একটা ডায়রী… ডায়রীটা পুরোটাই মিহিকে নিয়ে লিখা, আমার না বলা ভালোবাসা নিয়ে লিখা,,
ফ্রেন্ডশিপ নষ্ট হয়ে যাবে এটা ভেবে “ভালোবাসি” কথাটা বলতে না পারার গল্প নিয়ে লিখা…!!
.
প্রতিদিনের মতো আজকে রাতেও মিহিকে নিয়ে ডায়রী লিখছিলাম, হুট করেই টেবিলের উপর রাখা মোবাইলটা বেজে উঠলো,,
তাকিয়ে দেখলাম আমার বেস্টফ্রেন্ড রাহাতের কল… কলটা রিসিভ করলাম-
–হ্যালো রাহাত, এতো রাতে??
–মেহরাব, আমি লাস্ট কয়েকটা রাত ঘুমাতে পারছিনা দোস্ত… প্রতিটা রাত অনেক কষ্টে করে কাটছে, তুই কিছু কর প্লিজ !!
–কি হইছে তোর?? কোনো প্রবলেম?? আমি কি আসবো এখন?
–আরে না না… আমি আগামিকাল তোদের কলেজে আসবো, সবকিছু ওখানেই তোকে খুলে বলবো…!!
–আচ্ছা ঠিক আছে..!!
আমি ফোনটা কেটে দিয়ে আবারো ডায়রী লিখায় মন দিলাম, কিন্তু কেনো জানিনা আজকে ডায়রীটা লিখতে ভাললাগছেনা,
আর কতো রাত এভাবে ডায়রী লিখে কাটিয়ে দিবো? আর কতোদিন এভাবে আড়াল থেকে মিহিকে ভালোবেসে যাবো? এভাবে আর কতোদিন?
ডায়রীটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ মাথার উপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকলাম…
মনে মনে ঠিক করলাম আগামিকাল যেভাবেই হোক মিহিকে “ভালোবাসি” কথাটা বলতে হবে…
না বলা ভালোবাসার অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটানো অনেক বেশিই কষ্টের…!!
.
পরেরদিন একটু তাড়াতাড়ি কলেজে গেলাম, অপেক্ষা করতে থাকলাম মিহি আসার !!
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মিহিকে দেখলাম একটা রিক্সা থেকে নামছে… আমাকে দেখার সাথে সাথে আমার কাছে এসে বললো-
–মেহরাব? এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? মুখটা এরকম টেনশন টেনশন লাগছে কেনো? কিছু হইছে?
–আমি তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম মিহি…!!
–আমার জন্য অপেক্ষা?? সিরিয়াসলি?? মেহরাব সাহেব আমার জন্য অপেক্ষা করছেন? বাহহ…!!
–দেখ মিহি, আমি কিন্তু সিরিয়াস…আমি তোকে একটা জরুরী কথা বলার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম…!!
আমার কথাটা শুনে মিহি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, কপালে থাকা কয়েকটা চুল কানের ওপাশে নিতে নিতে বললো-
–জরুরী কথা? আচ্ছা বল !!
–মিহি… বিশ্বাস কর আমি তোকে অনেকদিন যাবৎ চেষ্টা করছি কথাটা বলার,
কিন্তু ভয়ে আর বলা হচ্ছেনা, এই দেখ এখনো বুকটা ধুক ধুক করছে…!!
আমার দিকে তাকিয়ে মিহি কেনো জানিনা মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো-
–বোকা ছেলে একটা… সাহস করে বলে ফেল !!
আমি চোখটা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলাম, তারপর মিহির চোখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললাম-
— মিহি… আমি তোকে~~
আমি কথাটা শেষ করতে পারলাম না, বুকটা অনেক বেশি ধুক ধুক করছে… মিহি আমার দিকে আস্তে আস্তে আরো ২পা এগিয়ে এসে বললো-
–হুম তুই আমাকে??
— মানে, আমি তোকে~~
আবারো কথাটা শেষ করবার আগেই পকেটে থাকা মোবাইলটা বেঁজে উঠলো… মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে দেখলাম রাহাত কল দিছে…
মিহির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও বিরক্ত ভাব নিয়ে আস্তে আস্তে ফিসফিস করে বলছে- “উফফফ, কলটা আসার আর টাইম পেলোনা”…!!
মিহির কাছ থেকে একটু দূরে এসে কলটা রিসিভ করলাম-
–হুম রাহাত? তুই না বললি আজকে আমাদের কলেজে আসবি,, তোর কি একটা প্রবলেমের কথা বলবি… কই তুই?
–দোস্ত শুন, আজকে অনেক জরুরী কাজ পড়ে গেছে… আজকে আর তোদের কলেজে আসতে পারবনা, কিন্তু কথাটা তোকে না বলেও থাকতে পারছিনা…!!
–খুলে বলতো, কি এমন কথা?
–তোর কলেজের একটা ফ্রেন্ড আছে না? নাম মিহি…!!
রাহাতের মুখে মিহির নাম শুনে মনের ভিতর কেনো জানিনা অজানা একটা ভয় কাজ করছিলো… আমি আমতা আমতা করে বললাম-
–হুম মিহি… কি হইছে মিহির?
–দোস্ত, মিহিকে আমি প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলছি, ওরে যেদিন তোর জন্মদিনের পার্টিতে দেখছিলাম,
সেদিন থেকেই মিহিকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলছি,
আমি ভাবছিলাম আমি নিজেই মিহিকে আমার মনের কথাটা বলবো, কিন্তু পরে ভাবলাম মেহরাব থাকতে আমি কেনো কষ্ট করবো?
মেহরাব বিশ্বাস কর… আমি প্রতিটা রাতে ঘুমাতে পারিনা, মিহির মুখটা চোখের সামনে ভাসতে থাকে…
তুই মিহিকে বল আমি মিহিকে অনেক অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি!!
আমি রাহাতের কন্ঠে কথাগুলো শুনবো কখনো চিন্তাও করিনি… আমি কি করবো এখন? বেস্টফ্রেন্ড?? না’কি ভালোবাসা??
আমি উপরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নেই… রাহাত আবারো ফোনের ওপাশ থেকে বলতে থাকে-
–মেহরাব? কিছু বলছিস না কেনো? প্লিজ দোস্ত, হেল্পটা কর !!
–আচ্ছা রাহাত… ধর মিহি অন্য কাউকে ভালোবাসে, বা তোকে ভালোবাসেনা, তখন তুই কি করবি?
–তুই থাকতে এরকমটা কেনো হবে মেহরাব? আর যদি এরকম হয়েও যায়, তাহলে বিশ্বাস কর…
আমি স্রেফ সুসাইড করবো, মিহিকে ছাড়া এখন আমি কিছু কল্পনাও করতে পারিনা !!
আমি আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রাহাতকে বললাম-
–চিন্তা করিস না দোস্ত, আমি আছিতো !!
–লাভ ইউ দোস্ত, আর মেহরাব শুন… মিহিকে বলিস আমি আগামিকাল সকাল ১১টায় সিলেট রেস্টুরেন্টে ওর জন্য অপেক্ষা করবো…!!
–ঠিক আছে !!
আমি ফোনটা কেটে দিয়ে আবারো মিহির সামনে গেলাম…!!
.
মিহির সামনে দাঁড়াতেই মিহি আমার গালে হাত দিয়ে বললো-
–হুট করে মুখটা এরকম বদলে গেলো কেনো মেহরাব?
আর এতো সময় কেউ ফোনে কথা বলে? যাইহোক… কি যেনো বলতে চাইছিলি, কথাটা পুরো কর !!
আমি মিহির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম… হয়তো পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজ এখন করতে যাচ্ছি…
“নিজের-ই ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের ভালোবাসার কথাটা না বলে এটা বলা যে, আমার বেস্টফ্রেন্ড তোমাকে ভালোবাসে…!!
–এরকম করে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেনো মেহরাব? কথাটা পুরো কর তাড়াতাড়ি !!
— আমি তোকে~~
আমি আবারো থামলাম, মিহি এবার বিরক্ত হয়ে বললো-
–উফফফফ, প্লিজ বল তাড়াতাড়ি…!!
–মানে… আমি তোকে বলতে চাচ্ছিলাম যে, আমার বেস্টফ্রেন্ড রাহাতকে তো চিনিস?
সেই ছোটবেলা থেকে আমার বেস্টফ্রেন্ড রাহাত…ও খুব ভালো ছেলে, তাইনা?
–আজব… এখানে রাহাত কোত্তেকে আসলো মেহরাব?
–রাহাত তোকে অনেক বেশি ভালোবাসে মিহি… আর আমি এটাই তোকে বলতে চাচ্ছিলাম !!
আমার কথাটা শুনে মিহি ২পা পিছন দিকে হেঁটে গেলো… কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-
–তুই এটাই বলতে চাইছিলি? এটাই তোর জরুরী কথা?
আমি মাথা নেড়ে হ্যা সূচক উত্তর দিলাম… মিহির দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখটা পানিতে ভরে গেছে,
যেকোনো সময় কান্না শুরু করে দিতে পারে… আমি মিহিকে আবারো বললাম-
–রাহাত তোকে অনেক সুখে রাখবে মিহি !!
–চুপ,, জাস্ট চুপ মেহরাব… আমি তোকে ক্লিয়ার করে বলছি, “আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি,, খুব বেশিই ভালোবাসি…
আর আমি জানি সেও আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু সেটা মুখ দিয়ে বলতে পারছেনা,
আমি এটাও জানি তার মুখ থেকে একদিন “ভালোবাসি” শব্দটা শুনবোই,, নেক্সট টাইম অন্য কারো কথা নিয়ে আমার সামনে আসবিনা..!!
কথাটা বলে মিহি চলে যাচ্ছিলো, আমি মিহিকে পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললাম-
— আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রাহাতকে এক্সেপ্ট করে নি,, প্লিজ…!!
মিহি আমার দিকে ফিরে তাকালো, ডান হাত দিয়ে চোখটা মুছে বললো-
–তুই এটাই চাস?
আমি মাথাটা নিচু করে “হ্যা” বললাম… মিহি আবার বললো-
–ঠিক আছে, তুই যখন এটা চাস, তাহলে এটাই হবে…!!
কথাটা বলে মিহি চলে যায়, আমিও বাসায় চলে আসি…!!
.
“৬বছর পর”
.
অনেকদিন হয়ে গেলো ডায়রীটাকে হাতে নেওয়া হয়না… অফিসের চাপ, সংসারের চাপ, সবমিলিয়ে দিনটা কিভাবে কেটে যায় বুঝতেই পারিনা… আজকে অনেকদিন পর ডায়রীটা হাতে নিলাম, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম ডায়রীটার দিকে…
কিছুটা ধুলো জমে গেছে ডায়রীটার মধ্যে… ডায়রীটা মুছতে মুছতে মিহিকে ডাক দিয়ে বললাম-
–মিহি একটু এদিকে আসো…!!
–উফফফ মেহরাব, কাজের সময় জ্বালাতন না করলে ভালো লাগেনা তাইনা? ডাকলে কেনো বলো?
আমি ডায়রীটা মিহির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম-
–মনে আছে ডায়রীটার কথা?
মিহি ডায়রীটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো-
–এই ডায়রীটাকে কখনো ভুলা যায় বলো?? আমার জীবনের সুখ তো এই ডায়রীটাই এনে দিছে তাইনা?
আমি মিহির কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকি…
মিহিও ডায়রীটা হাতে নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে… জীবনের সুন্দরতম মুহুর্ত…!!
.
সেদিন রাতে ডায়রীটাতে শেষ বারের মতো কিছু লিখছিলাম…
এতোদিন অবশ্য ডায়রীর মধ্যে আমার আর মিহির নামটাই ছিলো, কিন্তু সেদিন ডায়রীটায় নতুন একটা নাম লিখছিলাম,
আমার-ই বেস্ট ফ্রেন্ড রাহাত…!!
সেদিন রাতে অনেক কান্না করছিলাম… কান্না করতে করতে ডায়রীটা লিখছিলাম, আমার গল্প… আমার না বলা ভালোবাসার গল্প…
মিহিকে পেয়েও হারানোর গল্প… ডায়রীটা লিখতে লিখতে কবে যে টেবিলের উপর ঘুমিয়ে পড়ছিলাম নিজেই জানিনা,
ঘুমটা যখন ভাঙলো তখন সকাল ১১টা বাজে…
আমি মাথাটা ঘুরে ডান দিকে তাকাতেই দেখি রাহাত আর মিহি দাঁড়িয়ে আছে… আমি কিছুটা অবাক হই, ওরা এখানে কেনো আসলো?
আমি তাড়াতাড়ি টেবিলের উপর তাকিয়ে দেখলাম আমার ডায়রীটা টেবিলের উপর নেই…
আমি টেবিলের নিচে তাকাতে যাবো ঠিক এমন সময় রাহাত ডায়রীটা এগিয়ে দিয়ে বললো-
–এটা খুঁজছিস দোস্ত?
আমি রাহাতের দিকে বড় চোখ করে তাকিয়ে ডায়রীটা হাতে নিলাম, ওদের চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে ওরা ডায়রীটা পড়ে ফেলছে…
আমি আমতা আমতা করে রাহাতকে বললাম-
–মানে, দোস্ত এই ডায়রী ~~
আমার কথা শেষ করবার আগেই রাহাত আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে বললো-
–দোস্ত, তুই আমার জন্য তোর এতোদিনের ভালোবাসা~~
রাহাত আর কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে কান্না করা শুরু করে দিলো…!!
কি হচ্ছে এসব আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, আমি রাহাতকে বললাম-
–তুই এতো সকালে এখানে কেনো আসলি? আর মিহিও বা কেনো এখানে আসলো?
–গতকাল রাত থেকে তোকে ফোন দিয়েই যাচ্ছিলাম, কিন্তু তুই রিসিভ করছিলি না…
মিহি আমাকে ভালোবাসে কি’না, সকাল ১১টায় রেস্টুরেন্টে আসবে কি’না এটা জানার জন্যই আজকে তোর বাসায় আসছিলাম,
আর তার রুমে এসে এই ডায়রীটা পড়লাম, ডায়রীটা পড়ে আমিই মিহিকে কল দিয়ে এখানে আসতে বলছি…!!
–কিন্তু রাহাত, তুই তো মিহিকে ভালোবাসিস…!!
–তুই বাসিস না?? আর তাছাড়া মিহি তোকেই ভালোবাসে মেহরাব, আর মিহি তোর সাথেই সুখে থাকবে…!!
আমি মিহির দিকে তাকালাম, চুপ করে মাথাটা নিচু করে কান্না করেই যাচ্ছে মেয়েটা… রাহাত আবারো বললো-
–আব্বু গতকাল রাতে ফোন দিয়ে বলছে আমার টিকেট রেডি,,
২-১দিনের ভিতর আব্বু-আম্মুর কাছে বিদেশ চলে যাবো, ভাবছি আব্বু-আম্মুর মতো ওখানেই থেকে যাবো…
আমার জন্য টেনশন করিস না, ভালো থাকিস তোরা…!!
আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই রাহাত হাঁটা শুরু করে দিলো…
রাহাত রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে মিহি দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করা শুরু করে দিলো,
অনেক জোরে জোরে কান্না করছিলো মেয়েটা,, কান্না করতে করতে বলছিলো-
–ডায়রীতে এতো কিছু লিখতে পারিস, মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারিস না??
আমি মিহির চুলগুলো কান থেকে সরিয়ে ফিসফিস করে বললাম “ভালোবাসি”…
কথাটা শুনার পর মিহি আমার দিকে তাকিয়ে আর কিছু বললো না.. স্রেফ আরো জোরে আমায় জড়িয়ে ধরলো… অনেক বেশি জোরে…
ভালোবাসার মানুষটাকে প্রথম অনেক জোরে জড়িয়ে ধরা… জীবনের সবচাইতে সুন্দর মুহুর্ত নয় কি??