেই ত দেখা হবে। বললাম- কি হইছে তোর? সে বললো- মাথা ব্যাথা আর নিম্ন রক্তচাপ আমি বললাম – মরবি না তুই বেঁচে থাকবি আমার বিয়ে খাওয়ার জন্য হলেও।

সে বললো- আমি নাচুম আমি হাহা রিয়াক্ট দিয়ে বললাম – আচ্ছা সে বললো – চা থাকবে আমার জন্য? আমি বললাম – চা না শুধু ম* ও থাকবে। বাকীদের সবাইকে প্রস্তুতি নিতে বল চাঁদপুর আসার জন্য। এরই মধ্যে গ্রুপে বার্তাটি প্রচার হয়ে গেলো। সারা ভাবলো মজা করছি আমি, সারাও ভার্সিটি ফ্রেন্ড। গ্রুপে সবার সাথেই কথা হলো একেকজন একেক পরামর্শ দিলো যা দেখে মনে সবাই এক্সপেরিয়েন্স সম্পূর্ন। এর পর অপেক্ষা করতে লাগলাম পরবর্তীদিনটির জন্য, না জানি কি আছে কপালে?

কনে দেখতে যাবো কি যাবো না? নাকি বাসায় না বলে ঢাকায় ফিরে যাবো। সকালটা শুরু হলো ধূসরতায়, পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে খুব। চেহারাভর্তি একরাশ চিন্তার দাগ। কি হতে চলছে? কিইবা ঘটতে যাচ্ছে আমার জীবনে? একটু ভেবেছিলাম মেয়েটিকে নিয়ে, সবেমাত্র ইন্টারমেডিয়েট ১ম বর্ষে পড়ে, ১৮ বছর কি বয়স হয়েছে? যদি ১৮ বছর বয়স না হয়ে থাকে, তাহলে একজন সামরিক দ্বায়িত্ববান পিতা হয়েও কিভাবে মেয়েকে বিয়ের পিড়িতে বসানোর চিন্তা মাথায় আসে.?

যাই হোক তারা যতটা অসচেতন হোক আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তা মানতে পারি না। আর মেয়েটিই বা কেমন? হয়তো তারও রয়েছে পেছনের কোনো গল্প, ভালোবাসার সম্পর্কটা আজকাল না হওয়াটাই অস্বাভাবিক, তাছাড়া এ বয়সটা ভয়ংকর প্রেমঘটিত সম্পর্কে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার কথাই বা ভিন্ন কি বলবো.?

আমিও কাউকে না কাউকে ভালবাসতাম বা ভালোবাসি। যদিও আমার সেই সম্পর্কের বহুআগেই ইতি ঘটেছে কিন্তু ভালোবাসাটা আমৃত্যুই রয়ে গেছে এবং রয়ে যাবে। বিছানা ত্যাগ করেছিলাম প্রায় আটটার দিকে, উঠেই দেখি আম্মু নাস্তা রেডি করে রেখেছে। নাস্তা সেরেই দোকানের দিকে গেলাম , দেখি অনেকেই আছে । ঘন্টাখানেক সেখানে সময় কাটিয়ে বাড়ির দিকে ফিরেই বাবার সাথে দেখা। হাতে দুইশ টাকা দিয়ে বললো- বাজারে যা, চুল দাড়ি কেটে আয়, বড়চুলে খারাপ দেখাচ্ছে। চুল দাড়ি এলোমেলোতেই কম্পোর্টেবল বোধ করি, সেখানে চুল দাড়ি কাটতে বলায় মাথায় রাগ উঠে গেল, কেম্নে কি? এমনিতেই একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিছে তা মেনে নিয়েছি কিন্তু চুল কাটবো এটা কেমন কথা.?

বাবাকে বললাম – চুল দাড়ি এমনিতেই সুন্দর কাটা লাগবে না

বাবা বললো – ভালো দেখায় না খারাপ দেখায় সেটা তুমি আমার

চেয়ে ভালো জানো না, সেলুনে যেতে বলছি যাও। আমার রাগ মাথায় উঠে বসলো – চুল যদি কাটতেই হয় তাহলে আমি পানিয়ালা যাচ্ছি না। এখন কি আপনি চান আমি পানিয়ালা না যাই? তাহলে আমার চুল দাড়ি যেভাবে আছে সেভাবে থাকলে যামু না হয় না। সোজা বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে, রাস্তায় গিয়ে বসে রইলাম। মোবাইল এ প্লে মিউজিকে গিয়ে ওয়ারফেজ এর রূপকথা গানটি ছেড়ে শুনতে লাগলাম এরই মাঝে আম্মুর ফোন – বাবা কই তুই..?

আমি – রাস্তায়

আম্মু – বাড়িতে আয় তোর আব্বু রাগ করছে

আমি – চুল দাড়ি থাকলে সমস্যা কি.?

আম্মু – বাবা কথাটা রাখ তুই, তোর বাবার একটা সম্মান ত আছে, তুই বাড়িতে আয় ।

আমি – আচ্ছা । কি আর করার, বাড়িতে গেলাম ।

আম্মু বলে- বাবা যা চুল দাড়ি কেটে আয়

আমি বললাম – আবার একই কথা. ?

আম্মু – তোর আব্বু রাগ করবে

আমি – কোন দুঃখে যে বাড়িতে আসতে গেলাম । দাও, টাকা দাও বাধ্য হয়ে বাইক নিয়ে সোজা সেলুনে, আর বিসর্জন দিয়া দিলাম যত্মে গড়া চুল দাড়িগুলোকে। একদম ক্লিন শেভ। সেলুনের আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেকেই চিনতে পারছি না।

পুরাই বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। কি আর করার, এটাই কপালে ছিল হয়তো। কেমন জানি আনইজি ফিল করতে লাগলাম। প্রায় তিন বছর পর ক্লিন শেভ হওয়া, আনইজি ফিল করাটাই স্বাভাবিক। ইনোসেন্ট একটা লুক নিয়ে যখন বাড়িতে ফিরলাম, আম্মু দেখে মহাখুশি বললো বাবা এবার তোরে সুন্দর লাগছে , আর চুল দাড়ি বড় করবি না। শখের চুল, শখের দাড়ি বিসর্জন দিয়ে এমনিতেই আমার গা জ্বলছে, আর আম্মু বলে এভাবেই তোরে সুন্দর লাগছে। ভাবতে পারি না কেন যে মুরুব্বিগন মনে করেন ক্লিন শেভে ছেলেদের সুন্দর লাগে। যাইহোক, দুপুরের পর বের হওয়ার পালা, কনের বাড়িতে যাওয়ার কথা। সবাই যে যার মত প্রস্তুত হইছে, আমার বেলায় এসেই ঝামেলা বাধলো।

কালো রঙের টি-শার্ট, জিন্স আর সু। এগুলো নাকি পোশাক না, আমাকে ফরমাল হতে হবে। আরে বাবা এত নিয়ম কানুন কে চালু করলো কনে দেখার ব্যাপারে তা আল্লাহ মালুম। এবার আমি টি-শার্টেই অটল ছিলাম। যেখানে ভার্সিটিতে ফরমাল না হয়ে পেজেন্টশন দেই, সেখানে কনে দেখতে গিয়ে বুঝি ফরমাল হবো? এবার যাওয়ার পালা- বাবা, চাচা, কাজিন, আর একটা কাজিনের জামাই সিনএনজিতে করে যাবে, আমি আর ছানাউল্লাহ বাইকে যাবো। সেখানেও আপত্তি, আমি বাইক চালিয়ে গেলে নাকি খারাপ দেখায়।

হায়রে মানুষ, এত নিয়ম কানুন কে সৃষ্টি করলো আল্লাহ মালুম। এবারও মুরুব্বিদের নিষেধ অমান্য করে বাইক চালিয়েই যাত্রা শুরু করলাম। পানিয়ালা বাজার পর্যন্ত গিয়ে সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুসময় পর বাবা চাচাদের বহন করা সিএনজি আসার পর সিএনজিকে অনুসরণ করে কনের বাড়িতেই পৌঁছলাম । প্রথমেই পরিচয় পর্ব এবং মিষ্টান্নভোজন ও সুপেয় পানীয় পানের পর্ব শেষ হয়ে মধ্যাহ্নভোজন এর পালা। পোলাও,চিংড়ি, ইলিশ, মুরগী, ডিম আর গরু দিয়েই বুফে সাজানো, যে যার ইচ্ছে মতই আহার করা শেষে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কনে দেখার পালা। কনে দেখার পালা শুরু হওয়ার পূর্বমুহূর্তে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হল, না জানি মেয়েটির মনে এখন কি চলছে। মেয়েটি কেমন হবে?

মেয়েটি কি একটি অনিশ্চিত ভবিষৎ এর দিকে চলে যাচ্ছে না তো? আবার আমার ক্যারিয়ার এবং স্বপ্নও কি শেষ হওয়ার পথে নাকি? ভার্সিটি বন্ধুদের এবং সার্কেলের সবাইকে কনের ছবি দেখাতে হবে, সেখানে বর হিসাবে ছবি তোলাটা শোভনীয় না, তাই কাজিন কে বললাম – তুই মেয়ের ছবি তুলে নিস কয়েকটা।

ভাবনার মাঝেই, পানের থালা হাতে নিয়ে কনের প্রবেশ হয় রুমে। হালকা খয়েরি বর্ণের শাড়ী পরেছে সম্ভবত, কিছু কমন রঙ ছাড়া অন্য রঙ আমি চেনিনা। শাড়ীটা দেখে তবে খয়েরি রঙই মনে হল। মেয়েটিকে মুরুব্বিগন বসতে বলার পর মেয়েটি আমার মুখোমুখি একটি চেয়ারেই বসলো, আমি নিচের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। চাচা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো – মা তোমার নাম বলো? মেয়েটি নিচু কণ্ঠে বললো- মুনতাহা ইসলাম নাদিয়া চাচা বললো – কোথায় পড়ো.?

মেয়েটি বললো- শামসুল হক খান স্কুল এন্ড কলেজে ইন্টার ১ম বর্ষে সায়েন্স বিভাগ নিয়ে পড়ি। এরপর বাবা চাচা আরো অনেককিছুই জিজ্ঞেস করলো, মেয়েটি স্বল্প বচনে বাবা চাচার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। মেয়েটিকে বুদ্ধিমতি এবং মেধাবিনী মনে হয়েছিল। মরুব্বিদের কথা বলার মাঝে আমি মেয়েটির দিকে কয়েকবারই তাকিয়ে ছিলাম এমনকি দুজনের চোখাচোখি ও হয়েছিল কয়েকবার। ভীষণ রূপবতী মেয়েটি, কপালের মাঝে ছোট্ট একটি টিপ পরেছিল টিপে যেন মেয়েটির সৌন্দর্য্য দ্বিগুন বৃদ্ধিকরে দিয়েছিল।

যদিও মেয়েদের চুলের প্রতি আমার দূর্বলতা সেখানে মেয়েটির চুল শাড়ীর আচলে ঢাকা ছিল তাই চুল আর দেখা হয়নি। মেয়েটির সাথে যখন মুরুব্বিদের কথা বার্তা শেষ হলো তখন চাচা আমাকে বললো – বাবা তোমার কোনো কিছু জানার আছে? জিজ্ঞেস করতে পারো। আমি তখন এমনিতেই আনইজি ফিল করতেছিলাম, অন্য মনের মাঝে ভালোবাসর মানুষএর প্রতিচ্ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে, হানা দিয়ে উঠেছে যেন জমে থাকা সব বিরহ বিচ্ছেদ এর বেদনা। চাচাকে বললাম আপাতত আমার কিছুই জিজ্ঞেস করার নাই। চাচা মেয়েটিকে বললো- তোমার কিছু জানার আছে.?

মেয়েটি বললো – না চাচা বললো – মা তাহলে তুমি ভিতরের রুমে যাও। মেয়েটি ভিতরের রুমে চলে গেল, আমার কাজিন তার সাথেই ভিতরে গেল। আমি সেখান থেকে উঠে একটু দূরে গিয়ে বসলাম। মোবাইল বের করে নেট অন করতেই অনেকের মেসেজ কতদূর এগুলাম? অনেকে তখনই ছবি চাচ্ছিল কনের, কিন্তু ছবি তোলার জন্য যাকে দ্বায়িত্ব দিয়েছিলাম সে এখনো কনের রুমেই। মুরুব্বিগন গল্প জুড়ে দিলেন, চাচা আর কনের বাবার বন্ধুত্বের গল্প। এবং বিভিন্ন সুখ দুঃখের গল্প। এরই মাঝে সন্ধ্যা নেমে আসলো।

তারউপর আজ আবার বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ, যে দল জিতবে সে দলই খেলবে এশিয়া কাপের ফাইনাল ভারতের সাথে। ছটপট করতে লাগলো মন, খেলা শুরু হয়ে গেছে আর আমিও এখানে অসহায়ের মত বসে আছি। চাচা ডাকলো আমাকে এবং বললো – একটু এদিকে চল, আমাকে নিয়ে বারান্দার দিকে গেলো চাচা এবং বললো- নাদিয়াকে কেমন লাগছে তোমার? আমি বললাম- দেখতে সুন্দরীই পছন্দ হওয়ার মতই চাচা বললো- আমরা কি এখন সামনে এগুবো..?

আমি বললাম- আমার একটু সময়ের প্রয়োজন চাচা বললো – আংটি পরিয়ে রাখলে ত তুমি সময় পাবেই তাছাড়া মেয়েটির বয়স এখনো আঠারো হয়নি, আঠারো হওয়ার পর বিয়ে হবে হাতে একবছর সময় থাকবে তোমার। আমি বললাম- আংটি পরানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমার সময় লাগবে। আমাকে কয়েকদির সময় দাও আমি পরে জানাচ্ছি। চাচা বললো – আনুমানিক তোমার কতদিন সময় লাগবে.? আমি বললাম – সর্বনিম্ন একমাস সময় দাও চাচা বললো – তোমাকে ১৫ দিন সময় দিলাম তোমার মতামত জানানোর জন্য। আমি বললাম – আচ্ছা। আমরা এখন চলে যাই.?

চাচা বললো – দাড়া, সবাইকে বলে যা। চাচাকে নিয়ে আবার সবার মাঝে ফিরে আসি, চাচা বললো ইফাত তুমি তাহলে চলে যাও এখন, আমি বললাম আচ্ছা, সবাইর নিকট থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর ছানাউল্লাহ বাইক নিয়ে সোজা বাজারে, ছানাউল্লাহকে বাজারে রেখে আমি বাড়ি এসে ড্রেস চেঞ্জ করে আবার বাজারে ব্যাক করি ।

বাজার থেকে খেলা শেষ করেই বাড়িতে ফিরি, তখন আর সময় ছিল কারো সাথে কথা বলার। কাজিনকে মেসেঞ্জারে নক দিয়ে একটি ছবিও নিয়েছিলাম কনের, কাজিন সেল্ফি তুলেছে । ছবিটা বন্ধুদের মাঝে পৌঁছানোর পরই তাদের কারো কারো মন্তব্য এমন ছিল- ইফাত শালী আছে তোর.?

আমি বললাম- না একবোন একভাই বেচারা হৃদয়ের তখন হৃদয় ভেঙ্গে গেল এবং বললো শালা, শালী ছাড়া বিয়ে করতে গেলি কেন.?

স্বপ্না বললো- মামা মেয়ের ভাইর সাথে আমারে সেট করাইয়া দে, আমি বললাম – মামা, শালা সেভেনে পড়ে মাত্র বেচারির ও মন ভেঙ্গে গেল। সবাই প্রস্তুত আমি বিয়ে করবো সেখানো তারা উদযাপন করবে বলে, কিন্তু আমিই অনিশ্চিত তা নিয়ে। হাতে আছে মাত্র পনের দিন সময় – একদিকে ফ্যামেলি অন্য দিকে ক্যারিয়ার, স্বপ্ন এবং ভালোবাসা..

The End

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত