নাফিজা ঘুমাচ্ছে । গুটিসুটি হয়ে, ওপাশ ফিরে । ওর মুখটা দেখা যাচ্ছে না । আমার কেমন যেন অস্থির লাগছে । হয়তো ওর মুখটা দেখতে পারছি না, তাই ।
আমি উঠে গিয়ে বিছানার ওপাশে দাঁড়াই । একটা হাত মাথার নিচে দিয়ে আরেক হাত বুকের কাছে নিয়ে শুয়ে আছে ও । কি নিষ্পাপ মুখটা ! আমি ওর কপালে চুমু এঁকে দেই । নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোক। নাফিজা । আমার প্রিয়তমা স্ত্রী । এ ঘরে কোনো ঘড়ি নেই । আমি ঘর থেকে বেরিয়ে নিচের রুমে যাই । সাতটা বেজে সাইত্রিশ মিনিট । ডাইনিং টেবিলের পাশের বড় জানালাটা খুলে দেই। ক্যালেন্ডারে আজকের তারিখটা মার্ক করে রাখতে হবে । আজ একটা বিশেষ দিন । এই দিনটা ভুলে যাওয়া চলবে না । আচ্ছা মার্কার পেন কোনটা ব্যবহার করব ? কোন রঙ ? কালো না লাল ?
সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না । মাথা ধরে যাচ্ছে । আজকাল এটা বেশী হচ্ছে । মার্কার পেন দুটো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি । আচ্ছা…টস করলেই তো হয় ! এই সহজ ব্যাপারটা মাথায় আসে নি কেন প্রথমে ! টস করলাম । কালো রঙ- এর মার্কার । হুমম…খারাপ না । শোক দিবসের মত হবে । হা হা হা । ডাইনিং রুমে আসলাম আবার । ক্যালেন্ডারটাতে ২৭শে ফেব্রুয়ারি দিনটাতে মার্ক করতে গিয়ে প্রচণ্ড অবাক হলাম । ঠিক ঐ দিনটাতেই লাল রঙ দিয়ে গোল মার্ক দেয়া ।
কে দিয়েছে এটা ? নাফিজা ? নাতো, ও কেন দিবে ! নাকি নাফিজা কিছু সন্দেহ করছে ?
নাহ, মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না । হঠাৎই কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় হেসে উঠলাম আমি। আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী । নাফিজা হয়তো সেকারণেই মার্ক করে রেখেছে আজকের দিনটা । কিসব যা-তা ভাবছিলাম এতোক্ষণ ! আমি কালো মার্কারটা দিয়ে লাল দাগটার উপর ঘুরিয়ে আঁকলাম । একটু বিদঘুটে দেখাচ্ছে । দেখাক । মার্কার দুটো জায়গা মত ফেলে দিলেই চলবে । কেউ কোনোদিন খোঁজও পাবে না । নিচতলার বাথরুম থেকেই গোসল করে,ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখি সেই প্রিয় মুখ । নাফিজা জানালার কাছের চেয়ারটাতে বসে আছে । শীতের সকাল । তবে আজ একটু রোদেলা । আবছা রোদের আলোয় নাফিজাকে আগের চেয়েও বেশী রূপবতী লাগছে । আনমনা হয়ে দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ও। “রাতে ঘুম ভালো হয়েছিল ?” নাফিজা ঝট করে ফিরে তাকালো । মুখে ছোট একটা হাসি ফুটে উঠল ওর । চেহারা সহজ হয়ে এলো । আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম ।
“হ্যাঁ…তোমার ?”“ভালো ।”কফি-মেকার থেকে দু’কাপ কফি বানিয়ে নাফিজার হাতে এক কাপ ধরিয়ে দিয়ে ওর সামনের একটা চেয়ারে বসলাম। বাচ্চা মেয়ের মত দু’হাত দিয়ে কাপ জড়িয়ে ধরে অল্প অল্প করে তাতে চুমুক দিচ্ছে নাফিজা । আমাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই হয়তো আমার দিকে মুখ ফেরালো ।
“কিছু হয়েছে ?”
আমি না-সূচক মাথা নাড়ি । “তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে নাফিজা। ও মাথা নামিয়ে ফেলল । লাজুক হাসি ফুটে উঠেছে ওর মুখে । আমি একইরকম মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি। সেই একই চোখ,একই ঠোঁট, একই রকম নাক, চোখের সামনে এসে পড়া এক গাছি চুল । প্রতিদিনই দেখি । শুধু আজ না, প্রতিদিনই মুগ্ধ হই । শ্যাম বর্ণের এই মেয়েটাকে এইটুকুতেই এতো সুন্দর লাগে কেন ? অসহ্য রকমের সুন্দর !
আমি কফির কাপটা নামিয়ে রাখি । নাফিজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ও যা বুঝার বুঝে ফেলে । “না…না…এখন না” বলে মৃদু বাঁধা দিতে চাইলেও আমি রাজি হই না । ওকে কোলে তুলে নিই । এই সময়টা শুধুই আমাদের । আমি একজন সুখী মানুষ । বেশ সুখী । অসুখী হবার মত কোনো ব্যাপার আমার সাথে ঘটে না । হয়তো সেকারণেই মাঝে মাঝে আমার ভয়ংকর কিছু একটা করার খুব ইচ্ছা হয় । ভয়ংকর…খুব বেশী ভয়ংকর । আজ সেরকমই ভয়ংকর কিছু একটা করার মত দিন । জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমি নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম আরও জনা পঞ্চাশেক ছেলেদের সাথে । বড় একটা হলরুমে থাকতাম । একসাথে খেতাম,ঘুমাতাম,পড়তাম,মারামারিও করতাম । জায়গাটাকে সবাই এতিমখানা বলে । আমি কি এতিম ছিলাম ?
যার বাবা-মা নেই তাকে এতিম বলে । আমার বাবা- মা ছিল । আমি ছিলাম তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান । আমার অবস্থা অনেকটা ‘থেকেও নেই’ এর মত ।
হ্যাঁ, সেই অর্থে তাহলে আমি এতিমই । বাংলাদেশে এতিমখানা নিয়ে খুব খারাপ কিছু ভাবা হয় । অনেকে ভাবে যে, এতিমখানার ভেতরে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলার বালাই নেই । ভুল ভাবে । আমাদের বেশ কড়াকড়ি নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হত । খাবার-দাবারও ভালো ছিল । প্রতি শুক্রবারে মাংসের ব্যবস্থা ছিল । শুক্রবারের দিনটাতেই মারামারিটা বেশী হত আমাদের মধ্যে । খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি । সেসময় নেয়ামত আলী হুজুর আমাদের সবাইকেই জালি বেত দিয়ে পেটাতেন । কেউ বেশী ঝামেলা করলে তাকে আলাদা করে নিয়ে শাস্তি দেয়া হত । ভয়াবহ শাস্তি । আমাদের এতিমখানা জীবনের বিভীষিকা ছিল এই লোকটা ।
সেখানে থাকাকালে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল আব্দুল্লাহ । একদিন নেয়ামত হুজুরের শাস্তির পাল্লায় পড়ে ও । ফলাফল, রাতে প্রচণ্ড জ্বর । একসময় রক্তবমি । রাত পেরিয়ে ভোর হবার আগে আগেই মৃত্যু । সারাক্ষণ আমি ওর পাশেই ছিলাম । আব্দুল্লাহ মারা যাবার সময় ওর হাত আমার হাতে ধরা ছিল । কি শান্ত,চুপচাপ সে মৃত্যু । আমি টেরই পাই নি বলতে গেলে । পরদিন হুজুর বয়ান দেন, “আব্দুল্লাহর মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে । আল্লাহ-পাক ওর মৃত্যু এভাবে নির্ধারণ করে রেখেছিলেন । ওর সেটাই হয়েছে । তা নিয়ে আমাদের কোনো দুঃখ করা উচিত নয় । মৃত্যু নিয়ে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন…”
আমি সেদিন চুপ করে ছিলাম । অন্যান্য দিনের মতই । এতিমখানায় আলিম পাস করা পর্যন্ত রাখা হয় । আমি আলিম পরীক্ষার ফলাফল দেয়া পর্যন্ত সেই সেখানেই ছিলাম । এতিমখানাতে থাকার শেষ দিন আমি হুজুরের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা পাই । আর চলে আসার আগে হুজুরের অতি প্রিয় কাপড় ইস্ত্রির মেশিনটার তার আর প্লাগের লাইন ওলট- পালট করে দিয়ে আসি। আমি এতিমখানা থেকে চলে আসার দিনই নেয়ামত আলী হুজুরের মৃত্যু হয় । আমি ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছিলাম । পজিশন শেষের দিকে ছিল। তারপরও ঢাকা মেডিকেল তো ! সবার সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড়,গাড়ি,বাড়ি দেখে আমার খুব লোভ লাগত । আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আমি একদিন বড়লোক হব । বিশাল বড়লোক ।
মেডিকেলে পড়ার সময়েই আমি নেয়ামত আলী হুজুরকে খুন করার ঘটনাটা নিখুঁতভাবে লিখে চরিত্র- নাম পালটে ছদ্মনামে পাঠিয়ে দেই একটা দৈনিক পত্রিকায় । ওরা সেটা ছাপায় । লেখাটা কেমন করে যেন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় । আমার ছদ্মনাম ছিল ‘খুনে লেখক’। এই নামটা তখন রটে যায় ভার্সিটির অনেক ছাত্র-ছাত্রীর মুখে । আমার শুনতে বেশ ভালোই লাগত । তবে, আমি কখনও আমার পরিচয় ফাঁস করিনি। এম বি বি এস শেষে প্র্যাকটিসের জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে যাওয়া লাগত। আমার পুরনো ইচ্ছাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইত। ভায়োলেন্স। আই লাভ ভায়োলেন্স ! কিন্তু আমি কিনা শেষমেশ হলাম চাইল্ড স্পেশালিষ্ট । ছোট ছোট বাচ্চা-কাচ্চাদের সর্দি,কাশি,পেট ব্যথার ডাক্তার ! বছর দুই এর মাথায় আমি ডাক্তারী থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নেই। সাত বছর ধরে করা টিউশনির সব টাকা,পার্ট টাইম টিচার ছিলাম সেটার টাকা আর ডাক্তার হিসেবে দু’বছরে আয় করা জমানো সব টাকা ব্যাংক থেকে উঠিয়ে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম ! অনেক টাকা !
আমি সব টাকা দিয়ে একটা ঔষধের দোকান খুলে বসি। অখণ্ড অবসর । পুরনো লেখালিখির ইচ্ছাও জেগে উঠল । কিন্তু খাতা,কলম নিয়ে বসে একটা লাইনও লিখতে পারলাম না। আমি খুনে লেখক। খুন ছাড়া আমার লেখা সম্ভব না । সেদিন রাতেই আমি বেরিয়ে পড়ি। অনেক হাঁটতে হাঁটতে কাকরাইলের মোড়ের কাছে একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া রেস্টুরেন্টের সামনে ঘুমিয়ে থাকা ছোট্ট একটা বিড়ালছানা পাই । বিড়ালটা সাদা রঙ এর । তবে চোখের পাশে আর পিঠে কালো রঙের ফুটকি আছে। বেশ সুন্দর !
রাস্তার পাশে অর্ধেকটা থান ইট পড়ে ছিল । আমি সেটা তুলে নেই সন্তর্পণে। সম্পূর্ণ জোর না দিয়ে খানিকটা আস্তে বিড়ালটার মাথায় ইটটা দিয়ে আঘাত করলাম । বিড়ালটা ভয় পেয়ে,ব্যথায় অদ্ভুত স্বরে চেঁচিয়ে উঠে পালাতে চাইলো। সেই মুহূর্তে আমি ওটার একটা পা সম্পূর্ণ পিষে দিলাম। বিড়ালটার আর্ত-চিৎকার শুনতে বেশ ভালো লাগছে। ধীরে সুস্থে আমি বিড়ালটাকে মারতে থাকি। একেবারে থ্যাতলা করে দেই। আমি ফিরে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ঘটনাটা গল্পের আকারে লিখে পাঠিয়ে দিলাম সেই পত্রিকার সম্পাদকের ঠিকানায়। গল্পের নাম “আর্তনাদ”। সাত বছর পর আমার এই লেখা আবারো তুমুল জনপ্রিয় হল । আমি খুশিতে ফেটে পড়লাম । কিন্তু পরিচয় ফাঁস করিনি ।
আমি এরকম প্রায় প্রতিরাতেই একটা একটা করে খুন করতাম,কাউকে বিপদে ফেলে তারপর সেই মানুষটাকে লক্ষ্য করতাম । তারপর সেই ঘটনাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা লিখে দিতাম। দিন দিন আমার লেখা জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠতে লাগল । আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না। তবে এরকম কোন একটা ব্যাপার আমার মধ্যে খুব বেশী পরিমাণে ছিল। মাত্র দুই বছরের মধ্যেই আমার দোকান থেকে প্রচুর পরিমাণে লাভ আসলো। সবাইকে অবাক করে দিয়েআমি একটা ফার্ম খুলে বসলাম । আমাকে যে বড়লোক হতে হবে !
আমি লেখা পাঠানোর সময় খুব সাবধান থাকতাম। প্রাপকের জায়গায় কিছু লিখতাম না । হাতের লেখা স্পষ্টভাবে যাতে বোঝা না যায়, তাই ইচ্ছা করে ছোট,বড় করে লিখতাম । পত্রিকাওয়ালারা আমাকে সম্মানীসূচক টাকা দিতে চাইলেও আমি নেই নি কখনো । রাস্তায় চলতে,ফিরতে গিয়ে নিজের লেখার প্রশংসা যখন শুনতাম, খুশিতে মন ভরে যেত । কেমন যেন এক অদ্ভুত আত্মতৃপ্তির অনুভূতি ।
নাফিজার সাথে দেখা হয় এরকমই এক সময়ে। আমি কখনই রোমান্টিক কিছু ছিলাম না। ভার্সিটিতে পড়ার সময় অনেক মেয়েই আমার সাথে মিশতে চেয়েছে, আমিই তাদের সবসময় এড়িয়ে গিয়েছি। ওসব মেয়েরা আমার সঙ্গ চাইতো । সঙ্গটা সৎ ভাবে ছিল না । বোকা মেয়ের দল ! কিন্তু…কিন্তু নাফিজা অন্যরকম ছিল । ছিল মানে এখনো আছে । ওর মধ্যে কিছু একটা আছে যেটা সবার থেকে আলাদা। সেটা হল, এই মেয়েটার ভালোবাসার ক্ষমতা। এই মেয়েটা ভালোবাসতে জানে। ও আমাকে ভালোবাসে। অনেক অনেক বেশী ভালোবাসে। আমিও নাফিজাকে ভালোবেসেছিলাম । এখনও বাসি । নাফিজার সাথে পরিচয়ের পর বিয়ে হয়ে যেতেও খুব বেশী সময় লাগেনি । মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে ছিল । আমি ততদিনে বেশ বিত্তবান । ওর বাবা-মাও বিয়েতে মত না দেয়ার কোনো কারণ পান নি ।
লেখা নিয়ে আশেপাশের মানুষজনের কাছ থেকে নানারকম মন্তব্য শুনে আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, বই বার করব । এ বুক, ফুল অফ কমপ্লিট ভায়োলেন্স ! এমন গল্প, এমন ভয়ের অনুভূতি আগে কেউ কখনো পড়ে নি । আমার ফার্মের অবস্থা তখন বেশ ভালো । মাত্রাতিরিক্ত ভালো । উন্নতির দিকে এগিয়ে
যাচ্ছিলাম দ্রুত । প্রায় চার হাজার কর্মী রয়েছে আমার এখানে । আমার পরবর্তী গল্পের টার্গেট হল এই কর্মীদের মধ্যে প্রধান দুজন । সুমন এবং বশির । আমি খুব সূক্ষ্ম চাল ফেললাম । প্রথমে এই দুজনের মধ্যে একটা ঝগড়া লাগানোর ব্যবস্থা করি রফিককে দিয়ে। রফিকও আমার প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী। বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সেও আমার পরিকল্পনার একটা অংশ। ঝগড়া-কলহ থেকে একসময় কোন্দল,আন্দোলন,ধর্মঘট। মোক্ষম সময়। আমি রফিককে ডেকে এনে পুরো জায়গাটায় আগুন লাগিয়ে দেয়ার জন্য বলি। রফিক অবাক হলেও দ্বিমত করে না।
পুরো কারখানাটা যখন দাউ দাউ করে আগুনে জ্ল ছিল আমি তড়িঘড়ি করে পুলিশ ফোন দিয়ে জানাই । তারপর ফায়ার সার্ভিসে ফোন দেই। আমার কাঁচের দেয়ালের রুমটা থেকে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছিল বেশ স্পষ্টভাবে। আমি ড্রয়ার থেকে নতুন কেনা রিভলভারটা বের করে নিলাম। কেনার পর থেকেই নিয়মিত প্র্যাকটিস করে হাত পাকিয়ে ফেলেছি। গুলির চেম্বারটা চেক করে, ঠিকমত পরিষ্কার করে নিয়ে হাতের কাছে রাখলাম। রফিক একটু পরেই আসবে ওর পাওনা টাকা নিতে। মনে মনে হাসলাম আমি।
আমি রফিককে গুলি করি ঠিক কপালের মাঝ বরাবর। টু শব্দ করার আগেই ওকে ধরে নিয়ে উপর থেকে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দেই। প্রমাণ খতম। রিভলভারটা আবার চেক করে নিলাম। ততক্ষণে এর মাথায় সাইলেন্সর শোভা পাচ্ছে। বীমা কোম্পানি তদন্ত চালিয়ে শেষ পর্যন্ত কিছুই না পেয়ে আমাকে তাদের সন্দেহের তালিকা থেকে অব্যাহতি দিয়ে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিল। আর এর মাঝের ক’দিন আমি ঘুরে বেড়ালাম সেই দুজনের বাসায়। সুজন আর বশির। দুজনকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আমিই অভিযোগ এনেছি তাদের বিরুদ্ধে।
বশিরের বড় মেয়েটার বিয়ের কথা চলছিল । ভেঙ্গে গেছে । সুমনের বড় ছেলেটা বাড়ি ছেড়ে গেছে দু’তিন দিন আগে। সংসার কিভাবে চলবে তারা সেটা জানে না । সব ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে এসেছে। এই যে,আমিই তাদের পরিবারের ভাঙ্গনের জন্য মূল দায়ী। একথাটা এখন তারা জানে না, তাই ধরে নিয়েছে নিয়তি, তারা শান্ত রয়েছে। কিন্তু যখন সব আসল কথা জানবে, তখন তারা নিয়তির হাতে সবকিছু দিয়ে বসে থাকতে পারবে না । তারা ছুটে আসবে আমাকে মেরে ফেলতে,প্রতিশোধ নিতে।
রাতে ডিনারের ব্যবস্থা করলাম আমি নিজেই । প্রায়ই করি । আর কফির ব্যবস্থা করে নাফিজা। আজ কফিও আমি বানালাম । এই কফি দিয়েই হবে সব কাজ । সাদা শাড়ি পরা অবস্থায় নাফিজাকে আজকে সত্যিই অপ্সরীর মত লাগছে । কি সুন্দর, মায়াময় এই মুখটা ! কফি নিয়ে রুমে ঢোকার পর নাফিজাই দরজা লাগিয়ে দিল। ওর মুখে দুষ্ট হাসি । এটাই ওর শেষ হাসি হবে । গল্পে ঠিকঠাক ফুটিয়ে তুলতে হবে পুরো ব্যাপারটা । আমি পূর্ণ মনোযোগে কাজ করতে লাগলাম । কফিতে অল্প করে পটাসিয়াম সায়ানাইড দেয়া আছে । ধীরে ধীরে কাজ করবে । আমার সেটাই চাই । কষ্ট দেয়ার পুরো প্রসেসটা সম্পূর্ণ তুলে ধরা যাবে তাহলে । কফির কাপটা রেখে আমি মৃদু হেসে নাফিজার হাতে হাত রাখতেই অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় ও আমার হাতে ইনজেকশন দিয়ে কিছু একটা পুশ করে দিল । প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করে উঠি আমি । “এটা কি নাফিজা !” নাফিজা হাসে । “তুমি কখনও ‘খুনে লেখক’ নামের লেখকের লেখা পড়েছ ?” আমি হা হয়ে যাই । ও একটু আগে আমার শরীরে কি দিয়েছে সেটা বুঝতে আর বাকি নেই আমার । আমার পুরো শরীর অবশ হয়ে যাওয়া শুরু করে ।
হাঁটু মুচড়ে বসে যাই আমি । “জানো, উনি না খুব সুন্দরভাবে মানুষের শারীরিক কষ্টের বর্ণনা লিখতে পারেন । লেখাগুলো পড়লে কেমন যেন মাদকতা ভর করে। খুন করতে ইচ্ছা করে। প্রচণ্ড কষ্টে মরে যাওয়ার সময় মানুষের মুখ কেমন হয়, সেটা জানতে ইচ্ছা করে। অ্যাই…তুমি কি মরে যাচ্ছ ? প্লিজ এখনই মরে যেওনা। তোমার মুখটা আর কিছুক্ষণ দেখি। খুব কষ্ট হচ্ছে, না ?” নাফিজা আগেও বোকা ছিল, এখনও তাই রয়েছে ।ও প্রচণ্ড তীব্র কোনো বিষ আমার শরীরে দিয়ে দিয়েছে। আর বেশীক্ষণ নেই। আমি বুঝতে পারছি, আর বেশীক্ষণ টিকব না আমি। আমার অস্ত্র আজ আমার উপরই প্রয়োগ করা হয়েছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে নাফিজার মুখটা দেখার চেষ্টা করি। ইসস, এতো মায়া কেন মুখটায় ? ওর চোখের বিষণ্ণতাই কি এই মায়া ফেলেছে মুখে ? চকিতে আমার একটা ব্যাপার মনে পড়ে গেল। আমি হা করে দম নিতে থাকলাম।
প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। নাফিজা একমনে কথা বলে যাচ্ছে। কিছু বুঝতে পারছি, কিছু পারছি না। তবে আমাকে শেষ কাজটা করে যেতেই হবে। গায়ে যতটুকু শক্তি ছিল তার সাথে মনের পুরোটা জোর দিয়ে আমি সজোরে লাথি হাঁকাই টেবিলটার পায়ায়। কফির কাপটা উলটে পড়ে গেল মেঝেতে। আমি চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ি। কাজ শেষ। আর মাত্র কিছুক্ষণ। নাফিজা আমাকে দেখুক,আমিও ওকে দেখি । শেষবারের মত। ওর চোখেমুখে কিশোরী মেয়ের মত আনন্দ ফুটে উঠেছে। আর খানিকটা উন্মাদনা। আমি কষ্ট সহ্য করে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকি। আমার শেষ গল্পের শেষটা যে এমন হবে, সেটা আমি কখনও ভাবিনি। কি অদ্ভুত রকমের এই বিশ্বাস তাদের! মরুক বোকা গাধার দল।
এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে লেখা বই আমি প্রকাশ করি মাস ছয়েক পর। এটা তখনকার সময়ে আগের সব রেকর্ড ভেঙ্গে বেস্ট সেলার হয়ে যায়। সবখানে শুধু একটাই নাম। খুনে লেখক’। এই কটা দিন নাফিজাকে আমি একদমই সঙ্গ দিতে পারছিলাম না। তবে ও আমার ব্যস্ততা বুঝতে পারছিল। ও ঠিক মানিয়ে নিয়েছিল। মেয়েটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়েই যাচ্ছিল দিন দিন । আমার প্রথম বই প্রকাশ হবার পর বেশ কিছু ঘটনা ঘটে যায় বেশ দ্রুত। সারা শহরে হঠাৎ করেই খুন, ডাকাতি, মারামারি বেড়ে গেল। একেবারেই সহজ-সরল মানুষজনও রাতের আঁধারে হয়ে উঠতে শুরু করল ভয়ংকর। পত্রিকায় এসব নিয়ে লেখা হল বেশ। সেসব মানুষদের জিজ্ঞাসাবাদ করার পর জানা গেল, তারা এই আমার লেখা পড়েই হঠাৎ করে বর্বর দৃশ্যের অদ্ভুত সৌন্দর্যটা দেখার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। মৃদু হাসি আমি। যাক, আমি কিছুটা হলেও সফল। প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই অপরাধ প্রবণতা থাকে। তা নাহলে অপরাধ সমর্থন করে এতো এতো গল্প লেখা হত না। মুভি বানানো হত না। অথবা আমার মত লেখক এতো বিখ্যাত হতে পারত না। আমি বর্বরতার দৃশ্যগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখতে পেরেছি বলেই মানুষজন আমার লেখা এতো বেশী পছন্দ করে।
অনুকরণ করে। আমার লেখা নিষিদ্ধ করে দেয় সরকার। তাতে বরং আরও ভালোই হল। সাধারণ লেখকের চেয়ে নিষিদ্ধ লেখকের প্রতি সবার আকর্ষণ সবসময়েই বেশী থাকে। এর কিছুদিনের মধ্যেই আবার খবর পাওয়া গেল, আমার গল্পের কাহিনীর সাথে কারখানা পুড়িয়ে ফেলার ঘটনার মিল পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু কোনো প্রমাণের অভাবে আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারছে না। আর এসব খবরই পেলাম দৈনিক পত্রিকাগুলোতে । এই বোকা সাংবাদিকরা কি জানে না যে, তারা যেসব তথ্য প্রকাশ করে সেগুলো অপরাধীদের জন্য কতটা উপকারী ? আমি কিছুদিন গা ঢাকা দেওয়ার কথা ভাবলাম। অফিসে ছুটি ঘোষণা করে আমি আর নাফিজা ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।
ওকে এতোগুলো দিন একদম সময় দেয়া হয়নি। আমরা কক্সবাজার,সেইন্ট মার্টিন আইল্যান্ড,মংলা বীচ,পতেঙ্গা বীচ সব জায়গায় ঘুরে বেড়াই। বিদেশে কোথাও যেতে চাইনি, কারণ গোয়েন্দারা নিশ্চয়ই এয়ারপর্টের দিকে লক্ষ্য রাখছে । সন্দেহ করতে পারে, যে, আমি দেশ থেকে পালাতে চাচ্ছি কি না। আমি সন্দেহ বাড়াতে চাইলাম না আর। নাফিজার সাথে একান্তে সময় কাটাতে কাটাতেই আমি নতুন গল্পের প্লট খুঁজতে লাগলাম। নাফিজাকে কক্ষনো আমার লেখক পরিচয় দেই নি।একদিন সী-হোটেলের নিজস্ব সমুদ্রের জায়গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে খেয়াল করলাম নাফিজা ডুবে যাচ্ছে। ও সাঁতার জানে না। আমার হঠাৎ করেই ইচ্ছে হচ্ছিল ডুবন্ত মানুষের মৃত্যুর সময় দেখতে কেমন লাগে তা দেখতে।
কিন্তু নাফিজা আমাকে সে সুযোগ না দিয়ে আমার হাত জড়িয়ে ধরে উঠে চলে আসল। নাফিজা বেঁচে যায় সেদিন।কিন্তু আমার মাথায় আটকে থাকে ব্যাপারটা। আমার পরবর্তী গল্পের জন্য উৎসর্গিত হবে আমার স্ত্রী, নাফিজা।বহুদিন ধরে চিন্তা-ভাবনা করে এইদিনের কথা ভেবেছি আমি। আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। আর নাফিজার মৃত্যুদিন;
এখনও হয়নি…তবে হবে।