আজও ঠিক একই জায়গায় লাল গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। আজ প্রায় সাত দিন হলো ছেলেটা প্রতিদিন একই জায়গায় হাতে গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
তবে সেটা অবশ্য আমার জন্য না।ভার্সিটির এক সুন্দরী মহিয়সী বালিকার জন্য। আর আমি তাদের এই প্রেমময় চিত্রের নিয়মিত দর্শক মাত্র।
অবশ্য এই চিত্রটা প্রেমময় বলা যায় কিনা তাতে আমার যথেষ্টই সন্দেহ আছে।কারন
প্রতিদিনের এই দৃশ্যের আরেক টা ঘটনা হচ্ছে,
” তিন জন বান্ধবী সহ আসা তার মহীয়সী সুন্দরী প্রিয়তমা এসে তার হাত থেকে তার
ভালোবাসা সমেত গোলাপ নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিবে মাটিতে। তারপর সেই লেভেলের ঝারি আর রাগ দেখিয়ে সেখান থেকে চলে যাবে।
আর বেচারা ছেলে কিছুক্ষন তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে সেখান থেকে প্রস্থান নিবে।
আর বেচারি আমি আজ একসপ্তাহ ধরে ক্লাস মিস করে তাদের এই প্রেমের ইতি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকি।
আর তার সেই ভালোবাসাময় লাল গোলাপ গুলো সযত্নে কুড়িয়ে আমার লিখাহীন সদ্য কিনা ডাইরীটা ভরাট করছি
আমি বুঝিনা এতো কিউট একটা ছেলেকে মেয়েটা ফিরিয়ে দেয় ই বা কিভাবে ?
হোক সে যতোই সুন্দরী, ছেলেও তো আর কম যায়না!
তার চশমা পড়া চোখ দুটোতে সে কি মায়া।যদিও আমি কখনো তাকে হাসতে দেখিনি তবে কল্পনা করতে পারি তার সেই হাসি হবে মন মুগ্ধকর।
দিনে দিনে আমার মাথাটা যে খারাপ হচ্ছে সেটা অবশ্য ভালোই বুঝতে পারছি আমি।কেনো জানি ছেলেটাকে সেই প্রথম দিন থেকেই আমার মনে ধরেছে।তার সেই মায়াবী চাহনী বার বার তাকে ভাবতে বাধ্য করে আমায়।
একদিনের জন্য গোয়েন্দা হয়ে গিয়ে তার সম্পর্কে খোজ নেওয়ার পর জানতে পারলাম ছেলেটা আমার ৪ ক্লাস সিনিয়র।আর সেই সুন্দরী তার ক্লাসমেট।
ছেলেটার নাম স্পর্শ।
যাইহোক পরের দিন যথারিতী ৫ মিনিট আগে কলেজ মাঠের সেই কৃষ্ণচূরা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি পরিচিত প্রিয় সেই মুখে হাসি দেখার জন্য। কিন্তু আজ ও কিছু হলোনা।
সেই একই ঘটনা রিপিট।দূর ভাল্লাগেনা।মেয়েটা রাজি হবেই বা কবে??
তবে আজকে হয়তো আমার লুকোচুরি প্রেম কাহিনী দেখার ঘটনা ধরা পড়লো। ছেলেটা আমার দিকে অনেক রাগী লুক নিয়ে তাকিয়ে আছে।
আবার আমার দিকেই আসছে। মনে মনে সেই ভয়ে দাঁড়িয়ে আছি এমন রাগি মুড নিয়ে কেন আমার দিয়ে আসছে?
– এই মেয়ে,নাম কি তোমার?(স্পর্শ)
>—(আমি চুপ)
-কি হলো চুপ করে আছো কেনো?
>পুর্না (আমি)
-কোন ক্লাসে পড়ো?
>ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার।
-ক্লাস ফাকি দিয়ে প্রতিদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকো কেনো?(রাগি কন্ঠে)
>এমনি
-এমনি মানে?কি ভেবেছো প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থেকে আমার মজা উড়ানো হয় সেটা কি আমার চোখে পড়েনা?(আরো রেগে?)
>নায়ুজুবিল্লাহ,,আমি কই আপনার মজা উড়ালাম? আমিতো শুধু দেখছিলাম।
-কি দেখছিলে শুনি,?
> এই আপনার অপূর্ন প্রেম পূর্নতা পেলো কিনা সেটা(একটু হেসে বললাম)
-এই ইন্টারেস্ট টা পড়াশোনায় দেখাও ভবিষ্যৎ ভালো হবে।কাল থেকে যেনো ক্লাস ফাকি দিয়ে এখানে আসতে না দেখি।যাও ক্লাসে যাও বলেই চলে যাচ্ছিল তখন ই পিছন থেকে ডাকলাম
>এই যে শুনেন!(আমি)
-কি হলো?(স্পর্শ)
>প্রতিদিন লাল গোলাপ না এনে একদিন নীল রঙের একটা গোলাপ এনে দেখতে পারেন।
ওই মেয়ের জায়গায় আমি হলে নীল গোলাপে অবশ্যই পটে যেতাম(একটু দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বলে ক্লাসে চলে গেলাম)
মানা করা সত্যেও পরের দিন একই জায়গায় দাড়িয়ে আছি।এতোদুর এসে আমি কেন হাল ছাড়বো?
আর স্পর্শও পারে বটে, সেই এক লাল গোলাপ ই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,,আর রাগি লুক নিয়ে আমার দিকে বার বার তাকাচ্ছে।
আজকে আর আমি ভয় পাচ্ছিনা।আমিও দেখেই ছাড়বো। কিন্তু আজকে তার সেই সুন্দরী প্রেয়সী আর আসেনি।
অনেক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে যেই তার রাগি মুড নিয়ে আমায় ঝাড়তে আসছিল আমিও তারাতারি সেখান থেকে প্রস্থাব করতে লাগলাম কিন্তু পালানোর আর ঠাই হলোনা।সেই সামনে এসে হাজির।
-তোমায় না এখানে আসতে মানা করেছিলাম?(স্পর্শ)
>তোহ আপনার কথা আমার শুনতে হবে কেন?(আমি)
-শুনতে হবে।কারন আমি তোমার সিনিয়র।
>তোহ আমি শুনবোনা আমার ইচ্ছা।
যাইহোক আপনাকে না কাল বললাম নীল গোলাপ আনতে।সেটাও তো আপনি শুনেন নি?
-এখন আমার জুনিয়র পিচ্ছিদের কথাও শুনতে হবে?
>হুহ আমি পিচ্ছিনা।আর মাঝে মাঝে জুনিয়র দের কাছেও কিছু শিখার থাকে বুঝলেন?
-খুজেছিলাম নীল গোলাপ,পাইনি।নীল গোলাপ সহজে পাওয়া যায় নাকি?
>ভালোবাসা কি সহজে পাওয়া যায়???(আমার সেই দুষ্টুমির হাসি)
তারপর তাকে কিছু বলার সুজোগ না দিয়েই চলে গেলাম।
সেদিন বাসায় এসে শুনতে পারলাম বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে তাকে সিলেটে বদলি করা হয়েছে।আর কাল পরিবার সহ আমরা সবাই সেখানেই চলে যাচ্ছি। শুনেই কেমন ভিতরটা ধুক করে উঠলো।
কেনো জানি খুব খারাপ লাগছে।সারারাত চিন্তায় আমার ঘুম আসেনি।ঘুমহীন চিন্তিত মন নিয়ে এটাই উপলব্ধি করলাম যে, সেই ছেলের মায়াবি চোখে আমার মন আটকে গেছে।এখন মনহীন সেই আমি তাকে ছেড়ে যাবো কি করে?
পরক্ষনেই আমার মনে পড়লো সেতো আরেক জন কে ভালোবাসে।আজ নাহয় কাল সেতো তার ভালোবাসা গ্রহন করে নিবে।
সমস্ত চিন্তা,ভাবনা,অনুভুতি কে পেছনে ফেলে চলে আসলাম এক নতুন স্থানে।
সারাদিন মন মরা হয়ে বসে বসে তার ভাবনায় মগ্ন থাকতাম আর স্বার্থপরের মতো দোয়া করতাম সেই মেয়ে যেনো কখনো তার প্রস্তাবে রাজি না হয়।
তারপর দীর্ঘ চার বছর চলে গেলো।সময়ের সাথে সাথে সব ভুলে গেলেও সেই চশমা ওয়ালা ছেলেটাকে আজও মনে পরে।মাঝে মাঝে ভাবি পাগলটা এতো ধৈর্য্য পেতো কোথায়??তারপর একদিন আমার কাজিনের বিয়েতে যাই এতো বছর পর সেখানে আমার চোখ একটা ফুটফুটে মেয়ে কোলে নিয়ে থাকা সুন্দরি রমনীর দিকে আটকে যায়। বড্ড চেনা চেনা লাগছে তাকে কোথায় যেনো দেখেছি কিন্তু মনে পরছে না।
হঠাৎ মনে পরলো আরে এতো সেই আপুটা যার জন্য এক পাগল প্রতিদিন লাল গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো।যে পাগল টা নিজের সাথে সাথে আমাকে পাগল বানিয়ে রেখেছিল।
পরক্ষনেই আমার মন খারাপ হয়ে গেলো।ওরা তাহলে বিয়ে করে ফেলেছে।মেয়েও আছে একটা।এতো ফুটফুটে একটা মেয়ে,,এতো মায়াবি তার চাহনী।এই মেয়ে স্পর্শের ই হতে
পারে।এমন আজগুবি চিন্তা ভাবনায় মন এতোটাই খারাপ হলো যে আমি আর বিয়েটা এটেন্ড ই করতে পারিনি।
সেদিন বাসায় এসে ডাইরি সহ ডাইরির ভেতর জমিয়ে রাখা শুকনো গোলাপ গুলোর জলাঞ্জলি দিয়ে দিয়েছি।অন্যের হাজব্যান্ডের স্বৃতি আমার কাছে রেখে তো কোনো লাভ নেই।
কিছুদিন পরে যখন বাবা বিয়ের কথা বললো তখন কিছু চিন্তা না করেই হ্যা বলে দিয়েছি।এখন তো আর কারো জন্য অপেক্ষায় থাকিনা।আর মানা করে হবে টাই বা কি?
তার এক সপ্তাহ পর ছেলে পক্ষ আমাকে দেখতে আসে।মন খারাপ নিয়েই তাদের সামনে গিয়ে বসি।একবার ও পাত্রের দিকে তাকাইনি।তাকিয়েই বা কি হবে?
আমার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে না থাকা সত্যেও পাত্রের সাথে একা কথা বলতে আমাকে আমার রুমে পাঠানো হলো।
চুপ করে নিচে দিকে তাকিয়ে আছি।এমন সময় পাত্র বলে উঠলো
-কি ব্যাপার,,পাত্র না দেখেই বিয়ে করে ফেলবে?
হঠাৎ চমকে উঠি আমি,,কেমন পরিচিত প্রিয় কন্ঠ।তাৎক্ষণিক পাত্রের মুখ দর্শন কর আমি পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।
>স্পর্শ!
-যাক চিনতে পেরেছো তাহলে।আমি ভাবলাম হয়তো অনেক আগেই মন থেকে উঠে গেছি।(একটু হেসে বলল)
>আপনি না বিবাহিত?/আপনার তো বাচ্চাও আছে।
তাহলে এখানে কি?
-নায়ুজুবিল্লাহ! কি বলে মেয়ে আমি কবে বিয়ে করলার।আমি সম্পুর্ণ রুপে সিংগেল এখনো।
>তাহলে সেদিন আপনার প্রিয়তমার কোলে যে বাচ্চা দেখলাম সেটা?(অবাক হয়ে)
-আরেহ ওর তো সেই চার বছর আগেই বিয়ে হয়ে গেছে।
>তোহ মন দিয়েছেন একজন কে আর বিয়ে করতে আসছেন আরেক জন কে?আমি এই বিয়েতে রাজি না(রেগে গিয়ে বললাম)
-মন তো তাকে দিয়েছি যে প্রতিদিন লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ভালোবাসা মিস্রিত ফেলে দেওয়া ফুল গুলোকে কুড়িয়ে নিয়ে তার মনে ঠাই দিয়েছিল।
>মানে আপনি?
-হুম।একজন আমার প্রেমের পূর্নতা দেখার জন্য প্রতিদিন কৃষ্ণচূরা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতো আর আমি চুপি চুপি দাঁড়িয়ে থাকতাম আমার ফেলে দেওয়া ভালোবাসাকে তার মনে ঠাই দেওয়া দৃশ্য কে দেখার জন্য।
প্রতিদিন রিজেক্ট হয়েও ততোটা কষ্ট পাইনি যতোটা না পরের দিন কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মিষ্টি মেয়েটাকে না দেখতে পেয়ে পেয়েছিলাম।
বিশ্বাস করো সেদিন বুঝতে পেরেছি আমার মনে তোমার জন্য জমানো অনুভুতিটাকে।
তারপর থেকে তোমার জন্য সেই কৃষ্ণচূরা গাছে নিচে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
আরো কয়েকদিন পরেও যখন দেখলাম তুমি আসছোনা তখন খোজ নিয়ে জানতে পারি তোমরা পরিবার সহ সেখান থেকে চলে গেছো।
এতো বছরে চেয়েও তোমায় আমি মন থেকে মুছতে পারিনি।অনুভুতিটা শুধুই বাড়ছিল।
সেদিন যখন ভাইয়ার বিয়ের হলুদ নিয়ে ভাবিদের বাসায় গেলাম সেদিন নীল রঙের শাড়ি পড়ে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি কে কিন্তু আমি ঠিকই চিনতে পেরেছিলাম।
তোমার সামনা সামনি হতে যাবো তার আগেই তুমি হারিয়ে গেলে।হলুদের দিন,বিয়ের দিন সারা বাড়ি খুজেও তোমায় পাইনি।
পরে ভাবির কাছ থেকে জানতে পারলাম তুমি তার কাজিন হও।তারপর সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠালাম।আর আজ আমি তোমার সামনে।
>কিন্তু আমি কেনো আপনার প্রস্তাবে রাজি হবো?(হালকা একটু মুড নিয়ে বললাম।মনে মনে তো সেই লেভেলের খুশি)
-কেও একজন আমাকে বলেছিল নীল গোলাপে প্রপোজ করলে সে পটে যাবে।
>কিন্তু নীল গোলাপ পাওয়া তো সহজ না?
-ভালোবাসা টা কই সহজে পেলাম?
বলেই একটা টকটকা তরতাজা নীল গোলাম আমার সামনে এগিয়ে হাটু গেরে বসে পড়লো।
-উইল ইউ মেরি মি পুর্না ? (স্পর্শ)
>উমম…
-কি হলো ?
কিছুক্ষন পর গোলাপ টা হাতে নিয়ে একটু মুডি ভাব নিয়ে বললাম
নীল গোলাপ বলেই রাজি হলাম লাল হলে কিন্তু প্রথম এবং শেষ বারের মতো আমার কাছ থেকেও রিজেক্ট হতেন।
(বলেই হেসে দিলাম সাথে সাথে দেখতে পেলাম আমার সেই কাল্পনা করা মুগ্ধকর হাসি।যা হাজার বার আমার কল্পনায় দেখা দিয়েছিল)