“পরলে প্রেমে মানুষের মন হয় আনমনা।
ভাবতাম আমি ভালবাসা পাগলের কান্ড কারখানা।
সেই আমার একি হলো, ভালবেসে মন হারালো।
এখন রাত্রি জেগে, ভাল লাগে ভাবতে যে তাকে।”
গানটার মতই ঠিক এমনিই নিত্তিয়ার প্রেমে পরে আমি নিজেই বদলে গেছি। আগে অনেক দুষ্টু ছিলাম তবে আমার চেয়ে বড় মাপের দুষ্টুর কাছে তো আমায় হার শিকার করতেই হলো। নিত্তিয়ার সাথে আমার প্রথম দেখাটা একটু ঝগড়ার আর তারপর অল্প অল্প কাছে আসা আর শুরু হয়ে যায় ভালবাসা।
সকালে এলাকার একটি দোকানের সামনে বসে সব বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছি। তখন আমার গায়ে একটা ক্রিকেট বল লাগলো। বলটা আমার ডান পাশের গালে লাগলো। অনেকটা ব্যাথা পাওয়ার কারনে রাগ নিয়ে বলটা হাতে নিয়ে ডান দিকে তাকালাম। দেখি দুইটা ছোট ছোট ছেলে মিলে রাস্তায় ক্রিকেট খেলছে। কিন্তু এদের তো আগে কখনো দেখি এলাকায়। তবে শুনেছি আমাদের বাসার পাশের বাসায় নাকি নতুন কোন ভাড়াটিয়া আসার কথা। যাই হোক, যেহেতু আমরা এলাকার বড় ভাই তাই আমার গায়ে বল লাগার কারনে তো শাস্তি পেতেই হবে। তাই আমি ছেলেটাকে ইশারা দিয়ে সামনে আসতে বললাম।
— এই যে হাফ টিকিট এদিকে আয়।
— সরি ভাইয়া আসলে আমি খেয়াল করি নি।
— বুঝলাম, তোর নাম কি? আর তোকে তো আগে কখনো এই এলাকায় দেখি নি।
— আমরা গতকাল রাতে ওই যে ২ তলায় ভাড়া এসেছি। আর আমার নাম হৃদয়।
— গুড আচ্ছা হৃদয় তুই আমায় চিনিস? আমার গায়ে যে বল লাগছে তাই আমি তোর কি করতে পারি জানিস?
— যেহেতু গতকাল মাত্র আসলাম এখানে তাই আপনাকে চিনার তো কোন প্রশ্নই আসে না।
— ও তাও তো ঠিক। কিন্তু শাস্তি তোমায় পেতেই হবে এবার শাস্তিটা কম হোক বা বেশি। যেহেতু তুই নতুন তাই আমি শুধু তোর বলটা রেখে দিচ্ছি। আর এবার থেকে মাঠে খেলবি। রাস্তায় খেলতে দেখলে তোর হাতের ব্যাট টাও নিয়ে নিবো।আর শুন আমার নাম রাজ। এই এলাকার সবাই আমায় চিনে। তুইও চিনে নে।
— ওকে।
ছেলেটা আমার সামনে থেকে চলে গেল। আর মাত্র ২টা বছর আছে আমার ভার্সিটি লাইফ শেষ হয়ে যাবে। তাই ছাত্র জীবন যতদিন আছে ততদিন একটু মজা করে নেই। এখন থেকে দুষ্টামীটাও একটু বাড়িয়ে নিবো। আবার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠলাম। কিন্তু আমার হাসতে ব্যাথা করছে কারন বলটা জোরেই লেগছে।হঠাৎ ডান পাশ থেকে আমার নাম ধরে একটা মেয়ে ডাক দিলো…
— আপনাদের মাঝে রাজ কে?
আমি মেয়েটার দিকে তাকাতেই একটু শক খেলাম। মেয়েটা কোমড়ে ওড়নাটা এমন ভাবে বেধেঁ আসছে যে আমার সাথে মনে হয় ঝগড়া করবে। কিন্তু মেয়েটা কিউট বললেও ভুল হবে কারন মেয়েটা একদম ঝাক্কাস।
— এই যে আমি তো প্রশ্ন করছি আপনাদের মাঝে রাজ কে? ( মেয়েটার ডাকে বাস্তবে ফিরলাম)
— আমি, কেন কি হয়েছে?
— ও আপনার হাতের ক্রিকেট বলটা ফেরত দেন।
— কেন?
— কারন এটা আমার ভাই হৃদয়ের বল।
— ও ওই হাফ টিকিট টা তোমার ভাই লাগে বুঝি।
— একদম মুখ সামলে কথা বলেন।
— বলবো না। ও আমার মুখে বল মারছে আর আমি ব্যাথাও পাইছি তাই আমি বল রেখে দিছি।
— রাস্তায় ক্রিকেট খেললে বল লাগবে স্বাভাবিক। তাই বলে বল রেখে দেওয়াটা ঠিক না। আর ছোট থাকতে আপনারাও তো ক্রিকেট খেলছেন আর মানুষের বাসায় বল মারছেন। এবার নিজের ছোট বেলার কথা ভেবে বলটা দিয়ে দেন।
–বাহ্ খুব ভাল যুক্তিবিদ্যা পারো তো দেখছি।
— নিত্তিয়া কথায় কথায় যুক্তি দিতে খুব ভালই পারে।
– নিত্তিয়া কে?
— এই যে আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে আর বলটা দেন তো।
— হুমম নাও ( বলটা নিত্তিয়ার দিকে এগিয়ে দিলাম)
নিত্তিয়া আমার হাত থেকে বলটা নিয়ে চলে গেল। আমিও ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিত্তিয়া আমার বাসার আগের বাসাটায় ডুকে গেল। কি মেয়েরে বাবা,আসলো রাগি ভাব নিয়ে আর যুক্তি দিয়ে বলটা নিয়ে চলে গেল।তখন আমার পাশে বসা তুহিন বলল…
— কিরে মেয়েটা তোরে বোকা বানিয়ে বলটা নিয়ে চলে গেল আর তুই চুপ করে ছিলি?
— মাঝে মাঝে হার শিকার করতেই হয় আর হেরে গিয়ে জিতে যাওয়াকে বাজিগর বলে।
— হুমম তুই অলরেডি হেরেই আছিস।
— কী?
— না মানে এখানে তুই হেরে গিয়ে কি জিততে পারিস?
— স্বয়ং নিত্তিয়াকেই।
— বাহ্ বাহ্
তারপর আবার সবার সাথে আড্ডায় ফিরে গেলাম। তবে আড্ডার ফাঁকে আমার পকেট টা একটু হালকা হয়ে গেল। কারন, নিত্তিয়াকে আমার ভাল লাগার কারনে সবাইকে খাওয়াতে হয়েছে। হায়রে বন্ধু মহল তোদের যে কি দিয়ে উপরওয়ালা বানাইছে এটা শুধু ওনিই জানেন। কাউকে ভাল লাগলে ট্রিট,প্রেম করলে ট্রিট, ঝগড়া করলে ট্রিট, অসুস্থ হলে ট্রিট আবার ব্রেকআপ হলেও ট্রিট।
একদিন বিকালে ছাদের গাছ গুলোর আগাছা পরিষ্কার করতে ছিলাম। তখন আমাদের ছাদের শুকাতে দেওয়া আমার একটা গেঞ্জি বাতাসে উড়ে নিত্তিয়াদের ছাদে গিয়ে পড়লো। আর আমাদের থেকে নিত্তিয়াদের ছাদের দূরত্ব এক হাত হওয়ায় আমি আমাদের ছাদে থেকে ওদের ছাদে গিয়ে গেঞ্জিটা নিয়ে আসার সময় আমার পা লেগে ওদের ছাদের একটা ফুলের টপ পড়ে গেল। আর তখনই নিত্তিয়া ছাদে চলে আসলো। ও শুধু দেখছে আমার পা লেগে ওদের একটা ফুলের টব পড়ে গেছে। আমি তারাতারি আমার ছাদে চলে আসলাম। ও আমায় ডাক দিলো…
— ওই আপনি আমাদের ছাদে কি করছিলেন?
— আমার গেঞ্জি পড়ে গেছিল তাই আনতে গেছিলাম।
— একদম মিথ্যা বলবেন না। আমি নিজের চোখে দেখলাম আপনি আমার ফুলের টবটা ফেলে দিছেন।
— ও এটা বুঝি তোমার ফুলের টব ছিল। আসলে খেয়াল করি নি তো। খুব মায়া হচ্ছে ফুলের টবের জন্য।
— একদম কথা ঘুরাবেন না। আমি আজ আপনার মায়ের কাছে বিচার দিবো?
— কি বিচার দিবে?
— বলবো যে আপনি আমার ফুলের টবটা ইচ্ছাকৃত ভাবে লাথি দিয়ে ফেলে দিছেন।
— কিন্তু আমি তো এটা করি নি
— কিন্তু আমি তো নিজের চোখে তাই দেখলাম।
— ওই চোখের দেখাই কি শেষ নাকি?
— একদম তাই। আচ্ছা ধরেন আপনি একটা মিষ্টির দোকান চালান। আর আপনার দোকানে কিছু পিঁপড়ে কর্মচারী আছে। এখন প্রতিদিন আপনি খেয়াল করছেন যে, দোকান থেকে গণনা করা মিষ্টি থেকে মিষ্টি কমে যায়। এখন কি এই মিষ্টি কমে যাওয়ার জন্য সকল পিপড়েকে শাস্তি দিতে পারবেন।
— না তো।
— তাই আপনাকে নজর রাখতে হবে কোন পিপড়ে মিষ্টি চুরি করে। তাই একদিন রাতে আপনি জেগে দোকানে গিয়ে দেখলেন সব পিপড়ের মাঝে ৪ নাম্বার পিপড়েটা মিষ্টি খাচ্ছে। এখন আপনি সব পিপড়ের মাঝে কোন পিপড়েটাকে শাস্তি দিবে।
— অবশ্যই ৪ নাম্বার পিপড়েকে।
— গুড, এবার বলেন আপনি যেই কারনেই আমাদের ছাদে আসেন না কেন আমি আপনায় কি করতে দেখছি?
— ফুলের টব ফেলে দিতে।
— তাহলে এখন আপনার মায়ের কাছে আমি কিসের বিচার নিয়ে যেতে পারবো।
— ফুলের টব ফেলে দেওয়ার জন্য।
— ওকে আপনি একটু দাঁড়ান আর আমি বিচারটা দিয়ে আসি।
— ওকে, ওই না একদম যাবে না। তাহলে মায়ের থেকে কথা বাবার কানে যাবে আর আমায় বকবে। এমনি পড়াশুনার জন্য বকা খেতে খেতে এতো দূরে এসেছি।
— ওকে যাবো কিন্তু এখন আপনি তারাতারি এসে ফুলের টবটা আগের জায়গায় রেখে যান।
— একটাই তো ফুলের টব। নিজেই তুলে রাখো না।
— ওই আসবেন নাকি আপনার মায়ের কাছে যাবো।
— আসছি তো, এভাবে ব্লেক মেইল কেন করো? ভাবলাম কিউট একটা মেয়ে। তাই পটিয়ে একটু প্রেম করবো কিন্তু তা না শুধু ব্লেক মেইল করে আর যুক্তিবিদ্যা দেখায়।
— কী বললেন?
— না আসছি তো।
তারাতারি আবার ওদের ছাদে আসতে গিয়ে একটা ফুলের টব তোলার বদলে আরো তিনটা ফুলের টব ফেলেই দিলাম।নিত্তিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি ও খুব রাগি রাগি চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি কোন মতে সব গুলো ঠিক করে দিয়ে চলে আসলাম।আর নিত্তিয়াকে দেখে মনে হলো ও মুখ চেপে হাসার চেষ্টা করছে।
এভাবে দিন গুলো ভালই কাটতে লাগলো। নিত্তিয়ার সাথে আমার মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি আর ঝগড়া হয়। কিন্তু আমি তো মন থেকে নিত্তিয়াকে ভালবাসতে শুরু করে ফেলেছি। আগে বিশ্বাসই করতাম না ভালবাসলে নাকি মানুষ বদলে যায়। কিন্তু যখন থেকে আমি নিত্তিয়ার প্রেমে পড়েছি তখন থেকে নিজেই বদলে যেতে শুরু করেছি। এখন আড্ডা দিতে গেলেও শুধু ভাবি একটু যদি নিত্তিয়াকে দেখতে পারতাম। একটু যদি নিত্তিয়ার আশে পাশে থাকতে পারতাম। সব সময় নিত্তিয়াকে নিয়ে ভাবি। কবির ভাষায় বললে বলতে হয় ” আমি নিত্তিয়াকে চোখ খুলে যতটা দেখি তার চেয়েও বেশি দেখি যখন চোখ বন্ধ করি “। শুধু নিত্তিয়াই আমায় বুঝলো না আমি ওরে কি পরিমান চাই।
একদিন সকালে ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ অনেক চেঁচামিচির আওয়াজে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। যতই ঘুমানোর চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই ঘুমাতে পারছি না। মনে হচ্ছে, নিত্তিয়াদের রুম থেকে এতো আওয়াজ আসছে আর গলাটাও নিত্তিয়ার লাগছে। তাই আমি আর শুয়ে না থেকে মায়ের কাছে গেলাম।
— ও পাশের বাসায় এতো আওয়াজ কিসের?
— আমি কি করে বলবো বল তো? তবে যতদূর শুনেছি আজ নাকি নিত্তিয়াকে কোন ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে কিন্তু নিত্তিয়া বিয়ে করতে চায় না।
— যাক বাবা বাঁচা গেল যে ও বিয়ে করতে চায় না।(আস্তে আস্তে বললাম)
— মানে?
— না মানে ও কেন বিয়ে করতে চায় না এটা কি জানো?
— শুনেছি কোন এক ছেলেকে নাকি ও ভালবাসে।
— না এটা হতেই পারে না। ( একটা শক খেলাম)
— কেন?তোর কি হলো?
— না মানে? ওর মত ঝগড়াটে মেয়ে ভালবাসার মত আবার কেউ আছে নাকি।
— কি জানি বাবা? আমার এসব জেনে লাভ নেই। তুই আবার কোন মেয়ের চক্করে জড়িয়ে পড়িস না যেন।
— এমনি তো ওই মেয়ের চক্করে পড়েছি আর ওই মেয়ে নাকি অন্য কাউকে ভালবাসে।
— কিছু বললি? নিজে নিজে কি কথা বলছিস।
— না মা তেমন কিছু না। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি তুমি খেতে দাও।
— ওকে যা।
আমি ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। ওই নিত্তিয়ার সাথে আমার কথা বলতেই হবে। ক্রাশ খাবো আমি, এক তরফা প্রেম করবো আমি আর নিজে অন্য কাউকে ভালবাসবে। নিত্তিয়াকে আমার চাই না বরং এতদিন যে ওরে ভালবাসলাম এই ভালবাসাটা আমায় ফিরিয়ে দিতেই হবে।
সকালের খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি এলাকার মোড়ের উদ্দেশ্যে বের হলাম। কারন, এই পথ দিয়েই নিত্তিয়া ভার্সিটি যাবে। আর আমি আর ওর পিছু নিবো। দেখি কোন ছেলের সাথে ও প্রেম করে। এলাকার মোড়ে আধা ঘন্টা ওয়েট করার পর নিত্তিয়াকে আসতে দেখলাম। অন্য সময় নিত্তিয়া রিকশা নিয়ে ভার্সিটি যায় কিন্তু আজ তো হেঁটেই আসছে। তাই আমিও চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম। এভাবে ১০ মিনিট হেঁটে হেঁটে একটা পার্কের সামনে এসে নিত্তিয়া আমার দিকে ফিরে তাকালো।আর আমার উদ্দেশ্যে বলল…
— এই যে মিষ্টার রাজ, এভাবে আমার পিছু নেওয়ার মানে টা কি?
— তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।
— পারমিশন না নিয়েই বলে ফেলেন।
— তুমি কাকে ভাললবাসো? যার জন্য বিয়েটা ভেঙ্গে দিছো।
— ও এই ব্যাপার। তাছাড়া আপনাকে আমি এই প্রশ্নের উত্তর কেন দিতে যাবো?
— এমনি জানতে চাইছি।
— না আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড লাগেন আর না আমার পরিবার আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছে আমার বয়ফ্রেন্ড কে খুঁজার?
— এতো কিছু জানি না, শুধু জানতে চাই তোমার বয়ফ্রেন্ড কে?
— আচ্ছা ধরেন এখন যদি আমার বয়ফ্রেন্ড না থাকতো আর আমার বিয়ে হয়ে যেতে তাহলে কি আপনি খুশি হতেন?
— জানি না তবে প্লীজ বলো তোমার বয়ফ্রেন্ড কে?
— আপনি আমার কি লাগেন যে আপনাকে আমার ব্যক্তিগত কথা বলবো?
— ও তাও তো ঠিক। আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও। বায়
— ওকে
আর না দাঁড়িয়ে চলে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম। এখন খুব কষ্ট হচ্ছে। তখনই নিত্তিয়া বলল….
— মিস্টার রাজ, আপনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে যাকে দেখতে পান আমি তাকেই ভালবাসি।
— হুমম যাও ভালো।( কিছু না ভেবে বলে দিলাম)
হঠাৎ নিত্তিয়ার কথাটা বুঝার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমি নিত্তিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে যাকে দেখি তাকে নিত্তিয়া ভালবাসে। তার মানে,আমি যদি নিত্তিয়ার দিকে তাকাই তাহলে তো আমি নিজেকেই দেখতে পারবো। তার মানে নিত্তিয়া আমায় ভালবাসে। এই কথাটা বুঝতে এতে সময় নিলো। আমি আর না ভেবে পিছনে তাকালাম কিন্তু নিত্তিয়া কোথায়? ও কি চলে গেল। তখনই পাশে থেকে কেউ বলল…
— আচ্ছা কাউকে খুঁজচ্ছেন বুঝি?
আমি পাশে ফিরতেই দেখি নিত্তিয়া। আর তখন যে আমার মাঝে কেমন একটা ফিলিং কাজ করছিল তা বুঝাতে পারার মত না। শুধু নিত্তিয়ার হাতটা অনেক শক্ত করে ধরে রেখেছি । আর ওর পাশে হাঁটতে লাগলাম।
এভাবে খুব ভালই ভাবেই দিন গুলো কাটতে লাগলো। আমার প্রতিটা দিন শুরু হয় নিত্তিয়ার ফোনে আর ঘুম আসে নিত্তিয়ার ফোনে। এমন ঝগড়াটে মেয়ে যে এত্তো কেয়ার নিয়ে ভালবাসতে পারে তা কল্পনাও করতে পারি নি। নিত্তিয়া আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার হয়েছে। ও আমার লেখাপড়ার খুঁজ নেয় আর না পড়লে এই করবে সেই করবে হুমকি দেয়। কিন্তু কথায় আছে না বেশি সুখ কপালে টিকে না। তেমনি আমারও টিকে নি।
একদিন আমি ভার্সিটি থেকে ব্যাংকে গিয়েছে আমাদের বাসার কারেন্ট বিল আর গ্যাস বিল জমা দেওয়ার কারনে। আজ বিলের শেষ তারিখ তাই অনেক ভিড়। তবুও আমি কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। তখনই নিত্তিয়ার ফোন আসলো আর আমি ফোনটা রিসিভ করলাম…
— মিস যুক্তিবাদী বলো এই অসময়ে ফোন দেওয়ার কারন কি?
— ওই বার বার যুক্তিবাদী বলবে না তো। আচ্ছা আগামীকাল তো হ্যাপি নিউ ইয়ার তাই বলো তোমার কি গিফট লাগবে? আমি এখন শপিং মলে আছি।
— তুমি আমায় কি দিতে চাও ওইটা বলো?
— যা চাইবে তাই।
— পাক্কা যা চাইবো তা দিবে তো।
— একদম পাক্কা।
— পরে চাইলে কিন্তু না করতে পারবে না।
— ওকে না করবো না। এবার বলো কি চাও?
— বেশি কিছু না তোমার আইডি কার্ড দিয়ে আমায় একটা এয়ারটেল সিম কিনে দাও তো। আসলে অন্য সিমে কথা বললে টাকাটা একটু বেশি কাটে।
— হা হা হা তুমিও না ওকে দিবে নে। এটা বাদে কি চাও বলো?
— কিছুই না। আপাতত তুমি বলো আমার কাছে কি চাও?
— তেমন কিছু না শুধু সবার প্রথম হ্যাপি নিউ ইয়ার জানালেই হবে।
— হুমম জানাবো।এবার তুমি ভালভাবে বাসায় এসো তো। এমনি রাস্তাঘাটের অবস্থা ভাল না।
— ওকে মশাই আসছি।
তারপর ফোনটা রেখে দিলাম। পাগলী একটা, সব সময় আমায় ফোন দিয়ে বলবে এটা করবে না ওইটা করবে। আমি প্রায় ১ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে গ্যাস বিল আর বিদ্যুৎ বিল জমা দিয়ে মাত্র ব্যাংক থেকে বার হই তখনই আমার মোবাইলটা বেঁজে উঠে। তাকিয়ে দেখি নিত্তিয়া ফোন দিয়েছে। উফ পাগলীটা কি আমায় না বলে কিছু কাজ করতে পারে না?
— হুমম পাগলী বলো।
— হ্যালো আপনি কি রাজ?( অপরিচিত একটা ছেলে কন্ঠ)
— জ্বি কিন্তু আপনি।
— আমায় আপনি চিনবেন ন।। আমি সদর হাসপাতাল থেকে বলছি। আসলে একটা মেয়ে এক্সিডেন্ট করছে আর তার পাশে এই মোবাইলটা পাওয়া গেছে। আপনি একটু তারাতারি হাসপাতালে আসেন।
ওই লোকের কথা শুনে আমার সব কিছু যেন থেমে গেল। যখন হুশ আসলো তখন হাসপাতালের দিকে দৌঁড়াতে লাগলাম। আমি হাসপাতালে যাওয়ার আগে নিত্তিয়ার বাসায় একটা ফোন দিয়ে দেই। আমি দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে ইমার্জেন্সি রুমে চলে যাই দেখি নিত্তিয়ার মাথা ব্যান্ডেজ করা। পাশে ডাক্তার দাঁড়িয়ে কি যেন করছে?
— ওর কি হয়েছে ডাক্তার?
— ও এসেছেন। আসলে ১ ঘন্টা আগে ওকে হাসপাতালে আনা হয়। আঘাতটা মাথায় লেগেছিল তাই অনেক রক্ত যায়। হাসপাতালে রক্ত ছিল বলে আমরা ব্যবস্থা করতে পেরেছি। আর সঠিক সময় ওনাকে হাসপাতালে না আনতে পারলে হয়ত ও মারাই যেতো। তবে ও কবে সুস্থ হবে আমরা শিউর বলতে পারি না। ও সব দেখতে পারবে আবার শুনতেও পারবে। কিন্তু ও যদি কোন কারনে শক খায় তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। ওকে এমন কিছু বলো না যেন ও শক খায়। আপাতত ওকে ঘুমের ঔষুধ দেওয়া আছে। আর ওর বাসার লোক কোথায়?
— ওরা আসছে।
কিছুক্ষন পর সবাই চলে আসে আর আমি ওদের সব খুলে বলি। কিন্তু সবাই কান্নাকাটি করতে থাকে। তাই আমি সবাইকে রুম থেকে বের করে দিয়ে নিত্তিয়ার পাশে বসে থাকি।
গল্পটা হয়ত এখানেই থেমে যেতে পারতো কিন্তু জীবনটা আরেকটা বার মোড় নিলো। কথায় বলে না,গল্পে যা হয় তা কখনো বাস্তবে হয় না কিন্তু বাস্তবে এমন কিছু ঘটনা কখনো ঘটে যা সব কিছুকে হার মানিয়ে দেয়। এভাবে দিন গুলো পার হতে থাকে। নিত্তিয়ার চিকিৎসা হাসপাতালে রেখেই করিয়ে যাচ্ছে। এদিকে আমি লেখাপড়া শেষে চাকরী পেয়ে যাই তবে সকালে বাসা থেকে বার হয়ে হাসপাতালে গিয়ে কিছুক্ষন নিত্তিয়ার সাথে কথা বলি আবার অফিস থেকে আসার সময় হাসপাতাল হয়ে আসি। জানি ও আমায় বুঝতে পারছে, শুধু বলতে না হয় পারছে না। অন্তত একটা ঘন্টা নিত্তিয়ার হাতটা ধরে তো বসে থাকতে পারি। এটাই তো অনেক। এভাবে আমার জীবন থেকে ৫টা বছর পার হয়ে যায়।
সকালে ঘুমিয়ে আছি তখন মা এসে আমার ঘুমটা ভাঙ্গালো। মা আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত ভুলাচ্ছে…
— কিরে আর কত ঘুমাবি? একটু উঠে বস।
— হুমম বলো।
— বাবারে আমার তো বয়স হয়েছে এটা একটু মাথায় রাখিস তুই। এখন তেমন একটা ভারী কাজও করতে পারি না। তুই আর কত দিন নিত্তিয়ার অপেক্ষায় থাকবি?
— তো কি চাও তুমি?
— আমি চাই তুই বিয়ে কর।
— কিন্তু?
— জানি তুই নিত্তিয়াকে ভালবাসিস আর ওর আশায় বসে আছিস।তবুও ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু ভাববি। আমরা প্রতিটা মানুষ অভ্যাসের দাস। অচেনা কারো সাথে সংসারে থাকা খুব কঠিন কিন্তু সেই অচেনা মানুষটাকে নিয়েই তো জীবনে এগিয়ে যেতে হবে।
— আচ্ছা তুমি মেয়ে দেখো।
— তাহলে আজ বিকালে একটু বাসায় আসিস আমি তোর জন্য মেয়ে দেখে রাখছি।
— আচ্ছা আসবো।
তারপর আমি ফ্রেশ হয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম। আধা ঘন্টা নিত্তিয়ার পাশে বসে ওর থেকে বিদায় নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলাম।
দুপুরে বাসায় এসে আমি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিলাম। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম মায়ের সাথে। মেয়ের বাসা নাকি সামনের এলাকায়। তাই রিকশা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
মেয়ে পক্ষের সবার সামনে বসে আছি। মেয়ে নাকি মায়ের পছন্দ আর মেয়েপক্ষও আমায় পছন্দ করেছে।একটু পর মেয়েকে নিয়ে আসা হলো। মেয়ে আমার দিকে তাকিয়েছে কি না জানি না তবে আমি মেয়ের দিকে তাকাই নি। বড়রা সব কথা বলে আমাকে মেয়ের সাথে আলাদা কথা বলার জন্য মেয়ের রুমে পাঠানো হলো। তখন মেয়েটি আমায় বলল…
— আপনি কি আমায় মন থেকে বিয়ে করতে চান?
— না শুধু মায়ের কারনে।
— কিন্তু আপনি কেন বিয়ে করতে চান না?
তারপর মেয়েটিকে নিত্তিয়ার ব্যাপারে সব বলে দিলাম। আরো বললাম বিয়ে হলেও আমি নিত্তিয়াকেই ভালবাসবো। তখন মেয়েটি আমায় বলল…
— আচ্ছা আপনি তুহিনের বন্ধু রাজ না।
— হুমম তুহিন আমারই বন্ধু।
— ভাইয়া আসলে আমি তুহিনকে ভালবাসি। প্লীজ আমি তুহিনকে ভালবাসি তাই আপনি বলেন বিয়েটা যেন আপনার সাথে আমায় না দেয়।
— ওদের কিছু বলে লাভ নেই। এতে তোমায় আর আমায় দুইজনকেই খারাপ ভাববে। তুমি তুহিনকে সাথে নিয়ে কাল সকালে সদর হাসপাতার সামনে দেখা করতে পারবে।
— হুমম পারবো কিন্তু হাসপাতালের সামনে কেন?
— কারন নিত্তিয়ার সাথে দেখা করে তারপর তোমাদের কথা বলে অফিসে চলে যাবো।
— আচ্ছা।
কথা বলা শেষ করে আমি আর মা চলে আসলাম।
প্রতিদিনের মত আজ সকালের ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে হাসপাতালে চলে গেলাম। নিত্তিয়ার পাশে বসে থাকা অবস্থায় তুহিন আমায় ফোন দিয়ে বলল ওরা গেটের সামনে। আমি বলে দিলাম ১০ মিনিট দাঁড়াতে। কারন, আমি নিত্তিয়াকে ছেড়ে এতো তারাতারি যেতে পারবো না।
নিত্তিয়াকে বিদায় দিয়ে তুহিনের সামনে আসলাম। ওর সাথে ওই মেয়েটি আছে। আমি এখনো মেয়েটির নাম জানি না। ওদের কাছে এসেই আমি তুহিনকে বললাম…
— তুই কি ওরে ভালবাসিস?
— হুম।
— এখন বিয়ে করতে পারবি।
— অবশ্যই
— তাহলে, চল কোর্টে। ওখানে সব ব্যবস্থা করা আছে। আর সাক্ষীর চিন্তা করিস না।
— চল।
তারপর ওদের কোর্টে নিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলাম। গতকাল রাতেই সব ঠিক করলাম। আর আগামীকাল নাকি আবার হ্যাপি নিউ ইয়ার। তাই আজই তুহিনের বিয়েটা দিয়ে দিলাম। এখন বাসায় গিয়ে ওরা ওদের ঝামেলা সামলাক।তবে তুহিন ছেলে হিসেবে খুব ভাল। ওদের বিদায় দিয়ে আমি চলে আসলাম অফিসে।
অফিস শেষ করে আমি রাতে ফুল নিয়ে আসলাম হাসপাতালে। ঠিক এমন দিনটায় নিত্তিয়া আমার কাছে থেকেও আমার থেকে দূরে চলে গেল। আমি এখন নিত্তিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
— জানো নিত্তিয়া আজ পাঁচ বছর পূরন হয়েছে তুমি আমার সাথে কথা বলো না। এতো রাগ কিসের তোমার। তোমার নাকটা বড্ড লম্বা হয়েছে হুমম। আমাকে হ্যাপি নিউ ইয়ারে কোন কিছু দিতে হবে না তবু একটা বার আমার সাথে আবার ঝগড়া করো। তোমার প্রতিটা নিঃশ্বাস আমি অনুভব করতে পারি। এটা কি তুমি একটুও বুঝতে পারো না। এই যে ফুল গুলো তোমার জন্য আর জানো আজ তুহিনের বিয়ে দিয়ে দিছি। সবাই শুধু জানতে চায় তুমি কেমন আছো? আমি তো জানি তুমি খুব ভাল আছো। শুধু আমার সাথেই রাগ করে আছো। আচ্ছা দেখো ৫ বছরে আমি একবারও কাঁদি নি। যাই হোক, তোমাকে একদিন ফিরতেই হবে আমার জন্য আর আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবোই।
কথা গুলো বলা শেষ করে আমি পিছন ফিরে চোখে মুছতে মুছতে চলে আসবো। তখনই সেই চির চেনা কন্ঠে কেউ বলল…
— হ্যাপি নিউ ইয়ার যুক্তিবাদীর অপেক্ষাকারী।
আমি শুধু পিছন ফিরে চমকে গেলাম। কারন নিত্তিয়া ৫ বছর পর আমার সাথে কথা বলেছে আর ওর চোখ দিয়েও জল পরছে। বড্ড ভালবাসি এই মেয়েটাকে। আমার অপেক্ষায় প্রহর মনে হয় এইবার শেষ হলো।