নীল গগনের রাণী

নীল গগনের রাণী

ধানমন্ডি জেনেটিক প্লাজাতে একটি শাড়ির দোকান রয়েছে। যদিও সেখানে দোকানের শেষ নেই তারপরেও একটি দোকান বলার পেছনে রয়েছে অনেক কারন। সেই দোকানের শাটারের ভেতর লুকিয়ে আছে এক জলন্ত বাস্তব জীবন কাহিনী। আমি যে দোকানের বর্ণনা দিয়ে লেখা শুরু করতেছি সেই দোকানের নাম “জামদানী ওয়ার্ল্ড”। দোকানটি আমার কিংবা আমার কোন আত্মীয়র নয়, দোকানটি এমন একজন মানুষের যাকে আমি চিনিনা, জানিনা কখনো দেখিনি কিন্তু অন্তর জুড়ে সেই দোকানের মালিকের প্রতি রয়েছে শুধু ঘৃনা, ঘৃনা আর ঘৃনা। সবার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যাকে আমি জানিনা যার সাথে কোনদিন আমার কথা হয়নি তাকে ঘৃনা করার কারন কি? তাহলে চলুন গল্পটি শোনা যাক।

শুরুটা আমার জন্ম থেকে হোক। বর্ষা মাস, চারিদিকে ঘনো কালো অন্ধকারে ছেয়ে থাকে আকাশে উড়ে যাওয়া কালো মেঘগুলোর জন্য। ক্ষনে ক্ষনে বৃষ্টি ঝড়ে, কখনো বাড়ির ডোবা, পুকুরের ভেতর থেকে ভেসে আসে কুনোব্যাঙ এর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শব্দ। সময়টা যেমনি ছিলো বর্ষারদিন তেমনি ছিলো ঘোর আমাবস্যা। বাশ চাটের বেড়ার ভাংগা ফুটো দিয়ে কান্নার আওয়াজ বের হয়ে আসলো। বাবা ততক্ষনাৎ আল্লাহু আকবার দিয়ে শুরু করে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ দিয়ে আযান শেষ করলো। এই আযানের সুরের সাথে আমার জন্ম একজন মুসলমান হিসেবে হলো।

বাবা বড্ড রোগা মানুষ ছিলেন বেশী ভারী কাজ তার নাকি সয়না। আমি হবার আগেও আমার জন্য ঠিক করে রেখেছেন তিন তিনটি বোন। তাদের ভালোবাসা আমি হয়ত পেয়েছিলাম যতদিন আমি বুঝতে শিখিনি গরীবি কাকে বলে অভাব কাকে বলে। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তারাও কেমন যেন পর হয়ে গেলো। মায়ের মুখে শুনেছি আমার বাবা কাজ করতো না বলে, অপমান হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিলো। ২ শের আটার জন্য মাকে হতে হয়েছিলো যাচ্ছেতাই অপমান। সে ঘৃনা বুকে পুষে রেখে আমার মা বাবা আর তিন বোন গ্রাম ছেড়ে ঢাকা আসেন। আমার গল্প এখনো শুরু হয়নি মায়ের মুখ থেকে শোনা গল্পটির বর্ণনা দিয়ে যাই প্রথমে।

মা ঢাকা শহর মোটেও চিনতো না, বাবা কয়েকবার ঢাকা এসেছেন তাই কিছুটা জানাশোনা আছে। লঞ্চে করে মাদারীপুর থেকে ঢাকা আসতে আসতে প্রায় সকাল ১০ টা বেজে গেছে। বাবা মা মিরপুর শিয়ালবাড়ির পথ ধরে শিয়ালবাড়ির একটি টিনসেট কলোনীর সামনে এসে কারো খোজ করছেন। এখানে নাকি বাবার এক বন্ধু থাকতো, যার কাছে আশ্রয় পাবে বলে তারা তিন মেয়ে এক ছেলে সহ ঢাকায় এসেছেন। শুধুমাত্র নামজানা এক বন্ধুর আশাতে ছয়টি জীবন ঢাকায় পা রাখে। কিন্তু বাবা খোজ নিয়ে জানতে পারে তার বন্ধু এখানে নেই তারা অন্যজায়গায় চলে গেছে। শেষ আশাটাও মাটিতে মিশে গেছে। নতুন শহর নেই কোন আপনজন, কোথায় যাবে, কি করবে কোন কিছুই মাথায় আসেনা। তখন তারা হাটতে হাটতে চলে আসলো মিরপুর-১১ নম্বর। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে এখনো কারো পেটে কিছু পড়েনি। আর আমি তো ক্ষুদা সইতে পারিনা, ক্ষুদা লাগলে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠি। আর মা তখন লোকচক্ষু আড়াল করে বুকের দুধ আমার মুখে পুড়ে দেয়। কিন্তু তার বুকেও এখন দুধ নেই। সে না খেলে আমাকে খাওয়াবে কি, আমার কান্না যেন কোনভাবেই থামেনা। তখন বয়স মাত্র ছয় মাস আমার, আমার কান্না থামাতে মা ব্যাগ থেকে গ্রাম থেকে বানিয়ে আনা একটি রুটি পানিতে ভিজিয়ে একদম নরম আটার মতো করে আমাকে খাইয়ে কান্না থামিয়েছে। একটিই রুটি ছিলো, আর এই রুটি তৈরির আটার জন্যই আমার মা বাবা কে পুরো গ্রামের সামনে অপমান অপদস্ত করেছিলো আমার আপন চাচা আর ফুফু। আমিও স্বার্থপরের মতো সবাইকে না খাইয়ে নিজে একাই খেয়ে মায়ের কোলে গুপটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

মিরপুর ১১ এর ৮ নম্বর রোডের মাঝামাঝি স্থানে ছিলো একটি স্কুল নাম তার স্টারলিট গ্রামার স্কুল। সেই স্কুলের সামনে ছয়টি জীবন্ত মানুষ বাচার আশার আলো নিয়ে অপেক্ষা করছে। সেই অন্ধকার রাতে আশার আলো নিয়ে হাজির হয়েছিলো হানিফ কাকা। হানিফ কাকা স্টারলিট গ্রামার স্কুলের ভ্যান ড্রাইভার ছিলেন। স্কুলের কাজ শেষ করে সে, অন্যকাজ করতেন কিছু বাড়তি উপার্জন এর জন্য। রাত প্রায় ১২ টার কাছাকাছি। হানিফ কাকা কাজ শেষ করে স্কুলে ফিরে আসলেন, তার বাসা স্কুলের ছাদের উপর ছিলো। সে আমাদের সেখানে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কারা? আর এখানে কেন বসে আছেন?” মা তখনো চোখের জল ফেলে যাচ্ছিলো, চোখের পানি শাড়ির আচল দিয়ে মুছে নিয়ে বলতে লাগলো। “আমরা মাদারীপুর থেকে এসেছি, থাকার কোন জায়গা নাই, আর কাউরে চিনিও না। রাইত কইরা আর কই যামু, তাই এইখানে বইসা আছি”। এরই মধ্যে আমি আবার কেদে উঠলাম, বড্ড পেটুক ছিলাম হয়ত, না খেয়ে থাকতেই পারতাম না। মা আমার কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো, বাবা হানিফ কাকার সাথে কথা বললো অনেকক্ষণ। তারপর হানিফ কাকা এসে সবাইকে বলতে লাগলো, “আজকের রাত আপনারা স্কুলের ভেতর থাকেন, কাল সকালে একটা বাসার ব্যবস্থা করে দিবো” কাকার মুখে এই কথা শুনে মায়ের মুখে হাসি ফুটলো, সাথে আনন্দের জল গড়িয়ে পড়লো। কাকার কথামত আমরা সকলে স্কুলের ভেতর ঢুকলাম। হানিফ কাকার স্ত্রীর নাম নীলুফা বেগম, তার একটি ছেলে একটি মেয়ে। মেয়েটা আমার বয়সী, ছিলো।

নীলুফা কাকী, কাকার থেকে সব কথা শুনে আমাদের উপর হৃদয়বান হলেন, আমার ক্ষুদা কমাতে সে তার মেয়ের জন্য তৈরি করা সুজি আমাকে খাওয়ালেন। আর সবাইকে পেট ভরে ভাত খাওয়ালেন। আমরা খাওয়া দাওয়ার পর স্কুলের ব্যাঞ্চ সরিয়ে জায়গা করে সেখানে কাথা বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। ভোর ৬ টা বাজেই আমাদের ডেকে তুললেন হানিফ কাকা স্কুলের ছাত্র ছাত্রী ৮ টার মধ্যে চলে আসবে সব। ব্যাঞ্চ গুছাতে হবে ফ্লোর ঝাড়ু দিতে হবে। আমাদের নিয়ে নীলুফা কাকী তখন বের হয়ে গেলেন, স্কুলের পাশেই ছিলো একটি টিনসেড বাড়ি। সেই বাড়ীতে একটি ঘর খালি আছে যার ভাড়া ২০০ টাকা। কিন্তু মায়ের কাছে টাকা ছিলোনা, সেই টাকা দিলেন হানিফ কাকা। বাড়ি ভাড়া করে আমাদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা তো করলেনই সাথে বাবার জন্য ঠিক করলেন রংয়ের কাজ, আর মায়ের জন্য স্টারলিট গ্রামার স্কুলে আয়ার কাজ।

বড় আপা, আর মেজো আপা ঘরের হাল ধরতে গার্মেন্টস এ ঢুকলেন। যখন কেউ থাকতো না তখন আমার দেখাশোনা করতো আমার ছোট বোন। ধীরে ধীরে আমাদের পেটের জোগান হতে লাগলো। সবাই দিন রাত পরিশ্রম করে যায়। আমার বোনেরা কেউ তেমন পড়ালেখা করতে পারেনি, কিন্তু আমার মায়ের স্বপ্ন আমাকে যেভাবেই হোক পড়ালেখা করাবেন। আমার বয়স যখন পাচ বছর তখন থেকে আমার জীবনের গল্প শুরু।

আমাকে মা স্টারলিট গ্রামার স্কুলে ভর্তি করালেন। মা সেই স্কুলেই যেহেতু কাজ করতো তাই আমার বেতন, পরীক্ষার ফিস সব কিছুই ছিলো ফ্রি। আমি স্কুলে যেতে শুরু করলাম, আমাকে যে প্রথম অ, আ, ই, ঈ শিখিয়েছিলো তার নাম কাশেম। তার বাড়ি ছিলো ময়মনসিংহ, তার এক পা ছিলো না, তাকে সর্বদা দেখেছি সকাল থেকে বিকাল রাস্তার ধারে গামছা বিছিয়ে বসে ভিক্ষা করতো। সন্ধ্যে হলে আমাদের বাসায় এসে আমাকে পড়াতো ক, খ, গ, ঘ। সেই আমার প্রথম শিক্ষক ছিলেন। আমার মেধা নাকি অনেক ভালো এই কথাটি তারই আবিষ্কার ছিলো।

হানিফ কাকার মেয়ে নাসিমা, তার ছেলে রাসেল আর আমি স্টারলিট গ্রামার স্কুল থেকেই পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি চাইলেও এখন আমি সেই স্কুলে আর পড়তে পারবোনা। কারন সেখানে পড়ালেখার সীমাবদ্ধতা পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্তই ছিলো। এবার আমাকে উচ্চ বিদ্যালয়ে যেতে হবে, আমার ফ্রিতে পড়ার দিন শেষ এবার পড়তে হলে টাকা খরচ করতে হবে।

আমাদের তিনজন কে যে স্যার পড়াতো, তার নাম নেসার, আমার সবাই নেসু স্যার বলে ডাকতাম। সে হানিফ কাকার গ্রামের ছেলে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সে পড়তো, আর অবসর সময়ে আমাদের কে পড়াতো। তার পরামর্শ নিয়ে, আমাকে আর নাছিমা কে মিরপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিলো, আর রাসেল ভর্তি হলো জান্নাত একাডেমী হাইস্কুলে।



আমার নতুন জীবন শুরু হলো, আজ আমার হাইস্কুলের প্রথমদিন। দুপুর ১২ টা থেকে আমার স্কুল শুরু হয়, আর সকাল ৭ টা থেকে নাছিমার স্কুল। ক্লাসে ঢুকলাম, একটু ভয় ভয় লাগছিলো, সেখানে আমি ছাড়াও আরো অনেক ছাত্র ছিলো, সবাই মজমাস্তি করছে। তাদের মধ্যে একটি ছেলের নাম, নুরমোহাম্মদ। আমি সামনের ব্যাঞ্চে তার পাশে গিয়ে বসতেই সে আমাকে বলতে লাগলো, “এখান থেকে উঠে অন্য জায়গায় বস, এখানে প্রান্ত বসবে ” প্রান্ত আমাদের ক্লাসের একজন খ্রিষ্টান ছাত্র ছিলো। আমি নুরমোহাম্মদ এর কথা মানতে চাইলাম না, কারন পেছনের সিট আমার ভালো লাগেনা, আমি তার সাথে জোর গলায় বলতে লাগলাম, “আমি উঠবো না আমি এখানে সিট পাইছি বসছি, এখন উঠবোনা। নুরমোহাম্মাদ কোন কথা না বলে আমার গলা চেপে ধরলো, তার হাতের আংগুল এর নকগুলোতে আমার গলার ছাল উঠে গেলো, আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে এক ধাক্কা দিলাম। সে পড়ে গেলো, উতাল পাতাল ঘুষি দিতে লাগলাম, বুকে মুখে, সেও যখন আমাকে পালটা আক্রমন করছিলো তখন পকেট থেকে কলম বের করে তার হাতে ঘাই বসিয়ে দিলাম, কলমের নিপ ভেংগে তার হাতের কব্জির ভেতর ঢুকে গেছে। সে কুকিয়ে উঠলো, চিৎকার করতে লাগলো। তখন সবাই আমাকে থামিয়ে মাঠের মধ্যে নিয়ে আসলো। প্রথম দিন স্কুলে এসেই মারামারি করার কারনে আমাকে শাস্তিও পেতে হলো। সেদিন থেকে আমাদের নিখিল স্যার যে অংক ক্ল্যাস করাতেন সে আমাকে ডন বলে ডাকতে লাগলো। পরবর্তিতে নুরমোহাম্মাদ আমার সবচেয়ে ভালো এবং প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছে সময়ের স্রোতের তালে তালে।

ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিলাম, আর পরিবারের অবস্থা বুঝতে শিখছিলাম। আমার মা আমার পড়ালেখার খরচ বহন করার জন্য স্কুলের কাজ বিকেলে শেষ করে অন্যের বাসায় কাজ করতে যেতেন। যদি তারা কখনো ভালো খাবার মাকে খেতে দিতো মা সেই খাবার আচলে মুড়িয়ে আমার জন্য নিয়ে আসতো। তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন প্রথম মনের মাঝে অনুভুতির সাড়া পাই। আর এই ক্লাস সেভেন ছিলো জীবনের শেষ হাসি, উল্লাস, আনন্দের বছর।

আজকাল নাছিমাকে আমার অনেক ভালো লাগে, তার সাথে খেলতে তাকে নিয়ে হাটতে, তার সাথে নানান গল্প করতে অনেক ভালো লাগে। তাকে ছাড়া আমার চলেনা আজকাল সব সময় নাছিমার আশেপাশেই থাকি। রোজ ১১ টার মধ্যে স্কুলের সামনে হাজির হয়ে যেতাম সে সাড়ে ১১ টায় স্কুল থেকে বের হয়ে আধাঘণ্টা আমার সাথে আড্ডা দিয়ে আমার ক্লাস শুরু হলে বাসায় যেতো। নাছিমা প্রথম সে নারী যার জন্য অনুভুতি বলে কিছু একটা আছে আমি উপভোগ করেছিলাম। আরেকটি মেয়েছিলো নাম জুথি যার মনে আমার জন্য প্রথম অনুভুতি জেগেছিলো। সেই বছরটা বড্ড আনন্দে কেটে ছিলো, জুথি নাছিমা সহ পিকনিক এ যাওয়া, এক সাথে আড্ডা দেওয়া। নানান বাহারী ঠাকুমার ঝুলির গল্পের সমালোচনা করতে করতে কিভাবে যে সেই সুখের বছর কেটে গেলো তা বলতে পারবোনা।

আমি ক্লাস এইটে উঠলাম, বছরের শুরুতেই বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বড় বোন সাইদুল নামের এক ছেলেকে বিয়ে করলেন, ছোটবোন আর মেজো বোন গার্মেন্টস করতে লাগলো। এখন বাবার চিকিৎসা করাতে করাতে মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, মা সব সময় ধুলাবালিতে কাজ করতো বলে নাকে পলি হয়েছে। এটা একধরনের মাংসপেশী রোগ, মায়ের নাকের মধ্যে মাংস স্থল জমা হয়েছে, যার কারনে শ্বাস কষ্ট হয়। এর চিকিৎসা অপারেশন করে নাকের ভেতরের বাড়তি মাংস কেটে ফেলতে হবে। এখন মা বাবা দুজনেই অসুস্থ আগে তাদের সুস্থ করতে হবে। দুই বোনের মাসের বেতনে সংসার চালানো খুবই কষ্টের হয়ে দাঁড়ালো। এখন আমাদের অবস্থা আগের মত হয়ে গেলো, মানুষ বলেনা যখন বিপদ আসে এক সাথে আসে, যখন যায় এক সাথেই যায়। বিপদ নামের বস্তু গুলো কেন দলবেঁধে চলতে ভালোবাসে তা আমি আজো বুঝলাম না।

আমার স্কুলের ফিস, ঘর ভাড়া, তিনবেলা খাবার আসবে কোথা থেকে। নানান চিন্তা মাথায় ভর করলো, দিক বেদিক পাগল উম্মাদ হয়ে উঠতে লাগলাম। অবশেষে স্কুল ছেড়ে দিয়ে আমিও কাজের সন্ধানে বের হলাম যে কাজ পেলাম তা হলো বাবার করে আসা রংয়ের কাজ। মা সেই অসুস্থ শরীর নিয়েই কাজে যেতে লাগলো, আমাকে পড়াতে চাইলো, কিন্তু আমার তখন জেদ আকাশ চুমি, আমি কিছুতেই এই অবস্থায় মাকে কাজ করতে দিবোনা। তারপরেও মা আমার কথা না শুনে কাজে গেলেন। মা যে বাসায় কাজ করতেন সে একজন ডাক্তার ছিলো, মায়ের এমন বিদিক অবস্থা দেখে সে সরকারী হাসপাতালে অল্প খরচে অপারেশন এর ব্যবস্থা করলো। কিন্তু আমাদের কাছে সেই অল্প খরচের টাকাও যে নেই। তাই সে নিজের থেকেই টাকা দিলেন ধার হিসেবে। মায়ের অপারেশন হলো, বাবাও সুস্থ হতে লাগলেন। মায়ের অপারেশনের সেই টাকা শোধ করতে আমাদের তিন ভাইবোনের ছয় মাস লেগে গেলো। ইতিমধ্যে আমার সাথে যারা পড়তো তারা নাইনে ভর্তি হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নাম আর বিল্ডিং টা দেখে আসতাম, বড্ড শান্তি পেতাম তখন।

মায়ের সাথে একদিন ফটোকপি করাতে কম্পিউটার দোকানে গেলাম সেখানে গিয়ে আমার কম্পিউটার শেখার ইচ্ছা জাগলো মাকে ইচ্ছার কথা জানাতে দেরি হলো, বাসায় এসে তার মাটির ব্যাংক ভাংতে দেরি হয়নি। সেখান থেকে ৩৮০ টাকা বের হয়েছে সেই টাকা নিয়ে ফিরোজা কম্পিউটার সেন্টার যেটা মিরপুর ১১ এর চার নম্বর রোডে অবস্থিত। সেখানকার পরিচালক ছিলেন আশরাফ স্যার, মা তাকে আমার ইচ্ছের কথা জানালেন, সে তখন বলেছিলো “তুমি তো অনেক ছোট এত তাড়াতাড়ি কম্পিউটার শিখে কি করবে?” কেন জানি তার কথাটা আমি হজম করতে পারছিলাম না, তাই বলে ফেললাম, “ছোট তো কি হইছে, মানুষ ছোট থেকেই বড় হয়, আর বুড়া বয়সে শিখেই কি লাভ যদি কাজে না আসে” আমার কথা তার কতটুকু পছন্দ হয়েছিলো জানিনা, কিন্তু তার মুখের মুচকি হাসি বলে দিয়েছে সে সন্তুষ্ট হয়েছে আমার কথায়। আমি আশরাফ স্যারের কাছ থেকে কম্পিউটার শিখতে লাগলাম। এক মাসের মধ্যে মাইক্রোসফট অফিস পোগ্রামের কাজে অনেক পারদর্শী হয়ে উঠলাম। আশরাফ স্যার খুব দ্রুত কম্পোজ করতো তার কম্পোজ দেখে আমারো ইচ্ছে জাগলো তার মত স্পীডে কম্পোজ করতে না পারলে, কম্পিউটার শেখা বৃথা। আরো মাস গেলো হাতের স্পীড আনতে অবশেষে এত বেশীই স্পীড এসেছে হাতে, যে এক মিনিটে ৫০+ বাংলা শব্দ অনায়াসে লিখে ফেলতে পারতাম, আর ইংলিশ ৫৫+ ছিলো। সে আমার কাজে সন্তুষ্ট হলো, এবং আমার অফিস প্রোগ্রামের কাজেও সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে তার দোকানে কাজে রেখে দিলো। আমি ঐ মিরপুর কম্পিউটার গলির সবচেয়ে কমবয়সী সবচেয়ে দ্রুতগামী কম্পোজার, এবং কম্পিউটার ট্রেইনার হয়েছিলাম।

তখন আশরাফ স্যার আমাকে আবার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। তারপর থেকে অর্ধবেলা কর্মজীবন আর অর্ধবেলা পরালেখার জীবনে কেটে গেলো অনেকগুলো বছর। কম্পিউটার ডিপ্লোমা করেছি এস.এস.সি এর পর কিন্তু ব্যস্ততা আমাকে কখনো জীবন উপভোগ করার সময়টা দেয়নি। নাছিমা বিশ্ববিদ্যালয় চলে গেলো, রাসেল বাইং হাউজ কাজে, জুথি পড়ালেখা ছেড়ে শাহ আলী মার্কেট এ সেলস গার্ল হিসেবে কাজ করতে লাগলো। আমি ততদিনে কম্পিউটারের অনেক কাজে দক্ষতা অর্জন করায়, ভালো চাকুরীও পেলাম সময় বুঝে কিছু টাকা গুছিয়ে চলে গেলাম মালয়েশিয়াতে নতুন জীবন শুরু করতে। কিন্তু মনের সেই না পুরন হবার স্বপ্ন আজো তাড়া করে বেড়ায়। যে স্বপ্ন আমার প্রতিটি শিরায় শিরায় বিচলিত সেই স্বপ্নের শেষ হয়েছে এই ধানমন্ডি জেনেটিক প্লাজাতে অবস্থিত “জামদানী ওয়ার্ল্ড” এর দোকান মালিকের কাছে।

মালয়েশিয়াতে আমার তিন বছর হলো আছি, অনেক টাকা বেতন পাই, একটি ইলেক্ট্রিক্যাল কোম্পানীতে জব করি মাসে প্রায় খেয়ে দেয়ে দেশে ৭০-৮০ হাজার টাকা পাঠাতে পারি। বাবা মা এখন ঢাকায় থাকেনা, আবার নিজ গ্রামে চলে গেছে এখন আমাদের বড় ঘর হয়েছে। আমার বড় বোন আর মেজো বোন দুজনেই জর্ডান চলে গেছে সরকারি গার্মেন্টস ভিসাতে। তারাও প্রতিমাসে অনেক টাকা ইনকাম করে এখন, আমাদের অভাব এখন নাই বললেই চলে আল্লাহ অনেক ভালো রাখছে, কিন্তু আল্লাহর পরীক্ষা নেওয়া শেষ হয়নি। ছোট বোনের বিয়ে হলো মাঝখানে তাও বছর দুই পর তালাক হয়ে গেলো। আমি এখন যান্ত্রিক জীবন থেকে খানিকটা মুক্তি। চাই এখন আমাদের ঋন নেই, এখন একটু ভালোবাসার বাতাসে উড়তে চাই, আমার না পুরন হওয়া স্বপ্নটা পুরন করতে চাই। তাই সখের বসে মন আনন্দে লেখালেখি করি। এই লেখালেখির জের ধরেই আমার জীবনে আসে শিখা, যাকে নীলাদ্রি বলে ডাকি আমি।

আমার মনের সকল গোপন কষ্ট, আমার ফেলে আসা অতিত, আমার এতদুর আসার পেছনে পরিশ্রমের সেই নির্মম ইতিহাস আমি কোন রকম সংকোচ না করে বলতে পারতাম শুধু শিখার কাছে। মালয়েশিয়া থাকতে জানতে পারলাম জুথি বিয়ে করেছে, নাছিমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তার হবু স্বামীও মালয়েশিয়াতে থাকে তার সাথে একবার দেখাও করেছি আমি। সব কিছু হারিয়ে এত ঝড় পেড়িয়ে যখন আমি ক্লান্ত তখন একটু ছায়া খুঁজতে খুঁজতে আমি পৌছে যাই শিখার দরজার সামনে।

কিছুটা মিথ্যে সময়ের জন্য হলেও সে আমাকে ভালোবাসি বলেছে, মিথ্যে ওয়াদা হলেও সে বলেছিলো কোনদিন আমার হাত ছাড়বে না। শান্তনা দেবার জন্য হলেও সে বলেছিলো, তোমার জীবনে অনেক কষ্ট করেছো তোমাকে আর কষ্ট দিবো না, এখন থেকে শুধু ভালোবাসার সুখ আর সুখ। তার মায়াবী হাসি, আর স্বর্নের মত চকচকে রুপ আমাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছিলো আমার এত বছরের করা কষ্ট একাকী রাতে একজন সংগী পাবার আহুতির ডাহুক কান্না সব ভুলে শুধু তাকে মন থেকে প্রান দিয়ে জীবন বাজি রেখে যতভাবে ভালোবাসা যায়, শুধুই ভালোবাসতে লাগলাম।

যে ছেলের জন্ম ঘোর বর্ষা আর আমাবস্যা নিয়ে তার কপালে চান্দের আলো কতক্ষণ জলবে। হঠাৎ নিভে গেলো সেই সুখের প্রদীপ। ঘোর অন্ধকারে লুটাতে লাগলো, আমার চারিপাশ। আর এ সব কিছুই জামদানী ওয়ার্ল্ড এর দোকান মালিকের কারনে।

আমি দেশে ফিরে আসি, একটি সরকারি চাকুরীর জন্য বেশ কিছু টাকা দিয়েছি একজন কে। এরই মধ্যে মা জমি কিনেছে তা আমি জানতাম না, অনেক টাকা ধার করেছে সে। যা আমার জানা ছিলোনা ভিসা শেষ করে আমি না কাউকে না জানিয়ে দেশে ফিরে আসলাম। কারন দেশে আমার চাকুরী হবে সব কথা বার্তা আগে থেকেই বলে রেখেছি। দেশে এসে যখন জানতে পারলাম মা আমার ঋন গ্রস্থ হয়েছে তখন আর ভালো লাগলো না কিছু। মালয়েশিয়া থেকে আসার পর কোন কাজ করিনি চাকুরীর অপেক্ষায় বসে আছি বেকার থাকলে শয়তান মাথায় বাসা বাধে, তাই আমি শিখার সাথে সারাদিন কথা বলতে চাইতাম। সময় কাটানোর একমাত্র রাস্তা তখন আমার শিখা। আসলে একটি কথা কি অতি ভালোবাসা সবাই সইতে পারেনা। আমার অতিরিক্ত ফোন ম্যাসেজ আর সে রিসিব না করলে টুকিটাকি ঝগড়া হতে লাগলো। এখান থেকে মনোমালিন্য শুরু আর শেষ তার জেদ এর কাছে, সে আমার প্রতি এতটাই অতিষ্ট হয়েছে যে ১ সপ্তাহের মধ্যে সব কিছু ভুলিয়ে দিয়ে এনগেইজমেন্ট করে ফেললো তার বাবা মায়ের পছন্দে। আমাকে ছেড়ে যাবার কারন অনেক এখন, তার বাবা মা বিয়ের জোর দিচ্ছে আমার কোন চাকুরী নেই, নেই কোন কর্মসংস্থান। মাথার উপর ঋন আছে, আমাকে সে সহ্য করতে পারেনা, তার বাবা মাকে কষ্ট দিতে পারবে না।

ধুলোয় উড়ে গেলো আমার ভালোবাসা, আমার স্বপ্ন, আমার আশা, আমার শত জনমের চাওয়া গুলো। সারা রাত তার বাসার সামনে দাড়িয়েছিলাম ঢাকা থেকে সিলেট গিয়ে অভিমানী শিখা আমার মুখ দেখতেও আসেনি একবার। আমার এক বন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো সে কেন আমার সাথে দেখা করলো না। তখন শিখা যে উত্তর দিয়েছিলো সে উত্তর যদি আমি আগে জানতাম আমার ঈমানের কসম আমি নিজ হাতে নিজের ভালোবাসার কুরবানী দিতাম, গোলা টিপে হত্যা করতাম সুখ খুজতে যাওয়া অব্যক্ত অনুভুতিগুলোকে।

শিখা আমার বন্ধুকে বলেছিলো “আমার সাথে দেখা করলে তার হবু বরের সম্মান নষ্ট হবে”।

আর সেই শিখার হবু বর হচ্ছে জামদানী ওয়ার্ল্ড দোকানের মালিক।

গত সপ্তাহে শিখার আংটি বদল হয়েছে, এরই মধ্যে সে আমার জনমভরা ভালোবাসার মোহ কাটিয়ে তার সাথেই সবচেয়ে সুখে আছে বলে এলান করেছে। আমি জামদানী ওয়ার্ল্ড দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আজ এই শাখার ওপেনিং। আমি এসেছি এই আশাতে যদি শেষবার হলেও শিখার দেখা পাই, তাতেই আমার শত জনমের ভালোবাসা পুর্নতা পাবে। আমার চাকুরীটা এখনো হয়নি হলে আমি শিখাকে হয়ত বলতে পারতাম এখন থেকে বেশী ভালোবাসবো কিন্তু দেখাবো না, আমার এখন চাকুরী আছে আগামী কয়েক কয়েক মাসের মধ্যে ঋন শোধ করে ফেলবো।

কিন্তু নাহ শিখার সামনে যাওয়া যাবেনা, তার স্বামীর সম্মান আমার জন্য নষ্ট হোক তা আমি চাইনা। সে সুখেই থাকুক, আমি বরং একটু আড়ালে দাড়াই, শিখাকে একবার দেখে চুপ করে এখান থেকে বের হয়ে যাবো। দোকানের মিলাদ পড়ানো শেষ হলো, একে একে কাস্টমার এসে বিভিন্ন ধরনের জামদানী শাড়ির সমারোহ দেখতে লাগলো।

শিখাও আসছে সাথে একজন লম্বা সুন্দর স্মার্ট টাই স্যুট পড়া সাহেবের সাথে হেটে। ফ্রাঞ্চকাট দাড়ি তার, সুন্দর মলিন চেহারা পুরুষটির। শিখা নীল রংয়ের শাড়ি পড়েছে। একদম আমার দেওয়া নামের মতই তাকে লাগছে। নীলাদ্রী “নীল গগনের রানী”। আমি আরেকবার সেই সুপুরুষের দিকে তাকালাম, একবার পাশে গ্লাসের আবছায়াতে নিজেকে দেখলাম। আমি কোথায় কালো শুকনো গাঁজাখোর টাইপ দেখতে একটা ছেলে, আর কোথায় এই সুদর্শন সাহেব বাবু। আমার থেকে দেখতে শুনতে আভিজাত্যে অনেক ভালো বর পেয়েছে শিখা, আমাকে তার জীবনে নিবে কি দেখে আমার তো কিছুই নাই। রুপও নাই, আভিজাত্য ও নাই। কিন্তু যখন আমাকে নিতেই পারবে না তবে ভালোবাসি কেনই বলেছিলো? হয়ত মোহতে ডুবে ছিলো।

আমি দোকানের দিকে এক পলকে তাকিয়ে ছিলাম। অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকার কারনে সেই ভদ্রলোকটি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার কি কিছু লাগবে”
০- হ্যা
— কি লাগবে বলুন, কোন মডেলের শাড়ি দেখাবো আমাকে বলুন।
০- শাড়ি না ভালো থাকার অসুধ লাগবে
— এটা ফার্মেসী নাতো দোকান।

আমি ছলছল চোখে ভদ্রলোকটির দিকে একবার তাকালাম। দীর্ঘ এক নিশ্বাস নিয়ে বললাম “জানেন যারা ভালোবাসতে শিখায়, তারা হঠাৎ করেই ভালোবাসতে ভুলে যায়। আর তখন নতুন ভালোবাসা শিখেছে সেই মানুষগুলো ধুকে ধুকে এক সময় মরে যায়, হেরে যায় ভালোবাসার দৌড়পাল্লা খেলায়”।

আমি আর কোন কথার জবাব এর আশায় না থেকে শপিংমল থেকে বের হয়ে আসলাম। অনুভব করলাম আমার চোখের জল, গড়িয়ে পড়ছে। বাম হাত দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে, মেইন রোডের রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে লাগলাম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত