তবু দূরে না গেলেই কি নয়?

তবু দূরে না গেলেই কি নয়?

প্রতিদিন সকাল ঠিক নয়টায় ডোরবেলটা বাজে। ততক্ষনে বাসার সবার দিনের প্রায় অর্ধেক শেষ হয়ে যায়। আব্বু অফিসে যাওয়ার পর দরজা লাগিয়ে আমি ঘুমুতে যাই। আম্মু পিচ্চিকে নিয়ে স্কুলে চলে যায় আরো অনেক আগে। আমি রাত জাগা মানুষ। সকালের ওই সময়টাতেই আমার ঘুমটা জাঁকিয়ে আসে। আমার বাসায় আমি ই একমাত্র বেকার মানুষ। ডোরবেলটা বেজে প্রতিদিন আমার ঘুমের বারোটা বাজায়। রোজ এক যন্ত্রনা কাহাতক আর ভালো লাগে!! কিন্তু তবুও আমি এই আমন্ত্রন উপেক্ষা করতে পারিনা। কারণ প্রতিবার দরজা খুললেই আমি একটা হলুদ গোলাপ আর নীল রঙা পাতায় টানা টানা অক্ষরে লেখা চমৎকার একটা কবিতা পাই।

প্রথম প্রথম ভাবতাম, কেউ বুঝি ভুল করে তার সাধের উপহারখানা আমাদের এখানে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রোজ রোজ একই ভুল করা সম্ভব নয় বলে, সে সম্ভাবনাকে বাদ দিয়েছি। এই কাজটা যে করছে, আমি নিশ্চিত সে প্রখর ভাবে আমাদের বাড়ির দিকে দৃষ্টি রাখে। আমি বেশ ক’বার ন’টা বাজার খানিকটা আগেই দরজা খোলা রেখে দেখেছি। কিন্তু কাউকে চোখে পড়েনি। অথচ আমি দরজা ভিড়িয়ে রুমে আসার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আবার ডোরবেল, আবার সেই হলদে গোলাপ আর কবিতা।

কবিতা পাগল আমি কখনই ছিলাম না, বরং কবি বলতেই আমার শান্তি নিকেতনি ব্যাগ কাঁধে ঝোলানো উশকো খুশকো দাড়ি আর ইয়াব্বড় বড় চুলের উৎভ্রান্ত এক যুবকের ছবি মনের দৃশ্যপটে ফুটে উঠত। বলাই বাহুল্য, এধরনের ড্রেস কার্টেসীর ব্যাক্তিবর্গ আমার চুড়ান্ত অপছন্দের। কিন্তু এই কাব্য লেখকের হাতের লেখা এত সুন্দর, যে কবিতাগুলো আমার খুব আপন হয়ে গেলো। সারাদিনে বেশ কয়েকবার আমি কবিতাগুলো পড়তে লাগলাম, নিজের অজান্তেই আগামী সকালটার জন্য অপেক্ষা করতাম।

সব মিলিয়ে ছত্রিশটা কবিতা, আর ৩৮টা গোলাপ আমি পেয়েছি। ওহ বলা হয়নি, প্রথম দিন গোলাপ ছিলো তিনটা। হলুদ গোলাপের সাথে দুটো ধবধবে সাদা গোলাপ। কবিতা পাঠানোর যদিওবা কোন ব্যাখ্যা দেয়া যায়, কিন্তু গোলাপের বিষয়ে কোন সমাধান আমার মনঃপুত হচ্ছে না। গোলাপের রং হলুদ কেন, কেনইবা লাল নয়!!

আমার বাবা মাও ব্যাপারটা জানেন। মা খুব চিন্তিত হলেও বাবা বরাবরের মতই চুপচাপ। বরং আমাকে চিন্তা করতে দেখে বিশাল এক গল্প ফেঁদেছেন। তিনি কবে ভার্সিটি পড়ার সময় কোন মেয়ের পিছু পিছু রোজ তার বাসায় যেতেন, সেই গল্প। বাবার গল্প শুনে আমার সমস্যার কোন সমাধান না হলেও মায়ের মেজাজখানা কিন্তু ঠিকই আগ্নেয়গিরির উত্তাপ ধারন করেছিলো, আর ফলস্বরুপ দুদিন মায়ের, বাবার মুখদর্শনে নিষেধাজ্ঞা জারী হয়েছিলো। তাই আমি ভালোভাবেই বুঝে গেছি, এই সমস্যার সমাধান আমাকেই করতে হবে।

এমন হাস্যকর অবস্থা আমার, যাকে দেখি তাকেই কেবল কবি মনে হয়। আমাদের উল্টোদিকের বাড়িটায় যে পরিবারটা থাকে, ওদের একটা ছেলে আছে। আমার প্রায় সমবয়সী ই হবে। আমি সেদিন আমাদের পিচ্চিকে নিয়ে ঘুরতে যাবার ছুতোয় ও বাড়িতে গোয়েন্দাগিরি করে এসেছি। ছেলেটার পড়ার টেবিলে আতিপাতি করে খুঁজে ওর একটামাত্র খাতা খুঁজে পেয়েছিলাম। হাতের লেখাটা দেখে আমার এত মন খারাপ হয়েছে, বলার মতন না। কি হতো, যদি এই ছেলেটাই সেই ছেলেটা হতো?

২)
কবি আমাকে একটা ঠিকানা দিয়েছে। এখন আমি চাইলেই তাকে যা ইচ্ছে লিখতে পারি। কিন্তু আমি যে তার মত সুন্দর করে লিখতে জানিনা!! কি লিখব আমি, কি এমন লিখব, যা পড়ে কবি আমার সব জমানো কথাগুলো একেবারে বুঝে ফেলতে পারবে??

আমি কি তাকে আমার সাথে এভাবে লুকোচুরী করার জন্য আচ্ছামত বকে দেবো? নাকি কেবল একবার দেখা করার মিনতি করবো?? আমি কি তাকে বলবো, আমি শুধু কবিতা পড়েই গত ছমাসে তাকে নিয়ে কত স্বপ্ন বুনেছি, নাকি তার নিষ্ঠুরতার জন্য তাকে অভিশাপ দেবো?? আমি কিইবা করতে পারি???

অনেক বেশী কথা একসাথে জমে গেলে বোধহয় কিছুই বলা হয়ে ওঠেনা। আমি বোকার মত ভুল বানানে রোল টানা খাতায় লিখলাম, “আপনি খুব সুন্দর কবিতা লেখেন। আপনি আমার প্রিয় কবি।”

এইটুকু লেখার পর আমার কথাগুলো যেন ফুরিয়ে গেলো। আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কলম হাতে বসে থাকলাম, অথচ দিব্যি করে বলছি, আর একটা শব্দও আমার কলমটা লিখতে পারলো না। আমি আমার দুলাইনের ছোট্ট চিঠিটা পাঠিয়ে দিলাম কবির ঠিকানায়।

চিঠি পাঠানোর পর থেকে আমি অস্থির হয়েছিলাম। যদি আমার তুচ্ছ লেখাটা কবির ভালো না লাগে? যদি সে সেটা ছুঁড়ে ফেলে ডাস্টবিনে? যদি আমার আবেগটুকু তার স্পর্শের বাইরে রয়ে যায়? এরপর এলো সেই অদ্ভুতুড়ে মুহূর্ত। আবারও এক নীল রঙা পাতা। প্রথম বারের মত ওতে কবিতা ছিলো না। ওটা একটা চিঠি ছিলো। আমাকে লেখা কবির প্রথম চিঠি। ওতে লেখা ছিল :

“মেঘমালা,
আমি তোমার প্রিয় লেখক জানতে পেরে খুব আনন্দ হচ্ছে। এই মন্তব্যটির জন্যই তো আমার এত সাধনা, এত কবিতার আশ্রয় নেয়া। শুধু তোমার জন্যই সবকিছু। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখি, সেদিন থেকেই ভাবছিলাম, তোমাকে কি উপহার দেয়া যায়!! কী এমন আছে, যা তোমাকে মুগ্ধ করবে?? যা দেখে তুমি হাসবে, যাকে তুমি ভালোবাসবে, কি আছে এমন??

আমি খুব তুচ্ছ একজন মানুষ। এতটাই তুচ্ছ যে আমি তোমাকে লুকিয়ে দেখতে পারি, কিন্তু তোমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুটো ভালোলাগার কথা বলার অবস্থান বা ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই। তবুও কোন এক ঘোরলাগা সন্ধ্যায় আমি তোমাকে দেখেছিলাম। সিঁদুর রঙা আলোর বন্যায় আকাশ ভাসিয়ে যখন সূর্য ডুবিডুবি করে, তেমন একটা মুহূর্তে তোমাকে দেখে আমার পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো। আমার পুরো সত্তা দিয়ে অনুভব করেছিলাম, আমি আজন্মকাল কেবল তোমার, শুধুই তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। ওই মুহূর্তটার চেয়ে প্রিয় আমার জীবনে আর কিছু নেই, কখোনো হবেও না, এ আমি হলফ করে বলতে পারি।

চিরটাকাল মুখ বুজে সব কিছু দেখে যাওয়া এই আমার, তোমাকে দেখে নতুন করে আবার শুরু থেকে সব ভাবতে ইচ্ছে হলো। জীবনটা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে হলো। যেদিন প্রথম তোমাকে বৃষ্টির ফোটায় নিজেকে ভেজাতে দেখলাম, সেদিনই প্রথম বৃষ্টিকে সৃষ্টিছাড়া মনে হয় নি। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো তোমার পাশে দাঁড়িয়ে একটু ভিজি। আর কিছু নয়, তোমাকে স্পর্শ করে নয়, শুধু তোমার পাশে দাঁড়িয়ে একটু ভিজি… যেদিন প্রথম তোমায় কাজল চোখে দেখলাম, সেদিনই প্রথম “কাজল চোখের মায়া” শব্দটার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পেরেছিলাম।

আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। তোমার মুগ্ধতাকে ছুঁতে চেয়েছি সবসময়। তোমার প্রাণখোলা হাসি দেখার জন্য আমি অসীম অপেক্ষার প্রহর গুনেছি। আমি আর সবার মত কখোনো কোন রাজকন্যাকে স্বপ্নে দেখিনি। কিন্তু তোমাকে দেখার পর বুঝতে পেরেছিলাম, যদি মনের ভেতরে উঁকি দিতাম কখোনো, কেবল তোমার ছবিটাই দেখতে পেতাম। আমি ভাগ্যবান, স্বপ্ন দেখার আগেই স্বপ্নের রাজকন্যাকে খুঁজ়ে পেয়েছি।

আমি তোমাকে যতটা ভালোবাসি, আমি নিশ্চিত জানি পুরো পৃথিবীর সবটা মিলিয়েও এতটা ভালো তোমাকে কেউ বাসবে না। কিন্তু এ ভালোবাসা দূর থেকে ভালোবাসা। আমি আমার প্রতিটা রক্ত বিন্দু দিয়ে তোমাকে চেয়েছি। জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত আমি কেবল তোমাকেই চাইবো। কিন্তু তোমার সামনে দাঁড়িয়ে এ ভালোবাসার স্বীকারত্তি দেবার সামর্থ্য আমার নেই।

মেঘমালা, আমি তোমার কাছে কেবল একটা নীল রঙের চিঠির পাতা হয়েই রয়ে যেতে চাই। অধরা, অস্পর্শী, অদেখা কাল্পনিক চরিত্র। তোমার প্রিয় কবি হয়ে। আমার প্রতিটা কবিতার প্রতিটা চরণ কেবল তোমার জন্য লেখা হয়েছে। তুমি ছিলে বলেই আমি কবি। আজ থেকে তোমার কবির কবিতা লেখার ইতি। আজকের পর তোমার ডোরবেল রোজ অসময়ে বেজে উঠবে না। আমি হারিয়ে যাচ্ছি তোমার জগৎ থেকে, তোমার দেয়া দুটো লাইন সঙ্গে নিয়ে। যাবার আগে ছোট্টো দুটো চরণ উপহার দেবো না তোমায়, তা কি হয়??

“তুমি ছুঁয়ে দিলে আকাশটা নীল হয়,
রংধনু সাত রং ছড়ায়, জোনাক সাজে।
তোমার হাসিতে ফুল ফোটে, চাঁদ ওঠে,
মেঘ সরিয়ে ঝলমলিয়ে রোদ হাসে।

তুমি চাও বা না চাও
তোমার, শুধু তোমার জন্য প্রজাপতি রঙিন হয়,
কাজল চোখে স্বপ্ন খোঁজে।
রাত্রি শেষে সূর্য ওঠে
দুচোখে বৃষ্টি নামে, সাত সুরের বীনা বাজে।

তবু দূরে না গেলেই কি নয়?”

মেঘমালা, আমায় ভুলে যেওনা কখোনো, আমার স্মৃতিটুকু সাজিয়ে রেখো তোমার মনের কোন এক কোণে। কী, রাখবে তো??

তোমার “কবি”

আমার চোখের সামনে এক মুহূর্তের মধ্যে আমার পৃথিবীটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো, কবি কে ছাড়া যে আমি আর কিছু ভাবিনি, আর কাউকে চাই নি!! আমি মানুষটাকে চিনলাম না, প্রাণভরে দেখলাম না, অথচ সে হারিয়ে যেতে চায়!! অতি নিষ্ঠুর এই মানুষটাকে না দেখেই নিজের সর্বস্ব দিয়ে আমি ভালোবেসে ফেলেছি, তা তাকে কিভাবে বোঝাবো?? এত সহজে আমি তাকে হারিয়ে যেতে দেবো, তা কি হয়?? কিছুতেই কি হয়?? কিন্তু তাকে খুঁজ়ে পাওয়ার কোন রাস্তাই সে আমার সামনে খোলা রাখেনি। আমি একটা অন্ধগলির বন্ধ দরজায় মাথা ঠুকিয়েই যাচ্ছি। আমি নিশ্চিত জানি এই ছেলেটা যদি হারিয়ে যায়, আমার পৃথিবী ধূষর হয়ে যাবে। এতটা ভালো আমি কাউকে কোনদিন বাসিনি…

৩)
একটা মানুষ এতটা নিষ্ঠুর কি করে হতে পারে!! গত সাতটা দিন আমি অনাবরত তাকে খুঁজছি, খুঁজ়েই যাচ্ছি। সে যদি আমার চেনা কেউই হয়, তবে আমার কান্নাগুলো কি তার চোখে পড়ছে না? আমি নাওয়া খাওয়া প্রায় ভুলতে বসেছি। এক মুহূর্তের জন্য চোখ বুজলেই দেখতে পাই, কবি কোথায় যেন দূরে সরে যাচ্ছে। চার দেয়ালের ভেতরে আমার যন্ত্রণা গুলো পাহাড় চাপা পড়ছে। ভালোবাসার জন্য এই তীব্র হাহাকার আমার মনে স্থায়ী ভাবে আসন গেড়ে বসেছে। কষ্টগুলো নিংড়ে নিচ্ছে আমার অশ্রুর প্রতিটা কণা। খুব সম্ভবত আমি মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে এসেছি।

অনন্তকাল পরে আবার আমার ডোরবেলটা আজ অসময়ে বেজে উঠলো। আমি সেই মুহূর্তেই জানতাম, আমার জন্য বার্তা এসেছে, নীলাভ রঙের পাতায় লেখা প্রিয় বার্তা।

আজও দরজার ওপারে কোন কাব্য ছিলো না। প্রিয় বন্ধুর আহ্ববান ছিলো। ছোট্টো করে লেখা ছিলো,
“মেঘমালা, লনের কাছটায় দাঁড়িয়ে আছি, তোমায় একটু দেখবো বলে। তুমি কি আসবে??

হতভম্ব আমি ছুট লাগালাম লনের দিকে। আমার প্রিয় মানুষটা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমার জীবনের সবচেয়ে কাঙ্খিত মুহূর্তটি আমার সামনে উপস্থিত। কবি কে দেখে আমি কি বলবো, কি করবো কিছুই মাথায় আসছে না। আমি শুধু জানি স্বল্পতম সময়ে আমাকে পৌছতে হবে আমার প্রিয়র কাছে। এবার আর তাকে কিছুতেই পালিয়ে যেতে দেয়া হবে না। কিন্তু ওখানে গিয়ে আমি কাউকে পাইনি কেবল…

আমার বহু চেনা, বহু দেখা একজন মানুষ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাস্তবিকই সে আমার চোখে অতি সাধারণ একজন মানুষ ছাড়া আর কিছু ছিলো না কখোনোই, আমি রোজ কত শতবার তাকে দেখেছি, অথচ কখনো ভাবিনি, এই সেই মানুষ, যাকে ভেবে আমার প্রতিটা সকাল হয়। কখনো কল্পনা করিনি, প্রতিটা রাতে আমার স্বপ্নের আলো আঁধারীতে দেখা চেহারাটা আমার এত চেনা!! আমি খুব হতাশ চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

শোনা যায়না প্রায়, এমন নীচু স্বরে সে বলতে লাগলো, “আমি জানি তুমি আমাকে দেখে খুব হতাশ হয়েছো। ঠিক এ কারণেই আমি তোমার সামনে আসতে চাইনি। আমি চাইনি তোমার স্বপ্নভঙ্গ হোক। আমি চাই নি কবি নামের যে স্বপ্নীল চরিত্র তুমি নিজের মনে ভেবে নিয়েছো, তার মায়া তোমার ভেতর থেকে হারিয়ে যাক। আমি সব সময় তোমার কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে চেয়েছি। আমাকে আশ্রয় দিয়ে তোমার বাবা যে মহানুভবতা আমার প্রতি দেখিয়েছেন, তার সম্মান রাখতে চেয়েছি।

আমি গ্রামের খুব সাধারণ একটা ছেলে। সামান্য মেধা ছাড়া আর কিছুই বিধাতা আমাকে দেন নি। আর দশটা সাধারণ ছেলের মত আমিও সময়ের স্রোতে হারিয়ে যেতাম যদি তোমার বাবা আমাকে আশ্রয় না দিতেন। যদি আমার মেধার উপর তার বিশ্বাসটুকু না থাকতো। যে ছেলেকে প্রতি মুহূর্তে জীবনের বাস্তবতাকে মাথায় রেখে পথ চলতে হয়, মায়ের স্বপ্ন পূরণ, বাবার কাঁধের বোঝার ওঠানোর কথা ভাবতে হয়, তার জন্য এমন স্বপ্ন দেখাটা কত বড় ধৃষ্টতা, তা আমি জানি।

গ্রাম থেকে প্রথম যেদিন এসেছিলাম এখানে, তুমিই দরজাটা খুলেছিলে মনে আছে? হলুদ একটা জামা পরেছিলে। তোমাকে ঠিক গোলাপের মতো লাগছিলো, ভিষণ স্নিগ্ধ, ভিষণ পবিত্র। তারপর দুটো বছর আমি কেবল তোমার মুগ্ধতায় ডুবসাতার কেটেছি। কখনো তোমার সামনে দাঁড়ানোর সাহস হয় নি। দাঁড়িয়ে কি বলতাম তোমাকে? আমি যে স্রেফ একজন আশ্রিত। কখনো যদি তুমি হেসে দুটো কথা বলেছো আমাকে, আমি তা নিয়েই মেতে থাকতাম সারাবেলা। ওটাই যে আমার জন্য বিশাল প্রাপ্তি

বিশ্বাস কর, অনেক চেষ্টা করেও আমি তোমার মায়া থেকে দূরে থাকতে পারি নি। নিজেকে বহুবার বোঝাতে চেয়েছি, তোমাকে ভালোবাসা আমার শোভা পায় না, পারিনি। তোমাকে ভালোবেসে আমি এক নিষিদ্ধ আনন্দ পেয়েছি। তাই দূর থেকে ভালোবেসে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখো, সেটাও আমি পারলাম না। তোমার অস্থিরতা দেখে নিজের সাথে লড়াইয়ে কিছুতেই জিততে পারলাম না। আবারও হেরে গেলাম।

আমি জানি আজকের পর থেকে কবি নামটা তোমার মনকে আর বিরক্ত করবে না। তুমি আর নীল রঙা পাতায় লেখা কবিতার জন্য ব্যাকুল হবে না। বাস্তবতা চিরকালই রুপকথাকে হারিয়ে দেয়। আমার রুপকথার সমাপ্তিটাও এমনই হওয়ার ছিলো। তাই আমি আজই চলে যাবো। আর কখনো ফিরে আসবো না তোমাকে বিরক্ত করতে। জানি করবে না তবুও বলি, সম্ভব হলে ক্ষমা করো”

প্রতিবার আমি ঠিক জরুরী সময়েই ছন্নছাড়া হয়ে যাই। যা বলতে চাই, তা কখোনো বলা হয়ে ওঠেনা। কখনোই বোঝাতে পারি না, আমি কি চাই। কিন্তু আজ তা কোনভাবেই হতে দেয়া যাবে না। আজকের দিনটা আমার। আজ শুধু তাই ঘটবে যা আমি চাই। যা কিছু অপ্রাপ্তি, আজ তা দূরে থাক। তাই দৌড়ে গিয়ে আমি ওর হাত টা ধরলাম। আর গাধামানবটাকে বললাম

“যদিও আমার উচিত, কষে তোমার গালে দুটো চড় দেয়া, তবু শুধু কবিতাগুলোর কথা ভেবে এবারকার মত মাফ করে দিলাম। এরপর যদি কখনো আমাকে এভাবে কষ্ট দেয়ার কথা মাথায়ও আসে তোমার, তোমাকে খুন করবো আমি। আর এবারকার জন্য তোমার লঘু শাস্তি ধার্য করা হয়েছে। সেটা হলো আজ থেকে প্রতিদিন আজীবন, হলুদ নয় আমার টকটকে লাল গোলাপ চাই।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত