সংসার

সংসার

রাস্তার ধারে ছোট একটা লেক।ওখানে আমি আর নবীন বসে প্রেম করতাম।আমাদের প্রেমের টপিক ছিল,রাস্তার ওপরপাশের উঁচু উঁচু দালানের দিকে হা করে তাকিয়ে কল্পনা করা। নবীন বলতো,ঝুমা আমাদের ও ওমন একটা বিল্ডিং হবে।সেখানে থাকবে বিশাল বারান্দা।বারান্দায় নানা রঙের ফুল।

আমি উঠে বলতাম এই শোন,আমরা একটা ময়না পাখি পালবো কিন্তু।বারান্দায় থাকবে কাঠগোলাপ গাছ।প্রতিদিন ফুল হবে তা আমার খোঁপায় পরিয়ে দিবে।

এভাবেই নবীন খোলা আকাশের নিচে স্বপ্ন দেখাতো আমায়।আমি ঘাড়ে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে স্বপ্ন দেখতাম।খালি পেটে,খালি পকেটে বেচারা আমায় কত স্বপ্ন দেখাতো।মাঝে মাঝে আমি কল্পনায় চার চাকার লাল গাড়িতে উঠতাম।আবার মাঝে মাঝে দেশ বিদেশে নবীনের সাথে ঘুরে বেড়াতাম।স্বপ্ন ভেঙে যেত গাড়ির হর্ন এ মাঝে মাঝে ট্রাফিক পুলিশের ডাকে। দুজন হাসতাম।কি অবুজ আর বোকা ই না আমরা।

সেবার হুট করে নবীন এসে বললো,ঝুমা আমি যদি মুরগীর ফার্ম দেই তাহলে আপত্তি আছে তোমার?

আমি ভ্রু বাঁকিয়ে বললাম কি বলো?পাবলিক থেকে অনার্স মাস্টার্স করে তুমি মুরগী বেঁচবা?

নবীন হাসি দিয়ে বললো আহা ঝুমা আমি কি বিক্রি করবো নাকি?লোক থাকবে তো।

আমি মুখ মলীন করে বললাম মানুষ যদি বলে তোমার জামাই কি করে?আমি তখন বলবো আমার জামাই মুরগীওয়ালা?

নবীন: বলবে সে বিজনেসম্যান।
ভেবে দেখো তোমার বাবাকে আমি প্রতিদিন ৪টা মুরগি খেতে পাঠালাম।সে কত খুশি হবে তাইনা?

আমি রাগ করে চলে আসলাম।নবীনের চাকরি ছিলনা।ছিলনা টিউশনি।পকেটে টাকা ছিলনা।চকচকে মানিব্যাগ ছিল যেটা আমার ই দেয়া।তবে চকচকে মানিব্যাগ এ ময়লা টাকাও ছিলনা।তবে ওর ছিল সুন্দর মন।৬বছরের সম্পর্কে আমার কখনো ভাবতে হয়নি নবীন আমায় ছেড়ে কাউকে নিয়ে ঘর বাঁধবে।আমার কখনো মনে হয়নি নবীন আমার সাথে বেইমানি করছে।আমাদের ঝগড়া হতো, সেটা হতো সামান্য বেপার নিয়ে।কখনো আমাদের মন মালিন্যতার পরিসর বড় হয়নি।এই রাগ আবার কায়দা করে ভাব করে নিত।

পরাপর চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে দিয়ে, হাঁপিয়ে গিয়ে ছেলেটা একদিন আমায় বললো,ঝুমা আমার মতন অপদার্থকে ছেড়ে দেও।যে সিগারেট এর টাকাও যোগার করতে পারিনা সে তোমার ভরণ পোষণ কি করে নেই?

আমি বার বার বলতাম নবীন,সব ছেলের জীবনেই এমন সময় আসে।ভেঙে পরলে চলবেনা।আমার অপেক্ষা করতে সমস্যা নেই।আমিও চাকরি খুঁজবো। একদিন আমাদের অনেক টাকা থাকবে।লাল গাড়ি করে সকাল সন্ধ্যা আমায় নিয়ে বের হবা তো?

তখন আমি নবীনের চোখে পানির উপস্থিতি দেখলাম।ওর কান্না আমায় অনেক দূর্বল করে দিত।আর যাই হই মেয়ে তো আমি!

বাসায় এসে হতাশ হয়ে কাঁদতাম।ওকে ধরা দিতাম না।বান্ধবীদের সুখে থাকা আমায় যে কষ্ট দিতনা তা নয়।আশেপাশের সুখি দম্পতি দেখলে বুক ভাড়ি হয়ে আসতো।নিশ্বাস মিস করতাম।তাও ও ভরসা রাখতাম অন ডে উই উইল বি হ্যাপি।

পার্কে কত রঙিন জুটি দেখে দুজনে মুগ্ধ হতাম।আনমনে তাকিয়ে ভাবতাম সুখী হবোতো?টাকা ই তো সব।টাকা হলেই সব সুখ আসে এসব মাথায় আসতো যে না তা নয়।কিন্তু নবীনের সামনে ধরা দিতাম না কখনো।

রাস্তার ফুটপাতে দুজনে ভিজতাম আর কল্পনা করতাম একদিন দুজনে ঘরের বারান্দায় বসে বৃষ্টি বিলাশ করবো।

এখন আমাদের বিয়ের ও ২ বছর হয়েগিয়েছে।বাসায় বিয়ে ঠিক করেছিল তখন নবীন কেবল একটা এন জি ও তে ঢুকলো।আমার হতাশাগ্রস্থ কণ্ঠ শুনে ও আমায় বাসা থেকে নিয়ে বিয়ে করলো।ওর বাসায় ও বলার সাহস করলোনা।বন্ধুর খালি বাসায় বিছানা ছাড়াই মেঝেতে ঘুমিয়েছি।মেঝেতে মাথা রেখে ঘুম আসছিলনা বলে নবীনের উষ্ণ হাতের উপর কী মধুর নিশ্চিন্ত ঘুম হলো আমার!প্রথম প্রথম বেতন ছিলনা ওর।মাঝে মাঝে এক বেলা না খেয়েও থেকেছি।কত ভালোবাসা দিবস গিয়েছে আধপেটা খেয়ে। টিউশনির মাইনে যেদিন পেলাম মনে যে কি আনন্দ আমার।রাস্তা ফুরোচ্ছেনা।কখন বাসায় যাব নিজের বেতনের টাকা দিয়ে নবীন কে ভালো মন্দ রেঁধে খাওয়ানোর কথা কল্পনা করতেও যেন আনন্দ।চাল মাংস কিনে বাসায় গিয়ে রান্না করলাম।খাবারের প্লেট সামনে নিয়ে বসে আছি।ঘাম ভেজা ক্লান্ত শরীর নিয়ে নবীন বাসায় ফিরলো।

ভালো খাবার দেখেও নবীনের চোখে সেদিন জল অনুভব করেছিলাম।সেদিন পেট ভরে খেতে পারিনি।অনেকদিনের অভ্যাস এ পেট এর ইঞ্চি ও কমে গিয়েছিল।দুজন দুজনকে খায়িয়ে দিতে গিয়ে কাঁদিয়ে ভাসিয়েছি রাত।

সেবার বাসায় অপেক্ষা করে বসে নবীনের অপেক্ষা করছি।বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করছে।কি করা উচিৎ বুঝছিলাম না।

নবীন আসতেই আমতা আমতা করছি।আমার মলীন মুখ দেখে ও জিজ্ঞেস করলো,ঝুমা শরীর খারাপ তোমার?আমি উওরে কিছুই বলতে পারছিলাম না।বিছানায় শুয়ে কাঁদছি।নবীন আমার হাত ধরে বললো,কাঁদছো কেন?আচ্ছা তুমি কি হাঁপিয়ে উঠেছো?ঝুমা আসলেই অভাব থাকলে ভালোবাসা দিয়ে কদিন চলে?

আমি চোখ মুছে বললাম,ভালোবাসার ভাগিদার তো আরেকজন আসতেছে।

ভেবেছিলাম নবীনের চিন্তায় মুখ মলীন হয়ে যাবে কিন্তু না তা হয়নি।ও সেদিন মহা আনন্দে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগলো।

ধার করা টাকা দিয়ে খাবার এনেছিল।নিজে অতিরিক্ত পরিশ্রম করেও আমায় কাজ করতে দেয়নি।সারাদিন কাজ করে এসে নিজে না খেয়েও আমায় খায়িয়েছে।মানুষটাকে তাচ্ছিল্য করার মতন সাহস আমি করতে পারিনি।খুব ভয় হতো বাচ্চাকে বাঁচাতে পারবো তো?আমার সন্তান এই অভাবের সংসারে কি করে থাকবে!ওকে পেটে নিয়ে খুব ইচ্ছে হতো খেতে,খুব ইচ্ছে হত আইসক্রিম খাই।মাঝে মাঝে ১০টাকাও থাকতোনা। নবীন কি করে যেন বুঝে যেত আমার কি চাই।

রাতে আইসক্রিম নিয়ে হাজির।শুকনো মুখ দেখে আমি খেতে পারতাম না।

কেটে গেছে ১০টি বছর।আমাদের মেয়ে ঝড়া হবার পর সব পাল্টে যায়। নবীন ভাবে ঝড়া আমাদের জন্য সু ভাগ্য।এখন আর মেঝেতে ঘুমাতে হয়না।নরম বালিশ এ ঘুমাই দেখে নবীনের হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমানো হয়না অনেকদিন।তাই সেসময়ের মতন তৃপ্তিতে ঘুম হয়না অনেকদিন।

লাল রঙের গাড়ি না হলেও চকচকে নীল রঙের গাড়ি আছে তাতে আর আমাদের ঘুরে বেড়ানো হয়না।সারাদিন মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থেকে রাতে ঘুমাতে গেলেই দেখি নবীন নাক ডাকছে।আর আগের মতন আড্ডা দেয়া হয়না আমাদের।বিয়ের আগে, টাকার ঘরে বসে যে সুখের কথা ভেবেছিলাম সে সুখ ছিল কুড়ে ঘরে।টাকা ঠিক ই এসেছে তবে সুখ ওই কুড়ে ঘরেই রেখে এসেছি।

বৃষ্টি শুরু হলো।ঝড়া ড্রয়িং করছে ময়না পাখি।লাল ময়না পাখি।যে পাখি পোষার স্বপ্ন ছিল তবে আজকাল নিজেকেই বদ্ধ পাখি মনে হয়।

নবীন এসে বললো এক কাপ চা দেও ঝুমা।
আমি কিছু না বলেই চা বানিয়ে আনলাম।ওর হাতে দিতেই দেখলাম ও বারান্দা দিয়ে কি যেন লক্ষ করছে।

কি দেখছো?

নবীন: বাইরে তাকিয়ে দেখো ঝুমা।
তাকিয়ে দেখি লেকের পাশে বেঞ্চ পাতা।সেখানে বসে আছে দুজন। ছেলের কাঁধে মেয়েটির মাথা রাখা।এত দূর থেকেও দেখে বুঝতে বাকি নেই তারা কত সুখী।মেয়েটি লেকের পানিতে পা দুলাচ্ছে।বৃষ্টিতে কি অকপটেই ভিজে যাচ্ছে দুজন।

কি দেখবো নবীন?নেও চা খাও

নবীন আমার দিকে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে বলে,তুমি কিছুই বুঝলে না?আমি তো আমাদের অতীত দেখতে পাচ্ছি।

ওর হাতে চা দিয়ে অভিমান নিয়ে ভিতরে আসতে নিলাম।

নবীন হাত শক্ত করে ধরে বললো,কি ভাবো আমায়?আমার মন মরে গেছে?টাকার কাছে বিকিয়ে দিয়েছি।জানো ঝুমা আমার ও ইচ্ছে হয় তোমায় নিয়ে আগের মতন রাস্তায় ঘুরি।আইসক্রিম কিনে খাই।কিন্তু ওই যে কিছু পেতে হলে কিছু তো আমাদের ত্যাগ করতেই হবে।আগে খালি মানিব্যাগ এ টাকা দেখার সখ হতো।সেই সখ পূরণ করতে গিয়ে কখন সময় চলে গেল, সখ, আশা, চাওয়া,শেষ হয়ে গেল টের ই পাইনি।

আমি কাঁদছি।নবীন চায়ের কাপ পাশে রেখে আমায় বুকের ভিতর চেপে ধরে বললো বুকের ভিতর এর শব্দ টা আগেও যেমন ছিল এখন ও তেমন।চলো আজ আমরা বাইরে যাই।

গাড়ি, ছাতা কিছু না নিয়ে বাইরে বের হলাম।লেক এর পাশে বসে আছি সেই আগের মতন।এখন আর টাকা পাওয়ার স্বপ্ন নেই চোখে।এখন কেবল ভালোবাসার শূন্যতা পূরন করার নেশা।আজ এই স্বপ্ন দেখার পথিক কেবল আমরা দুজন নই।আমাদের একটি ময়না পাখি আছে যার নাম “ঝড়া”

ওর আবদারে ১০টাকার আইসক্রিম কিনে বৃষ্টিতে ভিজে খাচ্ছি তিনজন।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো ,আজ কারোই বাসায় ফেরার তাড়া নেই যে…

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত