“আমার জন্যই তোমার সব সমস্যা হচ্ছে তাই না আবির?”
নিজের ডেক্সে বসে বসে অফিসের প্রয়োজনীয় কাজগুলো করছিলাম। তখনি জান্নাত এসে উপরের কথাটি বললো। তার চাহনি দেখে বুঝলাম কিছুটা লজ্জ্বাবোধ কাজ করছে। যেনো মনে হচ্ছে আমাকে সে অনেক কিছুই বলতে চাই। বলতে চাই তার মনের জমানো অনেক কথা।
আমি চুপচাপ হয়ে বসে থাকলাম। কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না। তাই চুপ থেকে তাকে বোঝার চেষ্টা করছি।
– কথা বলছো না কেনো? তুমি কি চাও আমি চাকরিটা ছেড়ে দেই? ঠিক আছে আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চাকরিটা ছেড়ে দেবো।খুশি তো তুমি?
আমি এবারো চুপ করেই থাকলাম। জানি সে চাকরি ছাড়বে না। আমার জন্য তো মোটেও না। তাই কিছু না বলাটাই ঠিক মনে হল।
– তুমি কথা বলবে না তো? আচ্ছা বেশ বলা লাগবে না। তুমি থাকো আমি গেলাম।
কথাগুলো কেমন উদাস ভাবে বলে চলে গেলো জান্নাত। হয়ত সে আশা করেছিলো আমি তাকে কিছু বলি। কিন্তু যা বলার সেতো ৩ বছর আগেই বলে দিয়েছি। এখন আর নতুন করে বলার কিছুই নাই।
অফিস এর কাজ শেষ করে বাইরে বের হলাম। তখনি জান্নাত বললো..
– রিকশায় উঠে এসো। তোমাকে আজ আমি লিফট দিই।
তখনও চুপ থেকে উঠে গেলাম। কেনো জানি উঠতে ইচ্ছে করলো।
– আবির একটা কথা বলবো?
– হুমম..
– তুমি চাও আমি চাকরিটা ছেড়ে দেই?
– কেনো?
– আমার জন্যই তো তোমার কাজ করতে ঝামেলা হচ্ছে।
– বলেছি তোমাকে?
– বলোনি, কিন্তু বুঝে নিয়েছি।
কোনো কথা না বলে মুচকি হাসলাম। মেয়েটি কিছুই বুঝিনি। কিন্তু আমি তার মুখের ভাব দেখেই বুঝেছি, সে কি বোঝাতে চাচ্ছে আমাকে।
– আবির,
– হুম
– আরেকটা কথা বলি….?
তার প্রশ্ন শুনে তার মুখের দিকে তাকালাম। ঠিকঠাক ভুবে বোঝার চেষ্টা করলাম সে কি বলতে চাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তেমন কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।
– আবির, আমাকে কি তুমি এখনো ভালোবাসো?
– আমার বাড়ির রাস্তাই চলে এসেছি। আমি এখন নামবো। বাই
আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই নেমে গেলাম। কি বলবো আমি? তার প্রশ্নের যে কোনো উত্তর আমার কাছে এখন নেই। অফিসে জয়েন করার ১ মাস পরেই জান্নাত জয়েন করে। তখন থেকেই সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেটা আমার কাছে খুবই বিরক্তজনক একটা ব্যাপার। কাজ করতেও ঝামেলা হয়। সে তার চাহনি দিয়ে বারবার বোঝাতে চাই। আবির আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু সেটা আমি বুঝেও না বোঝার মত হয়ে থাকি। কারন সে যদি আবার ওমন করে?
আমি আর জান্নাত একই ভার্সিটিতে পড়তাম। জান্নাত ছিলো বড় লোক বাবার আদুরে মেয়ে। সারা ভার্সিটির সব ছেলেরা ছিলো জান্নাত বলতে পাগল। রোজ নিজের গাড়ি করে আসা,,সবসময় ভাব নিয়ে থাকাটা ছিলো ওর স্বভাব।
জান্নাত পড়তো আমাদের ক্লাসেই। তাই আমাদের ক্লাসের সব ছেলেরাই জান্নাতের সাথে কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকতো। অবশ্য আমিও যে থাকতাম না তা কিন্তু নয়।
তবে আমি খুব একটা কারো সাথে কথা বলতাম না। নিজের মত করেই চুপচাপ থাকতাম। একদিন ক্যামপাসে বসে আছি, ঠিক এমন সময় জান্নাত আমার কাছে আসলো।
– এই যে মি. আবির..
– জ্বি আমাকে বলছেন?
সেদিন মনের অজান্তেই অনেকটা অবাক হয়ে গেছিলাম। কারন আমি ভাবিনি এই মেয়ে নিজ থেকে এসে আমার সাথে কথা বলবে। যার জন্য প্রতিটা ছেলে ১ মিনিট কথা বলার জন্য লাইনে থাকে আর আজ কি না সে আমার সাথে কথা বলতে এসেছে? অবাক হওয়ারই বিষয়।
– কি হল,,এভাবে চেয়ে আছো কেনো?
– না মানে তুমি কথা বলছো আমার সাথে তাই অবাক হয়েছি।
– কেনো কথা বলা যায় না?
– না মানে…কিন্তু কেনো?
– কারন তুমি অন্য সবার মত না। তুমি খুব আলাদা, সব ছেলে আমার দিকে তাকালেও তুমি কোনোদিন তাকাওনি। ক্লাসের সব ছেলেদের সাথে কথা হলেও তুমি কোনোদিন এসে কথা বলোনি। তাই ভাবলাম আমি নিজে থেকেই তোমার সাথে কথা বলি।
– ওহহ,,ভালো..
– বন্ধু হতে পারি আমরা??
হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে জান্নাত বললো কথাটি। কিন্তু আমি অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলাম। তবে বন্ধুত্ব শুরু এখানেই।
জান্নাতের দিকে আমিও তাকাতাম। অন্য সবার থেকে বেশিই তাকাতাম আমি। তবে সেটা জান্নাতকে কখনই বুঝতে দেয়নি আমি। ক্লাসের ক্ষ্যাত ছেলে বলে খ্যাত,,সে কিনা এমন সুন্দরী মেয়ের দিকে তাকাবে,আর সেটা সে বুঝতে পারবে,,কেমন দেখায় না?
আর মজার বিষয় হল,,জান্নাতকে আমার খুবই ভালো লাগতো। অবশ্য সব ছেলেদেরই ভালো লাগার কথা,,তবে আমি মনে মনে ভালোও বাসতাম। কিন্তু কখনও বলবো বলে আশা করিনি।
একদিন ক্লাসে জান্নাত আমার হাত ধরেই প্রবেশ করলো, ক্লাসের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো সেদিন। জান্নাতকে যে বেশি পছন্দ করতো,,সে ছেলেটিও তাকিয়ে ছিলো হাতের দিকে। নিজেকে সেদিন খুবই হিরো হিরো লাগছিলো। সেদিন থেকেই দুজনে বন্ধুত্ব।
কিন্তু মনের অজান্তে তাকে নিয়ে যে ভালোবাসা তৈরী হয়েছিলো সেটা তো না বলাতে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। তাই একদিন ঠিক করলাম জান্নাতকে সব বলেদিবো।
– জান্নাত…তোমার সাথে আমার কিছু কথা বলার ছিলো।
– হুমমম বলো..
– আচ্ছা জান্নাত…তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?
– কেনো বলোতো,,আজ এই কথা জিগাস করছো?
– নাহ মানে এমনি,,তোমার সাথে তো কার্র ঘুরতে দেখিনা..
– তাহলে গাধা বুঝতে পারছো না যে কেউ নাই?
– ওহহ,,,তাইলে তো সহজ হয়ে গেছে।
– কি,,,?
– জান্নাত তোমাকে আমি ভালোবাসি।
জান্নাত খানিকটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিলো। হয়ত ভাবছে আমি তাকে সবার মত ভালোবাসিও বলে দিলাম? আবার হয়ত ভাবছে, আমার মত কেউ তাকে ভালোবাসবে?
– হিহিহি,,ভালোবাসো আমাকে?
– হুমম
– কতটুকু?
– সেটা তো জানিনা,,তবে মনে হয় অনেকটা বেশি।
– ও,,তাহলে কাল সবার সামনে মানে ক্লাসে এসে সবার সামনে প্রপোজ করতে পারবে?
– হুমম পারবো,,
– হাতে কিন্তু তাজা গোলাপ থাকা চাই।
ওহহ আজ নিজেকে খুব খুশি খুশি লাগছে। জান্নাত ও হয়ত আমাকে ভালোবাসে। তা না হলে প্রথম প্রপোজালেই আমাকে চড় মেরে বসত।
কালকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আমার। ইসসস,,কাল কখন যে আসবে? কিছুই ভালো লাগছে না।
তবে বুঝিনি ঐ দিন আমার জন্য, খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে।
সকালে উঠেই একটি তাজা গোলাম সংগ্রহ করলাম।
ক্লাস শুরু হওয়ার ২০ মিনিটা আগে ক্লাসে গেলাম।
– ফ্রেন্ডস.. শুনো তোমরা,,আজ এই ক্লাসে একটা নতুন কিছু হতে যাচ্ছে..
সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ঠিক তখনি আমি যেয়ে জান্নাতের হাত ধরলাম। সবাই আরো অবাক হয়েছিলো..
পিছনের পকেটে থাকা গোলাপটি বের করে হাটু গেড়ে বসে বললাম..
– জান্নত, আমি জানি তোমাকে সবাই পছন্দ করে। তোমাকে সবাই চাই। কিন্তু সেই সবার মত আমি না। তোমাকে আমি ভালোবাসি খুব। একদম মন থেকে ভালোবাসবো।
হয়ত আমার প্রপোজটা সাদামাটা,,তবে ভালোবাসাটা সত্য..
– উঠে দাড়াও আবির..
– ঠাসসস…ঠাসসসস
উঠে দাড়াতেই জান্নাত যে এভাবে থাপ্পড় দিবে বুঝতে পারিনি।
– তোর মত ক্ষ্যাত একটা ছেলেকে ভালোবাসবো আমি? কি মনে করিস তুই.? ফকির একটা,,কতটাকা হাত খরচ আছে তোর? আরে কদিন ধরেই রাফি নামের একটা ছেলে আমাকে জ্বালাচ্ছিলো…তার জন্য তোর সাথে ফ্রেন্ডশিপ করি। যাতে সে না জ্বালাতে পারে। ইডিয়ট একটা,,,ক্ষ্যাত..
কথাগুলো চুপচাপ শুনলাম। কখন যে কান্না চলে এসেছে বুঝতে পাইনি। যখন নোনতা স্বাদ মুখে আসলো তখনি বুঝলাম। নিজেকে এতটা অপমানিত করলাম ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। নাহ,,আর এখানে এক মুহুর্ত নয়। নিজেকে সামলিয়ে দৌড় দিয়ে ক্লাস থেকে বের হলাম। আসার সময় কানে আসলো, সবার হো হো করে হাসির শব্দ।
তারপর থেকে ক্লাসে আর কোনোদিন যায়নি। ক্লাস বদলিয়ে চলে আসি আমি অন্য জায়গায়। তারপর নিজেকে গুটিয়ে নিই।
।।
অফিসে এসে আগের কথাগুলি ভাবতে ছিলাম। কখন যে জান্নাত আমার ডেক্সের পাশে এসে দাড়িয়েছে বুঝতে পারিনি।
– আপনি কখন আসলেন?
– আবির তোমার সাথে আমার কিছু কথা বলার ছিলো।
– জানি কি বলবেন,,তবে আমি আর আপনাকে ভালোবাসি না।
– আবির তুমি প্লীজ আমাকে গ্রহন করো।
– হাহাহাহা,,যান,,নিজের কাজ করেন।
অফিস শেষে আজো দাড়িয়ে আছি, আজ জান্নাত তার গাড়িতে এসেছে।
– আবির, আসো তোমাকে পৌছে দিই।
– নাহ,,তার আর দরকার হবে না। আমি নিজেই যেতে পারবো। আর ক্ষ্যাতের সাথে এত কথা না বললেও চলবে আপনার।
কথাগুলো বলে চলে আসলাম। কি দরকার শুধু শুধু ওর সাথে প্যাচালে আবার জড়ানো। ভালো লাগে না আর এসব।
রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে গেছি। সকালে আম্মুর ডাকে ঘুম ভাংলো..
– ঐ হাদারাম,,তুই এত ঘুমাস কেনো?
– কেনো আম্মু?
– ওঠ..আজ তোর বিয়ে..
– মানে??
– মানে তোর আজ বিয়ে…
– কিন্তু কার সাথে…
– বাইরে গেলেই বুঝতে পারবি..হাদারাম।
বাইরে এসে আমি অবাক,,,জান্নত সহ তাদের বাড়ির সবাই। মাকে বললাম..
– আম্মু আমি এ বিয়ে করতে পারবো না।
– কেনো?
– এমনি,,মেয়েকে আমার ভালো লাগে না।
– চুপ শয়তান ছেলে..৩ বছর ধরে প্রেম করে এখন বলছিস পছন্দ না?
– মানে কি?
– জান্নাত সব বলেছে। তোরা একে অপরকে ভালোবাসিস।
– কিন্তু…
– আর কোনো কিন্তু না। আজই তোদের বিয়ে হবে। বিয়ের পর তোরা যা ইচ্ছে করিস।
নিজেকে যে একটা গাধা লাগবে এর আগে ভাবিনি,,,তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গাধামোর জন্য ভালো কিছুই হয়।
কিন্ত্র এখন নিরুপায়, বিয়ে জান্নাতকেই করতে হবে,কারন আম্মুকে উলটা পালটা বুঝিয়েছে। তাই বিয়ে ভাঙা আর সম্ভব না।
বিয়েটা করতেই হচ্ছে…কিছুই করার নাই.।
“সমাপ্ত”