লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে জারিফ। লিফট গ্রান্ডফ্লোর থেকে উঠে আসছে। জারিফ তিনতলায় দাঁড়িয়ে। সাধারণত জারিফ লিফট পরিহার করে। মাত্রই তো তিন তলা। সিঁড়ি বেয়েই ওঠা নামা করে। তবে আজ ও নিচে নয় বরং ছাদে যাবে। এগারোতলা ভবনে লিফট ব্যতীত ছাদে ওঠা খুব কষ্টসাধ্য তাই আর ছাদে ওঠা হয়না। আরেকটি কারন অবশ্য আছে তবে আজ সেটা আর মনে করতে চাইছেনা। আজ কেন জানি ছাদে যাবার ইচ্ছেটা মনে প্রবলভাবে জেগে উঠলো।
লিফট দোতলায় একবার থামলো, হয়তো কেউ নামলো বা কেউ উঠলো।
এবার উঠে আসছে, জারিফ লিফটের দরজা খোলার অপেক্ষায়।
দরজা খুলতেই চারতলার সীমা আন্টিকে দেখা গেলো দু’হাত ভরা শপিংব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে। তার পাশেই অপরিচিত দুজন ভদ্রলোক আর একদম পেছনে অসম্ভব সুন্দরী ললনা দাঁড়িয়ে। মনে হচ্ছে তার সৌন্দর্যে লিফটের উজ্জ্বলতা যেন দ্বিগুণ আকারে বেড়ে গেছে।
এই ছেলে হা করে কি দাঁড়িয়েই থাকবে, দুবার দরজায় হাত দিতে হলো, সীমা আন্টির ধমকে সম্বিৎ ফিরে পেলো জারিফ।
শপিংব্যাগে ভরপুর একটি হাত এখনো দরজায় কোন মতে ঠেকিয়ে আছেন তিনি। তড়িঘড়ি করে উঠেই ১০ নম্বর বাটনে চাপ দিলো। খেয়াল করলো ৩ আর ৬ নম্বর বাটন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। তারমানে সীমা আন্টি যাবেন চারতলায় আর অচেনা লোক এবং সুন্দরী রমণী হয়তো যাবে সাততলায়।
চার তলায় এসে লিফটের দরজা খুলতেই সীমা আন্টি বেরিয়ে গেলেন। আবার চলতে শুরু করলো। জারিফ আড় চোখে আরেকবার মেয়েটিকে দেখে নিলো। কিন্তু মেয়েটি নির্লিপ্ত হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে, এক ভাবে জারিফের দিকেই তাকিয়ে।
জারিফ কিছুটা অস্বস্তি লাগলো, এতো সুন্দর একটি মেয়ে কেন এভাবে ওর দিকে তাকাবে। আর সেই ঘটনার পর থেকে মেয়েদের এভাবে তাকানো দেখলেই গা শিউরে উঠে জারিফের।
লিফট সাততলায় পৌঁছাতেই অচেনা লোক দুজন নেমে গেলেন কিন্তু মেয়েটি নড়লোনা। এবার জারিফ একটু কেশে জানতে চাইলো, কয়তলায় যাবেন?
মেয়েটি এবার জারিফের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো, যেখানে আপনার গন্তব্য।
জারিফ কিছুটা অবাক হয়ে বললো, কিন্তু আপনি তো গ্রান্ডফ্লোর থেকে এসেছেন তবে কোন বাটনেই চাপ দেননি কারন?
কারন আমি যে জানতাম আপনি আসবেন! আর আপনি যেখানে যাবেন আমিও যে সেখানেই যাবো।
এবার মেয়েটির হাসি ওর কেমন পরিচিত পরিচিত লাগলো।
লিফটের দরজা বন্ধ হতেই ভেতরটা কেমন শীতল হতে শুরু করলো। জারিফের হালকা শীত করতে লাগলো। আড়চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো যে ওর একারই শীত করছে নাকি মেয়েটিরও করছে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো যে মেয়েটি অপলক নেত্রে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আবারো কেমন অস্বস্তি ভাব ফিরে এলো। মেয়েটির দিক থেকে চোখ ফেরাতেই পেছন থেকে কেউ যেন ডেকে উঠলো, জারিফ…
চমকে উঠে আবার তাকালো, দেখলো মেয়েটি মুচকি হাসছে, এ কণ্ঠস্বর, এ হাসি ওর খুব পরিচিত, হ্যাঁ খুব পরিচিত কিন্তু ও যাকে চেনে সে তো শ্যামবর্ণ আর এই মেয়েটি ফ্যাকাসে ফর্সা। তবে কেন.. কেন এমন চেনা চেনা লাগছে।
জারিফের আতঙ্কিত চেহারা দেখে মেয়েটির ঠোটে ঈষৎ হাসি ফুটে উঠলো।
— কি চিনতে কষ্ট হচ্ছে বুঝি?
— কে.. কে তুমি!!
— আমি তন্দ্রা, ভুলে গেলে এতো তাড়াতাড়ি !! কিন্তু আমি যে তোমার মায়া ত্যাগ করতে পারিনি।
— সেটা কি করে সম্ভব, তুমি তন্দ্রা হতে পারোনা, তন্দ্রা তো…..
— তিন বছর আগেই মারা গেছে এই তো?
— হ্যা ঠিক তাই, তুমি তন্দ্রা নও, হতেই পারোনা, মৃত মানুষ কখনওই ফিরে আসতে পারেনা, এ অসম্ভব!!
— তোমার কথাই ঠিক মৃত মানুষ কখনওই ফিরে আসতে পারেনা, তবে আমি তো এখন মানুষ নই , আত্মা হয়ে
তোমার মায়ায় তিনটি বছর এই লিফটে বেধে আছি। মনে পড়ে জারিফ, এই লিফটেই আমাদের প্রথম দেখা, তোমাকে প্রথম দেখেই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম, কতবার যে শুধু তোমাকে এক নজর দেখবো বলে লিফটে চড়েছি তার কোন হিসেব নেই। তুমি সবই বুঝতে, আমার চাহনি, আমার চাওয়া, তবুও তুমি না বোঝার ভান করে আমাকে এড়িয়ে যেতে। তোমার উদাসীনতা আমাকে কষ্ট দিতো আর তাইতো একদিন সাহস করে মনের কথাটা তোমাকে বলেই ফেললাম আর তুমি কি নিষ্ঠুর ভাবে আমাকে অপমান করলে, বললে আমি নাকি কালো কুৎসিত তোমাকে ভালোবাসার কোন যোগ্যতাই নাকি আমার নেই।
সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম, নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিলো তাই বাসায় না ফিরে সোজা ছাদে আর এরপর…
— এরপর যা ঘটেছিলো তা আমার কল্পনার বাহিরে ছিলো । তন্দ্রা আমি তোমাকে অপমান করেছিলাম ইচ্ছে করে যেনো তুমি তোমার পাগলামি থামাও। আমাকে ঘৃণা করো। তুমি হিন্দু পরিবারের মেয়ে আর আমি মুসলিম। আমাদের সম্পর্কের কোন ভবিষ্যৎ ছিলোনা আর তোমাকে বোঝালেও বুঝতে না তাই বাধ্য হয়েই সেদিন কথাগুলি বলেছিলাম। কিন্তু তুমি চরম বোকামি করে বসলে আর আমাকেও আজীবন অপরাধী করে রেখে গেলে।
— যেতে আর পারলাম কই দেখো আমার আত্মা এখনো তোমার সামনে, তোমাকে নিতে এসেছি জারিফ, এসো আমার সাথে, চলো চলে যাই অনেক অনেক দূরে, এসো জারিফ এসো।
হঠাৎ মনে হলো কেউ জারিফের হাত ধরে টানছে আর চেঁচাচ্ছে।
সম্বিৎ ফিরে পেতেই নিজেকে ছাদের রেলিং এর উপর এক পা শূন্যে বাড়ানো অবস্থায় দেখে জারিফের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। পেছন ফিরে দেখলো একটি মেয়ে ওর এক হাত টেনে ধরে চেচাচ্ছে, এই কি করছেন, নামুন, নামুন বলছি।
জারিফ আবার সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে সামনে কেউ নেই, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে কোথাও তন্দ্রার কোন অস্তিত্বই নেই তবে কি সবই কল্পনা, না তা হবে কেন, কল্পনা হলে ছাদের রেলিং এ কিভাবে এলো! আর ছাদেই বা এলো কখন , ও তো লিফটে ছিলো। আর ভাবতে পারছেনা প্রচন্ড মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে। রেলিং থেকে নেমে মেয়েটিকে কোনরকম ধন্যবাদ দিয়ে ছাদ থেকে নামতে যাবে হঠাৎ মনে হলো বাতাসে শিষ কেটে তিক্ষ্ণ একটি কন্ঠ ভেসে এলো ওর কানে — আমি প্রতীক্ষায় থাকবো জারিফ তোমার প্রতীক্ষায়।