আপনি আমার নামে আর গল্প লেখেন না কেন?
দুপুরের এই সময়টাতে আমি প্রতিদিনই এখানে বসি।ঠিক অফিস ক্যান্টিনে ঢুকে ডান পাশের দু টেবিল পরেই।আমি চেয়ার টেনে বসে পাশের থাই গ্লাসটা একটু সরিয়ে দেই।বেশ ভালই লাগে।সূর্যের আলো একদম টেবিলের উপর এসে পড়ে আর সাথে মৃদু বাতাস।খারাপ লাগে না।
আজও ঠিক থাইয়ের কাচটা সরিয়ে দিতেই সুপ্তি এসে কথাটি বললো।আমি সুপ্তির কথায় কিছু বললাম না।চেয়ারে বসে প্রতিদিনের মত চা, সিঙারা দিতে বললাম।
এসময় এখানে অন্য কিছু পাওয়া গেলেও সেগুলার দিকে তেমন নজর দেই না।আসলে যেটা আমার পছন্দ না সেটা আমি টেস্ট করেও দেখবো না।
প্রতিদিন সামনের চেয়ার ফাকাই থাকে তবে আজ সুপ্তি বসে আছে।আমার চুপ থাকা দেখে সুপ্তি আবারও বললো,
-আপনি আর আমার নামে গল্প লিখেন না কেন?
সুপ্তির কথায় আমি এবার ওর দিকে তাকালাম।মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে গেছে।হয়তো রোদে।বেশ উৎসুক চোখেই তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমি সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-লাঞ্চ করেছেন?
-আমার উত্তর আমি পাইনি।
সুপ্তির কথায় আমি এবারও চুপ করে রইলাম।আসলে ওর সাথে কেমন যেন কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না।
সুপ্তির সাথে আমার পরিচয় এই অফিসে জয়েন করার মাস খানেক পর।আসলে প্রথম দিকে তেমন কারও সাথে কথা হতো না।এখনও যে সবার সাথে কথা হয় ব্যাপারটা ঠিক তেমন ও না।আসলে কথা কম বলাটা আমার একটা অভ্যাস বলতে পারেন।
সুপ্তিকে যেদিন প্রথম দেখি সেদিন মেয়েটা কালো শাড়ি পড়ে অফিসে এসেছিল।আমার কেবিনে আসতেই মেয়েটার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিলাম যে অন্য কোন দিকে খেয়ালই ছিল না।তবে ধ্যানটা ভেঙেছিল সেদিন সুপ্তির ডাকেই।
কালো শাড়িতে যে কোন মেয়েকে এতটা সুন্দর লাগে সেটা আগে ভাবিনি।তবে মেয়েটা যেটাই পড়ুক সেটাতেই আমার কাছে বেশ লাগে।কিন্তু কালোতে একটা ব্যাপার আছে।এই কালারের কিছু পড়লে মেয়েটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে।
এরপর থেকে অফিসে কোন মেয়ে বলতে শুধু সুপ্তির সাথেই আমার বেশি কথা হতো।মেয়েটা হাসলে যেন ওর হাসিতেই হারিয়ে যেতাম।
ফেসবুকে টুকটাক লেখালেখির সুবাদে তখন থেকেই সুপ্তির নামে গল্প লিখতাম।তবে সেটা লুকিয়ে।বলতে গেলে ওই আইডি থেকে সুপ্তিকে ব্লক দেওয়া ছিল।
কিন্তু খুব বেশি দিন লুকিয়ে রাখতে পারিনি।সেদিন অফিসে আসতেই মেয়েটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-কাজটা কি ঠিক হলো?
সুপ্তির কথায় আমি একটু অবাকই হলাম।আসলে কোন কাজটা ভুল হলো এটাই মাথায় আসলো না।কি বা করলাম আমি।আমি সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-কোন কাজটা?
-আমাকে ব্লকলিষ্টে রেখে আমাকে নিয়েই গল্প লেখাটা।
সুপ্তির কথায় কি বলবো ভেবে পেলাম না।আসলে মেয়েটা এসব জানলো কিভাবে সেটাও বুঝে উঠতে পারতেছি না।তবে আমার মনের কথাটা সুপ্তি খুব সহজেই বুঝে গিয়েছিল।আমার চুপ থাকা দেখে সুপ্তি বললো,
-কি ভেবেছেন,আমি আপনাকে ফলো করিনা।আপনার লিষ্টে আমিও আছি।ফেইক আইডিতে।
মেয়েটার কথায় এবার কিছুটা ক্লিয়ার হলো।তারমানে মেয়েটা ফেইক আইডি দিয়ে আমাকে ফলো করে।আমি কিছু বলার আগেই সুপ্তি মুচকি হেসে বললো,
-তবে গল্প কিন্তু আপনি বেশ ভালই লেখেন আহাদ সাহেব।
আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে সুপ্তি এবার মুখে বেশ রাগি ভাব নিয়েই বললো,
-ফেইক আইডিতে আমার আর ঢুকতে ইচ্ছে করে না।আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন।
কথাটি বলেই মেয়েটা চলে গেলো।এদিকে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বোকার মত।আসলে মেয়েটার কাছে যে এভাবে ধরা পড়ে যাব বুঝতে পারিনি।আমি আর কিছু না ভেবে আমার রুমে গিয়ে মেয়েটাকে অতি দ্রুত আনব্লক করে দিলাম।বলা যায় না,আনব্লক না করলে আবার কি না কি বলে ফেলে।
আমার পছন্দের খাবারের মধ্যে সিঙারা অন্যতম।সিঙারা খাওয়ার সময় আমি খুব তৃপ্তি নিয়েই খাই।কিন্তু আজ কেমন যেন তৃপ্তির সাথে অস্বস্তি ও হচ্ছে।
এটা অবশ্য সুপ্তির জন্যেই।কেও যদি খাওয়ার সময় সামনে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে সেখানে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে।তবে এর মাঝে সিঙারা শেষ করে আমি সুপ্তির দিকে তাকালাম।মেয়েটা মনে হচ্ছে আজ উত্তর না নিয়ে যাবে না।
আমি কিছু বলার আগেই সুপ্তি আবারও বললো,
-খাওয়াটা আপনি বেশ ভালই পারেন।
-হ্যা, কিন্তু আপনার মত সবার সাথে অতটা ঘনিষ্ঠ হতে পারিনা।অন্য কারও গাড়িতে চড়া তো দূরে থাক।
আমার কথায় সুপ্তি কি বুঝলো বুঝলাম না।মেয়েটা সামনে রাখা গ্লাসের পানিটুকু খেয়ে একটু নরম গলায় বললো,
-ও, তাহলে এটাই কারন,আমার নামে গল্প না লেখার।
-হতে পারে।তবে সুমন সাহেবও বেশ ভাল কবিতা লেখেন।
আমার কথায় সুপ্তি আর কিছু বললো না।তবে এখানে আর বসলোও না।চলে গেলো।তবে যাওয়ার আগে ওর মুখের মলিন ভাবটা আমার চোখ এড়ালো না।
সুমন সাহেব।আমাদের অফিসেই জব করে।আমাদের অফিস না,ওনার অফিসেই আমরা জব করি।সেদিন যখন সুপ্তিকে দেখলাম ওনার সাথে ওনার গাড়িতে বেশ খুশ মেজাজেই যাচ্ছে সেদিন কেমন যেন নিজের কাছে এ ব্যাপারটা ভাল লাগেনি।আসলে আমার পছন্দের জিনিসে যদি অন্য কেও নজর দেয় তাহলে খুব একটা ভাল লাগে না।
অবশ্য এতে সুমন সাহেবের কি দোষ।ও যদি যেতে না চাইতো তাহলে তো আর জোর করতে পারতো না।ভুলটা আমারই ছিল।ভুল সময়ে ভুল মানুষের মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম।
আমি আর বসলাম না।বেশ কিছু কাজ আছে।সেটা শেষ করে বের হতে হবে।
এটা কি হলো?
আমার কথায় সুপ্তি কিছু বললো না।আরও যেন আমার দিকে চেপে বসলো।আমি কিছু বলার আগেই সুপ্তি বললো,
-রিক্সাওয়ালা চাচা, আপনি যান।
-যাবে মানে?
-কেন,আমার সাথে যেতে সমস্যা?
সুপ্তির কথায় আমি আর কিছু বললাম না।আসলে মেয়েটা কি চাচ্ছে বা কি বোঝাতে চাচ্ছে সেটাও বুঝতেছি না।
অফিস থেকে বের হয়ে রিক্সায় চেপে বসতেই সুপ্তি এসে ঠিক আমার পাশে বসলো।সেটাও আমার দিকে চেপেই বসেছে।
আমি কিছু বলার আগেই সুপ্তি বললো,
-সুমন ভাই আমার ফুফাতো ভাই হয়।আর সেদিন ফুফুকে দেখতেই ওনার সাথে যাওয়া।
-আমি কি জানতে চেয়েছি?
-যেভাবে রেগে আছেন তাই আমিই জানিয়ে দিলাম।
-আমি মোটেই রেগে নেই।
-সেটা আপনার ব্যাবহার আর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
সুপ্তির কথায় আমি এবার একটু চুপ করেই রইলাম।আমার চুপ থাকা থেকে মেয়েটা আমার হাতটা ধরে বললো,
-গল্পগুলা খুব মিস করি।
-শুধু গল্পই মিস করেন?
-না,গল্পের মালিককেও মিস করি।
-শুধু মিস?
-আর কি?
-কিছুনা,হাত ছাড়ুন।
আমার কথায় মেয়েটা এবার একটু জোরেই হেসে দিল।তবে হাতটা ছাড়লো না।যেন আরও শক্ত করেই ধরলো।আমি সুপ্তির দিকে তাকাতেই দেখি মেয়েটা আমার দিকে এক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে।
সুপ্তির তাকানোয় আজ কেমন যেন ভালই লাগছে।অন্য কেও হলে হয়তো অস্বস্তিতে পড়ে যেতাম। কিন্তু আজ তেমন হচ্ছে না।আমি সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-এভাবেই হাতটা ধরে রাখবে সবসময়?
আমার কথায় সুপ্তি কিছু বললো না।ওর মাথাটা আমার কাধে রেখে বললো, কোনদিনও ছাড়বো না।কোন ভাবেই না, কোন মতেই না। সুপ্তির কথায় আমি মুচকি হেসে বললাম,
-আজ গল্পটা তুমিই শেষ করে দিলে।
-হ্যা,তোমার গল্প পড়তে পড়তে এই লাইনটা একদম মুখস্থ হয়ে গেছে।
-ভুলে যাবে না তো আবার?
-উহু,ভুলবো না।কোন ভাবেই না কোন মতেই না।