বছরঘুরে আরেকটা বসন্ত আসি আসি করছে নাকি চলেই এলো কে জানে। আমাদের বড় বাগানের জামরুল গাছটার ডালে দুটি কাশকুশো পাখি এই এঁটো দুপুরে ডাকাডাকির খেলায় মেতেছে। মন খারাপ করে শুনছি আর জানালা দিয়ে দুপুরের বিষন্ন নিঃস্তব্ধতার সঙ্গী হচ্ছি। কতবছর পরে বাড়ি এলাম আমি? মনে হচ্ছে এইতো সেদিনের কথা শহরের কলেজে পড়ার উদ্দেশ্য কাঁদতে কাঁদতে চেনা এই আকাশ নদী গ্রাম পশ্চিমের মাঠ , মায় বাগানের গাছে গাছে বাসা বোনা চিরচেনা সবপাখি দম্পতি খেলনার ঘুড়ি পিস্তল মার্বেল সবচেয়ে বড় কথা আমার সদ্য বিধবা হওয়া জনম দুঃখিনী মা কে ছেড়ে চাচার সাথে চলে গিয়েছিলাম ।
আজ মা চাচী সবাই ছুটোছুটি করছে এটা সেটা রান্নায়। এত আয়োজন কেন ? মায়ের জুলফিতে পাঁক ধরেছে। ছেলে পঁচিশ বছরের যুবক হলে মাকে বৃদ্ধ হতে হয় বৈকি।
আমার বড় চাচা চাচীর কোন ছেলেমেয়ে নাই। বংশের একমাত্র সন্তান হওয়ায় আদরের কমতি হয়নি আমার।
কেন জানি মায়ের উপর অভিমান করে সেদিনের পর আর গ্রামে ফিরিনি। মা কেঁদেকেটে কত চিঠিই না লিখেছেন। অভিমান একটাই যে মানুষটাকে আমি যমের মত ভয় পাই মা কেন আমাকে তার সাথে বড় শহরে পাঠালেন।
এসেই শুনি চাচা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। কি অদ্ভুত!
তারচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার গতরাতে অদেখা অচেনা কোন মেয়ের হাত আমার হাতে গেঁথে গেছে! চেয়ারম্যানবাড়ির সেই মেয়ে নাকি পড়াশোনা কাজেকর্মে এত তুখোড় আমি ছাড়া দশগ্রামে তার যোগ্য পাত্র আর কেউ নেই!
অনেকটা যন্ত্রের মত চাচার আদেশ অনুযায়ী কলেমা পড়ে গেছি।
মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন কয়েকবন্ধু মিলে শপথ করেছিলাম এ জীবনে বিয়ে করবনা ।
আর সেই আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই টের পেলাম আমি বিয়ে করে ফেলেছি! পৌরুষ বিসর্জন! অভিমানে দগ্ধ! এ আমি কি করলাম!
ঠিক করেছি আজ রাতের ট্রেনে শহরে ফিরে যাব। চাপিয়ে দেয়া কিছু অনেকেরই মেনে নিতে কষ্ট হয়। একটা জেদ কাজ করে।
আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে ঠিক তাই ।
কাউকে কিছু বলবনা। শুধু সাঁঝ নামুক। যে মেয়েটাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে সহ সবাইকে ত্যাগ করে রাতের ট্রেনেই বিদায় হবো।
-আপনার চা
-আমি দুপুরে চা খাইনা ।
রিনরিনে কন্ঠটা শুনে চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিতে দেরি করলামনা।
-আচ্ছা সিগারেট খাবেন? এনে দেব ?
অবাক হয়ে পিছন ফিরলাম। আর পিছন ফিরতেই আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলনা,বাকরুদ্ধ হয়ে গেলনা,কারো রূপের ছটায় অন্ধ হয়ে গেলাম না শুধু টের পেলাম আমার চোখ ফেরানর সাধ্য নেই। হায় আল্লাহ! আমার সামনে দাড়ানো এ মেয়েটি কে ! শ্যামবরণ এক দেবী যেন ঠোঁটে আঁচল কামড়ে ধরে দুঠোঁটের অভিমান সামলাচ্ছে। ডাগর চোখে নিষ্পাপ একটা চাহনী । কাঁপা স্বরে বলে উঠলাম, আমিতো সিগারেট খাইনা !
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল ।
হাসিতে সচকিত হয়ে টেবিলের উপর রাখা এশট্রেটা দেখে লজ্জায় পড়ে গেলাম।
-রাতে তবে সিগারেট কে খেল? মামদো ভূত?
কথার ভঙ্গি আর বাঁকা হাসি আমাকে শরত্ উপন্যাসের নায়িকাদের কথা মনে করিয়ে দিল ।
মেয়েটি একটু হেসে পিছন ফিরল । প্রস্থানের ইঙ্গিত।
আমার হঠাত্ কি হলো কে জানে হাত বাড়িয়ে তার দীঘল কেশ মুঠোয় চেপে ধরলাম।
টান খেয়ে মেয়েটি পিছন ফিরল।
তার চোখের পাতার কাঁপন আমার বুকে তীর হয়ে বিদ্ধ করল ।
প্রথমটায় অবাক শেষে খিলখিল করে হেসে ফেলে আমার বুকে একটা কিল দিয়ে চুল ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে গেল।
আমি থতমত খেয়ে বসে রইলাম । বুকের ভেতর ড্রামের শব্দ। আর অনেক গভীরে কোথায় যেন একটা বীনার তারে টুংটাং সুর বাজছে।
কোথায় গেল আমার মাঝদুপুরের জেদী সব চিন্তাভাবনা। লজ্জা মিশ্রিত বিস্ময়ে আমি আবিষ্কার করলাম একটু আগের আমি আর এখনকার আমি অনেক আকাশ পাতাল তফাত।
ভেতরটা তরল হয়ে আছে!
একটু শব্দ হলেই পেছন ফিরছি , কেউ আসে কিনা দেখছি! আশ্চর্য এ অনুভূতি। আমি কি গাধার মত এক লহমায় প্রেমে পড়ে গেলাম!
তখন বসন্ত নেই। আকাশে শকুনের পাল। পিছনের বাঁশ কাটা জানালায় ভেজা গাল চেপে বিষন্ন সে দাড়িয়ে আছে । ফিসফিস করে বলল
-আবার কবে আসবে? সবাইতো জানে তুমি মিলিটারি ক্যাম্পের ডাক্তার। চাচা তোমাকে দিনরাত গাল পাড়ে ।
আমি বিষন্ন হাসি ।
-দিক যত খুশি গাল দিক । এবার একেবারে দেশ স্বাধীন হোক। তারপর ফিরে আসব।
-সত্যি ফিরবে বলো ?
-কখনো মিথ্যে বলেছি নাসরিন?
শোনো ছেলে হলে নাম রেখো ফাল্গুন আর মেয়ে হলে ফাল্গুনি
-নিজের খেয়াল রেখো লক্ষীটি। ঠান্ডা লাগলে শালটা গায়ে দিয়ো। পুটুলিতে সন্দেশ আর মুড়ি আছে । খিদে পেলে খেয়ো। অযত্ন করবেনা । রেগুলার দাড়িগোফ কামাবে আমি শেভিং ক্রিম আর রেজর দিয়েছি ..
-হয়েছে চুপ! একদম চুপ
জানালায় দুহাত বাড়িয়ে ওর মুখ তুলে ধরলাম। ঠোঁটে কতশত আবেগ তবু কিছু বলতে পারছিনে কেন!
ওর দু চোখ টলমল করছে। ছুঁতে গিয়ে মনে হলো ঐ অশ্রু চোখেই থাকুক ছুঁয়ে দিলে পাপ হবে ।
-কি পাগল আমি তোমাকে ছেড়ে একদিন পালাতে চেয়েছিলাম ! কি পাগল আমি
বিড়বিড় করতে করতে হঠাত্ ঝটকা মেরে পিছ ফিরে চলে যেতে থাকি আমি।
আমার ভেতরটা চিত্কার করে শাসন করতে লাগল পাগল তোর যুদ্ধে যাওয়ার দরকার নেই , ঐ মমতামাখা মুখটা বুকে করে পালিয়ে যা!
কবে যে জ্বরের ঘোরে মাঝরাতে উঁকি দিয়েছিল দুটো মায়াকাড়া রাতজাগা চোখ, মমতার হাত। ভালবাসায় এফোঁড় ওফোঁড় পরিপূর্ণ আমি যার কপালের টিপ। আমার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত মা আমার সহধর্মিনী আমার প্রেয়সী।
চার মাস পূর্বের একটা নিঃস্তব্দ বসন্ত দুপুর, প্রথম প্রেমের সমস্ত অনুভূতি কে যেন একত্র করে দুচোখে বিছিয়ে দিলো। সেটুকু মুছে আমি সমস্ত শক্তি জড়ো করে পায়ে পায়ে হেঁটে যেতে থাকি।
এ পথ এত ঝাপসা লাগছে কেন।
যতক্ষন না আমি পথের বাঁকে হারিয়ে যাব সে তাকিয়ে রবে। সে ছাড়া আর কেউ জানেনা আমি যুদ্ধে যাচ্ছি।
না না না আমি পিছু ফিরব না। লাল শাড়ি গায়ে জড়িয়ে তীব্র ব্যথায় ব্যাকুল হয়ে প্রেয়সী কাঁদছে এ দৃশ্য সইবার শক্তি কোন পুরুষের নেই!
গাঁয়ের রাস্তাটা পশ্চিমের মাঠ হয়ে আকাশের সাথে মিশে গেছে। সাঁঝ নেমেছে। অন্ধকারে মিশে এখন আমার হারিয়ে যাওয়ার পালা।
রনক্ষেত্রে আমাকে ওদের দরকার । বড় দরকার!
ফিরে আসি বা না আসি সে আমার অপেক্ষায় থাকবে!
আর আমি তার ..
ফিরে আসি বা না আসি এই বিচ্ছেদ ব্যথার উপাখ্যান লিখবেনা ইতিহাস ..