বিল একদিকে যেমন অসতর্ক অন্যদিকে বেপরোয়া, অন্তত আমার তা-ই মনে হতো। নিজের অজান্তেই তার চেপে রাখা বিষয়গুলো পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়ে। তার সাথে যেদিন আমার প্রথম দেখা, আমাদের বিয়ের দিন, ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকার জন্যেই অর্থহীন বকবক করে যাচ্ছিল। আমার হাতে ওর উষ্ণ হাতের আলতো চাপে ছিল যন্ত্রণায়-ভেজা এক করুণ আর্তি। ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বিছানা ছেড়ে আমি যখন জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম মুহূর্তের জন্যে বিল কেমন নিভে গিয়েছিল। ওর এই অতি তুচ্ছ সংবেদনশীলতা আমার হাস্যকর মনে হলেও হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে তুলতো।
জানালার সার্সিতে আনমনে জেনির নির্বিকার ভঙ্গিতে হাত বোলানো দেখে সেদিনই আমার মনে হয়েছিল সব ইচ্ছেশক্তি দিয়েও এই আচ্ছন্নতা কাটিয়ে তাকে একচুল নড়াতে পারব না। ওর নরম ত্বকে খুব যত্ন করে বিধাতার বসানো পাতলা অনড় দুটি ঠোঁট কি তীব্রতায় বলে দেয়-
“আমাকে সেই হিসেবের বাইরে রাখো বাইরে রাখো”
দুটি চোখের চিরন্তন দৃষ্টি প্রতি মুহূর্তে আড়ষ্ট করে দেয় আমার ইচ্ছেগুলোকে। হৃদয়ের সব শক্তি দিয়ে সেই দৃষ্টিজয়ে শুরু হয়েছিল আমার অদৃশ্য সংগ্রাম।
স্বর্গ হতে ধার করে আনা আমাদের বিকেলগুলো সুন্দর ছিল। সাঁকোর ওইপাশে গোধূলি মেশানো মাঠটা থেকে বাচ্চাদের চেঁচামেচির শব্দ আসতো। ও বলতোঃ
– শোন কেমন ঝরনার মতো মধুর!!
আমি বিরক্তি নিয়ে চুপ করে থাকতাম। ওই দূর আকাশের গায়ে পাড় দেয়া পাহাড় পেরিয়ে হলদেটে আলো নিয়ে রোজ এগিয়ে আসতো একটা দীর্ঘ কালো ছায়া। সমস্ত আগুন এখানে জড়ো হতে হতে নিভে যায়। এখানে ওখানে হাসিখুশিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুলগুলো বাতাসে দুলেদুলে সূর্যটাকে বিদায় দিতে তৈরি। সবকিছু জীবন্ত, অবিনশ্বর। আকাশের বুক চিরে পাখিগুলো যেতে যেতে ছোট থেকে আরও ছোট হয়। সেই নিঃস্পন্দ মুহূর্তে আমি সব অস্থিরতা ভুলে যাই। যার স্পর্শ আমি চরম সর্বনাশের শুরুর মতো ভয় করি, হাসি-ভরা মুখে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে তার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিই। আমার ঠোঁট কাঁপে; স্বচ্ছ লেকের বুকের মতো উপচে পড়া মন নিয়ে এই প্রকৃতির সব রূপ উঠে আসে আমার আয়ত চোখের তারায়। যেন সুখস্বপ্ন। ও কি শু্নতে পায় আমার হৃদয়ের নিঃশব্দ তোলপাড়?
বাড়ি ফিরে আমি ওকে দেখার জন্যে এখান থেকে ওখানে ছুটে অস্থির হয়ে যাই। জেনির লঘু পায়ে নীরব চলাফেরা আমাকে আরও পাগল করে তোলে। আমি ঘুমের ভান করে আধবোজা চোখে তাকে দেখি- ওর প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, প্রতিটি কদম। মুখটা শান্ত স্থির, কালচে ভ্রু দুটো আয়েশি ভঙ্গীতে সুন্দর ভাঁজহীন বসে আছে। অথচ প্রতিমার মতো ছাঁচে গড়া চিবুকে রাজ্যের অভিমান; কি যেন দলা পাকিয়েছে। ওর গলার দিকে যত্নে পড়ে থাকা চিবুকের ছায়াটার কাছে সব কামনা বাসনা দমে যায়। মিষ্টি একটা গন্ধে আমি এলোমেলো হয়ে যাই। ওই ছায়াটাকে জোর করে চোখের আড়াল করি। সামনে দাঁড়িয়ে ওর বাহু দুটো ধরি।
-জেনি!
-হুম..
ওকে কাছে টানি। ধীরে ধীরে কানের কাছে জোরালো হয় আমার চাহিদার প্রতি অদ্ভুত সীমাহীন ঘৃণা আর অবিশ্বাসের শ্বাস প্রশ্বাসের জোরালো শব্দ।
-জেনি দেখো আমার বুকের পাশটায় ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। ছুঁয়ে দেখো!
-তাই? আমাকেও ঘামতে বলো? তুমিও কি আমার ঘামে ভেজা জায়গাটা ছোঁবে!!! আমি খেই হারাই।
-ফ্রেশ হয়ে আসছি, চাওমিন করো।
হাত ছেড়ে দিই। এক মুহূর্তের জন্যে দেখতে পাই, ক্রোধের উত্তাপে লাল হয়ে যাওয়া গালের চেয়ে ওর ঠোঁট আর জিভটাকে দেখাচ্ছিল অসম্ভব রকমের বেশি লাল!
রাতে খেতে বসলেই ওর খাওয়ার ভঙ্গীতে কেমন কুৎসিত একটা কিছু বারবার ফেরে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস আর অস্থিরতা নিয়ে ও চাওমিন নাড়াতে থাকে। একটা অংশ একবার টুকরো করে, তাকে আবার, সেই অংশগুলোকে সে আবারও খুঁচিয়ে টুকরো করে। গভীর থেকে গভীরে যাওয়ার অদম্য বন্যতাকে তখন কাঁটা চামচে জীবন্ত দেখতে পাই। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে আমি ঘরময় ওর পায়চারি দেখি। ওর জামা, তার ভেতর ওর বুক, তার ভেতরে পাঁজর, তার ভেতরে তার বুনো আদিম ইচ্ছেগুলো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট দেখতে পাই। আমার গলা বেয়ে তেতো আর ঝাঁঝালো একটা ঢেকুর উঠে আসে। রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে জমাট বাঁধা আঁধারে বারান্দার একা ক্যাকটাসটাকে আমার বিলের চেয়ে অনেক বেশি আপন মনে হয়।
বাতাসের মুখে হাল্কা পালকের মতো আমার অনুভূতিগুলো জেনির বন্ধ দরজার আশেপাশে উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়, যেন মরতেও সুখ! দিনরাত ওই জানালার গায়ে হাত বুলিয়ে কি ভাবে, আমি কোনদিন জানিনি। গভীর আত্মমগ্নতাতেও ওর মুখের অভিব্যাক্তি এতটুকু বদলায় না! নমনীয়, তবু সজীবতা নেই, আবার শিথিলতাও নেই, নেই আত্মসমর্পণ। নিজের বিশ্বাসকে গভীর একাগ্রতায় ও মুঠোতে চেপে ধরে থেকেছে। ওর সজীবতা ছিল নিজেকে নিজের করে ধরে রাখার নিবিড় প্রয়াসে। আমি যেন চিরকাল একাই ছুটছি ওর দিকে। রেকাবি থেকে একগুচ্ছ লালগোলাপ তুলে আমি জেনির হাতে তুলে দিই। বুঝতে পারুক আমার বুকের রক্তক্ষরণ, সব গোলাপ হয়ে সামনে আসুক।
– জেনি
– হুম..
– জেনি ভালবাসার মানেই তো মিলন। এক জীবন থেকে কিছু আলো অন্য জীবনে দিয়ে দেয়ার মাঝেই তো বেঁচে থাকা। আমার দেহটা শেষ হয়ে যাবার পরেও পৃথিবীতে ঘুরেফিরে বেঁচে থাকা জীবন্ত কোন উপাদানে আমার প্রাণের স্পন্দন!!
জেনি অপলক চেয়ে থাকে। আমার ঠোঁট দুটো আবেশে ওর ঠোঁটে চেপে ধরি। সময় কতো আমার জানা নেই।
ঝড়ের মার খেয়ে একলা প্রদীপের শিখার মতো নুয়ে পড়ে ওর তুলার মতো শরীরটা। সেখানে তখন হাজার বছরের বরফ জমে থাকা তেপান্তর। সে চুমু তার মুষড়ে পড়া বরফ শীতল আত্মার গভীরে যেতে পারেনি! এরপর থেকে জেনির নিঃশব্দ হাঁটা দেখিনি!
দেখতে দেখতে অনেক সময় চলে যায়। বিলকে ছেড়ে আসলাম প্রায় তিনমাস। এখনো সেই কথা ভাব্লে আমি কুঁকড়ে যাই। ভাঙ্গনের কথা ভাবি। সোনালী মেঘগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে থাকে। তীব্র ঔজ্জল্যে বারবার পরিবর্তন আসে। নিজের অজান্তে আমি আমার একদিনের আহত ঠোঁটে হাত বুলাই, এপাশ-ওপাশ। উড়ে আসা ঝরা পাতারা আমার মুখে ঝাপটা মারে। মনে করিয়ে দেয় বিলের কথা, যাকে আমি অস্পষ্টভাবে ভালবেসেছি একটা মিশ্র জটিল অনুভূতি দিয়ে; জানিনা ভয়ে নাকি ভরসায়! তাকে আমার খুব কাছের বলে মনে থাকে। এদিকে মেঘের ভাঙন আকাশের আর সহ্য হচ্ছিল না; এজন্যেই হয়তো রাত নামে। ধূসর- আরও ধূসর- কালো- জমাট কালো। তারপরই তো আবার..
আমার বুকের মধ্যে কান্না জমে। বিধ্বস্ত প্রজাপতির মতো অন্ধ ভয়ে আমি ছটফট করতে থাকি। যদি সে আর না আসে! আমার একলা বাড়িটায় কিসের একটা মিহি আর্তনাদ ছুটে বেড়ায়। একটা শূন্যতা আমার দম আটকে দেয় বারবার। চুলগুলো টেনে ধরে আমি প্রচণ্ড আক্রোশে চিৎকার করি
-মুক্তি চাই!
হিমেল হাওয়ার কানাকানি যেন আমার কাছ থেকে বিলের দূরত্বের সমস্ত পথটা জুড়ে। নির্ঘুম লাইটপোষ্টের মেলে রাখা কুতকুতে দৃষ্টি পেছনে ফেলে আমি এগিয়ে যাই ওই বাড়িটার দিকে। ক্যাকটাসের পাশে বিল হাঁটু গেঁড়ে বসে! ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ সময়টাতে আরও বেশি তৎপরতা জুড়ে দেয়। আমি সামনে দাঁড়াই। বিল আমাকে জড়িয়ে থাকে।
– এলে!
– আমি একটা বন্ধ গোলকধাঁধায় হেঁটে মরছি। বেরোবার পথ পাচ্ছি না বিল।
– এলে তো!
আমি শিউরে উঠি।
– সব যন্ত্রণার মধ্য দিয়েও আমি তোমাকে ভালবাসতে চাই বিল!!