সুপ্তি। বাংলাদেশের উত্তরের জেলার এক মেয়ে। একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। মেধাবী, খুব ভাল আর মেয়ে হয়েও সাহস খুব। অসাধারণ এক মেয়ে বলা যায়। সুন্দরের দিক দিয়ে বলার বাহিরে। দেখতেও অপরূপা। হয়ত তাকে দেখতে পারে না এমন ছেলে বা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। কারণ, সব প্রপোজ ইগনোর করায় তাকে অহংকারী, ভাবওয়ালী বলে তার সামনেই অনেকে অনেক কিছুই বলেছিল। বাবা মায়ের একমাত্র কন্যাসন্তান। দুইজন ভাই আছে। একজন বড় আর একজন ক্লাস ফাইভ এ পড়ে।
তার পরিবারের সবার আদরের একজন হচ্ছে সুপ্তি। তার বাবার রাজকন্যা সে, মায়ের কলিজার টুকরা, ভাইয়ার লক্ষ্মী বোন, ছোট ভাইটার চকলেট আপু। এই চকলেট আপুরও কারণ আছে। সে যখন স্কুলে পড়তো তখন টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তার ভাই (আশিক) এর জন্য চকলেট নিয়ে যেত। তাই এই নাম। সবার আদরের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সে। ছোট থেকেই তার অজানা এক রোগ ছিল। সেটা শুধু তার বাবা-মা জানতো। অন্য কেউ জানতো না।
একবার স্কুলে। তখন সে ক্লাস নাইনে। টিফিনের আগের ক্লাসে। হঠাৎ ক্লাস করতে করতেই তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব শুরু করে। শেষে সে অজ্ঞান এর মতই হয়ে যায় বলা যায়। দ্রুত স্কুল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সবাই টেনশনে ছিল। পরে তার বাবা-মা গিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে চিকিৎসা করায়। সেটি ছিল ইউরিন এর ব্যথা। এরকম আরো কিছু ঘটনা ছিল। মন খারাপ করার ঘটনা এগুলো। এরপর কিছুদিন যাওয়ার পর আবারো স্কুল শুরু করে।
তার জীবনে প্রেম করার সুযোগ কমই হয়েছে। ও যখন ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল তখন প্রায় সবই বুঝতে পারছে। এসএসসি পরীক্ষার বাকি তখন মাত্র ৪ মাস। সামনেই টেস্ট পরীক্ষা। ঠিক সে সময় দূরারোগ্য এক রোগের সন্ধান তার শরীরে। নিজে জানতো না এসব। অসুস্থ্য হয়ে যাওয়ার পর বড় ডাক্তারের দ্বারা চিকিৎসা নেয়া হচ্ছিল। তার মনে প্রশ্ন বাঁধে, হয়েছে টা কি তার! এরপর এসএসসি পরীক্ষার ৩টি পরীক্ষা শেষ হবার পর “ইংরেজী ২য় পত্র” পরীক্ষার আগের দিন জানতে পারে। তার শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে নি। পড়া হয় নি সেদিন। তবুও পরীক্ষা ভালোভাবেই দিয়েছিল। আল্লাহ্র কাছে সে শুকরিয়া জানিয়েছিল কারণ রেজাল্ট ভালই এসেছিল।
সব পরীক্ষা শেষ। হাতে ২ মাসেরও বেশি সময়। বাড়তি প্রাইভেট পড়ার লাগবে না। বাবার কাছে ফোন কিনার আবদার করে। আদরের সন্তান হওয়ায় দামী ফোন কিনে দিয়েছিল। আর ফোন কেনা মানেই তো ফেসবুক একাউন্ট। খুলে নিল বড় ভাইয়ের কাছে। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধীরে ধীরে অগ্রসর। তার মনে জমে থাকা কথা গুলো স্ট্যাটাসের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিল। এরপরই বড় বড় লেখকদের দেখে সেও হালকা পাতলা লেখালেখি শুরু করেছিল। ভালোই সাড়া পাচ্ছিল। দেখতে দেখতেই অবসরের দিনগুলো পেরিয়ে গেল।
পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলো। আল্লাহ্র রহমতে ভালোই করলো… জিপিএ-৫। যদিও এখন জিপিএ-৫ পাওয়া কোনো ব্যাপার না। তবুও তার জীবন আর অন্যের জীবন তো আলাদা। যাইহোক, বাবার প্রতিশ্রুতি মতে রেজাল্ট ভাল হলে ল্যাপটপ কেনা। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলো সুপ্তির বাবা। এরপর চলছে তার ফেসবুকের জীবন, লেখালেখির জগৎ। ভার্চুয়াল জগতের এক্টিভিটি বেড়েই চলছে। কলেজ এর সিলেকশন আসলো। পেল বিভাগীয় জেলার এক স্বনামধন্য কলেজে।
আমাদের কলেজে ভর্তি হলো। একে তো ফেসবুক ফ্রেন্ড আবার এদিক ক্লাস মেট। কথা-বার্তা ফেসবুকেই (ভার্চুয়ালে) শুরু। এরপর বাস্তবে। দেখা হলো, সাক্ষাৎ হলো, ফুচকা খাওয়া আর কফি খাওয়ার দিনগুলিও পার হতে লাগলো। একসাথে প্রাইভেট পড়া, কলেজ যাওয়া আসা হতো। হঠাৎ একদিন সেই আগের ইউরিনের ব্যথা শুরু হলো। সেদিন মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়েছিল। এরপর কিছুদিন পরই তার ডাক্তার দেখানোর ডেট ছিল। যদিও সেটা ঢাকায় গিয়ে দেখাতে হয়েছিল। আমি বা আমাদের বন্ধুরা কেউ জানতাম না।
: রিশু….
: হুম সুপ্তি বলো।
: দোয়া করো।
: কেন কি হলো?
: আমার ডাক্তার দেখানোর ডেট ১৬ তারিখ। ঢাকা যাব ১৪ তারিখ। দোয়া করিও।
: হঠাৎ?
: হুম। আমার শরীরের ভিতর লুকিয়ে থাকা ক্যান্সার যাতে ভাল হয় সেজন্য।
: ক্যান্সার?!
: হুম! আমি ক্যান্সারাক্রান্ত।
বলেই সেদিন চলে গিয়েছিল। এরপর গেল ১০ তারিখেই তার আব্বু-আম্মু তাকে মেস থেকে বাড়ি নিয়ে যায়। ১৪ তারিখ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ঢাকা গেল। ডাক্তার দেখালো। ডাক্তারের কথা তখন যেন নিমপাতার চাইতেও তেতো লাগছিল তাদের। কারণ, ডাক্তার সুপ্তির অনুপস্থিতিতেই বলেছিল সে আর বেশিদিন থাকবে না এই ধরনীতে। তার মায়ের চোখ দিয়ে পানি বেরোচ্ছিল তখন। ওর বাবা নিজেকে শক্ত করে রেখেছিল। আশিক ও সুপ্তি তখন বাইরের ওয়েটিং রুমে।
আশিক সুপ্তি কে বলছিল:
: চকলেট আপু! তুই আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবি না তো?
: কই যাব রে পাগল?
: তোর বিয়ের পর তো শ্বশুরবাড়ি তে যেতে হবে। তুই বল চলে যাবি?
: না রে যাব না।
সুপ্তি চোখেও পানি। কারণ সেও আন্দাজ করতে পেরেছিল খারাপ কিছুই একটা হবে। এরপর বাড়ি ফিরলো। সুপ্তির বাবা-মা ঘরে এই বিষয়ে কথা বলছিল। শুনতে পেরেছিল সুপ্তি। নিজে অনেকটা দুর্বল হয়েছিল। এরপরই সেদিন আমাকে ফোন দেয়। কথা বলি। জানি তার কাছ থেকে।
: হ্যালো রিশু….
: হুম সুপ্তি বলো।
: জানো আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না।
: মানে?
: তোমরা ভাল থেকো। আমি আর কলেজেও যাব না। (কান্না কান্না কণ্ঠে)
ফোন কেঁটে দিয়েছিল। এরপর দুইদিন আমি ফোন দেই। সে বলতে চেয়েছিল আমায় অনেক কথা। হয়ত ভালবাসার। নাও হতে পারে। সে উপরের সকল গল্প বলেছিল সেদিন। আমাকে তার মনের ভিতরের কথা টা বলতে না চাইলেও আমি বুঝে গিয়েছিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার জীবন টার সাথেই কি এমন হওয়ার লাগে!!! এরপর আজ ফোন দিয়েছিলাম তাকে। কারণ, কলেজে রেজিস্ট্রেশনের কাজ চলছিল।
: হ্যালো সুপ্তি….
: রিশু!!
: তুমি কেমন আছো….
: আমি তো এই ভাল। এই খারাপ। তুমি কেমন আছো?
: আছি আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা তুমি কি আর কলেজ আসবা না? ফুচকার দোকানে বসবা না? ক্যাম্পাসে আমার হাত ধরে হাঁটবা না?
: আর সম্ভব না রিশু….( কান্না )
: দেখো কান্না করিও না। যে কদিন আছো আল্লাহর ইবাদত করো। আমাদের হাসির দিন গুলো মনে করিও। দেখবা সকল কষ্টগুলা আটকে যাবে।
: হুম নামাজ পড়ি আমি। তোমাদের খুব মিস করি জানো? আমাকে মনে রেখো। ভুলে যেও না কখনো!!
: ধুর পাগলী। আমি যতদিন থাকবো। মনে রাখবো তোমায় ইনশাল্লাহ।
: আচ্ছা রাখি তাহলে!! খারাপ লাগছে আমার।
: আচ্ছা বাই। ভাল থাকিও।
: তুমিও থাকবা।
আর কোনো কথা হয় নাই। অপূর্ণ থেকেই গেল তার না বলা কথাটা। আমার মনের ভিতরের জমানো কথাটা বলাও হলো না। তবুও দোয়া করি, সে যেন বেঁচে থাকে তার পরিবারের কাছে, আমাদের কাছে। কখনো যাতে ভুলে না যাই তাকে। পরিশেষে, সুপ্তির জন্য দোয়া চাই সকলের কাছে। ক্যান্সারের সাথে যেন লড়াই করে থাকতে পারে। সবার সাথে যেন ভাল থাকে। যাতে আনন্দঘন পরিবেশে থাকে।