সারাদিনের পর এতক্ষণে একটু ফাঁকা হলো সুমনা। সন্ধ্যে প্রদীপটা জ্বালিয়ে ভাতটা হাঁড়িতে চড়িয়ে দিয়ে ফাঁকা উঠোনে এসে বসল সে। কি গুমোট গরম পড়েছে ক’দিন হল। মেঘ জমছে আকাশে কিন্তু বৃষ্টি কই ! অলস চোখে উঠোনের একপাশে তুলসী মন্দিরের কোটরে জ্বলতে থাকা প্রদীপটার দিকে তাকায় একবার সুমনা। পিতলের প্রদীপ, তিরতির করে কাঁপছে তার শিখা। হাওয়া নেই, তবু বাতাসের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে শিখাটা। দীপকের আসতে এখনো ঘন্টা দুয়েক দেরি। তার মধ্যে ভাত আর একটা সবজি হয়ে যাবে। ফ্রিজে ওবেলার ডাল রাখা আছে। খাবার আগে গরম করে নিলেই হবে। উঠোনে ক্যাম্প খাটটার উপর শুয়ে পাশে পড়ে থাকা মোবাইলটা হাতে তুলে নিল সুমনা। নেটটা অন করে ফেসবুকটা খুলল। কালই রিচার্জ করে দিয়েছে দীপক। রোজ খোলাও হয়না এসব আর। বিয়ের আগে আর বিয়ের পর পর কি ঝোঁক ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার উপরে। কি করছে, কি খাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে সব আপডেট না দেওয়া অবধি যেন শান্তি হত না। এখন সংসারের ব্যস্ততায় ওসবের সময়ও হয় না। তখনকার সেই সুমনা এখন পুরোদস্তুর গৃহিণী। পড়াশোনা শেষে চাকরির চেষ্টা করেছিল সে কিন্তু কঠিন সেই লক্ষ্য সহজে পূরণ হবে না বুঝে মা বাবা সময়ের কাজ সময়ে করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে সামাজিক প্রথা মেনে। সুমনা আপত্তি করার বিশেষ কারণও পায়নি। প্রাইভেট একটা ফার্মে কেরানির কাজ করা দীপকের সাথে দু’বছর হল ভালোই সংসার করছে সে।
ঘুরছে তো ঘুরছেই। খোলে আর না। অবশেষে ফেসবুকের টাইমলাইন এলো। কোনো নোটিফিকেশন নেই, মেসেজও নেই। তিন দিন পর খুলল সে ফেসবুকটা তাও কেউ তাকে মনে করেনি। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। সে বা তার বর্তমান মধ্যবিত্ত জীবন কোনোটাই কারো আগ্রহের বিষয়বস্তু নেই আর। এই দুনিয়াটা সবসময় উত্তেজনা আর উদ্দীপনা খোঁজে। ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমনা। স্ক্রল ডাউন করতে থাকে টাইমলাইনে। কে একজন কবিতা লিখেছে। একজন ফিলিং হ্যাপি লিখে বন্ধুদের সাথে রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার পিক দিয়েছে। পাশে বসে থাকা বন্ধুদের হাতেও মোবাইল দেখা যাচ্ছে। সামনে নানাবিধ খাবারের পদ সাজানো। একজন আবার এডিট করে প্রোফাইল পিক দিয়েছে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সাথে। নাম “রাতের মায়া” ! কি হাস্যকর ! আরেহ ! বিভু দার ছেলের জন্মদিন ছিল। পার্টির পিক দিয়েছে। বাহ, ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে ! ফাল্গুনী দিরা লাদাখ ঘুরতে গেছিল। তার পিকগুলো দেখল সে। কি সুন্দর জায়গা ! ইস ! কতদিন কোথাও ঘুরতে যায়নি সুমনা। অবশ্য কবেই আর গেছিল ! আরো কিসব হাবিজাবি আসছে টাইমলাইনে। ধুর ! বিরক্ত হয়ে ফেসবুকটা বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ে যায় টাইমলাইনে আসা একটা পিকচারে। তার কলেজের বান্ধবী প্রমিতা। বহুকাল কথা হয়না। ওর বিয়ের ছবি ! কলেজের দিনগুলো মনে পড়ে যায় পলকে। ডানাকাটা পরী ছিল সে। লম্বা, ফর্সা, পটলচেরা চোখ। কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না ওর সাথে। সবাই শুধু ঘুরে ঘুরে ওকেই দেখত। কলেজে পড়াকালীনই পাঁচবার বয়ফ্রেন্ড বদল করেছিল ও। যদিও সবসময় দাবি করত যে ভালো ও একজনকেই বসেছে। ওদের পাশের বাড়ির সৌগত নামের একজনকে, যে নাকি টুয়েলভের পরীক্ষায় পাশ করতে না পেরে সুইসাইড করেছিল স্লিপিং পিল খেয়ে। তার দুঃখ ভুলতেই নাকি একের পর এক সম্পর্কে জড়ায় সে। সত্যি মিথ্যে ভগবান জানে ! তারপর তো কলেজ শেষ হতে কে কোথায় ছিটকে গেল ! শেষ কবে কথা হয়েছে ওর সাথে মনে করতে পারল না সুমনা। বন্ধুত্ব রয়ে গেছে ফেসবুকের লিস্টে। প্রোফাইলটায় ক্লিক করে ঢুকল সুমনা। প্রমিতা রায় সরকার। প্রোফাইল পিকে ওর নিজের ছবি। বউ বেশে। টাইমলাইনে পায় আরো ছবিগুলো। ক্লিক করে একটায়। একটা ছবিতে ও আর ওর বর। ছেলেটার ছবিটা দেখেই কেঁপে ওঠে সুমনা। কিংশুক ! কিংশুককে বিয়ে করেছে প্রমিতা !
ভাতে জল দিয়ে এসে আবার ছবিটার দিকে ভাল করে দেখে সুমনা। সেই কিংশুক, সেই কলেজের রকবাজ ছেলেটা , যে সব মেয়েদের ট্রাই করত। এমনকি সুমনাকেও একবার বিশ্রি ইঙ্গিত দিয়েছিল সে। তার সাথে একগাল হেসে পোজ দিয়েছে প্রমিতা। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফি করেছে বিয়ের। দুজনকে ঠিক বলিউড মুভির হিরো হিরোইন মনে হচ্ছে। এক গা গয়না পড়ে , ডিজাইনার লেহেঙ্গা পড়ে সব ছবি। আবার কোনোটায় সোনালী লাল জারদৌসী বেনারসি। কিংশুকও শেরওয়ানি, ব্লেজার পড়ে কায়দা করে পোজ দিয়েছে। কি মনে করে পিকের সাথে ট্যাগ করা কিংশুকের প্রোফাইলটাও খোলে একবার সে। এক হাজার চুয়ান্ন জন বন্ধু ! বাপরে ! আর কিছু না দেখে বেরিয়ে আসে ওর প্রোফাইল থেকে। ওদের বিয়ের এলবামের পিকে লাইকটা দিতে গিয়েও থমকে যায় সুমনা। এই বিলাস বহুল বিয়ে, এই হাসি, এই জৌলুস এর পিছনে কি সত্যি এতটাই খাঁটি আনন্দ লুকিয়ে আছে ! কিংশুক আর প্রমিতা ভালোবেসে একসাথে সুখে আছে বিয়ে করে ? ওদের অতীত তো তা বলে না। কি জানি ! সুখেই থাকুক, এটাই আশা করে ও। আর ভাল লাগছে না। ফেসবুক থেকে বেরোনোর আগে দীপকের একাউন্টটা খোলে একবার সে। এক্টিভ থ্রি ডেজ এগো…
ঘড়িতে রাত দশটা। ডিনার টেবিলে খাবার বেড়ে দীপককে ডাকে সুমনা। পর্দাগুলোকে কেচে রেখেছিল আজ সে। টাঙানোর সময় পায়নি। দীপক সেগুলোই পরাচ্ছিলো। ডাক শুনে ওগুলো রেখে খেতে বসল সে। টেবিলে খাবারগুলো দেখে সে পুরো অবাক ! ফ্রায়েড রাইস, চিলি পনির, চাটনি আর স্যালাড।
“একি ! এসব খাবার ! হঠাৎ ?”
“এমনিই করেছি তো। কেন , করতে নেই বুঝি ?” মুচকি হেসে উত্তর দেয় সুমনা।
“না, তা নয়… সারাদিন এতো কাজ করে এবেলা এতকিছু করলে কেন আবার ? তাই বলছি।”
“এত কিছু কোথায় ? ভাত ফুটছিল হাঁড়িতে। তখনই মনে হল একটু অন্যরকম করি। সবজি দিয়ে, ডিম দিয়ে ভেজে, ঘি মশলা ফেললেই তো হয়ে গেল রাইস। আর ফ্রিজে পনির ছিল। চাটনিটা করতে আর কতক্ষন লাগে বলো !”
আর বেশি কিছু না বলে খাওয়া শুরু করে দীপক। বেশ খুশিই হয়েছে সে বোঝা যাচ্ছিল এই অপ্রত্যাশিত পাওয়ায়। বাচ্ছাছেলের মত ওর খাওয়ার ধরণটা। তাই দেখে মুচকি হাসে সুমনা। দীপকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার সহজ, সরল ভোলাভালা মানুষটা। ভালোবাসে তাকে খুব। উচ্ছলতার থেকে গভীরতা বেশি তার। সুমনা জানে এই মানুষটা তার, শুধুই তার। দুনিয়াটা খুব দ্রুত দৌড়াচ্ছে আজকাল। গভীরতার থেকে ব্যাপ্তি বেশি সবকিছুর। তার সাথে পাল্লা দেওয়ার লড়াইয়ে নেই এই দুটো মানুষের জীবন। দীপক আর সুমনার শান্ত সহজ জীবন একে অন্যকে ঘিরে ধীর গতিতে ঘুরে চলছে বেশ।
“কি হল সুমি, খাও তুমি !”
“হ্যাঁ। এই, খাচ্ছি তো।”
বাইরে মেঘ ডেকে ওঠে। একঝলক ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে আসে জানলা দিয়ে। অবশেষে আজ বৃষ্টিটা হবেই মনে হচ্ছে। সুমনা অপেক্ষা করে দীপকের খাওয়া শেষ হওয়ার। কাল রবিবার। ছুটি। আজ তারা ছাদে যাবে। বৃষ্টি না হলে মাদুর পেতে শুয়ে আকাশের তারা গুনবে। আর অনেক গল্প করবে ওরা। আর বৃষ্টি হলে ভিজবে খুব। সামনে বসা এই সাধারণ গোছের সাদামাটা ছেলেটাকে তৃপ্তি সহকারে খেতে দেখে হঠাৎ কেন জানি চোখে জল এসে যায় সুমনার। এই মধ্যবিত্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ সকলকে দেখানো কি খুব দরকার ? এই তো, বেশ ভাল আছে সুমনা, তার মানুষটার সাথে তার চার দেয়ালের পৃথিবীতে নিরিবিলিতে।
সমাপ্ত