অন্তহীন পথচলা

অন্তহীন পথচলা

আজ দুইদিন পর হিমেল আমায় ফোন করে বলল,”অফিসের কাজ শেষ করে বিকালে বাসায় ফিরবো”।আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে হিমেলের পছন্দের খাবার তৈরি করতে লেগে গেলাম।মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট,পুঁটিমাছের ঝাল চচ্চড়ি, ডিপ করে রাখা মাংশের কাবাব,নারকেল দুধের ভাত(যদিও ওত ভাল রাধতে পারিনা)।দ্রুত রান্না শেষ করে পছন্দের শাড়িটি পরে একটু সাজুগুজু করলাম কারণ,এই দিন কোন খবর না পেয়ে চিন্তায় প্রায় দিশেহারা। আজ তো ভেবেই নিয়েছিলাম পুলিশে খবর দেবো।যাই হোক খবর পাওয়াটা জরুরী।এদিকে হিমেলের আম্মা হিমেল হিমেল করে খাওয়া – দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।আমি সান্ত্বনা দিলেও মায়ের মন তো আর তাছাড়া আমারই বা কি করার আছে।না জানি হিমেলের অফিস,না জানি কিসে সে চাকরী করে।বারবারই জানতে চেয়েছি কিন্তু প্রতিবারই এক কথাই বলেছে, “জেনে কি করবা,সমস্যা হইলে সমাধান তো দিতে পারবা না তাহলে চুপচাপ থেকো”।

রাগ হইলেও কিছু বলতাম না।যখন হিমেলকে বিয়ে করি তখন হিমেল বেকার ছিল।আমার বাবা মা বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিবে না তাই সবকিছু ছেড়ে ভালবাসার দাবি নিয়ে হিমেলের হাত ধরেছিলাম। কারণ,হিমেল আমাকে প্রচন্ড ভালবাসে।হিমেলকে ঠকিয়ে বাবা মার পছন্দ করা চাকরীজীবি ছেলেকে বিয়ে করে কোনদিন সুখি হতাম না কেননা, হিমেল আমাকে ভালবেসে সবকিছু করতে রাজি ছিল।তাছাড়া, সারাজিবন একটা মানুষের কাছে অবিশ্বাসী আর ছলনাময়ী হয়ে থাকবো।সবকিছু জেনেই ভালবেসেছি।আগে সিকারেট এবং বেশ কিছু নেশা হিমেলের ছিল।যখন আমার সাথে মান অভিমানের পালা চলতো তখন আরো বেশি করে নেশা করতো,মাঝে মাঝে বলতো আমাকে না পেলে সুইসাইড করবে।যাকে ভালবাসি তার সুইসাইড দেখবো? সেটা কখনই সম্ভব না।আর একটা মেয়ে সবকিছু বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

প্রথমেই হিমেলকে বলেছিলাম, “হিমেল, তুমি আগে নেশা ছেড়ে দেও,”

হিমেল বলেছিলো,” বিশ্বাস করো জুঁই!তুমি আমার জীবনে আসলে সব ছেড়ে দেবো,সিনথিয়াকে ভুলতে তোমাকে প্রয়োজন, নেশাকে না,”

সিনথিয়া হল হিমেলের আগের প্রেমিকা।সন্দেহের কারণের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেছে।সিনথিয়া কারণে অকারণে হিমেলকে সন্দেহ করতো।

তারপর থেকে প্রতিদিন নিয়ম করে হিমেল আমাকে বলে সিকারেট খেতো।আমি বললে সে সিকারেট খাবে, না বললে, খাবে না।কতটা মূল্য দিত ভাবতেই সবকিছু বদলে যেত আমার।

তারপর,হঠাৎ করে বললাম, “হিমেল! বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে এভাবে বাজে সময় নষ্ট করো না,ভবিষ্যৎ আছে আমাদের, কিছু একটা করো।দেখো,আগে যা করেছো,করেছো!কিন্তু, এখন আমি আছি।”

হিমেলের ঐ একই উত্তর,” তুমি আমার জীবনে আসলে সব গড়ে দেবো,আমার পাশে তোমাকে প্রয়োজন,”।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল।কিন্তু, হিমেলের আসার কোন খবর নেই।দরজার গিয়ে সেই ধরে তাকিয়েই আছি।কিন্তু, নাহ!কোথাও হিমেলের আসার চিহ্ন নেই।

ঘড়ির কাঁটা চলছে প্রতিনিয়ত তার নিজস্ব নিয়মেই।হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে চমকে উঠলাম। চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ।আনন্দের হিল্লোল একঝলক বয়ে গেল হিমেল আসবে ভেবে।

দরজা খুলতেই দেখি হিমেল এবং আরো অনেকে দাঁড়িয়ে।আমি অবাক হয়েই দেখতে লাগলাম সত্যিই হিমেল এসেছে নাকি অন্যকেউ।চোখ যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না।”এই সেই হিমেল!”

দুইদিন আগের ঘটনা,

অফিস থেকে তড়িঘড়ি করে এসে রুমের দরজা বন্ধ করে হিমেল বসে রইলো।হঠাৎ এমন কার্যকলাপে আমি দরজার সামনে গিয়ে বললাম,” হিমেল!কি হয়েছে, বলো আমায়!হিমেল!প্লিজ বলো,”

হিমেল দরজা খুলে দিলো আমি ভেতরে প্রবেশ করে বললাম,” কি হয়েছে, এমনটা করছো কেন?”

হিমেল যা বলল তার জন্য কখনও প্রস্তুত ছিলাম না আবার নিজের কানকে বিশ্বাসও করতে পারছিনা।

হিমেল রাগি রাগি মুখ করে বললো,” দেখো জুঁই! তোমাকে ভরণপোষন করা আর আমার পক্ষে সম্ভব নাহ,তুমি নিজের চাহিদা যদি নিজে পোষন করতে পারো তাহলে থাকবে নয় তো নিজের পথ দেখো,”

কাঁদো কাঁদো করে বললাম, “কি বলছো এসব!আমার কি এমন চাহিদা!আর তাছাড়া এতদিনে তোমার কাছে কিছু আবদারও করিনি তুমি যা এনেছো তাই।কিন্তু আজ এমন কথা কেন বলছো? হিমেল! ”

“পারবো না বলছি, পারবো না।ব্যস! আর কোন কথা শুনতে চাচ্ছি না,”

চুপচাপ বসে রইলাম।কি বলবো,আর কি করবো সেটা ভেবে উঠতে পারিনি।তাছাড়া হিমেল আমাকে তাড়িয়ে দিলে কোথায় যাবো আমি? হিমেলের জন্য ঠিকমত পড়াশোনা করতে পারিনি আবার বাবা মার অমতে হিমেলকে বিয়ে করেছি।এই একবছর তাদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখিনি।কি বলবো তাদের?

হিমেলকে বিয়ে করার আগেরদিন বাবা বলেছিলেন,” আবেগ দিয়ে ভালবাসা যায় কিন্তু জীবন গড়া বা বেঁচে থাকা যায় না,বাস্তবতা খুব কঠিন জিনিস,সেখানে ভালবাসা ঠুনকো,”

আজ ভালবাসার জন্য সবকিছু ছেড়ে দিলাম আর সেই ভালবাসাই আমাকে ছুড়ে ফেলে দিলো ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখটা লেগে গেল।

হিমেলের ফোনের শব্দে চোখ মেলে তাকালাম।হিমেল কোথাও নেই।ফোনটা ধরতেই দেখি এক মেয়েলী কন্ঠস্বর।

–হেলো, কে বলছেন?
–আমি হিমেলের ওয়াইফ জুঁই বলছি।আপনি কে বলছেন?
–হিমেলের ওয়াইফ মানে? মিঃ হিমেল বিবাহিত?
–জ্বী! কিন্তু আপনি কে?
–কি বলছেন এসব!হিমেলের সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ।এমনকি আমরা বিয়ে করবো বলে ঠিক করেছি।
–আমার গলা যেন নিমিষেই ভারী হয়ে উঠলো।বুঝতে বাকি রইলো না কিছুু।বোধ হয় কেউ কটচিমটা দিয়ে আষ্টেপিষ্টে বিঁধে ফেলেছে আমাকে।তবুও বললাম, “কবে বিয়ে করছেন?”
–আজকেই।কিন্তু হিমেল বিবাহিত?
–আমি মুখচেঁপে বললাম, নাহ! মজা করলাম।
–ওহ।তাই বলেন!আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।আসলে, আমরা একই অফিসে কাজ করি।প্রথম দেখাতেই ভালবাসার কথা বলি আর হিমেলেরও ভালবাসতে কোন আপত্তি ছিল না।আমরা প্রায়ই লেকপার্কে দেখা করি।তাই আজই সব আয়োজন।আপনি আসছেন তো?

ফোনটা ইচ্ছা করেই কেটে দিলাম।স্বাভাবিকভাবে হিমেলের কাছে গিয়ে বললাম,”হিমেল! আমি চলে যাচ্ছি,”

হিমেল বললো,” কোথায় যাচ্ছো?”

—জানিনা, তবে চলে যাচ্ছি।

হিমেল বললো,” তুমি কোথাও যাবে না জুঁই, কারণ, এই বাসাটা তোমার নামে লিখে দিয়েছি।যেতে হয় আমি যাবো”

–কিন্তু সেটা হয় না।আমি তোমার জীবন থেকে চলে যাবো হিমেল।

–আচ্ছা,যেতে চাও যেতে পারো,বাধা দেবো না। কিন্তু দুইদিন পরই যেও, আমার শেষ অনুরোধটা রেখো জুঁই।

কিছু বলার আগেই পাশের ঘর থেকে হিমেলের মা আমাকে বৌমা বলে ডেকে উঠলেন।আমি আমার মাকে ছেড়ে আসার কষ্টটা তার থেকেই ভুলতে পেরেছি।

দৌড়ে গিয়ে মাকে বললাম,” ডাকছিলেন,”
আমাকে পাশে বসিয়ে বললেন,” আমাকে ছেড়ে কোথায় যাচ্ছিস মা! আমাকেও নিয়ে যা,যে ছেলে এমন চাঁদের মত মেয়েকে কষ্ট দিতে পারে সে আমার সন্তান নাহ,” বলেই আমাকে জড়িয়ে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন।আমিও নিজেকে সামলাতে পারিনি।কেঁদেছি অঝোরে।

বাইরে বের হয়ে কোথাও হিমেলকে দেখতে পেলাম না।বোধ হয় বিয়ে করতে গেছে।ভাগ্যে এমনটা হবে আশা করিনি।শেষ অনুরোধটা রেখে চলো যাবো।

আজ দুইদিন পর ফোন করে বললো,বাসায় আসবে।হয়তো বৌ নিয়ে।
ওদের যাতে কষ্ট বা অসম্মান না হয় তাই এতকিছুর আয়োজন।আমাকেও অভিনয় করতে হবে যেন আমার কিছুই হয়নি।পাক্কা অভিনেত্রীর মত।

হিমেলের পাশে যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে ওর নাম আসিফ, ও হিমেলের সবথেকে কাছের বন্ধু।আসিফ হঠাৎ বলে উঠল, ” হ্যাপী এনিভার্সারী ভাবি,(বলেই রঙ্গীন বেলুনে সুঁচ ঢুকিয়ে শব্দ করলো)আজ থেকে নতুন করে সবকিছু শুরু হোক,” বলে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা আমার হাতে দিল।তাই তো আজ আমাদের বিয়ের একবছর হল।অথচ,আমার মনেই নেই।

তারপর একে একে সবাই শুভেচ্ছা জানিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়েই রইলাম।পাশ থেকে হঠাৎ একটা মেয়ে বলে উঠল,” এই যে ভাবি,কি মনে করছো, তোমার বরটাকে আমি কেড়ে নিবো? তোমার বরটাকে তুমিই কেড়ে রেখেছে।সারাদিন আমাদের সামনে জুঁই জুঁই করে কিন্তু সেই জুঁইফুলটাকে কখনও দেখতে দেয় নি।আড়াল করে রেখেছে সবসময়।আসলে ভালবাসা না থাকলে এতকিছু সম্ভব না।জানো, এই দুইদিন দুইরাত জেগে কাজ করেছে শুধু আজকে তোমাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে।আর আগে বাজে ব্যবহার আর আমার কথাগুলো সাজানো ছিল।আসলে দেখছিলাম তুমি কতটুকু বিশ্বাস করো হিমেলকে।ভালবাসলেই হয়না,একটু খেয়াল রাখতে হয় বিশ্বাস রাখতে হয়, যত্ন করতে হয় ”

চোখে পানি চলে এলো।তাই তো,আমার ভালবাসায় তো কমতি ছিল না।তাহলে, কেন হিমেল চলে যাবে? হঠাৎ হিমেল আমার সামনে মাথা নত করে বললো,” জুঁই আজ থেকে তোমার সব দায়িত্ব আমার,আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না, তোমার জন্য নতুন করে বাঁচতে শিখেছি,নিজেকে চিনতে শিখেছি,জানি এতদিন তোমাকে কষ্ট ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি, তবুও বলছি, সবকিছু ভুলে আমার হাতটি নতুন করে আবার ধরবে জুঁই,বিশ্বাস করো, আর কষ্ট দেবো না!প্রমিজ,”

আমি কান্নাজড়ানো কন্ঠে বললাম,” এতো নাটক করার কোন দরকার ছিল,”

আসলে দেখছিলাম, “আমার পাগলীটা আমাকে কতটা বিশ্বাস করে”

–“হুউম!হইছে!পাগল কোথাকার!”

–“হুম, তোমার জন্য”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত