হঠাত্‍ একদিন

হঠাত্‍ একদিন

ঘুম থেকে উঠে দেখি বিশ মিনিট দেরী করে ফেলেছি। এখন সাড়ে আটটা বাজে। প্রতিদিন আটটায় ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। কোন কোন দিন আটটা দশ বেজে যায়। কোন মতে ব্রাশ হাতে নিয়ে বেসিনে গেলাম। বিপদ যখন আসে সব দিক থেকেই আসে। পৃথীবির তিন ভাগ জলের হিসেবটা ঢাকা শহরের বাড়ীওয়ালাদের কাছে হয়তো অজানা। তা না হলে ভাড়াটিয়ারা পানির অভাবে মরবে কেন? ভাড়াটিয়া শব্দটার সাথে টিয়া পাখির অপূর্ব মিল রয়েছে। টিয়া পাখি যেমন শেখানো বুলি ছাড়া কিছুই বলতে পারেনা। ভাড়াটিয়ারাও অনেকটা এমন। বাড়ীওয়ালার মুখের ওপর কিছু বলাটা অপরাধ। তবুও সাহস করে কেয়ারটেকারকে ঝাড়ি দিয়ে পানি ছাড়ালাম। গোসল করে ফ্রেশ হতে হতে সাড়ে নয়টা বাজলো।এরপর না খেয়েই স্কুলে চলে আসলাম। স্কুলের গেটের সামনে অসংখ্য ছোট ছোট বাচ্চাদের চিল্লাপাল্লা। হঠাত্‍ মনে হল আজ নতুন ছাত্র ছাত্রী ভর্তি হবে। আমি আবার ওদের দায়িত্বে। এমন একটা দিনে লেট করাটা ঠিক হয়নি। তড়িঘড়ি করে ক্লাসে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি নতুন ছাত্র ছাত্রীদের লিস্টটাই আনা হয়নি। প্রধান শিক্ষকের কাছে অবশ্য লিস্ট আছে।সেখান থেকে আনা যায়। কিন্তু ছোটখাট একটা ঝাড়ি খেতে হবে। সপ্তাহের দু একটা দিন মানুষের ঝামেলায় যাবে। যেদিন ঝামেলায় যাবে সেদিন প্রতিপদেই সমস্যা ভোগ করতে হবে। ছোটখাট একটা হাই তুলে পিয়নকে ডেকে লিস্টটা আনালাম। বিনিময়ে দশ টাকার একটা নোট খেসারত দিতে হল। একটা সময় ছিল এসব ছোটখাট কাছে দু এক টাকা ধরিয়ে দিলেই চলত। এখন সময় পাল্টেছে। বাংলাদেশের দুই টাকার নোট এখন বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর নোট। গরীবরা সৌন্দর্য বোঝেনা। তাই এদের কাছে দুই টাকার নোটের কোন মূল্য নেই।

ক্লাসে ঢুকে গাম্ভীর্য ভাব নিলাম। লিস্ট থেকে বাচ্চাদের নাম ডাকছি। তারা বাবা মার হাত ধরে আসছে। ছোট ছোট হাত কিন্তু বড় বড় স্বপ্ন। এদের মাঝে কেউ ডাক্তার হতে চায়। কেউ ইঞ্জিনিয়ার। অনেকে হতে পারবে অনেকে পারবেনা। যারা হতে পারবেনা তারা আমার মত স্কুল টীচার হবে। একসময় আমার বয়সে এসে বলবে নিজের স্কুল জীবনের প্রথম দিনের কাহিনী। এর অনেক টা সত্য অনেকটা ভুলে যাওয়া স্মৃতির কল্পনায় গড়া।

হঠাত্‍ একটা নাম ডাকতেই একটি ছেলে তার মায়ের হাত ধরে আমার কাছে আসল। ছেলেটির মাকে দেখে অবাক হলাম। চিত্রা। সাতবছর আগে যাকে শেষ দেখেছি। শেষ কথা বলেছি। শেষ বারের মত চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছি। যার সাথে আর কোনদিন দেখা করার ইচ্ছাও পোষন করিনি আজ হঠাত্‍ এই অবস্থায় তাকে দেখে বুকের কোথাও সূক্ষ্ম টান অনুভব করলাম। কাউকে মন প্রান দিয়ে ভালোবাসলে তাকে ভুলে যাওয়াটা অসম্ভব। চিত্রাকে আমি অনেক ভালোবাসতাম। অ-নে-ক। একজন মানুষের পক্ষে যতটা ভালবাসা সম্ভব তার চেয়েও বেশি। কলেজ জীবন থেকে ভার্সিটি লাইফ। কাছাকাছি ছিলাম। আমাদের মাঝে ভালোবাসা ছিল। মিথ্যে আবেগ ছিলনা। আমাদের সম্পর্কটা ছিল নদীর মত। যেখানে অভিমান হয়ে ছিল শৈবাল আর জল হয়ে ছিল চিত্রার ভালোবাসা। মাঝেমাঝে যদিও কিছু শৈবাল জমত। চিত্রার অজস্র ভালোবাসার স্রোতে আবার তা ভেসে যেত।

ভার্সিটির শেষ বর্ষে এসে চিত্রার বিয়ে হয়ে যায়। বেকার উপাধিটা তখনো আমার সাথে জড়িয়ে। অর্থের কাছে ভালোবাসা অর্থহীন। কোন বাবা মাই তার মেয়েকে অনিশ্চিত আগামীর পথে ঠেলে দেবেনা। এটাই নিয়ম। জীবনের চরম বাস্তবতা। চিত্রার বাবা মাও এর ব্যতিক্রম করেনি। তবুও সাহস করে আমি তাঁদের কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি। সীমাহিন ভালোবাসার যে অজস্র মায়া প্রকৃতি আমাদের দান করেছে তার অনেকটাই মিথ্যে আবেগে গড়া। কারো জন্যে কারো জীবন থেমে থাকেনা। তবুও জীবনে কখনো কখনো নেমে আসে তীব্র হতাশা। গাঢ় লিপস্টিকের মত বেদনা অথবা ষোড়শীর অভিমানের মত না বলতে পারার তীব্র কষ্ট। জীবন শুধু ভালোবাসার ওপরে চলেনা। এখানে রয়েছে বাস্তবতার এক অসীম কারাগার। আমরা সবাই সে কারাগারে বন্দী। নিয়তি নামের বিশাল সমুদ্রের কাছে আমরা দু ফোটা শিশির। পদ্মপাতার জলের মত অনিশ্চিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। প্রিয় মানুষ গুলো আমাদের জীবনে আসে অসীম ভালোবাসা নিয়ে আর চলে যায় সীমাহীন শুন্যতা ভরা অজস্র স্মৃতি রেখে। আর তাই না পাওয়ার কষ্টের চেয়ে পেয়ে হারানোর বেদনা অনেক।

চিত্রার বিয়ের পরেও ও প্রায়ই ভার্সিটিতে আসত। কখনো সামনাসামনি দেখা হত। ও কিছু বলতে চাইত। আমি এড়িয়ে যেতাম। যেন না বলতে পারার বেদনায় ও ম্রিয়মান। ও নিজেকে অপরাধী ভাবত। চোখে চোখ পরলে চোখ নামিয়ে ফেলত। ভালোবাসা থাকে চোখের মাঝে। আর তাই হয়তো অভিমান গুলো তার ই পথ ধরে ঝড়ে পরে। চিত্রাকে আড়ালে দেখতাম। বিয়ের পর শাড়ী পড়ত। এখনো পড়ে। তবে আগের চেয়ে ও অনেকটাই মলিন। বিমর্ষ যেন অনুভূতিহীন। ক্লাসটা কোন ভাবে শেষ করলাম। আশেপাশে চিত্রাকে খুঁজলাম। কিন্তু খুঁজে পেলাম না। হয়তো এখনো ও লজ্জা বয়ে বেড়ায়।নিজেকে অপরাধী ভাবে।

পরের দিনগুলো ভালোই কাটছিল। একদিন হঠাত্‍ গেটের সামনে চিত্রার সাথে দেখা হল। সেই সুন্দর মুখ। নীল চোখ। এলোমেলো চুল। সেই আনমনা দৃষ্টি। চিকন ঠোঁট। মুখে এখনো অভিমানের হাসি। তবে নিঃষ্প্রান। মনে হয় অনেকদিন ওর অভিমান কেউ ভাঙায়নি। চোখের নীচে কালি। যেন সভ্যতার বিষাদ জমেছে সেখানে। অতীত আবারো খুঁজে পেলাম বর্তমান বাস্তবতায়।

ওর সামনে দাঁড়াতেই ও মাথা নীচু করে ফেলল। যেন আমি ভালোবাসার রাজসাক্ষী আর ও অপরাধী। কিছুক্ষন দুজনে নিশ্চুপ ছিলাম। নীরবতা ভেঙে বললাম “কেমন আছ?

” ভালো তুমি?”সেই শীতল কন্ঠ। বুকের কোথাও অসীম শুন্যতার সৃষ্টি হল। দুজন দুজনকে দেখছি। যেন বহুদিন দেখা করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। আজ তা পুরন হল।

ও আমাকে জিজ্ঞেস করল ‘বিয়ে করেছ?”

“তোমার কি মনে হয়?” নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দিলাম।

“পুরুষ মানুষ বিয়ে ছাড়া থাকতে পারে?”

“যাকে চেয়েছিলাম তাকে তো পেলাম না,অন্য কারো মাঝে তাকে কীভাবে খুঁজবো?”

চিত্রার উত্তর দেয়ার আগে ঘন্টা দিল। ওর ছেলেটি দৌড়ে ওর কাছে আসল। ও আমাকে বলল “আমার ছেলেটিকে দেখে রাখবেন। ভীষন দুষ্টু”। বলে মলিন হাসি দিল। যে হাসির অর্থ অনেক। আমি কিছু বলতে পারলাম না। শুধু তাকিয়ে রইলাম ওর চলে যাওয়ার পথটির দিকে অবাক দৃষ্টিতে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত