বাংলাদেশে গ্রাম্য দৃশ্য মনকে শীতল করে দিতে যথেষ্ট।
তবে বর্তমানে কিছু শ্রেণীর মানুষ গ্রাম অপছন্দ করে।কারণ হয়তো টেকনোলজি দূর্বলতা।
কিন্তু যাই হোকনা কেন,গ্রামের আচার ব্যবহার এবং নদীর ধারে বসে শীতের সকাল এই দুইটি অনুভূতি পৃথিবীতে অন্য কিছুর মাঝে অবিদ্যমান।
খুব ভোরে নিধানের ঘুম ভেঙে গেলো।
চারিপাশ কুয়াশায় ঘেরা।ঘন কুয়াশার কারণে অল্প কিছুদূর দেখা দায়।
এমন পরিস্থিতিতে নিধান জ্যাকেট গায়ে হাঁটতে বের হলো।
অনেকটা পথ হাঁটার পর সামনে নদী।
নিধান সে নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াতে দেখে এক কন্যা থালা-বাসন ধুয়ে উঠে আসছে।
কালো বর্নের দেহ।টানা গভীর চোখ।লম্বা,কোমড় ছুঁই চুল।গোলগাল মুখ।সব মিলিয়ে অদ্ভুত মায়াবী।
মায়াবীর সে মায়ায় মুগ্ধ হয়ে নিধান ছোট্ট করে বললো “ওয়াও।”
বাক্যটা কোনভাবে কন্যার কান পর্যন্ত পৌছায়।যা শুনে কন্যা মুচকি হেসে চলে যেতে লাগে।
হাসিটা চমৎকার।হৃদয়ে কড়া নাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট।অনুরূপ ঘটে নিধানের সাথে।
নিমেষে ব্যাপারটা এতদূর গড়ায় যে,নিধান প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য হয়।
তারপর সে পিছু নেয়।
কারো মুখে টু শব্দ নেই।নিশ্চুপ দুজন হেঁটে চলেছে।
ভাগ্যক্রমে হঠাৎ মেয়েটা থমকে দাড়ায়।
নিধানও দাঁড়িয়ে যায়।
এরপর মেয়েটা চুপিচুপি পায়ে কাছে এগিয়ে এসে বলে “আপনি চলে যান,সামনে আমার বাসা।মামা-মামী দেখলে খুব রাগ করবে।”
কোমল মিষ্টি কণ্ঠ।কথা বলার সময় এক অস্থিরতা প্রকাশ পায়।
নিধান হেসে বললো “আপনার নামটা কিন্তু জানিনা।”
– নাম দিয়ে কি হবে?
– রাতে স্বপ্ন বুনার কাজে আসবে।
– মানে?
– নাম!
– নাম শুনে চলে যাবেন তো?
– উঁহু।
– তাহলে?
– এটাও বলতে হবে কাল সকালে নদীর ধারে আসবেন কি না।
– আমি প্রতিদিনই যাই।
– কখন যান?
– আপনায় কেন বলবো?
– না বললে চলবে।
– হুম।
– নাম?
– রুহি,এখন প্লিজ যান।
– কাল অপেক্ষায় থাকবো।
রুমি মিষ্টি হেসে চলে গেলো।
নিধান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো চলে যাওয়া সে পথের দিকে।
খুব আগ্রহের সাথে নিধান নদীর ধারে দাঁড়িয়ে।
অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পর রুহি এসে উপস্থিত হলো।চোখ গভীরে চলে গেছে।মুখ শুকিয়ে আছে।সম্ভবত রাতে ঘুমাতে পারেনি।
বালিকার দেখা পেয়ে যেন নিধানের অর্ধেক বুক ভরে উঠেছে।
নিধান রুহির নিকট এগিয়ে গিয়ে বললো “এত সময় লাগে আসতে?”
রুহির চোখে নীরবতা।সে নিজের অজান্তে বলে ফেললো “এমন আর হবেনা।”
– কি?”
– না,কিছুনা।
– মিথ্যা বলছো?
– না।
– তুমি খুবই সুন্দরী।
রুহির মুখ উজ্জ্বল হাসিতে পরিপূর্ণ হলো।বাক্যে নীরবতা।
– তুমি কি তোমার মামার বাসায়ই থাকো?
– হুম।
– বাবা মা?
– মা অনেক আগে মারা গেছে।বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে শহরে থাকে।
– তোমায় সাথে রাখেনি?
– বাবা আমাকে অপছন্দ করে।
– কেন?
– আপনায় দেখে তো গ্রামের মনে হয় না।এখানে কি আপনি বেড়াতে এসেছেন?
– হ্যা।
– কার বাসায়?
– জমিল চিয়ারম্যান।
– উনি আপনার কি হয়?
– নানু।
– কিছুদিন পর চলে যাবেন?
– হুম।
– আপনি আর আমার সামনে আসবেন না।
– কেন?
– এমনি।আপনায় দেখলে আমার কেমন লাগে।এভাবে প্রতিদিন দেখা হলে আমি আপনার প্রেমে পড়ে যাব।তারপর আপনি শহরে চলে গেলে থাকতে কষ্ট হবে।
– আর যদি বিয়ে করে সাথে নিয়ে যাই?
রুহি হেসে ফেললো।লজ্জায় মুখ ঢেকে কোনরকম থালা বাসন ধুয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলো।
নিধান মেয়েটার কর্মকাণ্ডে বাকরুদ্ধ।কিছু বলার ভাষা তাঁর কাছে নেই।
প্রতিদিন তাদের দেখা হতে থাকে।
বাড়তে থাকে কথার মাত্রা।এর মাঝে দুজন দুজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।বুনছে জেগে দেখা স্বপ্ন।
রুহি তাঁর ছোট ছোট ইচ্ছার কথা জানিয়েছে।নিধান মুগ্ধ হয়ে শুধু শুনেছে।
ব্যাপার একসময় এময় পর্যায় যায় যে কেউ কারো মুখ না দেখে থাকতে হিমশিম খায়।
এর মাঝে নিধানের বাবা,জরুরি কাজে তাকে ঢাকা ডেকে পাঠায়।
যাওয়ার দিন রুহি সে কি কান্না।
নিধান দু-হাতে চোখ মুছে দিয়ে বলে “তুমি চাও,মন খারাপ করে যাত্রা শুরু করি?’
রুহি চুপ।সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে কান্না থামিয়ে রেখেছে।
– রেডি থেকো।পরের বার এসে বউ করে নিয়ে যাব।
– কবে আসবা আবার?
– জানিনা,তবে সুযোগ পেলে চলে আসবো।
– এই’কদিক আমি থাকবো কিভাবে?
– অল্প কষ্ট করো।
– হুম।
– যাবো এখন?
– দেখে যেও।
– আচ্ছা।
নিধান যেতে লাগলো।
দুজনের চোখে অশ্রু।
বুকে হাহাকার।
ভাগ্যক্রমে যাওয়াটা বেশিদূর হয়ে উঠলোনা।অল্প গিয়ে দৌড়ে এসে রুহিকে জড়িয়ে ধরলো।
রুহি হতভম্ব।
অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে এখন।
মনে হচ্ছে,এরকম যদি সারাজীবন থাকা যেতো।
– রুহি।
– হুম।
– মিস করবো।
– আমিও।
– অপেক্ষা করবা তো আমার জন্য?
– করবো।
– ভুলে যাবা না?
– না।
– আই লাভ্ ইউ।
– আই লাভ্ ইউ টু।
অতঃপর চলে গেলো নিধান।তবে মন রয়ে গেলো মধুপুর গ্রামে।
কেটে গেছে তিনটি মাস।ব্যবসার চাপে যাওয়া হয়ে উঠেনি প্রিয় মানুষটির কাছে।অজানা রয়ে গেছে তাঁর অবস্থা।
কিন্তু এবার আর আটকায় কে?
চাপ কিছুটা কম দেখে নিধান বাবার অনুমতি নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
যাওয়ার পথে রুহির জন্য শাড়ি এবং এক জোড়া নুপুর কিনে নিয়েছে।
পথ যেন আর ফুরোয় না।
মনে টানটান উত্তেজনা।
অনেকদিন বাদে দেখা হবার পর সে কি বলবে কেমন ব্যবহার করবে ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছেনা।
ঠিক তখন গাড়ির চাকা নষ্ট হলো।
নিধান মনে মনে ভাবছে,’আজ নিশ্চিত রাত হবে।’
চাকা ঠিক করে মধুপুর গ্রামে পৌছাতে ঘটলোও তাই।
রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছে।
পরদিন সকালে রুহি থালাবাসন মাজতে এসেছে।মুখে উজ্জ্বল হাসি।তাঁর মামা কাল চিয়ারম্যান বাড়ি থেকে ফিরার পথে শুনে এসেছে,চিয়ারম্যানের নাতি ফিরতেছে।
খবরটা শুনার পরে যেন রুহি আর খুশি সামলে রাখতে পারছেনা।
মনে মনে নিধানের কথা ভেবে চলেছে।’সে কি আজ আসবে নদীর ধারে,নাকি ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে।’
ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু একটার সাথে বেধে রুহি পড়ে গেলো।ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় থালা-বাসনগুলো।
তারপর উঠে দাঁড়াতেই দেখে ছুড়ির আঘাতে মরে যাওয়া এক লাশ।
চেহারা অনুরূপ নিধানের ন্যায়।
রুহির মন আঁতকে ওঠে।
দিশা হারাতে থাকে মস্তিষ্কের নিউরোন গুলো।
সমাপ্ত