অশুভ গলির তিন প্রেত

অশুভ গলির তিন প্রেত

নন্দীপাড়ার সরু রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম। শুক্কুরবার সকাল। মেঘহীন উজ্জ্বল দিন। ঢাকা শহরের এ দিকটা বেশ ঘিঞ্জি। অনেকদিন এদিকটায় আমার আসা হয় নি। নন্দীপাড়ায় এসেছিলাম জমি দেখতে। আমার জমি পছন্দ হয়নি। তাছাড়া নিষ্কন্ঠক বলে মনে হল না। আমি ব্যাঙ্কে চাকরি করি। জাল কাগজপত্র সহজে ধরতে পারি। দালালের সঙ্গে কিছুক্ষণ চোটপাট করে এখন রাগের মাথায় বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।

হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল- এদিকেই তো আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু ওয়াহেদরা থাকত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ওয়াহেদের সঙ্গেই দু-একবার ওদের নন্দীপাড়ার বাড়িতে এসেছিলাম ।যদিও ওয়াহেদ-এর সঙ্গে বহু বছর যোগাযোগ নেই। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ করি তখনও মোবাইল যুগ শুরু হয়নি। এটা এক কারণ। অন্য কারণ হল, আমি এম.এ পাস করেই অনেকটা তাড়াহুড়ো করে বিদেশ চলে গিয়েছিলাম। দীর্ঘকাল প্রবাস জীবন কাটিয়ে এই বছর দশেক হল দেশে ফিরে এসেছি।

আমি ওয়াহেদের খোঁজ নেব ঠিক করলাম। ও যখন এদিকেই থাকে হয়তো সেআমাকে দস্তুরমতো এক টুকরো জমির খোঁজ দিতে পারবে। তাছাড়া ওয়াহেদের সঙ্গে দেখা করার আরও একটা কারণ আছে। আমাদের সবারই বয়স এখন চল্লিশের কোঠায়। চুলে পাক ধরেছে। হার্টের অসুখ আর ডায়াবেটিস নিত্যসঙ্গী। এই সময়টায় পুরনো বন্ধুবান্ধবের জন্য মন হু হু করে।

সামান্য ঘোরাঘুরির পর ওয়াহেদরা যে গলিতে থাকত সেই গলিটা চিনতে পারলাম। গলির ভিতরে ঢুকলাম। ঢুকতেই আমার গা কেমন ছমছম করে উঠল। এর কোনও কারণ খুঁজে পেলাম না। অস্বস্তিকর অনুভূতি এড়াতে একটা সিগারেট ধরালাম। দু’পাশে আস্তর-ওঠা দেয়াল, নোংরা ড্রেন। দোতলা, তিনতলা সব বাড়ির লোহার গেট। ঝাঁপি-ফেলা মুদিদোকান। সিগারেট টানছি। আর হাঁটছি। বাঁ পাশে কচুরিপানা ভরতি একটা পুকুর।বাতাসে পানার গন্ধ ভাসছে। শুক্কুরবারে এমনিতেই ঢাকা শহরটা ঝিম মেরে থাকে। এই গলিতেও এই মুহূর্তে লোকজন তেমন চোখে পড়ল না। রোদটা কেমন মরাটে হয়ে এসেছে। তবে আকাশে মেঘ-টেঘ জমেনি।

ভাবছি ওয়াহেদরা কি এখনও এখানেই থাকে। ও খুব প্রাণবন্ত ছেলে ছিল। সারাক্ষণ বন্ধুদের মাতিয়ে রাখত। এম.এ পড়ার সময় হঠাৎই ওর বাবা মারা যান। তারপর ওয়াহেদ কেমন গুটিয়ে যায়। ভার্সিটি কম আসত। ওর মা বেঁচে ছিলেন না। শিউলি নামে ওয়াহেদের এক বোন ছিল। আমরা ওয়াহেদদের বাসায় গেলে শিউলি পরদার ওপাশ থেকে উঁকিঝুঁকি মারত।ট্রেতে চা আর পাপড় ভাজা নিয়ে খুব সেজেগুঁজে বসারঘরে আসত। শিউলি বেশ সুন্দরী ছিল দেখতে। ফরসা। ক্লাস নাইন কি টেনে পড়ত সম্ভবত। (ওয়াহেদ রক্ষণশীল ছিল, ও বোনকে চোখে চোখে রাখত) মনে আছে … ওয়াহেদদের বাড়িটা ছিল দোতলা। ওরাঅবশ্য একতলায় থাকত। দোতলা ছিল ভাড়া। আর একটা ফার্মেসি ছিল ওদের। ওর এক আত্মীয় বসত ফার্মেসিতে। তবে বাবা মারা যাওয়ার পর ওয়াহেদকেই ফার্মেসি দেখাশোনা করতে হত।তার আগে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সুরভী নামে একটি মেয়ের সঙ্গে ওয়াহেদের ভালোবাসার সর্ম্পক গড়ে উঠেছিল। তবে সুরভীর চরিত্রে অদ্ভূত এক দ্বৈততা ছিল। বেশ শান্ত, গম্ভীর, চশমা পরা সুরভী পড়ত সমাজকল্যাণ বিভাগে। শ্যামলা রঙের ছিপছিপে সুরভী কথাও বলত কম। সুরভী ছিল রাজশাহীর মেয়ে। ওর এক কাজিন (চাচাতো ভাই) পড়ত লোকপ্রশাসন বিভাগে। কালো স্বাস্থবান, গোলগালচেহারার শাহনেওয়াজ আর সুরভীকে প্রায়ই আমরা ক্যাম্পাসে, টিএসসিতে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখতাম। ওয়াহেদ, বরাবরই দেখেছি, শাওনেওয়াজকে একেবারেই সহ্য করতে পারত না। সুরভী নাকি বলত, তুমি অহেতুক শাহনেওয়াজ ভাইকে সন্দেহ কর ওয়াহেদ।
অবশ্য আমি সরাসরি এসব ঘটনায় যুক্ত ছিলাম না। দূর থেকে দেখতাম কেবল; আর পাত্রপাত্রীকে চিনতাম শুধু। আসলে এ রকম কত ঘটনার সাক্ষীছিলাম ইউনিভার্সিটি জীবনে। ওয়াহেদ-সুরভী আর শাহনেওয়াজ-এর ত্রিমূখী দ্বন্দটি ছিল সেরকমই একটি ঘটনা।
ওদের কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত?

কথাটা ভাবতে ভাবতে হাঁটছি। হঠাৎ দেখি- একটা শাটার-ফেলা একটা সেলুনের সামনে ওয়াহেদ। মাথায় ছোটছোট করে ছাঁটা লালচে শক্ত চুলে পাক ধরেছে মনে হল। লম্বাটে ফরসা মুখে খোচা খোচা পাকা দাড়ি। চোখে কালো ফ্রেমের পুরু লেন্সের চশমা। পরনে খয়েরি রঙের বার্মিজ লুঙ্গি আর কুঁকচে যাওয়া গোলাপি রঙের শার্ট। পায়ে রাবারের স্যান্ডেল। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ গোটানো।

ওকে দেখে সিগারেট ফেলে দিলাম। ওয়াহেদ আমাকে দেখেছে। চিনতে চেষ্টা করছে বলে মনে হল। চিনতে পেরে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, এনামুল না?
আমি হাসলাম। হ্যাঁ, দোস্ত। কেমন আছিস? ওয়াহেদ ফ্যাকাশে হাসল। উত্তর দিলনা। পুরু লেন্সের ফাঁকে ওর চোখ দুটি কেমন ঘোলা দেখালো। ঘোলা খুব শীতল মনে হল। মনে হল চোখ দুটি মার্বেলের তৈরি। হঠাৎ আমার কেমন শীত করতে থাকে। হঠাৎ বাতাসে আশটে গন্ধ পেলাম। মনে হল কাছেই কোথাও বেড়াল বা ইঁদুর মরে পড়ে থাকবে। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। বললাম, অনেক দিন পর। তাহলে তোরা এখানেই থাকিস?
ওয়াহেদ মাথা নাড়ল। বলল, বাপদাদার বাড়ি।
চারিদিকে তাকিয়ে বললাম, এ দিকটা এখনও আগের মতেই আছে। তা এখন কি করছিস তুই?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল ওয়াহেদ। বলল, আমরা এখনও ওই দোতলা বাড়ির এক তলায় থাকি ।বলে হাত তুলে একটা হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি দেখাল। বাড়ির সামনে প্রাচীর। খয়েরি গেইট। প্রাচীরের ওপাশে পেয়ারা গাছ চোখেপড়ে। বাড়িটা দেখেই চিনতে পারলাম।বেশ পুরনো দোতলা বাড়ি। মনে আছে ওয়াহেদ বলেছিল- ওরা ঢাকার স্থানীয় অধিবাসী। তবে কুট্টি নয়।
পাশ দিয়ে একটা খালি রিকশা চলে যায়। আতরের গন্ধ ভুরভুর পেলাম। অবাক হলাম। রিকশাওয়ালা কি আতর মাখে নাকি?
এনামুল । ওয়াহেদ খসখসে কন্ঠে বলে।
কি? বল।
দোস্ত। তুই এখন আমার বাড়ি গিয়ে বস। আমি একটু পরেই আসছি।
সে কী! তুই যাবি না? তুইও চল না।
না, না। তুই যা। আমি এখটু পরেই আসছি। বলে হনহন
করে হাঁটতে লাগল ওয়াহেদ।
ভাবলাম ওর হাতে বাজারের ব্যাগ। বাজার-টাজার করতে যাচ্ছে। আমার সামনে কেনাকাটা করতে লজ্জ্বা পাচ্ছে।
আমি হাঁটতে-হাঁটতে ভাবলাম- আশ্চর্য! আমি কি করি বা কোথায় থাকি- সেসব ওয়াহেদ জানতে চাইল না।আর ওর হাতে মোবাইলও নেই দেখলাম। তবে ওয়াহেদের সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই হলো।
(চলবে)

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত