আমাদের পরিচয় টা আসলে একটু অন্যরকম ভাবে হয়েছিলো।তখন বর্ষাকাল।
ঘোর বৃষ্টি চারিদিকে, বিশেষ করে কাজের সময় তো বৃষ্টি আসবেই।
তা না হলে আপনার কাজ নষ্ট হবে কিভাবে।ধুর কোথায় কি, এক কথা বলতে যেয়ে আরেক কথা বলছি। যাচ্ছিলাম পাসপোর্ট অফিস।
আসলে তখন প্রায় প্রতিদিনই আমাকে ওখানে যেতে হচ্ছিলো।কারন পাসপোর্ট দেয়ার তারিখ অনেক আগেই চলে গিয়েছিল।
ওইদিন ও একইরকম হতাশা নিয়ে পাসপোর্ট অফিস যাচ্ছিলাম। বাস থেকে নামার সাথে সাথেই ঝুম বৃষ্টি শুরু।
ছাতা তা নিয়ে না ভেজার জন্য ৩য় বিশ্বযুদ্ধ করছিলাম রীতিমতো।
আশেপাশে কোনো দোকানের সামনে এতটুকু জায়গা খালি নেই যে সেখানে যেয়ে দাঁড়াবো।
ঠিক তখনি চোখে পড়ল রাস্তায় কাকভেজা হচ্ছে প্রকৃতির কাছে অসহায় হওয়া এক মেয়ে। ছাতা আনতে ভুলে গিয়েছিল হয়ত।
.
সাত পাচ না ভেবেই মেয়েটার দিকে ছাতা টা এগিয়ে দিলাম।কিছুটা অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে।
তারপর হটাৎ করেই ব্যস্ত হয়ে উঠলো তার ব্যাগ পানির কবল থেকে বাঁচানোর জন্য।
সাথে মেয়ে থাকলে এইসময় যেকোনো দোকানে জায়গা না থাকলেও আপনি জায়গা পাবেন, কারন বাঙালী অনেক উদার।
তো আমারও ব্যতিক্রম হলো না। লোকজন সরে যেয়ে জায়গা করে দিলো আমাদের।
একবার শুধু নাম জিজ্ঞেস করে ধন্যবাদ জানিয়েছিল সে আমাকে।
অল্প কিছুক্ষন পরেই বৃষ্টি থেমে যায়। আমরা চলে গেলাম আমাদের গন্তব্যে।হয়ত সৃষ্টিকর্তা চেয়েছিল আমাদের আবার মিলিয়ে দিতে।
.
পাসপোর্ট সেদিন পেয়েছিলাম আমি।
অফিসের নিচে এসে দেখি মেয়েটা করুন মুখে পাসপোর্ট ফরম নামক অকেজো কাগজ গুলো পুরন করার আপ্রান চেষ্টা করছে।
কিছুক্ষণ দাড়িয়ে দেখলাম ব্যপার টা।আসলে আমরা বাঙ্গালিরা ফ্রী তে বিনোদন পেলে তা নিতে/উপভোগ করতে একটুও কার্পণ্য করি না।
কারন আমরা কিন্তু মোটেও কৃপণ নই।যে বলে বাঙ্গালিরা কৃপণ সে আসলে বাঙালীই না। কাঙ্গাল সে একটা।
তো কিছুক্ষন পর তার পাশে গিয়ে বললাম “করতে পারি সাহায্য?” তারপর!! আর কি??
আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিয়ে ফরম তা আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল।
যেহেতু আমি পুরন করতে পারি সেহেতু ওর ফরম তা পুরন করে দিলাম।সেখান থেকেই জানতে পারলাম ওর নাম “ইচ্ছে”।
একটু আনকমন কিউট নাম। ফোন নাম্বার নিতেও কার্পণ্য করি নাই কিন্তু।আগেই বলেছি বাঙালী কৃপণ নয়।
হাসছেন কেনো?? আপনি নিজেও পরীক্ষা করে দেখেন,বাঙ্গালি কৃপণ না।
তারা মাইর দিলেও তাতে একটা মাইরও কম দেই না, যদিও পরে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসে।
.
কাজের চাপে প্রতিটা মানুষের মত আমিও ভুলে গিয়েছিলাম ইচ্ছে নামের এক অপ্সরির ফোন নাম্বার নিয়েছিলাম।
অবশ্য যখন মনে পড়েছে তখন আমি দেশের বাইরে। এক আলাদা জগত তৈরির যুদ্ধের নেমেছি।
নতুন পরিবেশে যখন হাপিয়ে উঠছিলাম ঠিক তখনি ফোনের কন্ট্রাক্ট লিস্ট ঘাঁটতে যেয়ে ইচ্ছে নাম টা চোখে পড়ে।
.
ঘরের এসি টার তাপমাত্রা একটু বাড়িয়ে দিলাম। মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে জ্বর যে কখন বেড়ে গেছে টের পায়নি।
ওষুধ টা যে কোথায় রেখেছি, উফ অসহ্য। হাতের সামনে কাচের গ্লাস টা আছাড় মেরে দিলাম। ভাল লাগে না এসব অগোছালো কাজ কারবার।
আজ রহিম চাচা কে বলতে হবে আমার জিনিসে হাত না দিতে। একদিন তো আমার ডায়রিটায় গায়েব করে দিয়েছিল।
পরে আমার টি টেবিলের নিচে পেয়েছিলাম। বেচারা সেদিন অনেক বকা খেয়েছিলো।
আমার প্রিয় ডায়রি, যেখানে সেখানে কি মানায় নাকি!! কাচ ভাঙ্গার শব্দে রহিম চাচা দৌড়ে এসে ওষুধ গুলো বের করে দিলো।
এবার রেখেছে আলমারির ভিতরে। ওষুধ গুলো এখন থেকে টি টেবিলের নিচে রাখতে বলে রহিম চাচাকে বিদায়
জানালাম। ও হ্যাঁ কি যেন বলছিলাম, ফোনের কন্ট্রাক্ট লিস্টে ওর নাম টা চোখে পড়ে। জানেন, তখন ওকে আমি ফোন দিয়েছিলাম
হ্যালো, কে বলছেন?? (ইচ্ছে)
জি আমি। আপনার হবু বন্ধু (আমি)
বুঝলাম না কাহিনী। ভাইয়া আমার ফালতু সময় কম, কে আপনি সেটা বলেন
বললাম ত।হবু বন্ধু
আরে ধুর যত্তসব, কোথাকার কোন জোকার।
এক্সকিউজ মি ম্যাডাম কিছুদিন আগে পাসপোর্ট অফিসের কথা মনে আছে?? আমি হাসান
অহ, সরি।বুঝতে পারিনি। আপনি তো আপনার নাম্বার দেননি।
হা হা হা।হুম, বুঝতে পেরেছি।তারপর, পাসপোর্ট হলো??
না, কাল দিবে।
আপনার ফেসবুক আইডি থাকলে দেন।তা না হলে তো ভুলেই যাবেন। যেরকম ভুলো মন আপনার!!
ওকে বাবা, এই নেন, ইচ্ছে নদী
তা কোন দেশে যাচ্ছেন??
লন্ডন। যাবেন নাকি আমার সাথে!!
আপনার সাথে গিয়ে কি হবে।তারচেয়ে লন্ডন এসে আমাকে ফেসবুকে একটা ম্যাসেজ দিয়েন।
আপনিও ওখানে নাকি!!
তারপর দেখা হলো লন্ডন এ আমাদের। ফোনে কথা বলার কোনো লিমিট থাকতো না আমাদের।
মাঝে মাঝে তো রাত যে কখন সকাল হত টের ই পেতাম না। ও ওর গ্রাজুয়েশন শেষ করল ওখান থেকে।
আর ততদিনে আমি আমার চাকুরি স্থলে অনেক উপরে চলে গেছি। দুই পরিবারের সম্মতিতে আমাদের ভালবাসা বিয়ে পর্যন্ত চলে যায়।
.
সেদিন আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী ছিল।আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলাম।
অনেক আসা করে হাতে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে সকালে বাসায় এসেছিলাম।
আসলে তার আগের দিন বাসায় না এসে এক বন্ধুর বাসায় রাত কাটিয়েছিলাম।
সাথে ফোন তা অফ রেখেছিলাম।পরের দিন যখন বাসায় গিয়েছিলাম মহারানী তো আমাকে কিল ঘুসি দিতে দিতে নিজেই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল।
আর তার কান্না দেখে তো আমি নিজেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।অনেক কষ্টে ওকে থামিয়েছিলাম।
স্যার খাবার তা খেয়ে নেন।(রহিম চাচা)
চাচা তোমাকে না বলেছি আমাকে স্যার বলবে না।
(আমি)
আচ্ছা বাবা খেয়ে নাউ।অসুধ খাওয়ার সময় হয়েছে তো।
হুম্ম। আচ্ছা চাচা তুমিও খেয়ে নাউ।আমি লাঞ্চ করে ওষুধ খাচ্ছি।
আচ্ছা বাপজান।
এই খাওয়া নিয়েও তো প্রতিদিন ঝগড়া হত আমাদের। আমি বেশি খেতাম আর ও রাগ করত আমি মোটা হয়ে যাব বলে।
.
এই ভালবাসাও একদিন কাচের গ্লাসের মত ভেঙ্গে গিয়েছিল। চাকরি টা হুট করেই ছেড়ে দিয়েছিলাম।
তারপর আর টেকেনি।প্রতিদিন ঝগড়া, ঝামেলা লেগেই থাকতো। প্রচণ্ড মানসিক চাপে ওকে মুক্তি দিয়েছিলাম।
আজ আমার আবারও সব আছে, কিন্তু সে আর নেই।কথায় আছে, যতদিন অভাব থাকে না ততদিন ডাল দিয়ে হলেও দুই প্লেট খেতে পারে।
আর যখন সব থাকে তখন আর সে খেতে পারে না। আজ সে অন্য কারোর ইচ্ছে হয়ে তার আকাশে ইচ্ছে ঘুড়ি হয়ে উড়ছে।
আর আমার আকাশ আজ শূন্য……