দুফোটা চোখের জল

দুফোটা চোখের জল

গ্রীষ্মকালের এক মধ্যদুপুর। অন্যান্য দিন এসময় কাঠফাটা রোদ থাকে। মানুষজন খুব একটা কাজ না থাকলে বের হতে চায় না। আজ দিনটা তেমন না। রোদ নেই, আছে মেঘ। বৃষ্টি হবে হবে, কিন্তু হচ্ছে না। রুদ্র জানে আজ বৃষ্টি হবে না। বৃষ্টি ‘হবে হবে’ এমন অবস্থার ১ ঘণ্টার মাঝে বৃষ্টি না হলে আর বৃষ্টি হয় না, নিয়ম নেই। মানুষ নিয়ম ভঙ্গ করে, প্রকৃতি নয়।

রুদ্র চায় না আজ বৃষ্টি হোক। আজ মেঘ আসবে বলেছে, ওর নাকি কি কাজ আছে, রুদ্র কে সাথে সাথে থাকতে হবে। রুদ্র জিজ্ঞেস করেনি কি কাজ, জানে বলবে না। এই মেয়েটা যতক্ষণ না নিজে চাইবে কিছু বলবে না। অনুরোধে কাজ হয় না, অনেক সময় বিনা অনুরোধেও মেঘ হড়বড় করে অনেক কিছু বলে দেয়, রুদ্র তাকিয়ে থাকে। আবার হুট করেই চুপ করে যায়, রুদ্রর হাজার চেষ্টা তখন এই মৌনতা ভাঙতে পারে না।

রুদ্র অপেক্ষা করে আছে মেঘের। ওর আসার কথা বারটায়। এখন সারে দশটা বাজে। এখনও অনেকক্ষণ বাকি। কিন্তু মেঘের জন্য অপেক্ষা করতে ওর ভাল লাগে। টানা নয় বছর শুধু অপেক্ষাই করে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে মনে হয় এর কোন শেষ নেই। রুদ্র হাসল, আসলেই কি শেষ নেই? না ও হতে দিচ্ছে না? অপেক্ষা জিনিষ টা কষ্টের, কিন্তু রুদ্রর ভাল লাগে। এই একটা জিনিসই তো আছে ওর, একান্ত নিজের, যার জন্য কারও অনুমতি নিতে হয় না, ও ছাড়বে কেন?

রুদ্র ঘড়ি দেখল, মাত্র পাঁচ মিনিট হয়েছে। দশ টা পঁয়ত্রিশ। সময় এগোচ্ছে না। এই নয়টা বছর কি এমনই মন্থর গতিতে গেছে? না খুব দ্রুতই চলে গেল সময় গুলো? রুদ্র চোখ বন্ধ করল, সামনে ভেসে উঠল সেই নয় বছর আগের রুদ্র কে। কিছুটা গম্ভীর, কিছুটা চঞ্চল। সারাদিন টো টো কোম্পানির ম্যনেজারগিরি করে রাতে বাসায় ফিরে ঠিকই বই নিয়ে বসা, আর পরদিন লাজুক লাজুক হেসে বন্ধুদের কাছে এসে বলা, দোস্ত লাইফ অফ অ্যা পাই দেখছস? ভাবখানা এমন যেন রাত জেগে সে লাইফ অফ অ্যা পাই ই দেখসে…

আর মেঘ? দুরন্ত আর চঞ্চলতার জ্বলন্ত উদাহরণ। একদণ্ড স্থির হয়ে থাকতে পারে না, ক্লাসের সব সহপাঠীর নাড়ি নক্ষত্র তার মুখস্ত। সবাইকে ঝাড়ির উপর রাখাটাকে পবিত্র দায়িত্ব বলেই মনে করে সে। দুপুরে খাস নাই কেন? জড় নিয়ে ক্লাসে আসলি কেনও? পরশু পরীক্ষা আর তুই শপিং এ? এক্ষন বাসায় যা… (কেউ বলার নেই পরশু পরীক্ষা হলে সে এখানে কি করছে?) এমন অসংখ্য খবরদারি…

রুদ্রর আড়ালে পড়ার ব্যপারটিও তার অজানা নয়। থাকার কোন কারণও নেই অবশ্য। ওরা ছিল বেস্ট ফ্রেন্ড। একজনকে ছাড়া আরেকজনের চলত না এমন নয়, কিন্তু ওরা একজন আরেকজনকে ছাড়া কিছুই করত না!

বন্ধুরা ক্ষেপাত, দুজনের কেউ দেরী করে আসলে জিজ্ঞেস করত, কিরে তোর বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ড আসে নাই? রুদ্র শুনে হাসত, আর মেঘ খুব খেপে যেত।

-কিরে? তুই ওদের কিছু বলস না কেন?

-কি বলব?

-দাঁত না কেলিয়ে সোজা সাপটা বলে দিতে পারিস না ফাজলামো না করতে???

-ফাজলামোই করতেসে যখন বুঝতেছিস তাইলে এত চেত্তেছিস কেন?

এই ছিল মেঘ আর রুদ্র। ছোটবেলার ফ্রেন্ড। একসাথেই বেড়ে ওঠা। দুজনই দুজনকে যেন খোলা বই এর মত পড়তে পারে!

এই মেঘ কেন যেন হঠাৎ করেই বদলে যায়! কারও সাথে বেশি কথা বলে না, এমনকি রুদ্রর সাথেও না। হাজার প্রশ্নের নিরুত্তর চাহনি! হাসে, কিন্তু সে হাসি মেঘের নয়, কথা বলে কিন্তু তা মেঘের গলার আওয়াজ নয়!

একটা উচ্ছল প্রাণবন্ত মেয়ে যেন হুট করেই নিষ্প্রাণ হয়ে গেল…

রুদ্র চোখ খুলল, চোখ টা কি জ্বলছে? রুদ্র আকাশের দিকে তাকাল।

আকাশ টা এখনও ছিঁচকাঁদুনে ভাব নিয়ে বসে আছে, হাসছেও না কাদছেও না! আচ্ছা সেদিনও কি এমনই ছিল আকাশ? নাহ। সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল, ঝুম বৃষ্টি!

রুদ্র উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে শুরু করল। আজ এমন কেন হচ্ছে? নয় বছর আগের প্রতিটি জিনিসের অস্তিত্ব সে অনুভব করতে পারছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলো তার গায়ে এসে বিঁধছে, এই তো মেঘের বাসা! সে তো এখান থেকেই হন হন করে মাত্র বের হয়ে এসেছে!

“রুদ্র আমি একজনকে খুব ভালবাসি রে” রুদ্রর হাঁটুতে মাথা রেখে বলেছিল মেঘ। ওর চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছিল রুদ্রর হাঁটুর জায়গাটা। কিন্তু রুদ্র কিছু টের পাচ্ছিল না। মেঘের কথাগুল ওকে অসাড় করে দিচ্ছিল। ওদের অস্তিত্ব কি আলাদা? মেঘ অন্য কাউকে ভালবাসতে পারে? বিশ্বাস হচ্ছিল না রুদ্রর! কেন যেন রাগ হচ্ছিল খুব।

মেঘ তার ভালবাসার মানুষকে হারিয়েছিল। কেন, কিভাবে তার সবটা সে রুদ্র কে বলেছিল, কিন্তু রুদ্র কি আর এ জগতে আছে? সবটাই কানে গেছে, হৃদয়ে পৌঁছায়নি কিছুই! শুধু মনে আছে ‘হারিয়েছে’ শুনে তার অমানুষিক আনন্দ হয়েছিল!

সেদিন খুব কেঁদেছিল মেঘ, সেই কান্না রুদ্র কে স্পর্শ করেনি। কোন শান্তনা দেয়নি সে মেঘ কে, বের হয়ে এসেছিল ওদের বাসা থেকে।

রাগ হোক আর অভিমানই হোক সেই একদিন হয়েছিল রুদ্রর, মেঘের উপর। বাকিটা সময় ও মেঘের পাশে পাশেই থেকেছে সবসময়। খুব ভেঙ্গে পড়েছিল মেয়েটা, সবাই ভেবেছিল কদিন যেতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই ঠিক হয়নি, বিষণ্ণতার যে একটা পাকাপাকি ছাপ মেঘের উপর পরেছিল তা আর সরেনি। রুদ্র ছাড়া আর কোন বন্ধুর সাথে যোগাযোগ ছিল না মেঘের। রুদ্রও সবকিছু ছেড়ে শুধু মেঘ কে নিয়েই পড়েছিল।

হাসি পেল রুদ্রর। কত ছেলেমানুষিই না করেছে সে। মেঘ কে তার ভালবাসার মানুষের কাছে পৌঁছানোর কতই না চেষ্টা! বন্ধুত্ব আর প্রেমিকস্বত্বা দুটোই কাজ করছিল রুদ্রর মাঝে। মহৎ হওয়ার একটু ইচ্ছাও কি ছিল? হয়ত!

রুদ্র মেঘ কে ভালবেসেছিল। সে ভালবাসার উৎপত্তি ওদের ছেলেবেলার বন্ধুত্ব থেকে নয়, তার জন্ম হয়েছে মেঘের ভালবাসা থেকে! সত্যিই তাই, রুদ্র মেঘের ভালবাসার প্রেমে পড়েছিল! এত ভালবাসতে জানে মেয়েটা? কেমন করে পারে সে? সেই ছেলেবেলায় কবে কাকে ভালবেসেছে, তার কোন খোঁজ নেই কিন্তু ভালবাসাটা মেঘ নিজের মাঝেই বাঁচিয়ে রেখেছে, রুদ্রর কাছেও তা প্রকাশ করে না, কিন্তু রুদ্র বুঝতে পারে।

পকেট থেকে মুঠোফোনের ভাইব্রেট এ ধ্যান ভাঙল রুদ্রর।

-হ্যালো

-কই তুই?

রুদ্র চারপাশে তাকাল। হাটতে হাটতে বেশ অনেকটা দূর চলে এসেছে সে।

-তুই দাড়া আমি দুই মিনিটে আসছি

মেঘ কে কিছু আর বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন টা কেটে দিল রুদ্র। আজ মনে হচ্ছে মেঘ টা না আসলেই ভাল ছিল। কেন যেন আজ ‘শুধুই বন্ধুত্বের’ ভণ্ডামিটা করতে ইচ্ছা হচ্ছে না! নয় বছরের সাধনা টা আজ চুরমার করে দিতে ইচ্ছা করছে।

“ভালবাসা তোমার ঘরে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসুক”… কত অসংখ্য বার সে শুনিয়েছে মেঘ কে এই গান টা, সেই বৃষ্টিতে মেঘের হাত ধরে যে সেও ভিজতে চায় এটা কবে বলবে রুদ্র?

মেঘ আজ শাড়ি পরে এসেছে। নীল রঙের। অনেকদিন পর সুন্দর করে সেজেছে, কপালে টিপ চোখে কাজল। আর হাতে বিশাল সাইজের ঝোলা।

-বাসা থেকে ভাগার প্লান করে এসেছিস নাকি? ঝোলার মধ্যে কি আবার?

মুখ টিপে হাসল মেঘ।

-চল লেকের পাড়ে গিয়ে বসি।

দুজন হাটতে হাটতে লেকের পাড়ে সিঁড়ির উপর গিয়ে বসলো। ঝোলাটা রুদ্রর দিকে এগিয়ে দিল মেঘ। কিছু কার্ড, শুকনো ফুল, আর কিছু বই আছে সেখানে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল রুদ্র।

রুদ্রর দিকে না তাকিয়েই বলতে শুরু করল মেঘ, ওর মুখটাও দেখতে পাচ্ছিল না রুদ্র।

“জানিস রুদ্র, ভালবাসা কি ব্যপার টা আমি কোনদিন বুঝিনি, না বুঝেই ভালবেসেছিলাম। মানুষটা চলে গিয়েছিল, তার দেয়া কার্ড আর ফুলগুলোকে আঁকড়ে ধরেছিলাম, ভেবেছি এটাই ভালবাসা… চারপাশের মানুষগুলোর এত দ্রুত প্রেমে পড়া আর তার থেকেও দ্রুত ‘প্রেম থেকে পড়া’ দেখে আস্তে আস্তে অহংকারি হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি সবার থেকে আলাদা, কেউ আমার মত ভালবাসতে জানেনা।

সত্যিই তাই… এইযে দেখ না… কয়েকটি জড়পদার্থ নিয়ে বসে ছিলাম এতগুল বছর আর একটা রক্তমাংসের মানুষের ভালবাসাই বুঝলাম না? একজন মানুষ হাজারবার ভালবাসি বলেও সেই ভালবাসাকেই পায়ে ঠেলে চলে গেল,আর আরেকজন মুখে একবারও ভালবাসি না বলেও আজীবন তার প্রমাণ দিয়ে গেল, আর আমি কিনা সেই পায়ে ঠেলা ভালবাসার স্মৃতিই বয়ে বেরাচ্ছি এতকাল ধরে… কি বোকা আমি দেখেছিস???

আমি ভালবেসেছিলাম রুদ্র, কিন্তু তার পূর্ণতা পেয়েছে তোর হাত ধরে।

আজকে এই জড়পদার্থগুলো কেন যেন একেবারেই মূল্যহীন মনে হচ্ছে, তোর সাথে কাটানো মুহূর্তই বার বার মনে পড়ছে… কেন এমন হচ্ছে বল তো?”

মেঘ ভেজা চোখ নিয়ে রুদ্রর দিকে তাকাল। সে তার হাত টা বাড়িয়ে দিল…

“রুদ্র, তুই কি আমার হাত টা একটু ধরবি? প্লিজ?”

রুদ্র মেঘের বাড়ানো হাতটি ধরল, পাগলী একটা… তোর না বাড়িয়ে দেয়া হাতটাই তো সেই কবে ধরেছিলাম আমি, সে তো ছাড়ার জন্য নয়! কিন্তু মুখে সে কিছুই বলতে পারল না, বরাবরের মতই!

অন্য হাত দিয়ে মেঘের চোখ মুছিয়ে দিল। মনে মনে বলল,

“মেয়েরে…

তুমি আমার জন্য দুফোটা চোখের জল ফেলেছো! তার প্রতিদানে আমি, জনম জনম কাঁদিব।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত