মিহিনদের বাসায় যাওয়ার এই গলিটা বেশ চাপা,একটু অন্ধকারও বটে।কেমন যেন ভুতুড়ে অবস্থা।অবশ্য এর আগেও আমি অনেকবার এসেছি এই রাস্তায়, মিহিনের সাথে আবার একাই।তবে আজ কেমন যেন অন্ধকারটা একটু বেশীই।এই সন্ধে বেলায় এরকম অন্ধকার আগে দেখিনি।
আমি আর কিছু না ভেবে আরও একটু এগিয়ে গেলাম।আজ লোকজনের আনাগোনাও বেশ কম দেখছি।হঠাৎ দু একজন কে দেখতে পাচ্ছি।আমি আরও একটু এগিয়ে গিয়ে মিহিনকে ফোন দিলাম।
ও কি আমার ফোন ধরবে নাকি কেটে দেবে।এসব ভাবতে ভাবতেই মিহিন ফোনটা ধরে একটু চুপ করেই রইলো।হয়তো কথা বলতে চাচ্ছে না নয়তো রেগে আছে।নীরবতা ভেঙে আমিই বললাম,
-একটু নিচে আসতে পারবে?
আমার কথায় মিহিন কিছু বললো না।সেই আগের মতই চুপ করে রইলো।ওকি আমার কথা শুনতে পেয়েছে নাকি পায়নি।আমি যখনি আবার কিছু বলতে যাব তখনি মিহিন বললো,
-পারবো না।
-কিছুক্ষনের জন্যে।
-বললাম তো পারবো না।
-আমি অপেক্ষা করবো।
কথাটি বলেই আমি ফোনটা কেটে দিলাম।জানি মেয়েটা আসবে।মুখে যতই না বলুক, মনটা তো আমার কাছেই।কিন্তু যদি না আসে।নাহ আসবেই।এটুকু বিশ্বাস আমার আছে ওর প্রতি।
মিহিনের সাথে আমার পরিচয় প্রায় বছর চারেক আগে।ওর ছোট ভাইকে পড়ানোর সুবাদেই ওর সাথে পরিচয়।প্রথম দিকে ওর সাথে দেখা হলেও কেমন যেন কথা হতো না।মাঝে মাঝে ও নিজেই নাস্তা নিয়ে আসতো।রেখে আবার চলে যেতো।তবে মিহিনের সাথে আমার কথা হয় এর বেশ কিছুদিন পরেই।
আমি মিহিনের ভাইকে পড়িয়ে যখনি বের হতে যাব তখনি মিহিনের মায়ের ডাকে আমি ঘুরে তাকালাম।উনি আমার সামনে এসে বেশ নরম গলায় বললেন,
-আসলে বাবা একটা কথা বলার ছিল।
-জ্বী বলুন।
-আসলে মিহিনের বাবা তো অসুস্থ।এদিকে মেয়েটা ওর ফ্রেন্ডের বাসায় গেছে সেই কখন।এত রাত হয়ে গেলো এখনও আসলো না।
মিহিনের মা এটুকু বলেই থামলেন। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-তো ফোন করুন ওনাকে।দেখুন কোথায় আছে।
-আসলে বাবা মিহিন ই ফোন করেছিল।এই রাতের বেলা একা আসতে একটু ভয় পাচ্ছে।তুমি যদি একটু যেতে তাহলে বেশ ভাল হতো।
মিহিনের মায়ের কথায় এটুকু বুঝলাম যে উনি বেশ টেনশনে আছেন।আর থাকার ই কথা।মেয়ে ঘরের বাইরে থাকলে সব মায়েরই এমন লাগে।আমি মিহিনের মায়ের কাছে থেকে বাসার ঠিকানাটা নিয়ে বের হলাম।ওনার অসহায় মুখটা দেখতে আর না করতে পারিনি।
মিহিনকে যে আমার খারাপ লাগে তেমন না।মেয়েটা বেশ ভাল।আমার জন্যে একদম পারফেক্ট।সেটা অবশ্য আমার দিকে।আমাকে মিহিনের কেমন লাগে এটা অবশ্য এখন পর্যন্তও বুঝতে পারিনি।
আমি বাসার সামনে আসতেই দেখি মিহিন সহ বেশ কয়েকটা মেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।কি নিয়ে যেন বেশ হাসাহাসি ও করছে।হয়তো কোন বিষয় নিয়ে বেশ মজায় আছে।
আমি রিক্সা থেকে নামতেই মিহিন আমার সামনে এসে বললো,
-আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।
মিহিনের কথায় আমি মুচকি হেসে বললাম,
-ওদিকে আপনার আম্মু আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে।
-আসলে এতটা রাত হবে ভাবতেও পারিনি।
-আচ্ছা,চলুন তাহলে।
আমার কথায় মিহিন মাথা নাড়িয়ে রিক্সায় চেপে বসলো।তবে মিহিনের পাশে বসতে আমার বেশ অস্বস্তিই লাগছে।এই প্রথম কোন মেয়েকে নিয়ে রিক্সায় তার পাশেই বসা, তাই অস্বস্তিটাও একটু বেশি।
আমি মিহিনের থেকে একটু দুরত্ব নিয়েই বসলাম। এই রিক্সাটা আজ বেশীই চাপা মনে হচ্ছে।আর এ অবস্থা দেখে মিহিন মুচকি হেসে বললো,
-এদিকে চেপে বসুন,পড়ে যাবেন তো।
মিহিনের কথায় আমি কিছু বললাম না।ওর দিকে একটু চেপেই বসলাম।তবে অতটা না,যতটা আপনারা মনে করছেন।
রিক্সা এসে মিহিনদের বাসার সামনে থামতেই মেয়েটা নেমে পড়লো।আমি কিছু বলার আগেই মিহিন বললো,
-আসেন,ভেতরে আসেন।
-নাহ,আজ আর না।কাল তো আবার আসতেই হবে।
কথাটি বলে আমি সামনে তাকাতেই দেখি একটা রিক্সা এসে থামলো।সাথে সাথে একটা মেয়েও নেমে পড়লো।কিন্তু মেয়েটাকে কেমন যেন পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথায় যেন দেখেছি।আমার ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিহিন একটু রাগি গলায় বললো,
-এই যে,ওদিকে কি?
-আসলে মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছি।হ্যা ওখানে আপনাদের সাথেই হাসাহাসি করছিল।তার মানে….
মিহিন আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে মুচকি হেসে বললো,
-তারমানে কিছুই না।রাত হয়ে গেছে।সোজা বাসায় চলে যাবেন।
-কিন্তু এটা কি হলো?
এতক্ষনে মেয়েটাও এসে মিহিনের পাশে দাড়িয়েছে। দুজনের মুচকি হাসি আমি বেশ ভালভাবেই টের পাচ্ছিলাম।আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা বললো,
-ভাইয়া আমাদের বাসায় আসবেন কিন্তু।মিহিনদের উপর তলাতেই থাকি।
কথাটি বলেই মেয়েটা এবার একটু জোরেই হেসে দিল।তবে আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে কি হয়েছে আমার সাথে।আমি আর কিছু না বলে রিক্সা ঘুরাতে বললাম এখানে আর না।এখানে থাকলে এবার মাথাটাও নষ্ট হয়ে যাবে।
রিক্সা একটু এগুতেই মেসেজ টোনটা বেজে উঠলো।আমি ফোন বের করে দেখি মিহিনের নাম্বার থেকে মেসেজ।একটু ছোট করেই লেখা,
ধন্যবাদ ইচ্ছেটা পুরন করার জন্যে।
ইচ্ছে পুরন।তারমানে মিহিনও কি আমাকে পছন্দ করে।আমি পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখি মেয়েটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে।হয়তো যতক্ষন দেখা যাবে ততক্ষন দাড়িয়েই থাকবে।কিন্তু মেয়েটা আমার নাম্বার পেলো কোই।তবে এটা খুব একটা কঠিন কাজও নয়।
এরপর মিহিনের সাথে আমার বেশ জমে গেলো।এখন আর ভালবাসাটা একদিক থেকে আসে না।দু দিক থেকেই আসে।
তবে মেয়েটাকে যতটা শান্ত ভেবেছিলাম ঠিক ততটা শান্ত নয়।মেয়েরা যে কম কথা বলে, মিহিনই তার প্রমান।ফোনে কথা বলতে শুরু করলে মাঝে মাঝে আমাকে সুযোগ দেয় কথা বলার।নইলে হু, হা পর্যন্তই আমার বলা শেষ।
মিহিনের ভাইকে পড়ানো ছেড়ে দিয়েছি এই বছর খানেক হবে।জবে ঢুকে আর এসবে মন দিতে পারিনি।আসলে ইচ্ছে করেনি।কিন্তু মিহিনের সাথে সম্পর্কটা আরও গভীর ভাবে রুপ ধারন করেছে।এখন ওর সাথে রিক্সায় বসলে আর আগের মত অস্বস্তি লাগে না। মাঝে মাঝে হাতটা বেশ শক্ত করেই ধরে রাখি।তখন ওর মুখে দেখতে পাই আমি তৃপ্তির হাসি।তৃপ্তির হাসি।
কিন্তু মেয়েটার রাগটা যে এত বেশি সেটা বুঝতে পারলাম এই সপ্তাহ খানেক আগে।সামান্য বিষয় নিয়ে মেয়েটা যে এতটা রেগে যাবে ভাবতে পারিনি।আজ প্রায় সাতদিন হবে সেই রাগটা পুশে রেখেছে।দেখা করা তো দূরে থাক,ফোনটা পর্যন্ত রিসিভ করেনি মেয়েটা।ফাজিল মেয়ে একটা।
শুভ জন্মদিন।
কথাটি বলতেই মিহিন আমাকে বেশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল।আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখি প্রায় রাস্তাটা ফাকাই।তাছাড়া এই অন্ধকারে কেও দেখবেও না।
আজ মিহিনের জন্মদিন। তাই কেক আর ওর পছন্দের চকলেট নিয়ে এসেছিলাম।মেয়েটা আমার সামনে এসে দাড়াতেই আমি কেকটা সামনে এনে বললাম,
-শুভ জন্মদিন।
কিন্তু মেয়েটার এদিকে কোন খেয়াল নেই।কিছু না বলে বেশ শক্ত করেই জড়িয়ে ধরলো।আমি মিহিনের কান্না থামতেই ওর চোখের পানি মুছে দিতেই মেয়েটা বললো,
-এতদিন পর আসলে কেন,জানো কতটা কষ্ট পেয়েছি আমি।
-আমিও তো ভাল ছিলাম না। সবকিছু কেমন যেন পানসে হয়ে গিয়েছিল তোমাকে ছাড়া।
-হু হয়েছে,আর বলতে হবে না।
মিহিনের কথায় আমি কিছু বললাম না।ওর হাতে ছুড়িটা দিয়ে কেকটা কেটে ওকে খায়িয়ে দিতেই মেয়েটার চোখটা আবারও ভিজে উঠলো।
আমি মিহিনের চোখের পানি মুছে দিতেই মেয়েটা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-ভালবাসি,একটু বেশিই ভালবাসি।
মিহিনের কথায় আমি কিছু বললাম না।ওকে বেশ শক্ত করেই জড়িয়ে ধরলাম।মেয়েটা রাগি হলেও ভালবাসতে জানে।আর যাই হোক,এই ভালবাসা হারাতে নেই।কোন ভাবেই না,কোন মতেই না।