অরুন্ধতী মেয়েটার নাম। গলির ৬৭/২ বাসায় থাকতো। শান্তস্বভাবী মেয়ে। মেয়েটা সবসময় লাল জুতা পড়তো।
লাল জুতোটা মেয়েটার খুব প্রিয় ছিলো।ছোট্ট মেয়েটাকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করতো;
‘বুড়ি! তোমার এই সুন্দর লাল জুতো কে কিনে দিয়েছে গো?
মিস্টি মেয়েটা বেনী দুলিয়ে লাজুক গলায় বলতো,, ‘আমার আব্বু’
-বাহ! বাবুনী; তোমার আব্বু তোমাকে অনেক আদর করে?
-হ্যা,, আমি আমার আব্বুর রাজকন্যা যে তাই; বুঝলে?
অরুন্ধতীর কাছে তার বাবা ছিলো সত্যিকার সুপারম্যান।
যে লাঠি ছাড়াই গাছ থেকে পেয়ারা পেরে দিতে পারে, শহরের এই যান্ত্রিক পরিবেশে ফড়িং ধরে দিতে পারে।
প্রতিদিন চেম্বার থেকে আসার সময় বাবা তার রাজকন্যার জন্য লজেন্স নিয়ে আসে, রং পেন্সিল নিয়ে আসে; কত কিছুই নিয়ে আসে।
মাঝে মাঝে দুস্টুমি; দুপুরবেলা না ঘুমালে আম্মু বকা দিতো ; আম্মুর উপর রাগ করে অরুন্ধতী ভাত না খেয়ে শুয়ে থাকতো।
তখন বাবা এসে অরুন্ধতীর গাল ফোলানো অভিমান ভেঙে ভাত খাওয়াতো।
অরুন্ধতী আস্তে আস্তে বড় হয়, কিন্তু তার বাবার কাছে সেই ছোট বেনী দুলানী অরুন্ধতীই থেকে যায়।
প্রথম পাবলিক পরীক্ষা দিতে শাহজালাল ভার্সিটিতে যায় মেয়েটি;
অরুন্ধতী যখন দুরু দুরু বুকে পরীক্ষার হলে ঢুকতে থাকে, তখন পিছনে ফিরে দেখে তার সেই প্রিয় মুখ, প্রিয় অবলম্বন।
যার চোখের দৃষ্টি বলে দেয়;’কিচ্ছু হবে না মা, বাবা তো আছি রে”
উচ্চশিক্ষার জন্য অরুন্ধতীর বাড়ি ছেড়ে সদূর ভার্সিটির কোন হলে উঠতে হবে; ব্যাগ ল্যাগেজ নিয়ে রোমাঞ্চ আর ভয়, পাশে সেই চিরচেনা একজন।
যে সবকিছু ঠিকঠাক করে চলে যাবার সময় বারবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে বলে,,
‘মা আমার সাবধানে থাকিস, খারাপ লাগলেই বাবাকে ফোন দিবি, টাকা পয়সা লাগলেই জানাবি কিন্ত”
টাকা লাগবে বাবা, নতুন ফোন লাগবে বাবা,, মেয়েটার কাছে তখন মা মানে নিশ্বাস, আর বাবা মানে তার পৃথিবী, তার আস্থা।
বাবা চায় একমাত্র রাজকন্যাকে একদিন এক রাজপুত্রের হাতে তুলে দিবে,
যে তার কলিজার টুকরোটাকে তার চেয়েও ভালো রাখবে, তার অভিমানি রাজকন্যটার চোখের পানি মুছে দিবে।
এদিকে অরুন্ধতী সময় আর বয়সের দাবিতে একজন রাজপুত্রকে নিজেই বেঁছে নিয়েছে!!!
তার শুধু ভয় বাবা মানবে তো, বাবাকে সে কষ্ট দিতে পারবে না, কিন্তু ভালোবাসে একজনকে দেয়া কথাটাও তো রাখতে হবে। চিন্তাকুলে অরুন্ধতী!
বাবা চায়; তার রাজকন্যার জন্য আরো যোগ্য কোন রাজপুত্র। তাই অরুন্ধতী ঠিক করেছে বাড়ি থেকে চলে যাবে, গোপনে বিয়ে করে সংসার করবে!
অরুন্ধতী তার কাপড় চোপড় ব্যাগে ভরছে, আজ রাতে সে পালাবে।
বাবা বাইরের বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছে, নতুন জুতো জুড়ো নিতে গিয়ে মেয়েটার চোখ আটকে গেলো,,,,,,,,,,,!!!
সেই বাবার দেয়া পুরোনো লাল জুতো,, ছোট জুতো জুড়ো এখনও যত্ন করে রাখা আছে।
হঠাৎ অরুন্ধতী বছর পনেরো আগে পিছনে ফিরে গেলো, একবার খেলতে গিয়ে একপাটি জুতো হারিয়ে ফেলেছিলো, বাড়িতে এসে তার কি কান্না,,
বাবা বাড়িতে এসে শুনলেন, তার অভিমানি রাজকন্যাটার কান্না।
ব্যাগটা রেখেই ; লাইট নিয়ে খেলার মাঠটাতে চলে গেলেন, প্রায় দু ঘন্টা পর ঘর্মাক্ত গায়ে ফিরে এলেন একপাটি লাল জুতো নিয়ে!!
অরুন্ধতী আর কল্পনা করতে পারে না, দৌড়ে বারান্দায় বাবার পায়ের কাছে গিয়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করে!!
বাবা চমকে ওঠেন, ‘কিরে মা কি হয়েছে তোর, পাগলী কাঁদছিস কেন?
অরুন্ধতীর কান্না থামে না। বাবাকে জড়িয়ে কাঁদতেই থাকে,,,,,,,,,,,,!!
অরুন্ধতী আজ তার দুটো বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে শপিং এ এসেছে, পরিবারের সম্মত্তিতেই তার পছন্দের ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়েছে।
অরুন্ধতীরর ছোট মেয়েটা আব্দার করেছে লাল জুতো কিনবে,
সে তার বাবার কাধে হাত রেখে নতুন জুতো পড়ছে, আর বাবা পরম যত্নে তার বাচ্চার পায়ে জুতো পড়িয়ে দিচ্ছে।
হঠাৎ অরুন্ধতী চোখে জল আসে, দোকানের বাইরে একটু খানি নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে।
অরুন্ধতী সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো;
“ভালো থেকো; সুপারম্যান আব্বু“